দেখতে দেখতে ব্লগ লেখার ৯ বছর হয়ে গেলো! "দেখতে দেখতে" শব্দবন্ধটি আমরা অনেক সময় অযথাই ব্যবহার করি। কিন্তু আমি এখানে এই দেখাদেখির বিষয়টাকে অনেক গুরুত্ব দিয়েই বলছি। কম তো আর দেখলাম না! কত কাহিনী, কত ক্যাঁচাল, আন্দোলন, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, তিক্ততা, দেখার কিছু বাকি নেই। বাংলা ব্লগমোস্ফিয়ারে সামু বড় অদ্ভুত এক নাম। অদ্ভুত এক উদাহরণ। কত ভালো ভালো ব্লগ বন্ধ হয়ে গেলো, কত ব্লগ এখন ধুঁকছে, কিন্তু সামু চলছে একদম ঠিকঠাক! এখানে বিশাল এ্যাডমিন প্যানেল নেই, মার্কেটিং নেই, লোকবল নেই, কিন্তু বাংলাদেশের ইন্টারনেট জগতে দেহঘড়ির হয়ে সামু চলছে ঠিকঠাক। ব্লগাররাই চালিয়ে নিচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে অবশ্য আর্থিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে কিছুটা, তবে আমি আশাবাদী, সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে সামুর অবাক রথযাত্রা চলতেই থাকবে।
সামুতে আমার বিগত বছরগুলো কেমন ছিলো? একটু ঘুরে আসা যাক অতীত থেকে!
২০০৮- এ সময়টায় মূলত পুরোনো গান-কবিতা-গল্প পোস্ট করতাম। বেশিরভাগই ছিলো লিরিক জাতীয় কবিতা। গল্প তখন খুব কম লিখেছি। ব্লগীয় ইন্টারএ্যাকশন বাড়ানো, প্রচুর কমেন্ট করা, নতুন ব্লগারদের পাল্লা দিয়ে আগে স্বাগতম জানানো, এগুলোই ছিলো ব্লগীংয়ের আনন্দ। এই বছরের প্রিয় লেখা- একটি মর্মস্পর্শি পত্র!(সাবধানতা-খুবই সিরিয়াস পোস্ট,চোখের পানি ফেলা আবশ্যক)
২০০৯- ব্লগের নেশা মূলত এই বছর থেকেই চাগিয়ে ওঠে। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে ব্লগ নিয়েই ভাবতাম সবসময়। ২০০৮ এ ছিলাম একা। ২০০৯ এ পেলাম কিছু বন্ধু। তাদের সাথে তুমুল আড্ডা চলতে লাগলো। এ সময় থেকে নতুন লেখা দিতে লাগলাম ধীরে ধীরে। বড় লেখা লিখতে বড়ই আলসেমী লাগতো। কিছু অণুগল্প লিখলাম, সবাই খুব পছন্দ করলো। রম্য লিখলাম, কবিতা লিখলাম, ১৮+ জোকস দিয়ে হিট হবার চেষ্টা করলাম, সফলও হলাম বেশ। সেসময় প্রচুর আজেবাজে পোস্ট দিয়েছি, যাদের অনেকগুলোই এখন ডিলিটেড অথবা ড্রাফটেড। ২০০৯ এ ব্লগে নানারকম আন্দোলন চলতো মডুদের বিরুদ্ধে। সেসবে স্বক্রিয়ভাবে অংশ নিতাম। ব্যান খাওয়া ছিলো খুবই নিয়মিত ঘটনা। এর মধ্যে একবার একাউন্ট সাসপেন্ড করে দেয়া হলো। আমার তখন সে কী কষ্ট! দ্রুতই অবশ্য আনব্যান হলাম। তারপর কিছুদিন সতর্ক ব্লগিং।
২০০৯ এর প্রিয় লেখা- প্লাস্টিকের ফুল আর খেলনা একতারার গল্প
২০১০- আমার ব্লগের সেরা সময়। বলতে দ্বিধা নেই, তখন আমি রীতিমত সেলিব্রেটি ব্লগারে পরিণত হয়েছিলাম! পোস্ট করলেই দুই তিনশ কমেন্ট। কখনও চার-পাঁচশ। এ সময় থেকে আমি নতুন এক আমাকে আবিষ্কার করি। দেখলাম যে আমি পরাবাস্তব ধারার গল্প লেখা শুরু করেছি কীভাবে যেন। শুরু হলো তুমুল গল্প লেখালেখি। আমাকে দেখে সেসময় অনেকেই ইনফ্লুয়েন্সড হয়েছিলো। আমাদের একটা সার্কেল গড়ে উঠলো, যারা সাহিত্যচর্চা করে, একে অপরের লেখার তীব্র সমালোচনা এবং দারুণ বিশ্লেষণ করে, আবার রাতভর আড্ডাও দেয়। আর ছাগুতাড়ানি তো ছিলোই! নিজেকে মনে হতে লাগলো ব্লগের রাজা!
২০১০ এর প্রিয় লেখা- সুইট হোম
২০১১- আমার পতনের সময়! বোধনের সময়! অস্বীকার করবো না, ২০০৮ থেকে ২০১০ এ ব্লগকে যেমন অনেক দিয়েছি, তেমন খানিকটা দূষিতও করেছি গালাগালি, মাল্টিনিক ইত্যাদি দিয়ে। এর ফলে জানুয়ারিতে কমেন্ট ব্যান হলাম। এখনও মনে আছে, জানুয়ারির ১৩ তারিখ! আমার তো মাথায় হাত! ব্লগে কমেন্ট না করে আমি থাকবো কীভাবে! একদিক দিয়ে অবশ্য লাভ হয়েছে। লেখালেখির দিকে আরো মনোযোগ দিতে পেরেছি। ২০১০ এর সেই সার্কেল তখনও আছে। আলোচনা, আড্ডা, দুষ্টুমী সবই চলেছে। তারপরেও বুকের মধ্যে হাহাকার কমতো না। ৬ মাসেরও বেশি সময় কমেন্ট ব্যান থাকার পর অবশেষে মুক্ত হলাম। সেসময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মাল্টিনিক দিয়ে কাউকে গালি দিবো না, মাল্টিনিক দিয়ে কারো পেছনে লাগবো না। যা করবার নিজের নিক দিয়ে করবো। সেই প্রতিজ্ঞায় আমি এখনও অটল। আর ২০১১ এর পর নতুন কোনো নিক খুলিও নি।
২০১১ এর প্রিয় লেখা- স্নাফ
২০১২- ২০১২ সাল হলো আমার ম্যাচিউরিটি এবং শুদ্ধতার কাল। বিয়ে করলাম,প্রথম বই বের হলো- "প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত"। লেখালেখি নিয়ে আরো মনোযোগী হলাম। পুরোনো বন্ধুদের অনেকেই তখন ব্লগে নেই। নতুনেরা আসছে, তাদের সাথেঅ দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠছে। গল্প লেখা চলছে পুরোদমে। এই সময় সামুর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। প্রতিদিন প্রচুর পোস্ট আসে, একটা পোস্ট ১০ মিনিটও প্রথম পাতায় থাকে না। পিক টাইমে ৩০০ পর্যন্ত ব্লগার থাকে! তবে সামুর কন্টেন্টের কোয়ালিটি বেশ পড়ে গিয়েছিলো সেসময়। বাজে লেখা, কপি পেস্ট লেখা অনেক আসতো।
২০১২ এর প্রিয় লেখা- অগ্নিঘড়ির ডায়াল
২০১৩- জানুয়ারিতে আমার মেয়ে জন্ম নিলো। আর একই সময়ে চলে গেলেন ইমন জুবায়ের ভাই। তারপর এলো শাহবাগ! এই মহান আন্দোলনের রূপকার ছিলেন ব্লগাররাই। ভার্চুয়াল জগতে বুঁদ হয়ে থাকা অসামাজিক আমিও তখন একজন এ্যাকটিভিস্ট! শাহবাগ তখন আমার প্রাণ জুড়ে। কিন্তু এই শাহবাগই কেড়ে নিলো সামুর জ্যোতি। ব্লগ ছেড়ে সবাই ফেসবুকে সেলিব্রেটি হতে লাগলো একে একে! ব্লগ এবং ব্লগারদের নিয়ে নানারকম ষড়যন্ত্র। সাইটেও তখন নানারকম বাগ, টেকনিক্যাল প্রবলেম। আমি কিন্তু রয়ে গেলাম সেই আগের মতই!
২০১৩ এর প্রিয় লেখা- মৃতবৎসা জোছনার কাল
২০১৪- ২০১৪ আমার পতনের বছর। ব্লগে না, ব্যক্তিগত জীবনে। তবে শুরুটা করেছিলাম দারুণ এক গল্প দিয়ে। আমার মেয়ে মিতিনকে নিয়ে লেখা একটা গল্প। সন্দেহ নেই, এটাই আমার জীবনের সেরা লেখা। এর মত ভাল লেখা আমি আর একটাই লিখতে পারবো। সেটা কোন লেখা হবে? পরে বলছি। ২০১৪ তে প্রচুর আজেবাজে লেখা লিখেছি। লিখতে চেয়েছি একরকম, হয়েছে আরেক রকম। যে স্খলনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাতে অবশ্য এমন হবারই কথা! সেই গল্প সবিস্তারে বলবো একদিন, যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে।
২০১৪ এর প্রিয়তম লেখা- মিতিন আর আমি
২০১৫- আমার পুত্র রুহিন এলো পৃথিবীতে। আবারও জানুয়ারিতেই। আমার স্খলনকাল তখনও চলছে। আমি নামছি তো নামছিই। লিখেও যাচ্ছি অবশ্য এর মধ্যে দুহাতে। ২০১৪ এর ধারা বজায় থাকলো। লিখতে থাকলাম বাজে বাজে গল্প। বছরের শেষদিকে অবশ্য ভাবলাম গল্প বাদে অন্য কিছু লেখাতেও মনোযোগ দেয়া যায়। আবারও লিখতে শুরু করলাম কবিতা এবং লিরিক। সেগুলো অবশ্য খারাপ হয় নি। তো যা বলছিলাম, মিতিনকে নিয়ে আমার লেখাটার পর আমি আরেকটি সেরা লেখা লিখবো। সেটা হবে রুহিনকে নিয়ে। ২০১৫ তে সামুর ব্লগারদের একটি কন্টেস্টে বিচারক হবার দায়িত্ব পেয়েছিলাম। এই সম্মানটা দেয়ার জন্যে আমি জানা আপার প্রতি কৃতজ্ঞ।
২০১৫ এর প্রিয় লেখা- এক পাতা সিভিট
২০১৬-
আমার ঘুরে দাঁড়ানোর সময়! ভার্চুয়াল জীবনে দীর্ঘদিন বুঁদ হয়ে থাকার পর ভাবলাম একটু বদলে দেয়া যাক নিজেকে! জব সুইচ করলাম। ইতিবাচক ভাবনা আমাকে অন্য এক জীবনের স্বাদ দিলো। এখনো যার স্বাদ নিয়ে চলেছি! আমার দ্বিতীয় বই 'আনন্দভ্রম' চলে এলো। এর আগের বইয়ের প্রতিটি গল্পই ছিলো ব্লগ থেকে নেয়া। এবার আর তা করলাম না। বইয়ের জন্যে আলাদাভাবে গল্প লিখেছিলাম। গল্প লিখে ব্লগে না দেয়া, বড়ই কঠিন কাজ ছিলো সেটা! কীভাবে যে লাইক, কমেন্টের লোভ সংবরণ করলাম! ২০১৬ থেকে আমার ব্লগিং প্যাটার্ন একদমই বদলে গেল। গল্প ছাড়াই অনেকরকম বিষয় নিয়ে লিখলাম। মার্কেটিং, বায়োগ্রাফি, বুক রিভিউ, সচেতনতামূলক পোস্ট, ইত্যাদি! এ বছর আমার একটা লেখা স্টিকিও হলো! ব্লগজীবন আর বাস্তব জীবনের মাঝে ভারসাম্য এলো। ব্লগের নেশাও ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। আগের মত আর কমেন্ট করতে পারছিলাম না। ব্লগীয় জনপ্রিয়তাও অনেক কমে গেলো। তবে তাতে কোনো আক্ষেপ নেই। যা পেয়েছি, তা কি কম?
২০১৬ এর প্রিয় লেখা- লিজি ভেলাসকুয়েজ- দ্যা মোস্ট বিউটিফুল গার্ল অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড
২০১৭- এবার এলো আমার তৃতীয় বই "নরকের রাজপুত্র"। এর আগে ব্লগে নিজের বইয়ের প্রচার তেমনভাবে করি নি। এবার একদম লজ্জা-শরম ভুলে প্রচারে লেগে গেলাম! এ বছরে পোস্ট দিয়েছি অনেক, তবে কমেন্ট করা আরো কমে গেছে। স্যরি সেজন্যে
এ বছরের সবচেয়ে প্রিয় লেখা- চলুন, দল বেঁধে পাবনা মেন্টাল হসপিটালে পিকনিকে যাই!
এই আমিময় লেখা পড়তে গিয়ে আপনারা নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হয়েছেন! আপনাদের বিরক্তি বাড়ানোর জন্যে আরো একটি 'আমিযোজন'-
আমার কোন লেখাটি আপনার সবচেয়ে প্রিয়?
ভালো থাকবেন সবাই। শুভ ব্লগিং।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৩