somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডেমো

২৬ শে মে, ২০১৭ রাত ৮:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্রথম অধ্যায়
(১)
নতুন একটা ব্যবসা ধরেছি আমরা। প্রকাশনীর ব্যবসা। আমরা তিনজন। তিন হরিহর আত্মা। আমি ববি, আর আমার অতি ঘনিষ্ঠ দুই স্যাঙাত। আসাদ আর শিমু। গত কয়েকবছর ধরে আমরা সবাই বিভিন্ন মেয়াদে বেকারত্বের কারাগারে বন্দী হয়ে আছি। মধ্যবিত্ত ঘরের চালচুলোহীন আধা বখাটে আধা ভদ্র ছোকড়াদের সাধারণত একটি লাবণ্যময় চেহারার আহলাদী প্রেমিকা থাকে, দুদিন পর পর যে “বাবার শরীরটা ভালো না, বাসা থেকে বিয়ের জন্যে খুব চাপ দিচ্ছে, তুমি কিছু একটা করো” জাতীয় হুমকি দিয়ে বেকার জীবনকে সত্যায়িত করে থাকে। দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য জানি না, আমাদের কারো তেমন কেউ নেই। তবে অন্য অনুষঙ্গটি অবশ্য বেশ ভালোভাবেই বিদ্যমান। তা হলো, টঙ দোকানে চা সিগারেট নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে দুনিয়ার যত্তসব আজাইরা বৃত্তান্ত নিয়ে গুলতানি মারা। তবে গুলতানি থেকেও মাঝেমধ্যে প্রোডাক্টিভ কিছুর জন্ম হতে পারে।
সেদিন বিকেলে আনিসুরের দোকানের আড্ডাটা কেন যেন তেমন জমছিলো না। সবারই মন-মেজাজ খিঁচড়ে ছিলো। আমরা হলাম গিয়ে বলতে পারেন মহামান্য জাতবেকার। তাই চাকুরি-বাকুরি না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও হতাশা নেই তেমন একটা। ছোটবেলা থেকেই আমরা যত্তসব অকাজের কাজী। কাজের প্রতি তীব্র অনিহাকে আমরা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। বড় হয়ে, বিএ- বিকম পাস করে মুরুব্বিদের লাথি-গুতো,ভর্ৎসনা হজম করে মনমরা হয়ে কিছু জায়গায় অবশ্য সিভি দিয়েছি আশ্চর্য উদাসীন নির্লিপ্ততায়। জগৎ-সংসার, শান-শওকতের প্রতি এই তুচ্ছভাব আমাদের নির্লোভ মনের একটা ভালো পরিচায়ক অবশ্যই। তবে এই নির্লিপ্ত মনোভাব একদিনে তৈরি হয় নি। বহুদিনের চর্চার ফসল এটি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেনেটুনে পাশ করে হুরমুড়িয়ে চাকুরি পেয়ে যাব এমন ভাবনা কস্মিনকালেও মনে ঠাঁই দেই নি। মানুষের মামা-চাচা থাকে। আমাদের খালু-ফুপা-তালুই কিছুই ছিলো না। তাই আমরা পাশ করার পর একদিন মোগলাই পরোটা আর আফিম চা খেতে খেতে ধৈর্য্যের সাথে ক্যালকুলেশন করে বের করলাম যে আমাদের খরা কাটতে অন্তত সাড়ে তিন থেকে সোয়া পাঁচ বছর লাগবে। আর যদি তিন বছরের মাঝে কিছু না হয়, তাহলে ব্যবসার ধান্দা ধরবো। টুকটাক তবলার বোল থেকেই একদিন হেভি মেটাল ড্রামস বাজবে এই বলে নিজেদের সাহস যুগিয়েছিলাম। তারপর... তিন বছর কেটে গেল যেন কীভাবে। ইদানিং বাসা থেকেও আর তাগাদা দেয় না। তবে আমরা ঠিকই ময়দানে নামার প্রস্তুতি নেই।
সেদিন বিকেলে আমি আর শিমু বিরসবদনে বসে চা খাচ্ছিলাম। দুজনেই জানি যে সেদিন তিন বছর পার হয়ে যাচ্ছে। সেই সে দিনের কথা মনে পড়ে কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগছিলাম। বেশ তো ছিলাম আরামে আবডালে! খামোখা কী দরকার এই ভীড়ের শহরে মানুষের পা মাড়িয়ে দিয়ে হন্যে হয়ে ছুটতে! এমনিতেই দেশের অবস্থা ভালো না, ব্যবসাপাতি করা... যাই হোক, আমি এমন ভাব করছিলাম যেন আমার মনে নেই কিছু। শিমুও দেখি বিব্রত ভঙ্গিতে খুকখুক করে কাশছে। আমি নিশ্চিত, সেও ভুলে থাকার ভান করছে। টেনশন হচ্ছিলো আসাদকে নিয়ে। আমাদের মধ্যে ও সবচেয়ে বেশি সিরিয়াস। কখন এসে আমাদের তিরস্কার করে হাস্যকরভাবে একটা আধা বিপ্লবী আধা পাতাচোর মুখের ভঙ্গি করে ‘উদ্দীপক (তার ভাষায়)” ভাষণ দেয়া শুরু করবে কে জানে! জানাজানির কিছু নেই, সে আসবে এবং আমাদের অডিয়েন্স বানিয়ে ফেলবে এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ভাবতেই আমাদের মেজাজ খিঁচড়ে গেলো। অযথাই আনিসুরের সাথে ঝগড়া করলাম কিছুক্ষণ। কেতলির পেছনে বসা চালু চেহা্রার ছোকড়াটিকে (নতুন এসেছে, কী যেন নাম তার!) ধমক দিলাম। সে পাল্টা জবাব দিলে বেশ একটা বচসা শুরু হয়ে গেলো। চা দোকানের মালিক এবং কর্মচারী বনাম আমরা দুজন। কিছুক্ষণের মধ্যে উৎসাহী জনতা গভীর আগ্রহ নিয়ে দোকানের কাছাকাছি এসে জড়ো হলো। মোটামুটি উত্তেজনাপূর্ণ ব্যাপার। নগরবাসীর জন্যে অতি প্রতিক্ষিত একটা ইভেন্ট নিঃসন্দেহে। এরই মাঝে স্পয়েলস্পোর্ট হিসেবে আবির্ভূত হলো আসাদ। লোকাল বাসে নিয়োজিত কন্ডাকটরের মত করে মানুষজন সামলিয়ে আমাদের পাকড়াও করে ধরে নিয়ে গিয়ে গেলো এক কোনায়। গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা শুরু করলো,
“কমরেড! ধিক তোমাদের! আজ এই ক্রান্তিলগ্নে নিজের ভুলুন্ঠিত হওয়া সম্মান ফিরে পেতে যেখানে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত, সেখানে তোমরা ঝগড়া করে...তা ও এই...”
অধিক উত্তেজনায় সে কথা হারিয়ে ফেললো। সব মিলিয়ে আমাদের মেজাজ তখন সপ্তমে। একে তো এই যেড ক্লাশ স্ক্রিপ্টের মত মুখস্ত বস্তাপচা বক্তৃতা, তার ওপর কমরেড সম্বোধন, আমরা কি বলশেভিক নাকি চিনাবাদাম? ক্ষেপে উঠে থামিয়ে দিলাম ওকে।
-ঐ, এইসব বকোয়াজ ধানাই পানাই বন্ধ করে আসল কথাটা বল।
এমন তিক্ত আক্রমণে তার বিপ্লবী বচন বাধাগ্রস্ত হলে সে বিড়বিড় করে “অরণ্যে রোদন” কিংবা “প্রলেতারিয়েত” মার্কা কিছু মুখস্ত বুলি ছেড়ে শ্রাগ করে। এসব লক্ষণ দেখে আমরা ধারণা করি যে সে হয়তো বা এইবার তার ফুপাতো ভাইয়ের চাচার শ্বশুর জাতীয় কারো কাছ থেকে তিরস্কৃত হয়েছে, তাই এমন অসংলগ্ন আচরণ। তবে এর প্রতিকারও জানা আছে আমাদের। তাকে নতুন আসা ইজি লাইট সিগারেট আর এক কাপ মালাই চা দিয়ে আপ্যায়ন করে প্রকৃতস্থ করি।
আর এভাবেই আমাদের রাগপর্বের সমাপ্তি এবং ব্যবসা সম্পর্কিত কিছু ফলদায়ক কথাবার্তা এবং যুক্তিতর্ক শেষে যুগান্তকারী এক বিজনেস প্ল্যান পেয়ে যাওয়া।
আমরা প্রকাশনীর ব্যবসাতে নামবো।
(২)
আমাদের এই ঐতিহাসিক এবং আনঅর্থোডক্স সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পেছনে মূল কারিগর ছিলো আসাদ। তার মতে, মানুষজন এখন পড়ার চেয়ে বেশি লেখে। লেখে এসএমএস, লেখে ফেসবুক স্ট্যাটাস, লেখে ব্লগ। অভিমানী বালক লেখে একাকীত্ব আর বিষণ্ণতার কবিতা, তেজী তরুণী সদম্ভে ঘোষণা দেয় “হ্যাপি টু ব্লিড”! হিটসিকার মাদারফাকার ‘লেখে’ চুরি করা কবিতা। এদের সবাই চায় পরিচিতি। ফেসবুকের নীল-সাদা জগৎ থেকে কালি ও কলমের কালো অক্ষরের রাজ্যে ওদেরকে নিয়ে আসার কৌশলটা রপ্ত করতে পারলেই হলো। তারপরে খালি লাভ আর লাভ! সেইবেলা আসাদের বক্তব্য, যুক্তি এবং উপস্থাপনা প্রায় অলৌকিক পর্যায়ের ভালো ছিলো। আমরা সহজেই কনভিন্সড হয়ে যাই। তারপর তুমুল আগ্রহে লেগে পড়ি বই প্রকাশের বিদ্যাটি আয়ত্ত করতে। মূলধন যোগাড়ের জন্যে ব্যস্ত হই নি আমরা। কিছু একটা করছি এই প্রমাণ দেখাতে পারলে পরিবার থেকে টাকা যোগাড় করাটা হয়তো বা তেমন কঠিন হবে না। কিছুদিন ঘুরে ঘুরে পেস্টিং,, প্লেট ও মেকিং ,৭০,৮০ এবং ১২০ গ্রাম কাগজের গুণগত পার্থক্য,ছাপা , বই বাঁধাই, বাজারজাত করণ, পেইজ সেট-আপ, পিএস প্লেট এবং ডিপিএস প্লেট ব্যবহারের মধ্যে পার্থক্য এসব সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা নিয়ে ফেললাম।
কাজের মধ্যে থেকে বেশ ভালো রকম সাহস এবং আত্মবিশ্বাস অর্জন করে ফেললাম। মগজের ঘুনপোকা কর্তৃক রচিত বুকের মাঝের ক্ষয়াটে বর্ণমালাগুলো তাজা বাতাসের সংস্পর্শ পেয়ে মাত্রবৃত্ত ছন্দে নাচতে লাগলো। আর এর ফলে আমরা একটা উদ্ভট রকম বোকাটে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।




(৩)
আমাদের প্রকাশনীর নাম দিয়েছি ছায়াঘর। সেদিন বিকেলে আমাদের ছাদের চিলেকোঠায় ‘ছায়াঘর’ এর নিয়মিত সাপ্তাহিক মিটিং হচ্ছিলো। মিটিং আর কী...এই কবে থেকে আমরা বই প্রকাশ করবো, মূলধন কীভাবে যোগাড় হবে, এসব নিয়ে আলোচনা। টেকনিক্যাল দিকগুলো কিছুটা হলেও আত্মস্থ করে ফেলেছি। এখনও অনেক জানার বাকি। শুরুর দিকের জোয়ারি মনটা কিছুটা হলেও থিতিয়ে গেছে। কবে পাবো মূলধন, কবে অফিস নেবো, কবে বই বের করবো, বিভিন্ন দুশ্চিন্তা। এমন অবস্থায় শিমু এমন একটা প্রস্তাব দিলো, যা শুনে আমাদের চক্ষু পাবনার প্যারাডাইস সুইটসের বিশাল রাজভোগগুলোর মত আকার ধারণ করলো। বলে কী সে!
-আপনারা কি জ্ঞাত আছেন যে পাড়ার রত্নপুর কিন্ডার্গার্টেন স্কুলে এক সপ্তাহব্যাপী বইমেলা হতে যাচ্ছে?
মিটিংয়ের সিরিয়াসনেস বজায় রাখার জন্যে আমাদের একে অপরকে তুই-তুকারি করা মানা। “চেয়ারম্যান” জনাব আসাদুজ্জামান পাটোয়ারির কঠিন নির্দেশ। আদেশ অমান্য করলে ভাগ্যে জুটবে তিরষ্কার এবং একটি বেনসন সিগারেট জরিমানা।
-জ্বী না। জানি না।
আমি অনাগ্রহের সাথে বললাম।
-এসব আপনাদের জানা উচিত। বিজনেসে উন্নতি করতে গেলে চোখ কান খোলা রাখতে হবে।
-আচ্ছা তা রাখা যাবে। এখন দয়া করে ব্যাখ্যা করুন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বইমেলার সাথে আমাদের বর্তমান কার্যক্রমের সম্পৃক্ততা কোথায়?
আসাদের কণ্ঠে নিরুত্তাপ অনাগ্রহ।
-ওখানে আমরা স্টল দেবো। আর মাত্র এক সপ্তাহ আছে। অন্তত গোটা তিনেক বই প্রকাশ করে ফেলবো এর মধ্যে। এ্যাজ আ স্টার্ট তিনটা বই কম না একেবারে।
শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। অফিসিয়াল মিটিংয়ে ফালতু রসিকতা করার জন্যে না। এই তপ্ত বিকেলে তাড়ি খেয়ে আসার জন্যেও না। হারামজাদা আমারে না বইলা কেমনে খাইতে পারলো? চিবিয়ে চিবিয়ে বাছা বাছা কিছু ভদ্রগোছের স্ল্যাং নির্বাচন করে তাকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে মুখ খুলতে গিয়ে অশিষ্টতা হয়ে গেলো, ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালি দিয়ে উঠলাম। আসাদ আমাকে দুইটি বেনসন জরিমানা করলো। বুঝতে পারছি, এই উৎকট রসিকতায় সে নিজেও বিরক্ত হয়েছে। তবে ভাবে তা প্রকাশ করলো না।
-আপনার বক্তব্য স্পষ্ট করে বলুন জনাব শিমু।
-আমরা বই বের করবো, তবে প্রথাগত ধারায় না। যেহেতু আমাদের মূলধন নেই, তাই এবার আমরা অল্প খরচে বিকল্প পন্থা অবলম্বন করবো। দুলাভাই স্যরি...আমার একজন নিকট আত্মীয় আমাকে একটি প্রিন্টার গিফট করেছে। কাজটা সিম্পল। কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট নিয়ে নীলক্ষেতে বাঁধাই করে ‘ডেমো’ বই বানিয়ে ফেলবো। মনে রাখবেন, আমরা কোন আন্তর্জাতিক বইমেলায় যাচ্ছি না। নিতান্তই ছোটদের ব্যাপার। ওখানে তো আর অন্যপ্রকাশ বা পাঠক সমাবেশ স্টল দিতে যাচ্ছে না! একটা স্কুলের ফিনান্সিয়াল অবস্থা আর কতই বা ভালো হতে পারে! মূল উদ্দেশ্যটা হচ্ছে সফটওয়্যারের কাজটা ঝালাই করে নেয়া, আর ডেমো বই প্রকাশের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস অর্জন করা, একেবারে বসে তো নেই। কিছু একটা তো করছি! ইদানিং আমাদের এই ঝিমিয়ে পড়া...
শিমু দীর্ঘ বক্তৃতা দিলো। আমরা ওর এই অভিনব প্ল্যানটাকে অনুমোদন না করে পারলাম না! আমাদের পরিচিত বেশ কয়েকজন ব্লগার আছেন, যারা শিশুদের নিয়ে লেখেন। এই ডেমো বই বের করতে তাদের অনুমতি নেয়াটাই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার।

দ্বিতীয় অধ্যায়
(১)
আমরা এসেছি স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মোখলেস মোল্লার বাসায়। বইমেলায় এন্ট্রি পেতে তার অনুমতি দরকার। এতটুকু একটা প্রতিষ্ঠানে এত নিয়ম-নীতির বাগাড়ম্বর! ভাবাই যায় না। ভদ্রলোক আমাদের এলাকায় থাকেন না। তার নামও শুনি নি কখনও আগে। শুনেছি দারুণ ডাকাবুকো এবং প্রভাবশালী লোক। কোন এক রাজনৈতিক দলের বড় পদে আছেন। তা থাকুক! আমরা অক্ষরের ব্যাপারী, কামানের খবর নিয়ে কী করবো? ভালোয় ভালোয় আমাদের অনুমোদন করলেই হয়। কেস শেষ! দুঃখের বিষয়, টাইমিংটা ঠিক ছিলো না। ভদ্রলোক পাড় মাতাল হয়ে আছেন। মেজাজ-মর্জি কোনদিকে প্রবাহিত হয় ধারণা করার চেষ্টা করছি উৎকণ্ঠার সাথে।
-তোমরা কী জন্যে আইছো? পিস্তল চাইতে? ক্যা সেইদিনই না দিলাম? কী করোস তোরা বাইঞ্চোতের দল। আমি কি অস্ত্রের কারখানা দিয়া বসছি নাকি হারামীরা!
সর্বনাশ!! আমরা কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছি না। ওদিকে ভদ্রলোক ক্রমাগত বকেই চলেছেন। আমি অনেক কষ্টে কয়েক হাজারবার মনের ভেতর শব্দ সাজিয়ে, ফেলে দিয়ে শেষ পর্যন্ত উচ্চারণ করতে সক্ষম হলাম,
-আমরা বরং আজ আসি। আপনার শরীরটা বোধ হয় ভালো নেই। বিশ্রাম দরকার।
-তোমরা কী ভাবসো? আমি মাতাল? হাহাহাহা! হ, কিছুটা ধরছে বটেক তয় আউট হই নাই। মাত্র ৬ পেগ জ্যাক ড্যানিয়েলস খায়া মোখলেস মোল্লা টাল হয় না। এতক্ষণ তোমগো সাথে মজা লইলাম। হাহাহা!
-ওহ তাই! হ্যাঁ আসলেই খুব মজা হয়েছে।
বোকার মত বলে ফেললাম।
হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি।
-তোমরা তো বইমেলার ব্যাপারে আসছো তাই না?
চমকে গেলাম তার কথা শুনে। আসলেই মাতাল হন নি। তার কন্ঠেও যেন এটি প্রমাণ করার জন্যে যথার্থ আশ্বস্ততা এবং স্নেহ বিদ্যমান। নাহ, তার সাথে বসা যেতে পারে মনে হয়। আমাদের উত্তর শুনে সন্তুষ্টির উজ্জ্বল রেখা ছড়িয়ে পড়লো তার মুখে।
-বই বাইর করা খুবই ভালো জিনিস। আমিও একসময় প্রচুর বই পড়তাম। তা তোমরা কী টাইপ বই বের করো?
-এই তো, নামী লেখক কোথায় পাবো বলেন স্যার! টুকটাক যারা লেখালেখি করে, এই ধরেন ব্লগারদের নিয়ে কিছু কাজ করেছি আমরা...শিশুতোষ...
-ব্লগার না? ব্লগার? হুম।
বিড়বিড় করে আওড়ালেন তিনি।
-আমিও ব্লগিং করতাম একসময়।
-কোন ব্লগে স্যার?
-কাঁঠালপাতা ব্লগে।
-ওহ তাই নাকি? হ্যাঁ সেটাতো খুবই ভালো ব্লগ।
আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলি। কী সব যে হচ্ছে এখানে!
বেশ কিছুক্ষন নীরবতা। তিনি বেশ দ্রুত ড্রিংক করে চলেছেন। মিনিট দশেক পরে যখন আমাদের দিকে তাকালেন, তখন তিনি ঘামছেন প্রচণ্ড। চোখে রক্তাভা। বুনো দৃষ্টি।
-তোমরা আমার বাপরে নিয়া কোন বই বাইর করো নাই?
-জ্বী? মানে...
-আমার বাপ কাউসার মোল্লা। তার নাম শোনোস নাই তোরা? এত বড় একজন সমাজসেবক, ধার্মিক, রত্নপুরের গর্ব, আর তোরা তার নামই শোনোস নাই? ঐ হারামীর বাচ্চারা তোরা চিনোস না তারে?
-জ্বী অবশ্যই চিনি। আরে চিনবো না মানে! তার বইও পড়েছি...বই...মানে মানে তার বই...
আবারও ক্লাইমেক্সে এসে কথা আটকে গেলো আসাদের। যার পরিণতি হলো ভয়াবহ। যদিও তা মিস্টার ডিজাস্টারের মুখে হাসি ফোটালো।
-কী কইলা? বাবারে নিয়া বই বাইর করসো? আগে কইবা না? কই বই? আমারে দাও তাড়াতাড়ি এক কপি। তাইতুল হুজুরের দোয়া নিয়া আসি।
ভয়ানক জটিল পরিস্থিতি। এই মুহূর্তে তার ভুল ভাঙানোর পরিণতি মর্মান্তিক হতে পারে। কিছুই করার ছিলো না আমাদের।
-স্যার বই তো সঙ্গে আনি নি, তবে প্রেসে আছে। এর পরেরবার এলে অবশ্যই আপনার জন্যে এক কপি নিয়ে আসবো।
এটা বলে তার মদ্যপানজনিত ব্ল্যাকআউট প্রার্থনা করতে থাকি কায়মনোচিত্তে।
-এর পরেরবার আবার কী রে বলদ? লোক পাঠাইতাছি, এক্ষণ তার হাতে দিয়া পাঠাইবি। রাসেল! রাসেল! শুইনা যা তো।

(২)
রাসেল লোকটা মুষকো জোয়ান। ভয়াবহ চেহারা। যেন লুকা ব্রাসির বাংলাদেশী ভার্সন। সাক্ষাৎ যম। এখনকার এই জটিল পরিস্থিতিতে উত্তরণের একটাই মাত্র পথ খোলা আছে আমাদের। খোদার কাছে আসমানী কিতাব প্রার্থনা করা। লুকা ব্রাসি বই না নিয়ে যাবে না। তাকে যে আদেশ দেয়া হয় নিরীহ ভেড়ার মত তা পালন করা, আর এতে কোন গাফিলতি দেখলে বাঘের মত লাফিয়ে পড়ে ঘাড় মটকিয়ে দেয়া, এদের জীবনটা এমনই সরল এবং স্পষ্ট। ভাবতে ভাবতে আমরা বাসায় পৌঁছে যাই। কার বাসায়, কেন; তার কোন উত্তর নেই। তাই প্রশ্ন করাটাও অবান্তর। মোখলেস সাহেবের ফোন আসে। রাসেল ওপাশের কথা শুনে আমার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দেয়।


(৩)
-বই কই?
-বই তো স্যার তেঁতুল তলায়।
-কোন তেঁতুল তলায়? ইয়াইতুল হুজুরের আস্তানায়? ওই যে যেই তেঁতুল গাছে কাঁঠাল পাতা ধরে সেইটায়?
নেশা কেটে যাচ্ছে তার। লজিক পরিষ্কার হচ্ছে। এটা ভালো না খারাপ লক্ষণ বুঝতে পারছি না। আমার অবস্থা সঙ্গীন। শিমু আর আসাদ কোন ফাঁকে যেন সটকে পড়েছে। যেই দৌড়টা দিয়েছে ভয় পেয়ে, জার্মানি পৌঁছানোর আগে থামবে না।
-হ্যাঁ, সেখানেই।
-তুড়ন্ত যাও! রাসেল মটর সাইকেল নিছে না? বেশিক্ষন লাগবে না যাইতে।
-মটর সাইকেলে করে সেখানে যাওয়া যাবে না স্যার। সামনে বিশাল নদী।
-আরে নদীর মায়েরে বাপ! নৌকা আছে না?
-জানি না স্যার।
-আরে না গেলে কেমনে জানবি বোকাচোদা! রাসেলরে নিয়া অক্ষুণি যা।

(৪)
ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ নদী। দূর থেকেই তার তর্জন গর্জন শোনা যাচ্ছে। ট্রান্সপোর্টের অবস্থা ভালো না। একটা মাত্র নৌকা। যাত্রীর সংখ্যা অনেক। আছে তীরে দাঁড়ানো নিযুত মানুষ। আর আছে পাহাড়ারত প্রহরীরা। যারা নৌকায় উঠতে পারছে না তাদের সবাইকে কচুকাটা করছে তারা। টাটকা রক্ত বুকে নিয়ে নদীটা দূরে চলে যাচ্ছে সেই আশ্চর্য, অলৌকিক গাছের কাছে। রক্তপান করে বলবান হচ্ছে বৃক্ষটি। তেঁতুল গাছে কাঁঠালপাতা প্রস্ফুটিত হবার সময়ে ঝড়োবাতাসের তান্ডবনৃত্যে খড়কুটোর মত উড়ে যাচ্ছে বাসস্থান। সরে যাচ্ছে সেই হিমহিম পশ্চিমে। ছিঁড়ে যাচ্ছে বাউলের একতারার তার, গ্রন্থের পাতা, এবং আর যা কিছু সবুজ।
পাড় ভাংছে ক্রমশ। আমি শুধু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি নৌকার যাত্রীরা ওপাড়ে গিয়ে দখল করছে জমি, নারী আর নিরাপত্তা। নৌকাটার কাছে পৌঁছুতে পারি না আমি। যাওয়া হয় না ওপাড়ে। গলায় শীতল কিছুর স্পর্শে চমকে না উঠে পেছন ফিরে তাকাই আমি...

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ২:২৪
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×