তখন আমি অনেক ছোট। স্কুলেও ভর্তি হই নি। সেসময় একটা গুজব চাউর হলো বেশ করে। শহরে নাকি রক্তচোষার আবির্ভাব হয়েছে। তারা দূর থেকে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়েই বাচ্চাদের রক্ত চুষে নিতে পারে। তা শুনে আমাদের সে কী ভয়! ভয়ের ব্যাপার না বলুন? রক্তচোষা, নামটাই তো কেমন গা হিম করা। আর তার ওপর তারা যদি দূর নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে বাচ্চাদের রক্ত চুষে নেয়ার উপায় বের করে ফেল, কে না ভয় পাবে? তবে এই ঘটনাটা যথাযথ প্রচারের অভাবে তেমন একটা ভাইরাল হতে পারে নি। আফসোস! তবে জনতাকে আশ্বস্ত করতে কিছুদিন পর এলো ঢোলকলমি পোকা। এই বিদঘুটে নামের পোকাটি যে ত্রাস সৃষ্টি করেছিলো আমাদের এই মেট্রোপলিটন-তিলোত্তমা শহরে, তার জুড়ি মেলা ভার! নব্বই সালের দিকে যারা ঢাকায় ছিলেন তাদের খুব ভালো করেই মনে থাকার কথা। শুধু ঢাকা না, ঢোল কলমি পোকার আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছিলো সারা দেশেই। এটা না কি খুব বিষাক্ত এক পোকা, যার সংস্পর্শে আসলেই নির্ঘাৎ মৃত্যু। তা ঢোলকলমি পোকাকে অবশ্য রক্তচোষার চেয়ে ভালো বলতেই পারেন, তারা আপনাকে কাছে এনে ছুঁয়ে-টুয়ে দেখে তারপর কতল করতো, রক্তচোষাদের মতো এত বেরহম ছিলো না যে দূর থেকেই আপনার মৃত্যু পরোয়ানা জারী করবে। আতঙ্ক এই পর্যায়ে পৌঁছেছিলো, যে টিভিতে একজন বিশেষজ্ঞ এসে পোকাটি ধরে দেখিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে এটি আসলে খুবই নিরীহ একটি কীট, মোটেও প্রাণ সংহারী নয়। এতে অবশ্য উত্তেজিত জনতা আশ্বস্ত না হতাশ হয়েছিলো তা মনে পড়ছে না।
মাঝখানে পেরিয়ে গেছে দুই যুগেরও বেশি সময়। এখন আমরা অনেক নতুন প্রযুক্তি এসেছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, যেদিকে তাকাই সেদিকেই বিবিএ, এমবিএ, বিসিএস কোচিং, সিএসইর পোলাপাইন। কিন্তু অবস্থার খুব কি পরিবর্তন হয়েছে? এখনও আমরা রক্তচোষা আর ঢোলকলমিকে ভয় পাই, অথবা স্বাগত জানাই। তবে একটু ডিজিটাল রূপে আর কী! এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো ব্লু হোয়েল গেম। মাঝখানে কথা নেই বার্তা নেই, ছড়িয়ে পড়লো ব্লু হোয়েল গেম নিয়ে মুখরোচক সব আরবান মিথ। ব্লু হোয়েল খেলে নাকি রাশিয়ায় ১৫০ জন টিন এজার আত্মহত্যা করেছে! সেই গেমের ডেভেলপারকে নাকি আটক করা হয়েছে। খুব ভালো কথা। তা রাশিয়ায় ব্লু হোয়েল খেলে টিনএজাররা মৃত্যুবরণ করতে পারলে আমরা পিছিয়ে থাকবো কেন? আমরা কি ওদের থেকে কম? মোটেও না! আমাদের একটা স্ট্যাটাস আছে না! তাই আমরা ঠিক করলাম আমাদের ছেলে-মেয়েরা মারা গেলেও এই ব্লু হোয়েলের তকমা লাগাবোই। যেমন সন্তান, তেমন অভিভাবক, তেমন মিডিয়া। কেউ ব্লেড দিয়ে হাত কেটে একটা নীল তিমির উল্কি এঁকে রেখেছে? ব্লু হোয়েল না খেলে উপায় কী তার? কিংবা যে মেয়েটি গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইল নিয়ে কী যেন করতো, দেখতে চাইলে লুকিয়ে ফেলতো সে সুইসাইড করেছে? আপনার সন্দেহ হয়েছে যে সে ব্লু হোয়েল খেলে থাকতে পারে? ব্যাস, আমাদের মিডিয়া প্রস্তুত “ব্লু হোয়েল আসক্ত কিশোরীর আত্মহত্যা” শিরোনামে খবর করতে। যুগান্তরে কোন এক আইটি আলেম বিশাল এক প্রবন্ধও লিখে ফেলেছেন, কীভাবে ব্লু হোয়েল খেলে, কী কী করতে হয় এই গেমের বিভিন্ন লেভেলে, কীভাবে গেমারদের সম্মোহিত করা হয় ইত্যাদি নিয়ে। সেটা আবার ভাইরালও হয়েছে। সবাই আতঙ্কে তটস্থ হয়ে গেছে, টক শো হয়েছে, আরো আরো নিউজ হয়েছে, আরো আরো ভিকটিম বের হয়েছে, কারো কি একটিবার একটু পরখ করে দেখার ইচ্ছে হয় নি যে এই ব্লু হোয়েল নামক বস্তুর আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে কি না!
ব্লু হোয়েলের উৎপত্তি একটি রাশিয়ান সোশাল মিডিয়া সাইটে। সাইটের নাম হলো ভিকে। সেখানে ফিলিপ বুদেইকিন এটি পরিচালিত করতেন একটি গ্রুপের মাধ্যমে। এটা ট্রুথ অর ডেয়ার টাইপের একটি টাস্কভিত্তিক একটিভিটি ছিলো। আর তাকে আপনারা বানিয়ে দিলেন গেমের ডেভেলপার? পারেনও বটে! যাই হোক, সেই গ্রুপটি পরে ব্যান করা হয়। এবং রাশিয়ান পুলিশ তদন্ত করে ১৫০টি মৃত্যুর কোনো প্রমাণই পায় নি। ব্লু হোয়েল অধ্যায়ের সেখানেই শেষ। চাইলে ঘেঁটে দেখেন! আমাকে মিথ্যা প্রমাণ করেন!
ব্লু হোয়েল ইস্যু শেষ, এটা নিয়ে আর বেশি কথা না বাড়াই। এবার বলবো আরেক আজব মিথ মারিয়ানা’স ওয়েব নিয়ে। কদিন আগে বাংলা ভাষার প্রথম এবং সর্ববৃহৎ প্রযুক্তি বিষয়ক সাইট টেকটিউনসে মারিয়ানা’স ওয়েব বিষয়ক একটা পোস্ট দেখলাম। সেটাকে তারা আবার এখনও নির্বাচিত পোস্ট হিসেবে ঝুলিয়ে রেখেছে। সেই পোস্টের বক্তব্য কী? ইন্টারনেটে নাকি মারিয়ানা’স ওয়েব নামক এক জায়গা রয়েছে, সেটা সবচেয়ে দুর্ভেদ্য এবং দুর্গম অঞ্চল। এটার নামকরণ করা হয়েছে মানিয়ানা ট্রেঞ্জ থেকে, যা হলো প্রশান্ত মহাসাগরের সবচেয়ে গভীর স্থান। খুব ভালো কথা। তা এই মারিয়ানা’স ওয়েব জিনিসটা কী? আসুন লেখকের ভাষ্যেই শুনি।
“এটা মানা হয় যে; সরকার এর যতসব টপ সিক্রেট তথ্যগুলো আছে তা এখানে পাওয়া যায়। দুনিয়ায় সবচেয়ে রহস্যময় আর গোপনীয় জিনিস যদি থাকে সেসব এখানে দেখা যায়। আরও বলা হয় যে; “এটলান্টিস” সমুদ্রের নিচে এক কাল্পনিক দ্বীপ যেটি আছে; তার তথ্যও এই মারিয়ানা’স ওয়েবে আছে। আরও বলা হয় যে; ইলুমিনাটি বা ইলুমিনাটিদের লোকদের [শয়তানের পূজারী] সাথে যোগাযোগ; এর ব্যবস্হা এই মারিয়ানা’স ওয়েবে আছে। তাই এই মারিয়ানা’স ওয়েব হল ইন্টারনেটের সবচেয়ে রহস্যময় ও গোপনীয় জায়গা। এর চাইতে রহস্যময় ও গোপনীয় ওয়েব আর নেই”।
“মানা হয় যে”, “বলা হয় যে” ইত্যাদি ধারণার ওপর ভর করে তিনি আস্ত একটা প্রবন্ধ ফেঁদে বসলেন, তা আবার সাইটে স্টিকিও করা হলো!
আচ্ছা, ধরে নিলাম মারিয়ানা’স ওয়েব আছে। কিন্তু এত গহীন গোপন এলাকার কথা লেখক জানলেন কীভাবে? তার কাছে কারা খবর পৌঁছে দিলো? তিনি নাকি জেনেছেন reddit সাইটে কোনো এক হ্যাকারকে কেউ কোনো একটা কাজের জন্যে অতি উচ্চ মূল্য দিয়ে হায়ার করে। সেই হ্যাকারের সন্দেহ হয়, এত টাকা কেন সাঁধছে? নিশ্চয়ই কোনো কিন্তু আছে এতে! হ্যাঁ, তার ধারণা ‘ঠিক’ ছিলো বটে! সাধারণ ওয়েবসাইট বানানোর নাম করে তাকে প্রাইভেট সার্ভারে ওয়েবসাইট ডিজাইন করিয়ে নেয়া হলো। তা সেই হ্যাকার ভদ্রলোকের আবার কিছু গোপন জায়গার এক্সেস ছিলো। সে ঐ জায়গাগুলোতে গিয়ে একটি ভিডিও ক্লিপ দেখে ভরকে যায়। সেখানে হিউম্যান এক্সপেরিমেন্ট আরো কী কী সব যা তা নিয়ে কাজ করা হয়। তারপর সে সেটা ডাউনলোড করে ইউটিউবে আপলোড করে দিলো। ব্যাস সেই ভিডিওর ওপর ভিত্তি করে আমরা পেয়ে গেলাম মারিয়ানা’স ওয়েব নামক অতি গোপন, অতি রহস্যময়, অতি দুর্ভেদ্য জায়গার খোঁজ একদম নগদে। কী তামশা, সব ফকফকা, তাই না?
ভিডিওটি দেখতে চান? এ আর এমন কী! এই লিংকে গিয়ে দেখেন!
ব্যাপারটা কেমন না! পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম ইন্টারনেট অঞ্চলের অধিবাসীরা ওয়েবসাইট ডিজাইনের জন্যে হ্যাকার ভাড়া করছেন অতি উচ্চ মূল্য দিয়ে, সেই হ্যাকার আবার কিছু জায়গার এক্সেস পাচ্ছে, সেই জায়গায় গিয়ে ভিডিও দেখে তা ডাউনলোড করে আবার ইউটিউবে আপলোড করে দিচ্ছে, তা আবার আমাদের বাংলা ওয়েবসাইটেও এসে যাচ্ছে চটপট!
আর্টিকেলের শেষে বলা হয়েছে মারিয়ানা’স ওয়েবে ঢুকতে না কি কোয়ান্টাম কম্পিউটার লাগে। সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার না কি সুপার কম্পিউটারের চেয়ে হাজারগুণ বেশি শক্তিশালী। মাত্র ৪টি কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে নাকি সম্পূর্ণ আমেরিকার কম্পিউটারের সকল কাজ কাভার করা সম্ভব।
আচ্ছা তাহলে এখন চিন্তা করে দেখুন গল্পটা কেমন দাঁড়াচ্ছে, কথিত হ্যাকার সাধারণ কম্পিউটার দিয়েই কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে পরিচালিত দুর্ভেদ্য মারিয়ানা’স ওয়েবে ঢুকে একটু পর আবার বের হয়ে এসেছেন, সাথে ১ মিনিট ২০ সেকেন্ডের একটি ডাউনলোডকৃত ভিডিও ক্লিপ। সারফেস ওয়েবেই আমাদের ইউটিউব থেকে ভিডিও ডাউনলোড করতে থার্ড পার্টি সফটওয়্যারের প্রয়োজন হয়, আর ইনি মারিয়ানাস ওয়েব থেকে কত সুন্দর করে ভিডিও ডাউনলোড করে ফেললেন!
খুব বেশি রিসার্চ করা লাগে না, কমনসেন্স থেকেও অনেক কিছু বোঝা যায়। সেটাও আমরা খাটাতে রাজী না। শুধু টেকটিউনস না, বাংলাদেশের প্রযুক্তি বিষয়ক সব সাইটেই মারিয়ানা’স ওয়েব সংক্রান্ত এই একটিই লেখা আছে, এবং তা মানুষজন ধুমিয়ে শেয়ার করে যাচ্ছে। আর সবাই কপি করেছে ভারতীয় একজন ইউটিউবারের ভিডিও থেকে, সে আবার কপি করেছে ইংরেজি ভিডিও থেকে।
পোস্টের শেষে আমাদের বিশিষ্ট টেকি ভাইরা লেখককে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, নতুন কিছু জানতে পেরে কৃতার্থ বোধ করেছেন। আশা করি আর কিছুদিনের মধ্যে তারা মারিয়ানা’স ওয়েব সংক্রান্ত আরো প্রচুর তথ্য-উপাত্ত, ছবি, ভিডিও যোগাড় করে ছড়িয়ে দিতে পারবেন। কেউ আমিন না বলে যাবেন না!
প্রথম প্রকাশ- এগিয়ে চলো ডট কম
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪৭