somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুহিন আর আমি

০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(রুহিন)
আমি তাকিয়ে হাসছি। দেখছি ওদের বোকামি। দেখছি ওদের থতমত মুখ। দেখছি ওদের অপ্রস্তুত ভাবসাব। ওরা ভাবে যে বড় হয়ে গেছে দেখে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা নিয়ে মুখ বেজার করে থাকা, আর একে অপরের মতামতের বিপক্ষে শাণিত যুক্তি ছুড়ে দিয়ে নাকাল করার ভেতরেই তাদের যাবতীয় শক্তিমত্তা নিহিত। কী বোকামি! কত আকাশ-পাতাল চিন্তা, কত পাতাল-নরক ভাবনা, কত নরক গুলজার কর্মকান্ড তাদের! কত হিসাব-নিকাশ, কত দলিল-দস্তাবেজ, কত ঔষধ-পত্তর খরচ করে। ওদের কাছে সেই জাদুর ক্যালকুলেটরটা নেই, যেটা দিয়ে এক নিমিষেই সকল হিসাব কষে ফেলা যায়। ওরা অযথাই আকূল হয়ে কাঁদে, অযথাই ফূর্তির হাসি হাসে, অযথাই লজ্জা পায়, ভয় পায়, কতরকম কায়দা কানুন রে বাবা! আমি ঠিক ঠিক জানি ওরা শেষ পর্যন্ত কী করবে। আমার তাই চিন্তার কিছু নেই। বেশ আছি আরামে আয়েশে। এভাবেই থাকবো। আমি জানি, ওরা আকারে বড়, আর মাঝেমধ্যে বড় অবুঝ চিন্তাভাবনা করে। এসব দেখে আমার বেশ রাগ হয়, আবার হাসিও পায়। বড় হলে অবশ্য এসব আমি বেমালুম ভুলে যাবো। একদমই মনে রাখবো না কিছু। আমি জানি সবকিছু মনে রাখার মত ঝঞ্ঝাট আর কিছুতেই নেই। ওরাও বুঝবে। আরেকটু বড় হলেই বুঝবে।

(আমি)
আমার পিঠের ওপর চড়ে বসেছে একটা ছোট্ট বাঘ। সেই বাঘটা ডাইনোসর পছন্দ করে। সেই বাঘটা হালুম করে হরিণ শিকারে বেড়োয়, কিন্তু তাদের না খেয়েই ছেড়ে দেয়। বড় দুষ্টু আর মিষ্টি একটা বাঘ। বাঘটা হরিণদের সাথে খেলতে পছন্দ করে, বিড়ালদের টুকি দেয়, আবার কখনও রেগে গেলে তর্জন গর্জন করে ভয়ও দেখায়। এই রাগী বাঘটাকে সামলাতে আমাকে কখনও ঘোড়া হতে হয়, কখনও গাড়ি হতে হয়, কখনও উড়োজাহাজ হতে হয়। এই বাঘটার জন্যে আমি উড়তে পারি, ডুবতে পারি, নামতে পারি, উঠতে পারি। ওকে পিঠে নিয়ে আমি বিছানার ওপর উবু হয়ে চার হাত পায়ে ঘুরে বেড়াই। যেতে হবে রূপকথার রাজ্যে মিরপুর দুই নাম্বারে। যেতে হবে ডিজনিল্যান্ডে, যেতে হবে ভালো ভূত তোতোরোর গোপন আস্তানায়, যেতে হবে পিপা পিগদের সংসারে।
-এই যে এসে গেছি। নামেন।
ছোট্ট বাঘটা ব্যস্তসমস্ত হয়ে আমার পিঠ থেকে নেমে পড়ে। নামার সময় আমার হাতে অদৃশ্য কিছু টাকা গুঁজে দেয়। যেখানেই নিয়ে যাই না কেন একই ভাড়া, ২০ টাকা! প্রতিদিন আমি ২০টা করে টাকা জমাই। প্রতিদিন আমি আমার পাওয়ার থলেটা ভরে উঠতে থাকে। ছোট্ট বাঘটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আমি ভাবি, আমার অবাক হবার আর কত বাকি আছে!

(রুহিন)
বলেছিলাম না? আমার কথা বিশ্বাস হলো তো? মিলে গেলো তো ঠিকঠাক? এখন তোমরা জিজ্ঞেস করবে যে আমি কীভাবে এতকিছু বুঝতে পারলাম, তাই না? এই হচ্ছে তোমাদের নিয়ে বিপদ। অবশ্য আমার যেমন যোগসাজশ আছে, তোমাদের তো তা নেই। আমার কাছে এমন সব জায়গা থেকে তথ্য আসে, যা তোমরা ধারণাও করতে পারবে না। তাই তো আমি এমন নিশ্চিন্তে থাকি, তাই তো আমার এত আনন্দ। আমার এই জগতে অবিশ্বাসের কোনো জায়গা নেই। আমার জগতে অনাদরের কোনো স্থানই নেই। আমি যেমন চাইবো, তোমরা তেমনই করবে। আমার শ্বাস নিতে সমস্যা হলে তোমরা শহরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জায়গায় নিয়ে যাবে, আমার বুকের ধুঁকফুঁক কমে গেলে তোমাদের ধুঁকফুঁক বেড়ে যাবে, আমি ঠিকঠাক খেলাধুলা করলে তোমরা ঠিকঠাক ঘুমোতে পারবে।
হ্যাঁ, জানি এখন তোমাদের নানারকম সমস্যা। তোমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। আমি অনেক কিছু পারলেও সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, এই আশ্বাস তোমাদের দিতে পারছি না। আমার অভিধানে যদি মন খারাপ বলে কিছু থাকতো, তবে অবশ্যই এটা নিয়ে আমি খুব, খুব মন খারাপ করতাম। কিন্তু আমার যে কিছুতেই মন খারাপ হয় না, আর মন খারাপ হয় না বলে যে মন খারাপ করবো তারও উপায় নেই। পুরো ব্যাপারটাই একটা মজার ঠাট্টা মনে হয় আমার কাছে। আমি আবারও হেসে উঠি!

(আমি)
সে যখন আমাকে খবরটা দিলো, আমি তখন স্নায়ু ডিসোসিয়েটিভ ড্রাগসে প্রভাবে ইউফোরিয়াক রাজ্যে বিচরণ করছি। সে মানে আমার অর্ধাঙ্গিনী অথবা প্রেমিকাও বলতে পারেন। বাথরুম থেকে ভীত এবং উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে আমাকে ডেকে বললো,
-শোনো!
আমি তার দিকে শঙ্কিত চিত্তে তাকালাম। কী না কী অপরাধ করে ফেলেছি আবার! আমার অপরাধের তো কোনো শেষ নেই!
-কী হয়েছে?
সে আমাকে দেখালো একটা লাল দাগ খচিত স্ট্রিপ। একটা চিহ্ন জন্মের, একটা চিহ্ন আবির্ভাবের, একটা চিহ্ন, যা এই মানবসভ্যতার সমস্ত আশা-নিরাশা, অপুর্ণতা আর প্রাপ্তির হিসেব মিলিয়ে দেয় মুহূর্তেই। সেই চিহ্নটা আমি আগেও দেখেছি, সেই পথ ধরে আমি আগেও হেঁটে গিয়েছি, গন্তব্যে পৌঁছেছিও ঠিকঠাক। কিন্তু তারপরেও এবার আমার কেন যেন খুব অচেনা লাগছিলো সব।
দ্বিধা!
ভয়!
উদ্বেগ!
সংশয়!
-I will keep…
আমার অর্ধাঙ্গিনীকে তখন দেখাচ্ছিলো ধরিত্রীর মত। তাকে দেখাচ্ছিলো দিনাজপুরের ভরা মৌসুমের পুনর্ভবা নদীর মত, তার চোখে তখন পৃথিবীর সমস্ত আঙ্গুর বাগানের সুনিবিড় ছায়ার স্নিগ্ধতা। তার সংশয় উবে গিয়েছে, সে শক্ত হয়েছে প্রস্তরখণ্ডের মত, সে দাঁড়িয়ে গেছে সুউচ্চ পর্বতসারির মত। তাকে টলাবে সাধ্যি কার?
আর আমি! আমি তখন টলছি, দ্রবীভূত হচ্ছি, পরাজিত হচ্ছি, কিছু দেখতে পাচ্ছি না, বুঝতে পারছি না। তবে সেই টালমাটাল অবস্থাতেও বুঝে গেলাম, ধরিত্রীর আহবানে সাড়া দিতেই হবে, সাড়া দেয়াটাই আমার গন্তব্য! ঠিক আছে বন্ধু! চলো তবে আবারও হাঁটা ধরি!
-Yes we will!
আমার রক্তে ইনজেকটেড হতে থাকে আনন্দের অনুঘটক। আমি দুলকি চালে হাঁটি। আমি পছন্দের গান শুনি। আমি তাকে আলিঙ্গনের আহবান করি। আমি তার উর্বরতার সম্মানে দু লাইন কবিতাও বলে ফেলি তৎক্ষণাৎ! সে কি আমার তরলতা বুঝতে পারে? সে কি হতাশ হয় কিছুটা?
রাত বাড়ে, বাড়ে আমার রক্তের চঞ্চলতা ধীরে ধীরে। আর কিছু সময় পর আমি স্যাচুরেশনে পৌঁছে যাবো। আর সে হতাশ কণ্ঠে বলবে,
-আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো তুমি তখন এত খুশি হয়েছিলে কেন!
গল্পটা যত সামনে এগুবে, এই যুগলের পারিপার্শ্বিক জটিলতা তত ঘনীভূত হতে থাকবে। কিন্তু চমকপ্রত্যাশী উত্তেজিত পাঠকের হতাশা লেখক অনেক আগেই অত্যন্ত সচেতনভাবেই ভেঙে দিয়েছে। হ্যাঁ, এই গল্পের সমাপ্তিটা সুখের, আনন্দের, সৃজনের। গল্পের শেষে কোনো টুইস্ট নেই। এই গল্পের নির্মাতা যে, তার জগতে এসব মেলোড্রামাটিক, ক্লিশে ব্যাপার পাত্তা পেল তো!


(রুহিন)

আমার চুলগুলো হয়েছে মায়ের মত। কোঁকড়া কোঁকড়া। আমার গায়ের রংটাও বেশ খোলতাই, ফর্সা। বিয়েবাড়ি বা জন্মদিনে যখন স্যুটকোট পরে সাহেব সেজে যাই, আমাকে ঘিরে আগ্রহী জনতার মোটামুটি ভালো একটা ভিড় জমে যায়। তারা আমার সাথে ছবি তোলে, তারা আমার গাল টিপে দেয়, তারা আমাকে কোলে নিতে উৎসুক হয়ে পড়ে। আমি তখন মুচকি মুচকি হাসি, আর ভাবি, গতকাল রাতে বাবা বকা দেবার পর ঠোঁট উল্টিয়ে কীভাবে আদর আদায় করেছিলাম, আর দাদুকে দিয়ে বকা খাইয়েছিলাম। বাবাদের ভড়কে দেয়া খুব সহজ। একটু ঠোঁট ওল্টালেই হয়। আমি অবশ্য ইচ্ছে করে আদর নেয়ার জন্যে ঠোঁট ওল্টাই না। একটু কড়া করে কিছু বললেই আমার ঠোঁট এমনিতেই উল্টে যায়, বুঝলে? একেকটা বাবুর একেকরকম স্বভাব থাকে জানো না তোমরা? আমার বড় বোনটা যেমন, যাকে তোমরা আগে থেকেই চেনো, মিতিন, ও আবার হৈ চৈ, চিৎকার চেচামেচিতে খুব পটু। কিন্তু বাবা একটু বকা দিলেই মুখ কালো করে জড়োসড়ো হয়ে লুকিয়ে যাবে। কিন্তু আমাকে বকা দিয়ে ভড়কে দেয়া? অত সহজ না! আমার আপুটা তেলাপোকা দেখলে ভয় পেয়ে হুড়োহুড়ি, দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দেয়, কানের সামনে বেলুন ফুটোলে ভীষণ চমকে যায়, ভূতের গল্প শুরু করলে মুখ শুকিয়ে যায়। কিন্তু আমি দেখতে একরত্তি হলে কী হবে! আমার বুকভরা সাহস আর হাতে অনেক শক্তি। এই যে আমার বাবাটা এত বড়সড় শরীরের একজন মানুষ, নিয়ম করে প্রতিদিন তাকে একটু পিট্টি না দিলে আমার ভালোই লাগে না। আর আপু তো আমার সাথে মারামারিতে কখনই জিততে পারে নি। পারবে কী করে, আমি ছেলে মানুষ না! (বড় হলে আমি জানতে পারবো যে আমার মা এমন জেন্ডার ডিসক্রেমিনেশন খুব অপছন্দ করেন)। তবে হাজার হলেও আপু আমার চেয়ে বড়। তাই সে যা করে আমারও তেমন করা উচিত। এই যেমন কার্টুন দেখতে না দিলে সে যখন জোরে জোরে কাঁদে, আমাকেও কাঁদতে হয়, কিংবা পাশের বাড়ির বাবুটার সাথে খেলতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে গেলে বাধ্য হয়ে আমাকেও পড়ে যাবার অভিনয় করতে হয়। এসবের জন্যে আপুই বেশি বকা খায়। বকা খেতে আমার একটুও ভালো লাগে আপুকে বকা খেতে দেখলেও ভালো লাগে না। কিন্তু দুষ্টুমী করার সময় এসব মনে থাকলে তো! (এ কথা অবশ্য এখনও আমি জানি না যে আমার বাবা তার চাচাজানকে বকা খাওয়াতে খুব আনন্দ পেতো)!

(আমি)

-আচ্ছা রুহিন দেখতে শান্তশিষ্ট, কিন্তু আসলে অনেক দুষ্টু তাই না?
প্রবাস থেকে অধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে “বড়আব্বা”।
-হ্যাঁ। সে এরকমই। তুমি কীভাবে বুঝলা?
-বোঝা যায়। ওকে দেখে বোঝা যায়।
হাজার মাইল দূর থেকে আমি অনুভব করি রক্তের অসম্ভব টান।
-তোমার পোলাডা তো দেখতে পুরাই মায়ের মত হইছে। একদম সেম চেহারা!
কাছের বন্ধুটা এলাকায় বেড়াতে এলে যতবার দেখবে এক কথা বলবেই!
কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতে অবশ্য চালু এক ফটোগ্রাফার বললো যে ছেলে-মেয়েরা বাপের মত দেখতে হইলে তারা সৌভাগ্যবান হয়। সেই লোক যদিও আমাদের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা খসিয়েছিলো, এবং সেটা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন তীব্র মনোবেদনায় ছিলাম, তবুও এই মুহূর্তে কেন যেন সেই লোকের সাথে এই স্মৃতিটাই মনে পড়ছে কেবল। মানুষের মন বড় অদ্ভুত! কুয়াকাটায় আমাদের বেশ চমৎকার সময় কেটেছিলো। কষ্টে জমানো টাকা প্রয়োজনের চেয়েও বেশি খরচ করেছিলাম। তা নিয়ে অবশ্য আমাদের কোনো আফসোস হয় নি কখনও। আমরা খেয়েছিলাম তরতাজা ভাজা মাছ, মোটর সাইকেলে করে ঘুরে বেড়িয়েছি সমুদ্র সৈকত ধরে। হোটেলের পেটমোটা টেলিভিশনটা দেখে আমাদের হাসি পেয়েছিলো খুব। আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম সমুদ্রের ঢেউয়ের যাবতীয় আদর-আহলাদ! আমার কাছে বেজোড় সংখ্যা সবসময়ই অসুখী মনে হয়। আমাদের এই অঢেল পূর্ণতার সময়ে সংখ্যাটা জোড় ছিলো বলেই সবকিছু মিলে যাচ্ছিলো ঠিকঠাক! সংখ্যাটা চার ছিলো বলেই আমরা চারজন ছিলাম বলেই আমাদের কারো কোল খালি ছিলো না। আমরা চারজন ছিলাম বলেই চাররকম ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে পেরেছি, আমরা চারজন ছিলাম বলেই বাসের পাশের সিটে অনাহুত কোনো আগন্তুক এসে বসে নি।
আমি খুব ভালো করেই জানতাম, আমাদের সেই সংকট আর দোলাচলের সময়টা পেরিয়ে এলে আমরা ঠিক এমনই একটা জীবন যাপন করবো। আমি খুব ভালো করেই জানতাম দুটি প্রাণের সংস্পর্শে প্রাণ এমনই সব বিমূর্ত সংলাপে জীবন্ত হয়ে উঠবে, জন্ম দেবে আরো অসংখ্য গল্পের। আমি জানতাম আজকের এই দিনটাতে ঠিক এমনভাবেই আমাকে লিখতে হবে আমার ছোট্ট বাঘটাকে নিয়ে।
জীবনের কিছু কিছু জিনিস প্রেডিক্টেবল বলেই সুন্দর, সুন্দর বলেই প্রেডিক্টেবল।

(রুহিন)

গতকাল খুব বিচ্ছিরি একটা ঘটনা ঘটে গেছে। আপু খাটের ওপর দৌড়োদৌড়ি করছিলো, হঠাৎ করে কীভাবে যেন পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেললো। অনেক রক্ত ঝরেছে। এসব দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না। আপুকে এত জোরে কাঁদতে দেখি নি কখনও। অনেক ব্যথা পেয়েছে মনে হয়! বাবা, মা, চাচাজান, দাদু আর দাদীও খুব হৈ চৈ শুরু করলো। এই প্রথম কোনো ঘটনা দেখে আমি বেশ ভালোরকম ভড়কে গেলাম। এরকম আগে কখনো ঘটতে দেখি নি। আমারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে এসব দেখে। পৃথিবীতে এমন অনেক পচা পচা ব্যাপার ঘটে শুনেছি। তবে সেসব নিয়ে আমি ভাববো কেন? আমার বাবা আছে না? মা আছে না? এই যে আপু এত কাঁদছে, এই যে বাবা আর মা এত ভড়কে গেছে, তারপরেও ঠিক ঠিক কীভাবে যেন সবকিছু ঠিক করে দেবে। জাদুর কোনো মলম লাগিয়ে দেবে, অথবা নিয়ে যাবে ভালো মানুষদের বাসায় যারা সাদা পোষাক পরে থাকে, আর বুকে কী যেন লাগিয়ে দেখে, ওরা সব ঠিক করে দিতে পারে। কোথা থেকে যে বড়রা এত জাদু শিখেছে, কীভাবে যে তারা সবকিছু এভাবে সামলে রাখে আর ঠিক করে দেয়, অবাক করা ব্যাপার!
খাটের নিচে বল ঢুকে গেছে? ওখানে তুমি ঢুকতেও পারছো না? চাচাজানকে ডাকো, সে বের করে দেবে।
কম্পিউটারে কার্টুন দেখার সময় হুট করে তা বন্ধ হয়ে গেছে? বাবাকে বলো, ঠিক করে দেবে।
জুতোর ভেতর বালু ঢুকে যাওয়াতে কিচকিচ করছে? মাকে ডাকলেই তো হয়! ঠিক করে দেবে। আপুকেও তারা ঠিক করে দেবে। আমার যদি কিছু হয় তাহলেও তারা ঠিক করে দিতে পারবে। পারবেই পারবে। আমি জানি তো!


(আমি)

মিতিনের মাথা ফেটে যাওয়ার পরদিনই আরেক দুর্ঘটনা ঘটলো। রুহিন বেসিনের নিচে খেলছিলো, কীভাবে যেন বেসিনটা ভেঙে পড়লো। আমি তখন ওর কাছে নেই। আমার মনে হচ্ছিলো পুরো পৃথিবীটাই ভেঙে পড়েছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার, কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার, কী অলৌকিক ব্যাপার, রুহিনের গায়ে একটা আঁচড়ও পড়লো না। একটু ব্যথা পেলো না। ভয় পেয়ে কাঁদলো অবশ্য, তাও খুব বেশি না। কিন্তু ঘটনাটা আমাকে খুব মুষড়ে দিলো। পরপর দুই দিন এমন দুটি দুর্ঘটনা মন ভেঙে দেবার জন্যে যথেষ্ট। অথচ ঠিক তার পরদিনই অফিসে ছিলো বছরের সবচেয়ে জরুরী কাজগুলোর একটি। সেদিন আমি পুরো ১০টি ঘন্টা নিজের ডেস্কে বসে চুপচাপ কাজ করে গেছি। কারো সাথে কোনো কথাই বলি নি বলতে গেলে। এরকম বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থাতেও যন্ত্রের ত কাজ করে যাওয়া, এবং সেটা ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন করানোর দৃঢ়টাতা দেখাতে পেরে অবশ্য ভালো লাগলো।
মনে পড়ে গেলো সেই সংকট আর দোলাচলের কঠিন সময়টার কথা। মনে পড়ে গেলো সেই সংশয় আর উৎকণ্ঠার প্রহরগুলো। মনে পড়ে গেলো মিথ্যে ইউফোরিয়ার মিথস্ক্রিয়া, মনে পড়লো ঘুরে দাঁড়ানো, মনে পড়লো জীবনকে বেছে নেয়ার সেই মহাক্ষণের কথা।
আমি ফিরছি অফিস থেকে বাসায়। আমি ফিরছি জীবনের কাছে। আমি ফিরছি আমার সুন্দরতম সিদ্ধান্তের কাছে। ফিরছি সুন্দরতম সৃষ্টির কাছে।
আমি জীবনকে বেছে নিয়েছি, জীবন কি আমাকে বেছে না নিয়ে পারে!


সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:০৭
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×