somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জড়জ

২৫ শে মে, ২০১৭ রাত ৮:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(১)
...হঠাৎ করেই তাকে উপলদ্ধি করলাম আমি। এতদিন কোথায় ছিলো, আদৌ ছিলো কি না এসব প্রশ্নে জেরবার হলো আমার বর্তমান অস্তিত্ব। প্রতি পলে তাকে চাইছি, অথচ সে নেই, কোথাও নেই এখন আর। অথচ সে ছিলো, কী ভীষণভাবেই না ছিলো! একটু খানি হেলান, একটু খানি আরাম, কোনরকমে একটা ঋজু কাঁধে আমার ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয়া, কী মমতায়ই না সে পালন করে চলতো এসব আবদার! এতদিন সে আমার এমন বায়নাক্কা মিটিয়ে আসছিলো নীরবে। বিনিময়ে কখনই কিছু চায় নি। আর তাই আমি বুঝি নি এই স্বয়ংচল নির্ভরতার বীজটা কত গভীরে প্রোথিত! আজ বারবার আমার পাশে তার ছায়া অস্তিত্ব অনুভব করছি...
(২)
যেদিনের কথা বলছি, তার আগের রাতটা গেছে বেশ উত্তেজনাময়। মোনালিসা মেসেজ পাঠিয়ে ছিলো আমি যেন তার সাথে দ্রুত দেখা করি সেই তাগিদ জানিয়ে। এক্সাক্ট কথাটা ছিলো "এখুনি দেখা করো"। পাগলী মেয়েটা এমনই অধিকার ফলিয়ে আসে সবসময়! স্মিত হাসিতে তাকে আশকারা জানাই আমি। এমন অসময় বেসময় উদ্ভট সময়েই সে সবসময় তার দাবী জানিয়ে আসে। কখনও ভর দুপুরে, কখনও সাত সকালে, কখনও গভীর রাতে। আমার উচাটন মন বেসামাল হয়ে যায়। পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে প্রচুর হরমোন নিঃসৃত হতে থাকে। কখনও আমি আর্দ্র হই সোঁদা আবেগে, কখনও এক চিলতে হাসিতে অভ্যর্থনা জানাই আমাদের নিস্কলুষ ইচ্ছেমালাকে।

মাঝে মাঝে ভাবি, এই মোবাইল ফোনটা না থাকলে যে কী হতো! সবার থেকে কত দূরে আমি, অথচ দূরে নই, স্পর্শের বাহিরে, অথচ অস্পৃশ্য নই, একা তবু নিঃসঙ্গ নই, অবজ্ঞা এবং অবহেলায় বিপর্যস্ত নই। করি না হয় সামান্য কাজ, খাই না হয় চাষের তেলাপিয়া মাছ দিয়ে দুটো ভাত, পরি না হয় সস্তা সুতির জামা,অনুভূতির সূতিকাগারে আমার জন্যেও বরাদ্দ থাকে জোছনা ফুলের তোষকে মেঘের বিছানা, স্বপ্ন স্বপ্ন রাত, আলতো রোদের আলসেমীর আদুরে সকাল। আর তাই এখনও বেঁচে আছি।

বেঁচে থাকতে হলে বেঁচে থাকার নিয়ম গুলি আত্মস্থ করতে হয়,গড়ে নিতে হয় নিজের সুবিধেমত বাস্তব, অভিযোজিত হতে হয় বিবর্তনের সেই সাবেক সূত্র অনুযায়ী। আমি সহজেই অভিযোজিত হতে পারি, তাই বেঁচে থাকাটা আমার জন্যে আর যাই হোক, অসম্ভব নয়।

(৩)
মোনালিসার কথা বেশি বেশি বলে আমার রক্ত সম্পর্কের মানুষ গুলোকে অবজ্ঞা করে ফেলছি না তো? আমি অবশ্য সম্পর্কগুলোকে ঠিক এভাবে মোটা দাগে ক্লাসিফিকেশন করার পক্ষপাতী না। জীবনে চলার পথে কত যোগ বিয়োগ ঘটে! হারিয়ে যায় প্রিয়জনেরা। দূরে সরে যায়। মারা যায়। সম্পর্ক হন্তারক হয়। আর ওদিকে নতুন সম্পর্ক দানা বাঁধে। ভুলিয়ে দেয় অপূর্ণতার হীনবোধ। কানায় কানায় পূর্ণ করে দেয় জীবনপেয়ালা। ঠিক যেমনটি আমার ক্ষেত্রে করেছে মোনালিসা... নাহ, আসলেই মোনালিসার কথা বেশি বলা হয়ে যাচ্ছে। আপাতত স্থগিত রাখি। অন্যসময় বলা যাবে।

সাধারনত দেখা যায় আমাদের বাবা মা, আমাদের বলতে আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে বেড়ে উঠেছি; তারা প্রযুক্তির ব্যাপারে একটু অজ্ঞ হয়ে থাকেন। মোবাইল ফোনে কোনরকমে কল করাটা রপ্ত করতেই তাদের বেশ অনেকটা সময় লেগে যায়। মেসেজ পাঠানো তো দূর অস্ত! কিন্তু আমার ফোনে দিনে কয়েকবার করে মেসেজ পাঠান তারা। হ্যাঁ, এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। আমার ফোনের মেসেজবক্স ঘাঁটলেই দেখা যাবে বাবা, মা এবং মোনালিসার অসংখ্য মেসেজ। মাঝেমধ্যেই ওভারলোডেড হয়ে যায়। কষ্ট লাগে পুরোনো মেসেজ মুছতে। তবু কী আর করা!

তবে একটা অভিযোগ আছে আমার। সেটা অবশ্য তিনজনের কাউকেই কখনও বলি নি। তারা আমাকে কল করেন কালেভদ্রে। কী যে মজা পান তারা মোবাইলে খুঁটখাঁট করে মেসেজ পাঠাতে! বাবা-মার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্ভবত এরকম, কোন বিশেষ কারণ নেই, মজা পান, তাই মেসেজ পাঠান। আমি যখন প্রথম তাদের মেসেজ পাঠানো শেখাই, এক অদ্ভুত সারল্যের দীপ্তিতে বাঙময় হয়ে উঠেছিলো তাঁদের মুখ। সেই ছেলেমানুষীটাই হয়তো এখনও লালন করে রেখেছেন তারা। মানুষের মধ্যে থাকে না, কতরকম বাচ্চামী! আর মোনালিসার ব্যাপারটা হলো, সে কল করার চেয়ে টেক্সট পাঠাতে বেশি পছন্দ করে কারণ- হয়তো এটা বেশি আপন, নিজস্ব স্পর্শটা বেশি থাকে বলে। এসবই অবশ্য আমার ধারণা। তাদের কাউকে কখনও আমি জিজ্ঞেস করতে যাই নি। কেন? যদি বলি না জানার মাঝে একটা রহস্যময়তা আছে, নিজের মত করে ভেবে নেয়ার সৃজনশীলতা আছে, তবে তা শুনতে ভালো লাগলেও সত্য প্রকাশিত হবে না। আসল কারণটা হলো,

ভয় লাগে আমার। বড় ভয়! এই অপ্রয়োজনীয় অনুসন্ধানটি যদি তাদের মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটায়! তারা যদি এটাকে নেতিবাচক ভাবে নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগই বন্ধ করে দেয়? যদিও বড়ই অমূলক ভাবনা তবুও...

সাবধান হতে ক্ষতি কী!

(৪)
অনেক কথাই বলা হয়ে গেলো, একটি ঘটনা বিবৃত করতে গিয়ে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে "হয়তো বা" খামোখা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছি। তবে সূক্ষ্ণ এমন কী বিপরীতধর্মী মনে হতে পারে এমন কিছু ব্যাপার আছে, যেগুলো শুধুমাত্র আমিই জানি। জানি না এগুলো ভেঙে বলবো কি না। আপনি আগ্রহী এবং ভালো শ্রোতা। আপনার কাছে মিনতি, যদি অসাধারণ পর্যবেক্ষণ শক্তির ফলে মিলগুলো ধরতে পারেন, তাহলে কাউকে বলবেন না। এমন না যে কাউকে বললে আমার ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু সবারই রয়েছে নিজস্ব জীবনদর্শন, এবং প্রাইভেসি বিষয়ক মতবাদ। আপনি এটাকে শ্রদ্ধা করবেন, এই আশা আমি করতেই পারি।

(পুনরায় ১)
অনুভূতিদের কোন স্টেশন নেই! খেয়ালী রাজকন্যার মত যেখানে সেখানে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার ডালা নিয়ে বসে পড়ে। আর আমরা সেখান থেকে সওদা করে আপ্লুত হই অভূতপূর্ব অনুভবে। কস্মিনকালেও কি ভাবতে পেরেছিলাম যে এই ভর দুপুরে কাঠখোট্টা অফিসের ভেতর আমি বিশেষ অনুভবে বিস্মিত হবো?
যদিও কাজ করে তেমন একটা টাকা-পয়সা পাই না, তবে একটা ভীষণ রকম ভালো কমফোর্ট আছে। আমার রুমটা ভবনের একদম কোণায়, নির্জনে। পূর্বমুখো হয়ে বসে থাকি। পাশে জানালা দিয়ে দেখি নাগরিক নক্ষত্রসমূহ। চাইলেই থাই গ্লাসের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বিচ্ছিন্ন হতে পারি কিছুক্ষণের জন্যে। তবে সেটা করার সুযোগ খুব একটু হয় না। অনেকেই আসে আমার কাছে, দরোজাটা বন্ধ করে রাখা ভালো দেখায় না।
আমার রুমে আছে একটি কম্পিউটার, টেবিল, এবং দুটি চেয়ার। ছোট্ট রুমটায় দুইটি চেয়ার থাকাতে কিছুটা হাঁসফাঁস লাগে। তবে কিছু বলার নেই। কারণ অনেকেই আসে আমার কাছে, তারা নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে থাকবেন না!

সেদিন অফিসে গিয়ে দেখি চেয়ারটা নেই। হয়তো বা মিটিং রুমে নিয়ে গেছে কেউ। কিংবা সারাতে দিয়েও থাকতে পারে। চেয়ারটার কি ভেতর থেকে কাপড়, রেক্সিন, স্প্রিং ইত্যাদি বের হয়ে খুব ভগ্ন দশার সৃষ্টি হয়েছিলো? মনেও পড়ছে না তেমন কিছু। একটা সস্তা, বিদঘুটে চেয়ারের কথা কে মনে রাখে?

আমার ভুল ভাঙতে সময় লেগেছিলো মাত্র বিশ মিনিট।

সেই অদ্ভুত চেয়ারটা, সেই বিদঘুটে চেয়ারটা, সেই রুগ্ন, সস্তা, বদখত, বেঢপ চেয়ারটা আমাকে জীবন সম্পর্কে এক অনির্বচনীয় অনুভব এনে দিলো। ঘটনাটা শুরু হলো এভাবে,

বেশ কিছু মেইল জমা হয়ে গিয়েছিলো। সেগুলো পড়ে, উত্তর দিতে কিছুটা সময় পার হয়ে গেলো। কাজ শেষে একটু আরাম করার জন্যে শরীরটা এলিয়ে দিতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম। এরকম হলো কেন? এমন তো আগে কখনও হয় নি! তখনই বুঝতে পারলাম কিসের অভাবে এই আচমকা শূণ্য অনুভূতি।

চেয়ারটা এমন দূরত্বে ছিলো, যাতে আমি সহজেই তার "কাঁধে" কনুইটা ভাঁজ করে রেখে শরীরের একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ওজন শিফট করে একটা আয়েশী অবস্থান নিতাম। এই কাজটি এতদিন করে এসেছি অবচতনে, এবং নিজের অগোচরে। আজকেও অভ্যাসবশত হাত রাখতে গিয়ে ভারসাম্য হারালাম। প্রথমে নিজের এই আচরণে খানিকটা কৌতুক বোধ করলেও পরে টের পেলাম ব্যাপারটা ঠিক অতটা কৌতুকপ্রদ নয়। আগামী এক ঘন্টায় তিন-চারবার সেই একই ভুল করলাম। এই কর্কশ, রুক্ষ্ণ, আত্মকেন্দ্রিকতার নরকে কার অত ঠ্যাকা পড়েছে আমাকে এগিয়ে দেব কাঁধ? বলবে আমায় ভাই? ডাকবে আমায় 'এসো'! চেয়ারটির প্রানহীন, কেঠো, জড় অস্তিত্বটি কী ভীষণ প্রাণময়, কী দারুণ বাঙময়! এরকম তো আমার সহকর্মী, বন্ধু, বা শুভানুধ্যয়ী কেউ'ই হতে পারে নি! প্রচণ্ড রকম একাকীত্বের হীনবোধে আক্রান্ত হলাম আমি।

(৫)
লাঞ্চের সময় একাউন্টেন্ট ইখলাক সাহেব এলো আমার রুমে। লোকটির বড় বাজে বকার শখ। কথা বলতে ভালোবাসে। তার সঙ্গ যে আমার খুব খারাপ লাগে তা না। তবে মিনিট পাঁচেকের বেশি তাকে সহ্য করা মুশকিল। একটা মানুষ এত কথা কীভাবে বলে? পান চিবিয়ে মুখ লাল করে ভাতঘুমপূর্ব অলসতায় হাই তুলতে তুলতে সে আমার দরোজায় এসে দাঁড়ালো।
-কী খবর শাহীন সাহেব? কিসের এত কাজ করেন! অবশ্য এখন তো ইয়ং ব্লাড। ইট ইজ হাই টাইম টু ওয়ার্ক।
শুনে আমি একটু টিপ্পনি কাটার লোভ সামলাতে পারলাম না।
-হু। আর বয়স হলে তো লাঞ্চের পর চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমানোর জন্যে হাই টাইম!
হাসিমুখে খোঁচাটা দেয়ায় সে বেশ মজাই পেলো। অফিসের সবাই জানে তার মিনিট ত্রিশেক ভাতঘুম টার কথা। হাহাহাহা করে হাসতে গিয়ে পানের পিক ফেলার যোগাড় আর কী! ভালো লাগলো তার আন্তরিক আচরণ। ইচ্ছে হলো, কিছুক্ষণ গল্প করি।
-আসেন না, বসেন!
সহৃদয় আমন্ত্রণ জানালাম তাকে। এমন অবস্থায় সে কখনই আপত্তি করে না। কিন্তু আজ বসবে কোথায়? রুমের ভেতরে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সে চলে গেলো কাজের অজুহাত দিয়ে।

আজ হয়তো সে আরো মিনিট দশেক বাড়তি ঘুমোবে।

(৬)
কেউ আসছে না আমার কাছে। কেউ বসছে না। পুরো অফিস জেনে গেছে আজ আমি একা। আমার আপ্যায়ন করার সামর্থ্য নেই। আমি কাউকে বসতে দিতে পারবো না। আমার ছিরিহীন অফিস রুমে ইখলাক সাহেব গালগপ্প করতে আসবে না, বড় স্যার কাজের তাগাদা দিতে এসে বসবেন না, সবাই জেনে যাবে আমি একা, আমি নিঃসঙ্গ। এ কী ভীষণ লজ্জার ব্যাপার! ইচ্ছে করছে মা'র সাথে কথা বলি, ইচ্ছে করছে বাবাকে ফোন করে আকুল হয়ে ডাকি, মোনালিসার কাছ থেকে আবেগ মথিত কোনো মেসেজ পাই... চেয়ারটার অভাব ভোলা যাচ্ছে না। এটা শুধু আমার আয়েশী হেলান কেড়ে নেয় নি, এক ভয়াবহ তথ্যবিভ্রাটের সম্মুখীন করেছে। যার সামনে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছি আমি। এতদিনের পরিশ্রমে গড়ে তোলা সাবধানী ফ্যান্টাসি জগৎ ভেঙে চুরমার হয়ে যাবার অবস্থা। ফোনটা হাতে নিয়ে বাবা-মা এবং মোনালিসার প্রেরীত মেসেজগুলো দেখতে থাকি। তাদের কে ফোন করবো? নাহ সেটা ঠিক হবে না। এই অসময়ে! কটকটে ভর দুপুরে! ঘুম, বিশ্রাম, কিংবা খাবারের সময়ে! তারা যদি ফোন না ধরে তাহলে আমার খুব মন খারাপ হবে। এমনিতেই আজকে মনটা ভালো নেই। রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না।

(৭)
দুপুর তিনটার দিকে একটা বিরল কাজ করে ফেললাম। রুম থেকে বেরিয়ে অফিস প্রাঙ্গনে হাঁটাহাঁটি করতে থাকলাম ইতস্তত ভাবে। বিশেষ কোন কাজ না থাকলে আমি সাধারণত রুম থেকে বের হই না। তাই যার সাথেই দেখা হলো, সেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো কী কারণে বেরিয়েছি। ইচ্ছে করছিলো কারো পাশে বসে মনের ভেতরের বয়ে যাওয়া ঝড় এবং ভীতিটা খুলে বলি। "আমার ভালো লাগছে না কিছু। মন খুব খারাপ। মনে হচ্ছে পাশে কেউ নেই"। কেউ যদি প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞেস করে কেন আমার এমন মনে হচ্ছে তখন আমি বলবো কীভাবে ঐ চেয়ারটা আমার মধ্যে একটা একাকীত্বের বিপদ সংকেত স্থাপন করেছে! ব্যাপারটা কি মেটাফরিক, যে আমি ধীরে ধীরে সব নির্ভরতা হারিয়ে ফেলবো? নাকি ইতিমধ্যেই ফেলেছি? সেই একাকীত্বের হীনবোধ আবার জাঁকিয়ে বসে। আর সাথে এও টের পাই যে মাথার ভেতর দলা পাঁকিয়ে ওঠা এই অনুভূতিগুলো অফিসের কারো কাছে ব্যাখ্যা করে বোঝানো সম্ভব না। তারা বিরক্ত হবে। তাদের গাবদা গোবদা সন্তান অথবা বোয়াল মাছের মত বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে পারি বরং। কিন্তু আমার তাড়া আছে।

-ইনভেন্টরির ফরিদ সাহেব কোথায় গেছেন? তাকে দেখছি না যে?
-সে তো আজ ছুটিতে।
-ওহ! দরকার ছিলো একটা।
-কী দরকার?
-আমার চেয়ারটা আমাকে ফেলে...না ইয়ে, মানে চেয়ারটারে দরকার ছিলো খুব...আমি ঘুমাই নাই কালকে রাতে ঠিকমত...

গুবলেট হয়ে যাচ্ছে সব। আমি এমন কিছুর আশঙ্কাই করে এসেছিলাম সবসময়। তাদের কৌতুহলী চোখ আর অসুস্থ জিজ্ঞাসায় ঝকঝকে মুখ দেখে আরো ডাউন হয়ে যাবার কোন মানেই হয় না। প্রায় ছুটে রুমে এসে দরোজা লাগিয়ে দিলাম। আজ আর কেউ আসবে না এখানে। বসবে না, তাই দরোজা খোলা রেখে লাভ কী! ভালো হতো, যদি কিছু শান্তির সুবাতাস এসে এই গুমোট পরিবেশটায় দম যোগাতো। সে আশাও করা বৃথা। চারিপাশে অনেক অনেক বেশি হাইরাইজ বিল্ডিং। দরোজা টা বরং বন্ধই থাকুক বাকিটা সময়। নাকি আগে আগে বেরিয়ে যাবো? কিন্তু তা করেই বা লাভ কী! কে আছে বাসায়! উফ! আবারও সেই অশুভ অনুভূতি! আমি একা নই। একা থাকি, কিন্তু মোটেও একা নই। বাসায় গিয়ে আমি বাবা-মা আর মোনালিসার সাথে অনেক কথা বলবো। মেসেজ দিবো। হ্যাঁ, আমি এখনই বাসায় চলে যাবো।

(৮)
ফেরার আগে ছুটির আবেদন করে এলাম। বাড়ি যাবো। অনেক অনেক দিন বাড়ি যাওয়া হয় না। চেয়ারটির জন্যে মন খারাপ লাগছে। তার যদি একটা মোবাইল ফোন থাকতো, তাহলে ভালো হতো খুব।

(৯)
আগামীকাল বাড়িতে যাবো। বেশ উত্তেজিত বোধ করছি। সেই পুরোনো দিন গুলোর মতো চঞ্চল লাগছে। যখন আমি ঈদের ছুটিতে ক্যাম্পাস থেকে বাড়িতে ফিরতাম। যখন বাবা-মা ছিলেন...
কী হলো? এমন করে তাকাচ্ছেন কেন? আমি কি ভুল কিছু বলে ফেললাম? ওহ...যখন বাবা-মা ছিলেন বলেছি এই জন্যে? অর্থাৎ আপনি বলতে চাচ্ছেন এখন আর তারা নেই? এত সাহস আপনার? তারা নেই, তবে কেন তাদের নাম্বার আমার মোবাইলে সেভ করা আছে? আর তারা তো আমাকে মেসেজও পাঠায়। আবার জানতে চাচ্ছেন কল কেন করে না? তাদের এত কিছু করতে ইচ্ছে করে না। ব্যাস! আপনি চাইলে আমার ফোনের মেসেজগুলো দেখতে পারেন। এই যে দেখুন, ইনবক্স ভরে গেছে বাবা আর মা'র মেসেজে। আরেকটু হলেই ওভারলোড হয়ে যাবে। কী বলছেন? পড়ে দেখতে চান কী লিখেছে? এটা কী ধরণের অভদ্রতা? আপনার বাবা মা কিছুই শেখায় নি? সে কী! আমার দিকে এরকম করে তেড়ে আসছেন কেন? ইউ আর মেকিং মি স্কেয়ার্ড! খবরদার ফোন নিবেন না। খবরদার না! তুই ধ্বংস হয়া যাবি কুত্তা। তোরে লাশ বানায়া ফালামু। আমারে চিনোস নাই। ফাঁপড়বাজি সবার লগে চলে না। প্লিজ! প্লিজ! ফোন নিয়েন না। পায়ে পড়ি আপনার। এইটুকু দয়া করুন আমাকে। আমি একা নই। খোদার কসম, আমি পরাজিত নই। চুৎমারানির পোলা...

(১০)
ফোন এলো। মেসেজ এলো। সবই মিস করে ফেললো বেচারা লোকটি। অপারেটর থেকে প্রায়ই এমন মেসেজ আর ফোন আসে। অদ্ভুত সব নাম্বার থেকে। সে সব সেভ করে রাখে। যেমন,

২৩৫৮-মা (এই রোজায় ফ্যাসিনেটিং সব মেনু পেতে ডায়াল কর ৫০০০ নম্বরে।) অনুবাদ- ইফতারের সময় ডাবের পানি খাস এক গ্লাস বাবা। শক্তি পাবি।
৩৬৭৭-বাবা (এখন থেকে বাসায় বসেই ব্যাংকিং করতে পারেন। বিস্তারিত তথ্যের জন্যে ডায়াল করুন ১০০০ নম্বরে) অনুবাদ- তোর একাউন্টে কিছু টাকা পাঠালাম। একটা ফরমাল শার্ট কিনে নিস।
৮৯০৭-মোনালিসা ( মডেল মোনালিসার সাথে দেখা করতে এক্ষুণি ডায়াল করুন ২৩৫৮ নাম্বারে) অনুবাদ-জান, ছয়টার মধ্যে হাতিরঝিলে চলে আসো। আমি সবুজ শাড়িটা পরবো। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ!

(পরিশিষ্ট)
-কী ব্যাপার, আজকেও অফিসে এলেন যে! আপনার না ছুটি কাটানোর কথা গ্রামের বাড়িতে?
-যাবো, অন্য কোন ছুটিতে। আমার চেয়ারটা ঠিক করেছেন? কেমন আছে সে?

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৭ রাত ৮:২৯
১৩টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×