somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যাদের প্যানিক এ্যাটাক নামক ভয়ানক অনুভূতি হয়, তাদের জন্যে হাত বাড়াচ্ছি

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


প্যানিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত একজন নাম না জানা মানুষ তার অজানা বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেছিলেন। সেটার অনুবাদ করলাম। অনুবাদ করাটা জরুরী ছিলো। কারণ আমিও ভুক্তভোগী, আমি লড়ছি এখনও। আমি সাহায্য করতে চাই আপনাদের...

“আমার অবস্থাটা কখনই বলে বা লিখে বোঝানো সম্ভব না। তবুও আমি তোমাকে কিছু বলবো আজ। বলবো আমার এই যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা ক্লান্ত মনটা নিয়ে। যুদ্ধ করে টিকে থাকা গৌরবের, আবার ক্লান্তিরও। আমার ক্লান্তির কিছুটা ভাগ তুমি নেবে?

অনেকবার হয়তো শুনেছো, আমি প্যানিক ডিজঅর্ডারে ভোগা একজন মানুষ। এই অদ্ভুতুরে রোগটা আমাকে গুটিয়ে দিয়েছে অনেকটাই ভেতরে ভেতরে। আমাকে দেখে যেমন ইন্ট্রোভার্ট আর লাজুক ভাবো, আমি কিন্তু তেমন না। বাইরে যেতে আমার ভালোই লাগে। কিন্তু ঐ যে একটা ভয়! কীসের ভয়? আমি জানি না। শুধু জানি যে যেকোনো সময় আমাকে ভয়টা জেঁকে ধরতে পারে। তখন আমার কিছুই করার থাকবে না। এই বোধটা আমাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। সত্যিকারের আমি ঢাকা পড়ে যাই ভয়ের দেয়ালে। আমি তোমায় মায়ায়, স্নেহে ভরিয়ে দিতে পারি, জানো? কিন্তু তোমাকে দেখে আমি মাঝেমধ্যেই ভয়ংকর নার্ভাস হয়ে যাই। এটা তোমার দোষ না, তোমাদের দোষ না। কিন্তু এমনটাই হবে, এমনটাই হয়ে আসছে। তোমাদের মাঝে মিশে গিয়ে, ‘তোমাদের’ মত মজা করে আমি অনেকসময় ভুলে থাকতে পারি এই অদৃশ্য ভয়ের হুংকার। কিন্তু সবসময় এতেও কাজ হয় না। হঠাৎ করে দেখবে আমার নাক ঘামছে, দ্রুত শ্বাস পড়ছে, আমার চোখের ভেতর রাজ্যের অসহায়তা আর আতঙ্ক। হয়তো বা তোমার হাত আমার কাঁধে রাখলে আমার খুব ভালো লাগবে। আমি আবার বাস্তব পৃথিবীতে তোমাদের মত করেই বিচরণ করতে পারবো। কিন্তু তোমার বাড়িয়ে দেয়া হাতটাও আমি সবসময় ধরতে পারি না। মাই ব্যাড!

আমি জানি, খুব ভালো করেই জানি, যে ভয় আমাকে ভয় দেখিয়ে বেড়ায়, তার সত্যিকারের কোনো অস্তিত্ব নেই। কোনো কারণ নেই। আমি জানি এটা একটা বিভ্রম। কিন্তু শরীরের ভেতরের রসায়ন এত উল্টোপাল্টা হয়ে যায় তখন! আমি নিজেকে অটোসাজেশন দেই, অভয় দেই, কিচ্ছুটি হবে না। আমি খুব ভালো করেই জানি এটা সাময়িক এক অনুভূতি। তারপরেও ভয়ের তরঙ্গ এসে আমাকে একদম ভেঙেচুড়ে দিয়ে যায়। আমার প্রতিরোধ ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে মনে হয় হাল ছেড়ে দেই। দিনের পর দিন কত কিছুই তো করছি,কিন্তু কিচ্ছু বদলাচ্ছে না। আমি নিজেকে সাহায্য করার জন্যে সবকিছুই করছি। তাই দয়া করে এ কথা বলো না যে, ধৈর্য্য ধরো, ঠিক হয়ে যাবে। কে জানে, হয়তো বা হবে কোনো একদিন! সেই একদিন যে কবে আসবে!

আমার খুব বিধ্বস্ত লাগে। তোমার মতো অফুরান প্রাণশক্তি আমার নেই। কীভাবে থাকবে বলো? দিনের পর দিন ভয়ের সাথে যুঝতে যুঝতে আমি খরচ করে ফেলি আমার ভেতরের রোদ্দুর। প্যানিক ডিজ অর্ডারের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে আসে ডিপ্রেশন। না, এটা শখের কোনো বড়লোকী ব্যাপার না। খুবই বাজে ধরণের ডিপ্রেশন। সবকিছু থেকে নিষ্কৃতি পেতে আমাকে ঘুমোতে হয় প্রচুর প্রায়ই। কাজের রুটিন ঠিকঠাক থাকে না। যেভাবে চলার কথা সেভাবে চলতে পারি না। আমার জন্যে তোমার কাজেরও অসুবিধে হয়। খুব সাধারণ কোনো কাজ করতেও দুবার ভাবি, সংশয়ে ভুগি, সময় নষ্ট করি তোমাদের। স্যরি! কী আর বলবো!

মাঝেমধ্যে তুমি হয়ে ওঠো আমার সবচেয়ে বড় ভরসা। তুমি হয়ে ওঠো আমার ত্রাণকর্তা, আমার গার্ডিয়ান এ্যাঞ্জেল। কোথাও যেতে হলে আমি তোমাকে সাথে নিতে চাই। এতে কি তুমি খুব বিরক্ত হও? বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। আমি তোমাকে জ্বালিয়ে যাবোই। মতিভ্রমের ভয়াল জগৎ থেকে বাস্তবের শুদ্ধ-সুন্দরে ফিরে আসতে তোমাকে না হয় একটা মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার করলাম। বেঁচে তো থাকতে হবে, না কি! কখন কোথায় ট্রিগার অন হয়ে যায়, তারপর অনবরত গুলিবর্ষণ এই ঠুনকো দেহটায়! আর কত পারা যায় বলো!

হেন কোনো উপায় নেই, যা আমি ট্রাই করি নি। মেডিটেশন? করেছি। ইয়োগা? করেছি। আকুপাংচার করেছি, মোটিভেশনাল স্পিচ শুনেছি, আর নানারকম ঔষধ তো আছেই! ঔষধ বদলায়, আর ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় বদলে যাই আমি। আমার ব্যবহার বদলায়, মেজাজ বদলায়, মুড বদলায়, অযৌক্তিক আচরণ করি। এটুকু সয়ে নিতে পারবে না? এটা সত্যিকারের আমি না, এটা রাসায়নিকের দোষে বিষাক্ত আমি!
আমার যখন প্যানিক এ্যাটাক হয়, সেটা নিয়ে ভুলেও ঠাট্টা করো না, প্লিজ! তোমার ঠাট্টা ছাড়াই আমি যথেষ্ট খারাপ থাকি, বিশ্বাস করো, এর চেয়ে খারাপ থাকা যায় না ঐ সময়ে। প্যানিক এ্যাটাক আমার কাজ না করার অজুহাত না। প্যানিক এ্যাটাকের কারণে আমি স্পেশাল প্রিভিলেজ পেতে চাচ্ছি না। আমি তোমার ঘাড়ে চড়ে বসতে চাইছি না। আমি তোমার মধ্যে নেতিবাচক চিন্তাও জাগ্রত করতে চাচ্ছি না। আমি যদি তোমার হাত ধরতে চাই শক্ত করে, ধরতে দিও, আর একটু সাহস যুগিও। হালকা রসিকতার ছলেও করতে পারো কাজটা। এর চেয়ে বেশি কিছু তোমার কাছে চাই না, এবং এর চেয়ে ভালো কোনো কিছু তোমার করারও নেই। আমার যদি হাজারবারও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়, একই কথা বলো, একইভাবে হাত ধরে থেকো? আমি চাই স্বাধীনচেতা এবং শক্ত হতে। তোমার মতোই।

প্যানিক ডিজঅর্ডার যে কেন হয়, আর কাদের হয় কীভাবে হয়, তা বড্ড ধোঁয়াটে ব্যাপার। তবে যাদের হয়, তাদের ক্ষেত্রে একটা অনুভূতি কমন- “আমি মারা যাচ্ছি” অথবা “ভয়ানক কিছু হতে যাচ্ছে”। একদিক দিয়ে দেখলে ভালো, আমরা জীবনে অনেকবার মরে যেতে যেতে বেঁচে উঠি, ব্যাপারটা অনেকটা পুনর্জন্ম লাভ করার মত, তাই না? হাহা! এত কষ্টের মধ্যেও হাসি পেলো। প্রথমবার যখন এমন হয় তখন কোনোভাবেই বোঝা সম্ভব না এটা সত্যিকারের মৃত্যু না, এত ভয় পাবার কিছু নেই। তবে সেসময় তা বলে দেয়ার মত কেউ থাকে না কারো সাধারণত।

বেশিরভাগ সময় আমাদের দেখে অবশ্য তোমার মনে হবে শান্ত, স্বাভাবিক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে কতবার বিস্ফোরণের ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছি, তা যদি দেখতে পেতে! এই স্বাভাবিক থাকার প্রবল ইচ্ছেটাই আমাদের জীবনের প্রধান সংগ্রাম, এটাই আমাদের চালিকাশক্তি। এই ইচ্ছেটা না থাকলে কতবার যে নার্ভাস ব্রেকডাউন হত কে জানে! এ ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, কিন্তু প্যানিক এ্যাটাক হলে পারি না নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। পারা যায় না।

এতক্ষণ তো অসুখের ঘ্যানরঘ্যানর করে তোমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছি হয়তো। এবার কিছু মোটিভেশনাল কথাবার্তা বলি! এটার খুব চল হয়েছে আজকাল! কখনও কখনও তোমার ঘরে তোমার অনুমতি ছাড়া ঢুকে পড়াটাই আমার জন্যে বিশাল এক অর্জন! আমার সারাদিনটাই ভালো করে দেয়। আর স্বাভাবিক অবস্থায় তো আমরা আস্ত একটা প্যারেডও চালাতে পারি। সমাজে কন্ট্রিবিউট করতে পারি অন্যদের মতই। মানুষ থেকে মেশিন, সবই কন্ট্রোল করতে পারি। আমাদের এই অবদানের স্বীকৃতিটুকু দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখো, প্লিজ!

যুদ্ধটা চালিয়ে যাবো, তবে একা সবসময় পারি না, পারা যায় না। একটু পাশে থেকো?”

ইতি
তোমার প্যানিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত প্যারানয়েড বন্ধু

প্রথম প্রকাশ- এগিয়ে চলো ডট কম
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১১:৪২
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×