একটা সময় মিক্সড এ্যালবাম মানে ছিলো আবেগের নাম, উন্মাদনার নাম। মিক্সড এ্যালবামে প্রিয় শিল্পী বা ব্যান্ডের গানটা বন্ধুর প্রিয় শিল্পী বা ব্যান্ডের চেয়ে ভালো হবে তো, এ নিয়ে টেনশনও হয়েছে রীতিমত। হ্যাঁ সময়টা এমনই ছিলো। উন্মাতাল নব্বইয়ের কথা বলছি আমি। সঙ্গীত বিষয়ক গীতি বিচিত্রা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে একদম সর্বশেষ পর্বে থাকতো ব্যান্ডের গান। ঐ গানটা দেখার জন্যে সারা সপ্তাহ (নাকি পক্ষ) ধরে অপেক্ষা করতাম। আর টিভিতে কালেভদ্রে ব্যান্ড শো হলে তো কথাই নেই! মনে আছে একবার কোনো এক ঈদের ব্যান্ড শোতে ১১টি ব্যান্ডের এক দুর্দান্ত প্রোগ্রাম হয়েছিলো। প্রমিথিওসের বিপ্লবের “চাঁদ সাজালো আলো রুপালী”র পাগলা নাচ, উইনিংয়ের “অচেনা শহর” এর নতুন পথে যাত্রা, নোভার “স্কুল পলাতক মেয়ে” সহ কত অসাধারণ গান, কত স্মৃতি! একসময় কিনতে হতো ফিতের ক্যাসেট, যেগুলো মাঝেমধ্যে বিচ্ছিরিভাবে জড়িয়ে যেতো, তখন কত কসরৎ করে আবার জোড়া লাগাতে হতো! বাসায় ক্যাসেট রাখার জায়গা ছিলো না। এরপর এলো সিডির যুগ। সিডি অবশ্য বস্তাভরা হতে পারে নি, ড্রয়ারেই আবদ্ধ ছিলো! একটু পরেই প্রবেশ করেছিলাম সেই যুগে। তারপর কী যেন হলো! হারিয়ে গেলো সব কোথায়! কোনো না কোনোভাবে গান শোনা হয়েই যায়। গান নিয়ে উন্মাদনা মোটেই কমে নি, কিন্তু গানের এ্যালবামের চেয়ে আমরা নির্ভর হয়ে গেলাম সিঙ্গেলের ওপর। আর বৈধভাবে এ্যালবাম শোনার জন্যে এলো নানারকম এ্যাপস। কিন্তু এতে কি নতুন ক্যাসেট বা সিডির স্বাদ পাওয়া যায়? এই কদিন আগেই সেই ভুলে যাওয়া ঘ্রাণটা নিলাম বুকভরে, আবার!
এ্যালবামের নামই হলো ‘আবার’! প্রায় দুই বছর ধরে শুনছিলাম একটা কিছু বের হতে যাচ্ছে। এমন একটা কিছু, যার জন্যে অপেক্ষা করে থাকা যায়। সেই অপেক্ষা সার্থক! নব্বইয়ের দশকে কাঁপানো ৩৩টি ব্যান্ডের ৪১টি গান, ৩টি সিডি একসাথে, ভাবা যায়! আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে বেড়ে উঠেছি, তাদের জন্যে এ এক অসাধারণ স্মারক উপহার, পুরোনো ভালোলাগা ঝালাই করে নেয়ার জন্যে। তেত্রিশটি ব্যান্ডের প্রতিটিই যে খুব জনপ্রিয় ছিলো তা না, তবে যারা নব্বইয়ের দশকের সুরেলা নির্যাস গায়ে মেখেছেন তাদের জন্যে লিস্টটা লোভ জাগানিয়াই হবে।
ব্যান্ডগুলো হলো- ফিডব্যাক, আর্ক, উইনিং, ডিফরেন্ট টাচ, রেনেসাঁ, বাংলাদেশ, ব্লু বার্ডস, বু হরনেট, ব্লু ওশ্যান, কেইডেন্স, ডিজিটাল, ড্রিমল্যান্ড, ইভস, ফেইথ, মনিটর, মিউজিক টাচ, নিউ ইভস, নেকসাস, নরদার্ন স্টার, অকটেভ, অডেসি, পেপার রাইম, পেন্টাগন, পালস, স্পার্ক, স্টারলিং, সাডেন, তরুণ ব্যান্ড, তীর্থক, দ্যা কিউ, দ্যা ওয়ার্ডস, উইন্ডস এবং সাঈফ।
আমি সবাইকে এ্যালবামটি শোনার উদ্বাহু আহবান জানাবো না। কারণ এই নামগুলির সবগুলো সবার চেনাজানা না, তেমন আবেদন জাগাবে না সবার কাছে। এই গানগুলি আমি শুনেছি পক্ষপাতিত্ব করে, আবেগ জর্জরিত হয়ে। বিশাল পিজ্জার প্যাকেটের মত একটা সুদৃশ্য এ্যালবামে একচিলতে অতীত খুঁজে নেয়া, অনেকখানি নস্টালজিক হওয়া! তাই আমি এই এ্যালবাম নিয়ে শুধু ভালোলাগাটাই শেয়ার করবো। কোনো মন্দ লাগা বলবো না, কোনো সমালোচনা করবো না, কেমন করলে ভালো হতো, আরো কী কী করা যেত কিছুই বলবো না। কারণ “আশিক মিউজিক” এতজন শিল্পীকে একসাথে করার যে দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করেছে তার পেছনে যে অবিশ্বাস্য আত্মনিবেদন লাগে, তা অর্জন করার সাধ্য খুব কম মানুষেরই আছে।
৩৩টি ব্যান্ড এবং শিল্পীর ৪১টি গানের প্রতিটি সম্পর্কে বলা অতি কঠিন ব্যাপার। কিন্তু প্রতিটা গানকে নিয়েই অনেককিছু লেখা যায়। আমি বলবো সেরা ৬টি গান নিয়ে।
তার আগে এ্যালবামের একটা সংক্ষিপ্ত ওভারভিউ দিয়ে নিই। গানগুলোর মধ্যে বেশ কিছু এখনকার তুলনায় একদম সেকেলে মনে হবে। আবার কিছু কিছু গান মনে হবে এই সময়েরই। মূলত ভালোবাসা,একাকীত্ব, এসব নিয়েই গাঁথা হয়েছে গানগুলি। তার মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম স্পার্ক এবং ফেইথের গান দুটি। স্পার্ক গেয়েছে বাংলা রকের গুরু আজম খানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, আর ফেইথ গেয়েছে সমসাময়িক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নিয়ে। বাংলাদেশের প্রথম মেয়েদের ব্যান্ড ব্লু বার্ডস আছে, তাদের কথা না বললেই নয়। তবে তারা যে গান অনেকদিন চর্চা করেন না এটা বোঝা গেছে। তারপরেও আগ্রহ নিয়ে শুনেছি। আর এটাই হলো এই এ্যালবামের আসল সৌন্দর্য। (পরে জেনেছি ব্লু বার্ডসের ভোকাল অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায়, হাতে স্যালাইন নিতে নিতে গানটি গেয়েছেন। ভাবা যায় ডেডিকেশন!) পেপাররাইমের সাদ ভাইয়ের গলা এখনও সেই বিশ বছর আগের মত বাচ্চা-বাচ্চাই লাগে শুনতে। তবুও তো শুনতে পেলাম! এই এ্যালবাম না পেলে “অন্ধকার ঘরে”র মত ক্লাসিকের জন্মদাতা এই ব্যান্ডটিকে আর কোথায় খুঁজে পেতাম! ড্রিমল্যান্ডের ভোকালদের অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গির গান নিয়ে বেশ হাস্যরস তৈরি হতো, যদিও তাদের গান ভালো ছিলো এই এ্যালবামে ড্রিমল্যান্ডের গান অনেক পরিণত লেগেছে।
সেরা ৬ গান
আমার হতি যদি (কেইডেন্স) (সিডি-টু) – চমৎকার প্লাকিং দিয়ে শুরু হওয়া গানটায় অদ্ভুতরকম বিষণ্ণতা আছে। আছে অপ্রাপ্তির হাহাকার। আছে নাইন্টিজ ফ্লেভার। আলী আফজাল নিকোলাস ভাইয়ের কণ্ঠটা গানের সাথে এতটাই একাত্ম লেগেছে, মনে হয়েছে তিনি আসলেই অনেক কষ্ট থেকে গানটি করেছেন। কেইডেন্সকে খুব জনপ্রিয় কোনো ব্যান্ড ছিলো না, কিন্তু যারা অনেক গান শুনতো তাদের কাছে সমাদৃত ছিলো খুব। যদি খুঁজে পান, কেইডেন্সের পুরোনো গান “স্বপ্নীল এই রাতে” শুনতে পারেন।
সন্ধ্যাতারা (ফিডব্যাক) (সিডি টু)- “আমার নতুন আকাশে তুমি সন্ধ্যাতারা” এই গানটা মনে পড়ছে কারো? উল্লাস এ্যালবামের গান। রোমেল ভাই গেয়েছিলেন। এবার সন্ধ্যাতারা নিয়ে ফিরে এলেন লিজেন্ডারি গিটারিস্ট এবং পার্ট টাইম ভোকাল লাবু ভাই!। গানটা তিনি বেশ ভালোই গেলেন! এত মেলোডিয়াস একটা গান! যেকোনো মুডে শুনতে পারেন। প্রেমিকাকে শোনানোর জন্যে পারফেক্ট। মনে রাখার মত একটি গান।
এখনো তোমাকে ভালোবাসি (সাঈফ) (সিডি টু)- বাংলাদেশের সর্বকালের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড শিল্পী কে? এই প্রশ্নের জবাবে আমি এক কথায় জবাব দেবো- সাঈফ। অসম্ভব রকম সুন্দর আর সুরেলা তার গলা। ভালোবাসার গানগুলো এত ভালো মানাতো তার গলায়! জন ডেনভারের বাংলা সংস্করণগুলোও অসাধারণ কাভার করেছিলেন। বাইশ বছর আগে বের হয়েছিলো তার সর্বশেষ এ্যালবাম “পিছু ডাকার মানে নেই”। তারপর হারিয়ে যান। কোথাও তাকে খুঁজে পাই নি। তিনি ফিরে আসার উপলক্ষ্যে একেবারে মন ভরিয়ে দিলেন। কণ্ঠের কারুকাজ শুনলে বুঝতে পারবেন কতটা দক্ষ শিল্পী তিনি। আরো গান করুন সাঈফ ভাই, আপনার এখনও আরো অনেক কিছু দেবার বাকি। আপনি একদম বদলান নি।
নতুনদের জন্যে সাঈফের পুরোনো গান সাজেশন- “কখনও জানতে চেও না”।
অচিনপুরের গান (উইনিং) (সিডি টু)- উইনিং সম্পর্কে নতুন করে বলার কী আছে! সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা একটি ব্যান্ড ছিলো। আর চন্দন ভাইয়ের গলা তো পুরোই খাঁটি সোনা! উইনিংয়ের শেষ এ্যালবাম ‘অচিনপুর’কে ট্রিবিউট করেই কি এ নাম দেয়া? অন্য গানগুলোর চেয়ে এই গানটির ধাঁচ কিছুটা আলাদা। রক ধাঁচের গানটিতে সেই অচেনা শহরের উইনিংকেই খুঁজে পাওয়া যাবে।
একটা মেয়ের কথা (আর্ক) (সিডি থ্রি)- এই যে মিক্সড ক্যাসেট কালচার, এটা শুরুই তো হয়েছিলো টুলু ভাইয়ের হাত ধরে!এক যুগ সন্ধিক্ষণের স্রষ্টা তিনি, তার কাছ থেকে তো স্পেশাল কিছু আশা করাই যায়! আর সেটা তিনি দিতে অপারগ থেকেছেনই বা কবে! মন ভালো করে দেয়া সহজিয়া সুর, সেই পুরোনো টুলু ভাই, পুরোনো আর্ক, গুড ওল্ড নাইন্টি!
কাল সারারাত (নেকসাস) (সিডি টু)- সত্যি কথা বলতে কী, নেকসাসের কোনো পুরোনো গানের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তাদের সম্ভবত এক বা দুইটি গান শুনেছি এর আগে। তাদের কাছ থেকেই পেলাম চিরদিন মনে রাখার মত একটি গান। গানটা শুনতে গেলে মনে পড়তে পারে খালিদ এবং প্রিন্স মাহমুদ ভাইয়ের কালজয়ী সৃষ্টি “কোন কারণেই” গানটির কথা। এত দরদ দিয়ে গেয়েছেন নাজিব জহির ভাই! এ্যালবামের সেরা গান আমি এটাকেই বলবো এক বাক্যে। ইতিমধ্যেই অনেকবার শুনে ফেলেছি গানটি।
আশিক মিউজিক সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা যেতো, আপাতত শুধু একটা কথাই বলি, তারা এই এ্যালবামের একটি ক্যাসেট সংস্করণও বের করতে যাচ্ছেন! জ্বী, ঠিকই পড়েছেন, সেই ফিতে জড়ানো ক্যাসেট! আপনি কিনে পুরোনো টুইনওয়ানটি মিস্ত্রির কাছে নিয়ে গিয়ে ঠিক করিয়ে এনে ঝেড়েমুছে তারপর ক্যাসেট চালাবেন এই আশায় নয়। স্মৃতিস্মারক হিসেবে। সেই উন্মাতাল, গানময় দিনগুলির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, স্যুভনির হিসেবে।
মুগ্ধতা বেড়েই চলছে তাদের প্রতি!
আশিক মিউজিকের ফেসবুক পেইজ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:০৪