somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৮:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



লোকটার ব্যবসা বুদ্ধি দারুণ। অবশ্য ব্যবসা বুদ্ধি মানে যদি ভেবে থাকেন যে সে টেকো লোকের কাছে উন্নতমানের শ্যাম্পু গছিয়ে দেয়ার উপায় জানে তাহলে অবশ্য ভুল করবেন। তার ব্যবসাটা বেশ জমজমাট হলেও সেটার ধরণ-ধারন একটু আলাদা। ব্যবসার কাঁচামাল, পুঁজি, বিনিয়োগ, লাভ সব যদি এখন সবিস্তারে বলতে যাই, তাহলে বিষম খেতে পারেন। ধীরে ধীরে বলি বরং, ঠিক আছে? কথায় আছে না, স্লো এন্ড স্টেডি উইনস দ্যা রেস! রেসে জিততে খুব ইচ্ছে করছে? তাহলে থাক! এখানে আসলে জেতা-হারার কোনো ব্যাপারই নেই। তবে হ্যাঁ, বুঝতে পারছি যেহেতু এখানে লাভের কথা আছে, ব্যবসার কথা আছে, বিনিয়োগের কথা আছে, সেহেতু এই কপাটরুদ্ধ অস্থির সময়ে শর্টকাট কোন পদ্ধতি যদি মুফতে জানা যায়, তার প্রতি আগ্রহ জন্মাতেই পারে। আপনাদের আগ্রহটা বেশ উপভোগ করছি। তাই খুব সহসাই অর্গল ভাংবো, তা ভেবে বসবেন না যেন!
লোকটা এই মুহূর্তে আমার পাশে নেই। থাকলেও যে বিশেষ সুবিধে হতো তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ব্যবসায়ী লোকদের নিয়ে এই এক সমস্যা। দেখা যাবে যে, নতুন কোনো বিজনেস প্ল্যান মাথায় এসেছে, তা নিয়েই মশগুল। তার বেশিরভাগ উদ্যোগই অবশ্য ফ্লপ খায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে বারবার লস খাওয়া, ফ্লপ খাওয়া এটা বিজনেস পলিসিরই একটা অংশ। ধোঁয়াটে ঠেকছে, তাই না? আমার নিজের কাছেও লাগতো। আমি নিজেও প্রথমদিকে বুঝি নি কীই বা তার ব্যবসা, কী তার মূলধন, কোথায় বিনিয়োগ করছে, আর লাভই বা হচ্ছে কীভাবে। আমি খুব একটু আলাপী মানুষ না, তবে তার সাথে মাঝেমধ্যেই গল্প জমে উঠতো। কর্মসূত্রে পাশাপাশি থাকার কারণেই এই নৈকট্য বজায় থাকতো ভালোভাবেই। ওহ আচ্ছা, বলা হয় নি লোকটা কিন্তু একটা চাকুরিও করে, এবং সেটা থেকেই তার জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহ হয়। সে যে প্রতিষ্ঠানে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে কাজ করে, সেখানে স্পষ্ট নীতিমালা আছে, প্রতিষ্ঠানে কাজ করা অবস্থায় অন্য কোন চাকুরি বা ব্যবসার সাথে জড়িত থাকা যাবে না। কিন্তু লোকটা এসব কিছুর তোয়াক্কা না করে ধুমিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে, নিয়ম নিগড়ের ফাঁক গলে । এ এক মহা সংকট! কোম্পানির একজন অনুগত কর্মচারী হিসেবে একসময় আমি ভেবেছি এ ব্যাপারে টপ ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলে তাদেরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলবো। সেটা করার মত টপে আমি আদৌ উঠতে পারবো কি না কখনও জানি না, তাই তো আপনাদের দ্বারস্থ হলাম। আমি যেহেতু একটু গল্প টল্প লিখি, তাই একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে, একটু রসিয়ে রসিয়েই বলি বরং কেমন?

আপনি যদি প্রবল সন্দেহবাদী, এবং খুঁতখুঁতে স্বভাবের হন, তাহলে লোকটার অনেক আচরণই আপনার মনে প্রশ্ন জাগাবে। আপনার সাথে দেখা হলেই সে আপনাকে নানারকম প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে পারে। আপনার জন্যে একটা বিজনেস আইডিয়া দেই। প্রশ্নের উত্তর মৌখিক বা লিখিতভাবে নিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিয়ে সে থার্ড পার্টির কাছে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য পাচার করছে এমন সন্দেহ যদি আপনার মনে জাগে, এবং আপনি যদি অনুসন্ধান করে এটা সঠিক প্রমাণিত করতে পারেন, তাহলে আর আপনাকে পায় কে! সরাসরি আর্থিক সংযোগ হয়তো বা এতে নেই, তবে এত বড় একটা জোচ্চুরি এবং দুর্নীতির কথা ভাইরাল করে দিলে আপনার যে সেলফ ব্র্যান্ডিং হবে তার মূল্যও কিন্তু কম না! তবে আমার পরামর্শ হচ্ছে, তার সাথে এসব না খেলাই ভালো। ঝানু ব্যবসায়ী তো, সব ধরে ফেলে।
তার ব্যবসায় সে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, এবং অনেক বছর ধরে বিনিয়োগ করেই যাচ্ছে। একদম ছোটবেলা থেকেই এই ব্যবসায় তার বিনিয়োগ শুরু। ভাবুন একবার অবস্থা! এখনও তার মূলধন উঠে আসার কোনো লক্ষণ নেই, তারপরেও সে বিনিয়োগ করেই যাচ্ছে। জন্মসূত্রেই সে অঢেল সম্পত্তির মালিক। তাই যথেচ্ছ বিনিয়োগ করার সুযোগ তার আছে। ঈর্ষাণ্বিত হচ্ছেন, তাই না? হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে মূলধন হিসেবে যে যা পেয়েছে তা আপনাকে দিলে আপনি কতটুকু ব্যবহার করতেন তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় আছে। ডোন্ট টেইক ইট পারসোনালি প্লিজ!

লোকটার ব্যবসাবুদ্ধি প্রখর হলেও বিষয়বুদ্ধি একেবারেই নেই। বিষয়বুদ্ধি ছাড়া ব্যবসা, এর থেকে অদ্ভুত কথা কখনও শুনেছেন? কিন্তু যদি বলি বিষয়বুদ্ধি না থাকাটাই তার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ, তাহলে কি আপনারা বিষয়টি হজম করতে পারবেন? ভনিতা না করে বলেই ফেলি, লোকটা মানুষ নিয়ে ব্যবসা করে। নিন্দার্থে তাকে আদম ব্যাপারীও বলতে পারেন, তাতে ভাবগত অর্থ পালটে গেলে যাক, রসিকতার অধিকার সবারই আছে নিশ্চয়ই! চুপিচুপি বলে রাখি, এই ব্যবসাতে আমারও খুব সামান্য হলেও অংশীদারিত্ব আছে। আমিও তার ব্যবসায় মাঝেমধ্যে ইনভেস্ট করি। ব্যবসাটা যেহেতু মানুষের, আমিও মাঝেমধ্যে তাকে টুকটাক সাপ্লাই দিয়ে থাকি আর কী! আমি তার মত অত রেকলেস জুয়া খেলার সাহস রাখি না, তবে বলা তো যায় না সামান্য ইনপুট থেকে যদি বিশাল আউটপুট আসে, তাহলে খারাপ কী! তার সাথে আমার অলিখিত চুক্তি আছে। তার সাথে সবার সবধরণের ব্যবসায়িক চুক্তিই অলিখিত, বা মৌখিক। কাগজ টাগজের ঝামেলায় সে যায় না ব্যবসাটা অবৈধ বলে এবং আইনী ঝুঁকি আছে বলে ব্যাপারটা এমন না। তার ভাষায়, লিখিত কাগজপত্তর হলো সিস্টেম লসের ভান্ডার। সিস্টেম লস নিয়ে যে এত সচেতন, তার ব্যবসায় লস আরো কম হলেই মানানসই হত নিশ্চয়ই! কিন্তু বাস্তব বড় নীরস!

তার সাথে আমার সর্বশেষ বিনিয়োগের কথাটা বলা যাক। লোকটা একবার ঠিক করলো তার ঘনিষ্ঠ দুই অনুজকে তাদের কর্মস্থল থেকে অব্যাহতি দেবে। এই দুই অনুজ আমাদের প্রতিষ্ঠানের ক্রিকেট টিমে খেলতো। আমাদের টিমটায় কিশোর থেকে তরুণ বয়সীদের সুযোগ দেয়া হয় ভবিষ্যতে বড় কিছু হবার লক্ষ্যে। তো ঝানু ব্যবসায়ী মানুষটার মনে হলো সেই দুই তরুণের এখন অন্যকিছুতে মনোনিবেশ করা উচিত। তাদের হয়তো বা খেলায় তেমন মন নেই, অথবা আর দেয়ারও কিছু নেই। কথাটা সাফ সাফ বলে দিলেই হতো, কিন্তু তা না করে সে বেশ আড়ম্বর করে এক ফেসবুক ইভেন্টের মাধ্যমে তাদের জাঁকজমকপূর্ণভাবে অবসর দেয়ার ঘোষণা চালাতে লাগলো মাস ধরে। আমাকে বলা হলো সেই দুই অনুজের জন্যে দু কলম কবিতা লিখতে। এরকম আরো অনেককেই সে এনগেজড করে ফেললো বিভিন্ন কর্মকান্ডে। শুরু হলো বিশাল কর্মযজ্ঞ! কবিতা লেখা হলো, পুঁথি রচিত হলো, বিভিন্ন রকম খাবার-দাবারও চলে এলো। তো এটাই হচ্ছে তার ব্যবসা, বুঝলেন না? মানুষের মধ্যে স্মৃতি প্রোথিত করা, মেমরি ক্রিয়েট করা। বছরের পর বছর ধরে সে এই কাজ করেই চলেছে, করেই চলেছে।

তার ধারণা এটা খুবই লাভজনক এক ব্যবসা এবং কোনো একদিন কেউ একজন তার কর্মকান্ডে খুশি হয়ে বলবে, “এই নাও লাখ পঞ্চাশেক টাকা, কিছু কিনে খেও”। আপনারা হয়তো ভাবছেন এটা খুব মোটা দাগের রসিকতা। আপনাদের স্বাধীন ভাবনায় আমি হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তবে এই ধরণের সুখভাবনায় সে আসলেই মজে থাকে, এবং একদিন এভাবেই তার বিনিয়োগ উঠে আসবে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস। সত্যি কথা বলতে কী, আমি নিজেও কিছুটা প্রলুদ্ধ হই তার এ ধরণের কথাবার্তায়। ৫০ লাখ না পেলেও দু-দশ হাজার যদি হাতে আসে তাই বা মন্দ কী! এই মন্দার বাজারে অল্প-স্বল্প বিনিয়োগে দু-চার পয়সা ইনকাম যদি করা যায়, সে তো খুব ভালো খবর! আমার কথা হচ্ছে, সে ত্রিশ-চল্লিশ বছর বিনিয়োগের পর পঞ্চাশ লাখ টাকা পেয়ে গেলে তার যতটা লাভ আমি দু-চার ঘন্টা বিনিয়োগ করে যদি দু-চার হাজার টাকা পাই, সেটা নিঃসন্দেহে বেশি লাভজনক। আমার ব্যবসাবুদ্ধি খারাপ না বুঝলেন! আর ইয়ে, মানে আমিও আপনাদের মত শর্টকাট রাস্তাই বেশি পছন্দ করি।
লোকটার মাথায় মাঝেমধ্যে খুব স্বাভাবিক কিছু বাতিক চাপে। বাতিক মানেই অদ্ভুত হবার কথা, তাই না? কিন্তু অদ্ভুত কাজকর্মই যেখানে স্বাভাবিক, সেখানে স্বাভাবিক কাজকর্মকে অদ্ভুত বলাটাই সমীচীন। লোকটা অবশ্য দাবী করে যে তার সব কর্মকান্ডের ভেতরই গভীর ফিলোসফি থাকে। এই “গভীর ফিলোসফি”র মাঝে আমি একটি শব্দ যুক্ত করবো। তা হলো- বিজনেস। বিজনেস ছাড়া সে কিছু বোঝে না। আমাদের কাছে অবশ্য বিজনেস খুব নেগেটিভ একটা শব্দ। বিজনেসের কথা শুনলে আমাদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে, শিরা দপদপিয়ে ওঠে, কণ্ঠ ঘড়ঘড়িয়ে ওঠে, আমার তর্জন গর্জন করে প্রতিবাদ করি, “শালা বিজনেস পাইছো আমার সাথে?”, অথবা “সবকিছুতে বিজনেস চলে না, বুঝলা মিয়া?”। তাও আবার মানুষ নিয়ে বিজনেস, বোঝেন ব্যাপারটা! যাই হোক, তার সবচেয়ে সমালোচিত এবং স্বাভাবিক কর্মটি ছিলো বিয়ে করে ফেলা। শুধু যে বিয়ে করেছে তা না, স্যুটও পরেছে, বিয়ের আগে প্রেমও করেছে। আমি নিজে এটাকে তার একটা ভুল ব্যবসায়িক পলিসি বলি, সে নিজেও তা স্বীকার করে। এটা নিয়ে আমরা নির্মম হাসি তামাশার শূলে বিদ্ধ করি তাকে। সেক্ষেত্রে তার সয়ে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না।
বিবাহ করার অবশ্যম্ভাবী ঘটনাচক্রে তাকে একদিন বাবাও হতে হলো।

(গল্পের এই অংশে এসে আমি বেশ উত্তেজিত বোধ করছি। কারণ আমার তো লেখার ব্যবসা, লেখার মধ্যে এসব বাবা-সন্তান-স্নেহ জাতীয় ইমোশনাল ব্যাপার চলে এলে তা এই নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানুষের মনে বেশ একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। গল্পে এবার কিছু নাটকীয় বাঁক না থাকলেই নয়!”)
তারিখটা সতেরই জুলাই, দুইহাজার সতের। মহিমান্বিত একটা তারিখ। এদিন তিনি দুটি কন্যা সন্তানের জনক হলেন। তারিখটাকে ঠিক শব্দ দিয়ে লিখলে বোঝানো যায় না। লিখতে হয় সংখ্যা দিয়ে।
১৭/৭/২০১৭
প্রতিটাও মৌলিক সংখ্যা! লোকটার আবার সংখ্যা নিয়ে ব্যাপক ফ্যাসিনেশন আছে। মৌলিক সংখ্যা না কি সুন্দরতম। সে যখন জানতে পেরেছিলো তার জমজ সন্তান হবে, দুটি জেন্ডার ইনডিপেন্ডেন্ট নাম ঠিক করে রেখেছিলো। ১৯ আর ২৩। তো ১৯ আর ২৩ জন্ম নেবে, আমরা প্রচুর পরিমাণে কমলা আর জাম্বুরা খাবো, এমন একটি পরিকল্পনা ঠিক হয়ে ছিলো। কিন্তু বাধ সাধলো কিছু বায়োলজিকাল ব্যাপার। উনিশ আর তেইশ পৃথিবীতে চলে এলো নির্ধারিত তারিখের দু মাস আগে। প্রি ম্যাচিওর বেবি। গম্ভীর মুখে ডাক্তার সাহেব জানালেন,
-এদেরকে বাঁচাতে হলে অন্তত পাঁচ সপ্তাহ আইসিইউতে রাখতে হবে। নিবিড় তত্বাবধান ছাড়া এদের বাঁচানো সম্ভব না। আপনি লাখ দশেক টাকার ব্যবস্থা করুন।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ছোটবেলা থেকেই মানবব্যবসার সাথে জড়িত থাকা এবং একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকা স্বত্তেও তার জমানো টাকা পয়সা ছিলো খুবই সামান্য, এবং তখন পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান বা ওয়ালটনের প্রেসিডেন্ট এসে তাকে কিছু কিনে খাবার জন্যে লাখ পঞ্চাশেক টাকা দেবে এমন কোন লক্ষণ দেখা যায় নি। তাহলে উপায়? দশ লাখ টাকা কি মুখের কথা না কি?
লোকটার সামনে তখন নিজের ব্যবসায়িক প্রজ্ঞা প্রমাণের মোক্ষম সময়। এতদিনের বিনিয়োগ যদি এবার উঠে না আসে, তাহলে সে তার মানব ব্যবসায় বিনিয়োগ ছেড়ে ফেনসিডিলের চোরাকারবারিতে ঢুকে যাবে কি না এ ধরণের কোন ডিলেমার মধ্যে ছিলো কি না আমি জানি না, তবে তেমন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে আমি অন্তত দোষারোপ করতাম না।
কিন্তু লোকটা ঝানু ব্যবসায়ী। হি মিনস বিজনেস। সে জানে, এবার রিটার্ন আসবেই। না এসে পারে না।
আমি যেহেতু তার ব্যবসার অতি ক্ষুদ্র অংশের পার্টনার ছিলাম, তাই আমার কাছেও লাভ-লক্ষণ একটু হলেও প্রকাশিত হলো। যে ছেলেটা অসুস্থ হয়ে মাসাধিককাল বিছানায় পড়ে আছে, এবং যাকে এককালে ব্যবসা কৌশলের অংশ হিসেবে মানিকগঞ্জের নদীতে নৌকা করে ঘুরিয়ে প্রচুর পরিমাণে কৈ মাছ ভাজা খাওয়ানো হয়েছিলো, সেই ছেলেটা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে আমাকে ফোন করে বললো,
“ভাই, শুনলাম তার মেয়ে দুইটা নাকি খুব অসুস্থ? অনেক টাকা না কি লাগবে?”
আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম চিন্তা না করতে। “চিন্তা করো না, ঠিক হয়ে যাবে” এমন কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি, তা বেশিরভাগ সময়ই কোন অর্থ বহন করে না। কিন্তু আমার নিশ্চিন্ত থাকার পরামর্শ ছিলো যৌক্তিক চিন্তা এবং ব্যবসায়িক আঁক কষে বের করা সুন্দর ফলাফল।
আমার যুক্তি ছিলো এই-
১) তার কন্যাদ্বয়ের নাম আগে থেকেই নির্ধারিত, দুটি মৌলিক সংখ্যা-১৯ আর ২৩। তাদের জন্ম ১৭/৭/২০১৭ তে যাতে আবার মৌলিক সংখ্যার ছড়াছড়ি। তো এটা যে ঈশ্বরের একটি খামখেয়ালি স্নেহের পরিচয় তা বুঝতে পয়গম্বর হতে হয় না।
২) সে বিনিয়োগ করেছে মানুষের ওপর। ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে কাউকে মেডেল দিয়েছে, কাউকে দিয়ে স্টুডিওতে গান রেকর্ডিং করেছে, কাউকে নিয়ে মিউজিক ভিডিও বানিয়েছে, এতসব বিজনেস ইনভেস্টমেন্টের ফল পাওয়ার একদম পিক সিজন এসে উপস্থিত। না পেয়ে উপায় কী!

তো যা বলছিলাম, তার ব্যবসায়ের অতি ক্ষুদ্র অংশীদারীত্ব থাকার ফলে আমার কাছেও কিছু কিছু লভ্যাংশ আসছিলো। ইতিমধ্যেই লোকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার দূরাবস্থার কথা জানিয়ে দিয়েছে যথাযথ নিরাবেগ ভঙ্গিতে।
তারপর...
ফেসবুকে কবিতার স্ট্যাটাস দেয়া নিঃসঙ্গ মেয়েটি আমাকে জানালো, সে কিছু টাকা দিতে চায়, কিন্তু ফেরত নেবে না, এবং নামটি যেন গোপন থাকে। কাজে নতুন যোগ দেয়া সহকর্মীটিও একই ধরণেই ইচ্ছা পোষণ করলো।

সুন্দর ইচ্ছেরা, শুভ ইচ্ছেরা, শুভ্র পেখম মেলে মুক্ত আকাশে উড়তে লাগলো মহৎ উদ্দেশ্যে দুটি দেবশিশুকে বিশুদ্ধ বাতাস দেবার জন্যে। যে মেয়েটিকে অনর্থক টেনশন আর বকবক করার শাস্তি হিসেবে মোল্লা সল্ট দেয়া হয়েছিলো, সে মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিলো। হাত বাড়িয়ে দিলেন স্নেহের প্রতিমূর্তি প্রবাসী অগ্রজ লেখিকা, কাজের স্পৃহা বাড়ানোর জন্যে আপাতদৃষ্টিতে কেঠো মনে হওয়া মানুষটিকে “আই এ্যাম মার্কেট এ্যানালিস্ট” টেক্সট অঙ্কিত টি শার্ট উপহার দেবার প্রতিদানই বা সে ভুলবে কীভাবে! তার ওপর তো কম বিনিয়োগ করা হয় নি! সে মূল্য না দিয়ে যাবে কোথায়! অসংখ্য স্মৃতিতাড়িত মানুষের দেখা মিলতে লাগলো বারডেম হাসপাতালের আশেপাশে, বেতার তরঙ্গে, অন্তর্জালের অলিগলিতে। সবাই স্মৃতির ধারক। কারো স্মৃতি জবুথবু হয়ে ছিলো, কারো স্মৃতি প্রবল পরাক্রমশীল, কারো স্মৃতি আবেগজর্জর...

পৃথিবীতে রূপকথারা এখনো আছে বলে আমাদের আর এখানে নতুন করে বলার কিছু নেই। সেই গুড ওল্ড হ্যাপি এন্ডিং । আমার অনুমানই সঠিক হলো। টাকা পয়সা নিয়ে ভাবতে হলো না, আর উনিশ-তেইশও তাদের কাঙ্খিত ওজন অর্জন করতে সক্ষম হলো। সিম্পল এ্যাজ দ্যাট!
নিত্যদিনকার কথাবার্তার মাঝে একদিন তাকে বলে ফেললাম,
-আপনার ইনভেস্ট তো সফল মিয়া! মানব গবেষণা এবং বিনিয়োগ থেকে তো ভালো ফল পাইলেন! ধার হিসেবে টাকা চাইলেন, আর মানুষ আপনাকে গিজফট হিসেবে দিয়া দিলো।
-হু, আমি তো জীবনের সিক্রেট জানি!
সন্তুষ্ট কন্ঠে তার প্রত্যুত্তর শুনে বুঝতে পারলাম এই সিক্রেট এমন এক সিক্রেট, যা রাস্তায় রাস্তায় বিলবোর্ডে, স্কুলে স্কুলে ব্ল্যাকবোর্ডে, আর অফিস আদালতের নোটিশবোর্ডে ইতং বিতং করে বিস্তারিত লিখে দিলেও মানুষ কাজে লাগাতে পারবে না। এই যে এই গল্পে আপনাকে এমন খোলাসা করে বলে দিলাম, তারপরেও কি আপনি মানব গবেষণা এবং মেমরি ক্রিয়েটের ওপর এমন হেভি ইনভেস্ট করবেন, বলেন?
লোকটার আত্মতুষ্টি অবশ্য মাঝেমধ্যে বিরক্তিকর ঠেকে। এই যেমন সে আমাকে মাঝেমধ্যেই বলে,
-বুঝলেন হাসান ভাই, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান বা এমন পদের কেউ কিছু কিনে খাওয়ার জন্যে পঞ্চাশ লাখ টাকা কাউকে দিলে আমাকেই দিবে, আপনাকে না!
কথাটা মেনে নিতে আমার কষ্ট হলেও আমি আর তর্কে জড়াই না। পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে কিছু কিনে খাবার অদ্ভুত বাসনা যদি কারো থেকে থাকে, তো আমার কী!
আমি শুধু জানবো যে আমিও স্মৃতি গড়তে পারি, আমিও ছিলাম উনিশ-তেইশের বর্ণাঢ্য পৃথিবী আগমন পরিক্রমায়!
(এটি গল্পের আদলে বলা একটি সত্য কাহিনী। মূল চরিত্রের নাম মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়। সে একসময় ব্লগিং করতো হিমালয়৭৭৭
নামে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১১:৪৮
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×