somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুবাদঃ "Genocide, a report published on The Sunday Times by Anthony Mascarenhas"

১৩ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(অনুবাদটা এখনো ড্রাফ্‌টস পর্যায়েই আছে। সে কারণে অসংখ্য বানান ভুল হিসেবে রয়ে গেছে, যেটা পরবর্তীতে সময়ের সাথে ঠিক করে ফেলা হবে।)

জুন ১৩, ১৯৭১
অ্যান্থনি মাস্কারেনহাস
দ্যা সানডে টাইমস

আব্দুল বারী ছিল দুর্ভাগা।
হাজার হাজার পূর্ব বাংলার আরও লোকেদের মতো সেও পাকিস্তানি সেনা বহরের সামনে দিয়ে দৌড়ে পালানোর মতো মারাত্মক ভুল টা করেছিল। ক্ষীণকায় ২৪ বছরের এক যুবক, তাগড়া জোয়ান সৈন্যদ্বারা পরিবেষ্টিত। মৃত্যু ভয়ে কাঁপছিল সে, কারণ হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে গুলি করা হবে।

“আমরা তাকে মেরেই ফেলতাম, যখন সে দৌড় দিয়েছিল”, G-2 অপঃ নবম ডিভিশন এর মেজর রাথোর গল্পচ্ছলে আমাকে জানাচ্ছিলেন; আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম কুমিল্লা থেকে ২০ কিমি দূরের মুদাফারগঞ্জ এর কাছের একটা ছোট্ট গ্রাম এর সীমানায়। “তোমার কারণেই আমরা ও কে তল্লাশি করছি। তুমি এখানে নতুন আর আমি দেখছি যে তুমি উদ্বিগ্ন।”

প্রবল উৎকণ্ঠার সাথে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মেরে ফেলা কেন তাকে?”
“কারণ সে হতে পারে একজন হিন্দু বা বিপ্লবী, হয়তো একজন ছাত্র বা আওয়ামী লীগার। তারা জানে আমরা এদেরকে খুঁজছি এবং তারা পালিয়ে বিশ্বাস ঘাতক হতে চায়।”
“কিন্তু কেন তুমি এদের মেরে ফেলছ? আর কেনই বা হিন্দুদের সনাক্ত করছ??”,আমি আবারো উদ্বেগ এর সাথে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“আমার তোমাকে মনে করায় দেয়া উচিত... তারা কিভাবে পাকিস্তান কে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা নিয়েছিল”, রাথোর আমাকে রাগান্বিত ভাবে বলছিলেন। “এখন যুদ্ধ এর কারণে আমরা এদেরকে শেষ করে দেয়ার সুযোগ পেয়েছি।”


রক্তের প্রথম দাগ..................

উষ্মার সাথে তিনি বলছিলেন, “আমরা শুধুমাত্র হিন্দু পুরুষদের এরই হত্যা করছি। আমরা সৈনিক, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ না। তারা আমাদের নারী এবং শিশুদের হত্যা করছে।”
আমি প্রথম রক্তের কালো দাগ এর আভাস পাচ্ছিলাম, যেটা পরবর্তীতে সমগ্র পূর্ব বাংলার সবুজ ভূমিতে ছড়িয়ে পরেছিল। প্রথমে এটা ছিল হত্যাযজ্ঞ অবাঙ্গালীদের দ্বারা বাঙ্গালিদের প্রতি হিংসার পাশবিকতায়। এখন এই হত্যাযজ্ঞ ইচ্ছাকৃত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা চালিত।

এই হত্যাযজ্ঞের শিকার শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠীর মাত্র ১০% হিন্দুরাই ছিল না, ছিল হাজার হাজার মুসলিম বাঙ্গালীও। এদের মধ্যে ছিল বিশ্ব বিদ্যালয়-কলেজ এর ছাত্র শিক্ষক, আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলের কর্মী; এবং ২৬ শে মার্চ স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করার অসফল স্বপ্নে শহীদ হওয়া ১৭৬০০০ বাঙালি সেনা ও পুলিশ সদস্য।

এপ্রিল এর শেষ দিকে পূর্ব বাংলায় আমার অবস্থানের ১০দিনে আমি আমার অবিশ্বাসী চোখে যা দেখেছিলাম বা কানে যা শুনেছিলাম তাতে এটা আমার কাছে খুব ভালো ভাবে প্রতীয়মান হয়েছিল যে এই হত্যাযজ্ঞে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর কমান্ডারাই একক ভাবে অংশগ্রহন করেছিল না। শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারাই পূর্ব বাংলায় এই হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল না।

২৫ শে মার্চ এর রাত এ, বাঙালি সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যারা পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত ছিল তারা পৈশাচিক পাশবিকতায় অবাঙ্গালীদের আক্রমণ এবং হত্যা করেছিল। হাজারখানেক অসহায় মুসলিম পরিবারকে ক্ষমাহীন ভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল, যারা অনেকেই ১৯৪৭এর দেশ ভাগের দাঙ্গার সময় বিহার থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। নারীদের কে ধর্ষণ অথবা তাদের স্তন কে বিশেষ ছুরি দ্বারা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল।

এই ভয়াবহতা থেকে শিশুরাও রেহাই পেয়েছিল না, ভাগ্যবান তারা ছিল যাদের কে তাদের বাবা-মা’র সাথেই হত্যা করা হয়েছিল। অন্য হাজারখানেক অভাগাদের ভাগ্যে ছিল ক্ষুপরে তুলে ফেলা চোখ এবং অঙ্গহানির মাধ্যমে অন্ধ-বিকলাঙ্গ বাকি জীবন।

২০,০০০ এর ও বেশি অবাঙ্গালী’র মৃতদেহ পাওায়া গেছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর এর মতো বড় শহর গুলো তে। সত্যিকার পরিসংখ্যান টা হয়তোবা ১,০০,০০০ যেটা আমাকে পূর্ব বাংলার সবখানেই বলা হয়েছিল। অসংখ্য অবাঙ্গালী’র কোন হদিস’ই ছিল না।


পাকিস্তান সরকার এই প্রথম ভয়াবহতাটার চিত্র টাই তুলে ধরেছিল সারা বিশ্ব এর কাছে। কিন্তু তারা এর পরের দ্বিতীয় এবং ভয়াবহতম, যখন তাদের সেনাবাহিনী হত্যা শুরু করল, এটা গোপন করছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা ব্যাক্তিগত ভাবে হিসাব করে দেখে যে, মহামারী ও অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়া দের বাদ দিয়ে ও উভয় পক্ষ ২,৫০,০০০ মানুষ কে হত্যা করেছে।

দেশ এর অর্ধেক এর ও বেশি মানুষের প্রাদেশিক বিভক্তির এই প্রায় সফল চেষ্টার জবাবে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সেনা সরকার তাদের নিজস্ব নিয়মে পূর্ব বাংলার এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছিল।

“আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার এই হুমকিকে চিরতরে নস্যাৎ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যদিও এর জন্য ২০ লক্ষ মানুষ কে হত্যা করতে হয় এবং এই প্রদেশকে একটা উপনিবেশ হিশেবে ৩০ বছর শাসন করতে হয়।”, ঢাকা ও কুমিল্লার ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা আমাকে এটা অনেকবার বলেছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা ঠিক এই কাজটাই করছে পূর্ব বাংলায় অত্যন্ত ভয়াবহতার সাথে।

চাঁদপুর থেকে ঘুরে আসার পর আমরা অস্তমিত সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছিলাম (পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা রাতের বেলা বাইরে বের হতো না পূর্ব বাংলায়), তখন Toyota Land Cruiser এর পেছনে বসে থাকা এক জওয়ান চিৎকার করে বলছিল, “সাহিব, একটা মানুষ দৌড়ায়!!”
মেজর রাথোর সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিলেন এবং একি সাথে দরজার দিকে তাক করা চীন এর তৈরি হাল্কা মেশিনগান হাতে নিয়েছিলেন। ২০০ গজ সামনে একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছিল হাঁটু সমান ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে বড় পদক্ষেপে দৌড়াচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই! গুলি কর না, সে নিরস্ত্র, সাধারণ একজন গ্রামবাসী”।রাথোর আমাকে কুৎসিত হাঁসি দিয়ে সতর্কীকরণ ফাঁকা গুলি করেছিল একটা।
মানুষটি যখন সবুজ গালিচার মাঝে হামাগুরি দিয়ে লুকানোর চেষ্টায় রত, ততক্ষনে দুই জওয়ান রউনা দিয়েছে তাকে ধরে নিয়ে আসার জন্য।

কাঁধ এর পেছনে রাইফেল বাঁট এর আঘাত এর সাথে প্রশ্নবান শুরু হয়েছিল...
~ “কৌন হ্যাঁয়?”
- “মাফ করবেন সাহিব! আমার নাম আব্দুল বারী। আমি ঢাকা নিউ মার্কেটের একজন দর্জি।”
~ “ঝুট নাহি বোলো, তুম হিন্দু হো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
- “কারফিউ এর সময় হয়ে আসছে, সাহিব! আমি আমার গ্রাম এর দিক এ যাচ্ছিলাম।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
এর উত্তর পাওয়ার আগেই তিনি এক জওয়ান কাছে থাকা অস্ত্র কেড়ে নিলেন এবং আরেক জন লোকটার লুঙ্গি টেনে খুলে ফেলে নিলেন। তার রুগ্ন নগ্ন শরীরটাতে মুসলিম দের অবশ্য করনীয় খৎনার পরিষ্কার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল।
অন্তত এইটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছিল যে, বারী হিন্দু ছিল না।
জবাবদিহি চলছিল...
~ “বোলো মেরেকো, কিউ ভাগ রাহা থা?”
বারী ভীত সন্ত্রস্ত চোখ নিয়ে ভয়ার্ত হয়ে কাঁপছিল, উত্তর দিতে পারছিল না। সে হাঁটু গেড়ে বসে পরেছিল। বারী কে টেনে তার পায়ের উপর দাড় করাতে করাতে এক জওয়ান বলছিল, “উসকো ফৌজি লাগ রাহি হে, স্যার” (‘ফৌজি’ একটা উর্দু শব্দ, যেটা বাঙালি বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে ঘৃণাভরে ব্যাবহার করা হতো)
“হতে পারে”, আমি রাথোর কে বলতে শুনছিলাম।
আব্দুল বারীকে রাইফেল এর বাঁট দিয়ে বার বার আঘাত করতে করতে তাকে একটা দেয়াল এর দিকে চাপানো হচ্ছিলো। তার ভয়ার্ত চিৎকার এর শব্দে অন্ধকারে একটা কুটির এর কোণা থেকে এক যুবক এর মাথা উকি দিচ্ছিল। বারী বাংলায় চিৎকার করে কিছু বলেছিল। উৎসুক মাথাটা হারিয়ে গিয়েছিল।
কিছুক্ষন পর একজন শ্মশ্রুমুণ্ডিত বৃদ্ধ কুটির থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রাথোর এবার তাকে ধরে বসলো।
~ “তুম ইয়ে আদমি কো জানতে হো?”
- “হ্যাঁ, সাহিব। সে আব্দুল বারী।”
~ “ওঃ ফৌজি হেয় কিয়া?”
- “না সাহিব, সে ঢাকা’র একজন দর্জি।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো।”
- “খোঁদার কসম সাহিব, সে একজন দর্জি”

কয়েক সেকেন্ড এর নিরবতা ছিল। রাথোর লজ্জা পেয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল, যখন আমি তাকে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই, তাকে যেতে দাও। এর পরও আর কি প্রমান দরকার তার নিষ্পাপতার?”
কিন্তু জওয়ানেরা তখনও খুশি ছিল না এবং তারা বারী’র চারপাশে ঘুরছিল। আমি যখন তার হয়ে আরেকবার বলেছিলাম তখনই মাত্র রাথোর তাকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এর মধ্যে সে আঘাতে ভয়ে কুঁকড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার জীবনটা রক্ষা পেয়েছিল।

অন্যরা এতো ভাগ্যবান ছিল না...
ছয় দিন ধরে কুমিল্লায় হেড কোয়ার্টার এ, ৯ম ডিভিশন এর অফিসার দের সাথে আমি যখন ঘুরেছিলাম তখন আমি হত্যা’র বিভিন্ন রুপ দেখছিলাম। আমি দেখেছিলাম হিন্দু দের গ্রাম থেকে গ্রামে, এক বাড়ি থেকে এক বাড়ি ঘুরে খুজে বের করতে। এবং “short-arm inspection” নামক এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন বের হতো যে তাদের খৎনা করানো নাই তখন তাদের কে হত্যা করা হতো।
কুমিল্লাতে সার্কিট হাউজের দেয়ালের ভিতর থেকে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলা পুরুষদের চিৎকার শুনতে পেতাম আমি। আমি ট্রাক ভর্তি অন্য ভাবে মৃত মানুষদের এবং এই মৃত দেহ গুলো কে অন্ধকারের মধ্যে কারফিউ এর মধ্যে মানবতার খাতিরে মানুষদের ট্রাকে বোঝাই করতে দেখেছি। আমি সাক্ষী হয়েছি সেনাদের “হত্যা ও আগুন লাগানোর” মিশন এর, বিপ্লবীদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা শহরে-গ্রামে এটা শুরু করতো।

আমি দেখেছি পুরা গ্রাম ধ্বংস করে ফেলতে শাস্তি স্বরূপ। আর আমি রাতে অফিসার দের মেস গুলো তে অবিশ্বাসীর মতো শুনতাম, বীরত্বগাথার মতো, সম্মানিত অফিসাররা গর্বের সাথে দিনের হত্যার গল্প করছে।
“কিতনা কাতাল কিয়া আজ?” উত্তর গুলো আমার স্মৃতিতে দাগ রেখে যেতো।
এরকম যখন ঘটছিলো, তখন যেকোনো পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার এর এই ব্যাপারে উত্তর ছিল এরকম যে, “এটা করা হচ্ছে পাকিস্তানের ঐক্য, সাম্যবাদ রক্ষা করার জন্য।” যদিও এটা এখন সুদূর পরাহত। হাজার মাইল এর ভারত দ্বারা বিভক্ত, একটা দেশ এর দুই অংশ কে একত্রিত রাখার এই সামরিক ব্যাবস্থা, বরং নীতিগত ভাবেই বিভক্তি কে অবশ্যম্ভাবী করছিলো।

পূর্ব বাংলা কে পাকিস্তানের সাথে শুধুমাত্র কঠোর সামরিক শাসন এর মাধ্যমেই রাখা যেতো। কিন্তু সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য ছিল পাঞ্জাবীদের, যারা প্রথাগত ভাবেই বাঙালিদের ঘৃণা এবং অপছন্দ করতো।

বিভক্তি এখন এতোটাই নিশ্চিত হয়ে গেছিল যে, স্ব-ইচ্ছায় খুব কম বাঙালিকেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে দেখা যেতো। এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল যখন আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে। আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার আগে সে বলছিল যে, “আমি দুঃখিত! সময় পালটে গেছে, তুমি ও L যেই পাকিস্তান কে জানতে, সেটার এখন আর তেমন না। আমাদের এটা কে ভুলা যাওয়া উচিৎ।”

কয়েক ঘণ্টা বাদে এক পাঞ্জাবী অফিসার আমাকে বলছিল, সেনা পাঠানোর আগে অ-বাঙ্গালীদের কিভাবে হত্যা করা হয়েছে; “১৯৪৭ এর দেশভাগ এর দাঙ্গার সময় শিখ রা আমাদের সাথে যেমন আচরন করেছিল, তার থেকেও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে তারা। আমরা কিভাবে এটা ভুলে যাবো বা মাফ করে দিবো।”

হিন্দু নিধন..................

নির্মম এই সামরিক অপারেশনের দুইটা বিশেষ দিক ছিল। প্রথমত, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তিগণ যেটাকে উল্লেখ করতো ‘শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া’ হিসেবে, যা ছিল গনহত্যার ইতিহাস বিকৃতি। এবং দ্বিতীয়ত, ‘পুনঃ একত্রীকরণের চেষ্টা’।
পূর্ব বাংলা কে পশ্চিম পাকিস্তানের বশীভূত উপনেবিশ বানানোর এই প্রয়াস কে এইভাবেই ব্যাখ্যা করা হতো। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া এবং ‘দুষ্কৃতকারী’ ‘বিশ্বাসঘাতক’ এর মতো শব্দগুলোকে সমানে উপস্থাপন করা হতো বিশ্বের কাছে। দেশভাগের এই মতবাদ কে নিঃশেষ করা, ঔপনিবেশিকরণ এবং হত্যাই ছিল আসলে ব্যাস্তবতা।

হিন্দু নিধন এর প্রক্রিয়াটাকে বৈধকরণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রধান, লেঃ জেঃ টিক্কা খান বেতার ভাষণে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেটা আমি শুনেছিলাম ১৮ এপ্রিল। তিনি বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমরা, যারা পাকিস্তান তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তারা এটাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের এই দাবীকে দমিয়ে রাখা হয়েছে, কিছু সংখ্যক হিংস্র আক্রমণাত্মক লোকের বল প্রয়োগ, জীবন ও সম্পত্তির প্রতি হুমকি প্রদানের মাধ্যমে। যেটা আওয়ামী লীগ কে ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বনের দিকে ধাবিত করেছে।”

অন্য আরও অনেকে এই বৈধকরণের এর ব্যাপারে আরও খোলাখুলি ভাবেই বলত।
কুমিল্লাতে অফিসারস মেস এ ৯ম ডিভিশন হেড কোয়ার্টার এর কর্নেল নাইম আমাকে বলেছিলেন, “হিন্দুরা তাদের টাকা দিয়ে মুসলিম জনতা কে দমন করে রেখেছে। তারা রাষ্ট্রটাকে রক্তশূন্য করে ফেলেছে; বর্ডার এ ইন্ডিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে খাবার আর টাকা দিয়ে। শিক্ষক শ্রেণীতে তারাই বিরাজ করছে আর তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য কলকাতা পাঠায়। এটা এমন এক অবস্থায় পৌছেছে যে, বাঙালি সংস্কৃতি আসলে হিন্দু সংস্কৃতি; আর পূর্ব পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত হয় কলকাতার মাড়ওয়ারি ব্যাবসায়ি দ্বারা। আমাদের এইসব ঠিক করে এই রাষ্ট্রকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে আর তাদের বিশ্বাস কেও।”

অথবা মেজর বশির এর কথা বলা যায়। সে পদবীধারী একজন ছিলেন। সে ছিলেন ৯ম ডিভিশন এর SSO কুমিল্লা তে। তিনি নিজে ২৮ জন কে হত্যা করেছিলেন এবং গর্ব করতেন এইটা নিয়ে। যা ঘটেছিলো তার ব্যাপারে তার নিজের একটা ব্যাখ্যা ছিল।
“এই যুদ্ধ হচ্ছে খাঁটি আর ভেজাল এর মধ্যে”, এক কাপ ভেষজ চা খেতে খেতে তিনি আমাকে বলছিলেন। “এখানকার মানুষদের মুসলিম নাম আছে এবং তারা তাদের মুসলিম বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু অন্তরে তারা হিন্দু। আপনি বিশ্বাস করবেন না, জুম্মার নামাজে ক্যান্টনমেন্ট মসজিদ এর মৌলবি ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী হত্যা করলে সে জান্নাতে যাবে। আমরা ঐ বেজন্মা টা কে শিক্ষা দিয়েছি আর অন্যদেরও খুঁজছি। বাকি যারা থাকবে তারাই শুদ্ধ মুসলমান। আমরা তাদেরকে উর্দুও শেখাবো।”

সবখানে আমি অফিসার ও অন্যদের দেখেছিলাম, নিজেদের কে ভালো করার জন্য নানা ভাবে নিজেদের কে অলঙ্কৃত করতে তাদের এই খারাপ কাজ কে ঢাকতে। আইনসিদ্ধ করার জন্য মিথ্যার বেসাতি করতো। যদিও তারা জানে যে, তারা ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে একটা রাজনৈতিক সমস্যা কে মোকাবেলা করতে, যেটা ছিল বাঙালি রা নির্বাচন এ জিতেছে আর তার শাসন করতে চায়।
পাঞ্জাবীরা... ১৯৪৭ এ পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে, সরকার কে নিয়ন্ত্রন করতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তারা তাদের ক্ষমতার কোন বিলোপ দেখতে চায় নি। সেনাবাহিনী তাদেরকে সহায়তা করেছিলো।

অফিসার রা ব্যাক্তিগত ভাবে বিশ্লেষণ করতো যে যা করা হয়েছিল তা সেনাবাহিনী নামার আগে অ-বাঙ্গালী হত্যার প্রতিকার স্বরূপ। কিন্তু বাস্তবিকে এই প্রতিকার ব্যাবস্থা অনিয়ন্ত্রিত অথবা হঠাত ঘটে যাওয়া কিছু ছিল না। এটা পরিকল্পিত ছিল।


জেনারেল টিক্কা খান ক্ষমতা নিলেন....................................

এটা পরিষ্কার ছিল যে এই “শুদ্ধিকরণ” শুরু হয়েছিল ঠিক যে সময় জেনারাল টিক্কা খান পূর্ব বাংলার ক্ষমতা নিলেন ভদ্র, আত্মস্থ অ্যাডমিরাল আহসান এর কাছ থেকে এবং সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রন বিচক্ষন লেঃ জেঃ সাহিবজাদা খান এর কাছ থেকে, তখনই।

সময়কালটা ছিল মার্চ এর প্রথম দিকে। বাঙ্গালিরা যেটা থেকে আশা করেছিলো অনেক সেই সংসদ অধিবেশন বাতিল হওয়ার পর শেখ মুজিব এর প্রশাসনিক অবাধ্যতার আন্দোলন বেগ পাচ্ছিল। (......)

ঢাকা’র পূর্বাঞ্চলীয় পাঞ্জাব কমান্ড কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারণে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। [এখানে উল্লেখ্য যে, খান এরা দায়ী ছিল না এই সময় কাল এ; খান পাকিস্তান এ প্রচলিত সাধারণভাবে অনেকের’ই নাম এর শেষাংশ] ২৫শে মার্চ এর সন্ধ্যায় ঢাকাতে যখন সেনাবাহিনী নামছিল পরের দিন সকালে বিদ্রোহ দমনের নামে আক্রমন করার জন্য তখন তাদের অনেকের কাছেই তালিকা ছিল যে কাদেরকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে।

এ তালিকা তে ছিলেন হিন্দুরা, মুসলিমদের একটা বড় অংশ; ছাত্র, আওয়ামী লিগার, অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং শেখ মুজিব এর আন্দলনের উল্লেখযোগ্য অনেকেই। এইটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছিলো যে, সেনাবাহিনী জগন্নাথ হল এর দিক থেকে মর্টার হামলা করবে, যেখানে হিন্দু ছাত্ররা থাকতো। দুইটা হিন্দু কলোনি যা রমনা রেসকোর্স এর মন্দির কে আবর্তিত করে ছিল এবং তৃতীয়টি পুরনো ঢাকার প্রাণ কেন্দ্র শাঁখারীপট্টি, এগুলোকে কে ধ্বংস করে দেয়াটাই উদ্দেশ্য ছিল এই হামলার। যার কোন যোক্তীকতা ছিল না।

এবং এরও কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না যে, ২৬-২৭ মার্চ এর দিবা-রাত্রির কারফিউ এর ভিতরে কিভাবে ঢাকা এর একটা বড় অংশ, ও পাশের শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জ এর হিন্দু জনগোষ্ঠী উধাও হয়ে যাবে। একইভাবে, মুসুলমান হত্যার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না যারাও কারফিউ এর ভিতরে ঘোরাঘুরি করেছিলো। পরিকল্পিত এই অভিযান থেকে এই মানুষ গুলো কে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং শুধুমাত্র হিন্দুদের ওপরই এই ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছিল।

১৫ এপ্রিল ঢাকা তে ঘোরার সময়, ইকবাল হল ছাত্রাবাস এর ছাঁদ এ আমি ৪ জন ছাত্রের পচিত-গলিত ছিন্ন মস্তক দেখেছিলাম। কেয়ারটেকার জানিয়েছিল যে তাদের কে ২৫ মার্চ রাত এ হত্যা করা হয়েছিল। দুই সিঁড়িতে ও চারটা ঘরে আমি রক্তের গাঢ় দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। ইকবাল হলের পেছনে এক আবাসিক বাড়ি কে সেনাবাহিনী তস-নস করে দিয়েছিল।

দেয়াল গুলোতে বুলেট এর অসংখ্য গর্ত এবং একটা পচা গন্ধ সিঁড়িঘর থেকে ভেসে আসছিলো যদিও খুব ভালভাবে ডি, ডি, টি পাউডার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রতিবেশিরা বলছিল, এক ঘণ্টা আগেই ২৩ জন নারী ও শিশু এর লাশ কে সরানো হয়েছে এখান থেকে। ২৫ মার্চ রাত থেকে ছাঁদ এ লাশগুলো পড়ে থেকে পচন ধরা শুরু হয়েছিল। অনেক বার প্রশ্ন করার পর আমি বের করতে পেরেছিলাম যে এরা সবাই আশেপাশের হিন্দু বস্তি এর বাসিন্দা ছিল। সেনা যখন নামা শুরু হয়েছিল রাস্তায়, তখন তারা এই বিল্ডিং এ আশ্রয় এর আশায় একসাথে ছিল।

এটাই গনহত্যা, যা করা হয়েছিল খুব সাধারণ ভাবে নিপুনতার সাথে।

১৯ এপ্রিল সকালে, কুমিল্লা শহরের Martial Law Administrator মেজর আঘা এর অফিস এ বসে থেকে আমি দেখছিলাম, অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে শাস্তি গুলো নির্ধারণ করার আদেশ দেয়া হচ্ছিলো। পুলিশ এর একজন বিহারি সাব-ইন্সপেকটার, পুলিশ এর কাছে আটককৃত আসামীদের একটা তালিকা তাকে দেয়ার পর, পেন্সিল এর কয়েক খোঁচায় উনি তালিকায় থাকা চার জনের নামে টিক দিলেন।
“এই চার জন কে সন্ধ্যায় আমার কাছে নিয়ে এসো”, তিনি বলেছিলেন। আবারো তিনি তালিকায় দিয়ে তাকিয়ে আরেকবার একটা টিক দিলেন পেন্সিল দিয়ে বললেন, “......এই চোর টা কেও এদের সাথে নিয়ে আসবে”।



মৃত্যুদণ্ড: ঠাণ্ডা পানীয় পান করতে করতে ..................................

এক গ্লাস ডাব এর পানি পান করতে করতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছিলো। আমাকে জানানো হয়েছিলো যে, আসামীদের মধ্যে দুই জন ছিলেন হিন্দু, তৃতীয় জন ছাত্র এবং চতুর্থ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন সংগঠক। চোর হিসেবে যা কে সম্বোধন করা হচ্ছিলো, সে ছিল সেবাস্তিয়ান নাম এ একজন, যাকে ধরা হয়েছিলো সে যখন তার এক হিন্দু বন্ধুর ঘরের জিনিশপত্র নিজের ঘরে সরাচ্ছিল।

পরবর্তীতে সন্ধ্যায় আমি এই মানুষ গুলো কে দেখেছিলাম, তাদের হাত ও পা হাল্কা করে দড়ি দিয়ে বাধা ছিল, সার্কিট হাউজ এর দেয়াল এর পাশের রাস্তায় পড়ে ছিল তারা। কারফিউ শেষ হওয়ার ঠিক পরেই ৬ টা এর দিকে, তাদের হাড্ডি ও মাংসের উপর পড়তে থাকা কাঠের মুগুরের মতো লাঠির আঘাতের শব্দের আর্তনাদ এক ঝাঁক উড়ে যাওয়া ময়না পাখীদের শব্দ গুলো কে মিলিয়ে দিচ্ছিল।

বালুচ রেজিমেন্ট এর ক্যাপ্টেন আজমত এর ব্যাপারে দুইটা ঠাট্টা প্রচলিত ছিল। একটা ছিল এর মধ্যে ৯ম ডিভিশন এর commanding officer মেজর জেনারেল শউকত রেজা এর ADC হিসেবে তার চাকরি, এবং অপরটা হচ্ছে তার উপর চাপানো তার সহকর্মীদের নানাবিধ খারাপ আচরন।

এটা বলা হতো যে আজমত ছিলেন ঐ দলের একমাত্র অফিসার যিনি এখনো কোন “হত্যা” করেননি। মেজর বাশির নির্দয়তার সাথে বলছিলেন।

“আসো আজমাত”, এক রাতে বাশির বলছিলেন, “আমরা তোমাকে পুরুষ করে তুলবো। কাল আমরা দেখব যে তুমি কিভাবে ওদের ভাগাও, এটা খুবই সহজ”।
বিষয়টা বোঝানোর জন্য বাশির তার এক লম্বা চওড়া ভাষণ দিয়ে দিলেন। SSOহিসেবে দায়িত্ব ছাড়াও বশির ছিলেন অফিসার (শিক্ষা) প্রধান কার্যালয়ে। তিনি ছিলেন একমাত্র পাঞ্জাবী অফিসার যাকে আমি দেখেছিলাম গড় গড় করে বাংলা বলতে পারতেন।

বশির এর সাথে সেইদিন সকালে একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক তার ভাই যে কিনা কুমিল্লা আওয়ামী লীগ এর একজন সংগঠক, তার ব্যাপার এ খোঁজ করতে এসেছিলেন। যা কে কয়েক দিন আগে সেনাবাহিনী চিরুনি অভিজানের সময় ধরেছিল বলে আশঙ্কা করছিলেন ভদ্রলোক। “ধড় গ্যায়া” বশির তাকে জানিয়েছিলেন যে, সে পালিয়ে গেছে। বৃদ্ধ লোকটা বুঝতে পারছিলেন না যে তার ভাই ভাঙ্গা পা নিয়ে কিভাবে পালিয়ে গেল। আমারও বোধগম্য হচ্ছিলো না বিষয়টা। বশির তখন আমাকে এই “ধড় গ্যায়া” এর বিষয় টা পরিষ্কার করলেন যে, রেকর্ড এ দেখানো হবে যে, পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
আমি পরে আর জানতে পারিনি যে, ক্যাপ্টেন আজমত কাওকে হত্যা করতে পেরেছিলেন কিনা...

বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা যারা ফেনী তে ঢুকেছিল, তারা ব্রিজ ও culvert ধ্বংস করে, ৯ম ডিভিশন কে চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিমি দূরে কুমিল্লা মহাসড়কে আটকিয়ে রেখেছিলো। ঢাকা এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে জেনারেল রেজা কে চাপ এ রেখেছিলেন দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে যেতে না পারে ঐ পথে। আবার উত্তরের সাথে যোগাযোগের এই পথ টা খোলা রাখাও জরুরি ছিল এই কারণে যে, অতীব প্রয়োজনীয় মালামাল গুলো চট্টগ্রাম বন্দর এ এসে জমা হচ্ছিলো।

এসব কারণে জেনারেল রেজা স্বভাবতই বিরক্ত ছিলেন অনেক। তিনি ঐ এলাকায় প্রায় প্রতিদিন বিচরন করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ফেনী তে ঘাঁটি করা ব্রিগেড কে নির্দেশাবলী দিতেন। ক্যাপ্টেন আজমত একইভাবে জেনারেল এর ছায়া হিসেবেই ছিলেন। আমি তাকেয়ার কখনোই দেখিনি।

মে মাসের ৮ তারিখে ৯ম ডিভিশন ফেনী ও তার আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার করতে পেরেছিল। গোলাগুলি আর বোমাবাজির ভিতরেই বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাশের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এইরকম বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এইসব বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের পালিয়ে যাওয়া ৯ম ডিভিশন এর G-1, কর্নেল আসলাম বেগ এর কাছে চরম আশংকার আর বিরক্তের।
তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন, “ভারতীয়রা তাদেরকে অবশ্যই ঐখানে থাকতে দেবে না। এটা ভারতের জন্য বিপদজনক হবে। তারা শুধু সীমান্তের ঐ পাড়েই থেকে এইদিক এ ঢোকার চেষ্টা চালায় যেতে থাকবে। যদি না আমরা তাদের হত্যা করি, তাহলে দীর্ঘ সময় ধরে আমরা বিপদের মাঝে থাকব”।

লে, কর্নেল বেগ ছিলেন একজন জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার, যিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর চীন এ বিশেষ প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন। এইটা ছিল সেই সময় যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী চীন এর তৈরি অস্ত্রশস্ত্রে পরিবর্তিত হচ্ছিলো। তাকে বলা হতো একজন গর্বিত পারিবারিক মানুষ হিসেবে। তিনি আবার তোষামোদকারীদের ও পছন্দ করতেন। তিনি গর্বের সাথে আমাকে জানিয়েছিলেন যে হেডকোয়ার্টার এর বিপরিত দিকের পুকুরে ফুটে থাকা বড় বড় Scarlet জলপদ্ম গুলোকে তিনিই নিয়ে এসেছিলেন চীন থেকে। মেজর বশির তাকে ভালোবাসতেন। একজন অফিসারের গোপনীয়তা বজায় রাখার রীতি কে ভঙ্গ করে মেজর বশির আমাকে বলছিলেন, একবার তারা এক মুক্তিযোদ্ধা কে ধরেছিলেন, তাকে নিয়ে কি করা হবে এটা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিলো।

যখন সবাই নানা জায়গায় ফোন করে কি করা যায় সেই ব্যাপার এ ব্যাস্ত ছিলেন, তখন তিনিই বিষয়টা সমাধান করেছিলেন। “ধড় গ্যায়া”। গর্তের ভিতর থেকে শুধু মানুষটার পা বাইরে বেরিয়ে ছিল।

এপ্রিল এর শেষে আমি যখন কুমিল্লা গিয়েছিলাম, তখন কুমিল্লাতে ফুটে থাকা অসাধারণ সব প্রাকৃতিক শোভা এর ভিতরে এইরকম বীভৎসতা কল্পনা করাটা কষ্টকর ছিল আসলে। বিপুল সবুজ গালিচার মতো দূরের সীমানা পর্যন্ত বিছিয়ে থাকা রাস্তার দুই পাশের সবুজ ধানখেত গুলোর সৌন্দর্য গুলো গাঢ় লাল এর ছোপ ছোপ দাগ এ ভরে গিয়েছিল। এটাকে মনে হতো গোল মোহর এর মত,ভাল ভাষায় বললে বলা যায়, “অরণ্যের দাবানল” যেইটা পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্ফুটিত হচ্ছিলো। গ্রামের আম ও নারিকেলের গাছ গুলো ফল এ ভরে গিয়েছিল। তেরিয়ার জাতের কুকুরের সমান মাপের ছাগলের পথে ঘাটে বিচরন আসলে বাংলার প্রাকৃতিক প্রাচুর্যতাই প্রকাশ করতো। তারা মাকে শিখিয়েছিল যে, তুমি শুধু একভাবেই এগুলোর মধ্যে ছেলে-মেয়ে আলাদা করতে পারবে, আর তা হোল সব মাদী ছাগল গুলোর পেট এ বাচ্চা।

আগুন লাগান আর হত্যা ছিল তাদের প্রতিশোধের প্রতিরূপ.................................

বিশ্বের ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা গুলোর মধ্যে একটা, কুমিল্লা শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গ মাইলে ১৯০০ জন। যেখানে একমাত্র মানুষেরই দেখা মিলতো না।
কয়েক দিন আগে ঢাকাতে আমার সাথে থাকা রক্ষীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সব বাঙ্গালিরা কোথায়”? সে চাতুর্যের সাথে উত্তর দিয়েছিলো যে সবাই গ্রামের দিকে চলে গেছে।

এখন এই গ্রামাঞ্চলেও কোন বাঙালি ছিল না। কুমিল্লা শহরও ঢাকার মতো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। লাকসাম এ যাওয়ার রাস্তায় নীরব সব গ্রাম পার হয়েছিলাম, এবং মাইল দশের ভিতর বিচরন করা গ্রামবাসি কে দুই হাতের আঙ্গুলে গোনা যাবে।
কিন্তু সেনা দেখা যেতো, শ’য়ে শ’য়ে গম্ভীর মুখাবয়বের খাকি পোশাক পরিহিত, যাদের প্রত্যেকের সাথে একটা করে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। যেভাবে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাতে তারা রাইফেল গুলো তারা কখনোই হাত ছাড়া করতো না। রাস্তা গুলো সব সময় রুঢ়, যখন তখন গুলি করে দেয়ার মতো সেনাদের দ্বারা পাহারা দেয়া হতো। যেখানেই সেনাবাহিনী ছিল, সেখানেই কোন বাঙালি ছিল না।

সামরিক আদেশে, রেডিও ও সংবাদপত্রে সারাক্ষন গোপন ষড়যন্ত্রকারীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হতো যদি তারা ধরা পরে। যদি কোন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা বা ব্রিজ ধ্বংস অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে তার চারপাশের ১০গজের মধ্যে অঞ্চল গুলোর বাড়ি গুলো কে ধ্বংস করা হতো আর সেখানে থাকা মানুষ গুলোকে হত্যা করা হতো।

বাস্তবিকই অবস্থা আরও ভয়াবহ ছিল যা কোন ভাষায়ই বর্ণনা করা সম্ভব না। এইরকম ভয়াবহতায় বাঙ্গালিদের ভীত করে দিয়েছিলো।

এর একটা উধাহরন পাওয়া গিয়েছিল, যখন আমরা হাজিগঞ্জ এ যাচ্ছিলাম রাস্তা দিয়ে যেটা চাঁদপুরের সাথে মিলেছিল। ১৭ এপ্রিলের সকালে। কয়েক মাইল আগে হাজিগঞ্জ এর, একটা ১৫ ফুট লম্বা ব্রিজ কে আগের রাত এ মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করেছিলো, যারা তখনও হয়তো ঐ অঞ্চলেই ছিল।

মেজর রাথর তখনই একদল সেনাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শাস্তিযোগ্য ব্যাবস্থা নিতে। লম্বা লম্বা ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গিয়েছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া ব্রিজ এর আশেপাশের পৌনে এক মাইল জায়গা জুড়ে সব দিক থেকে। আমরা সতর্কতার সাথে বিছানো কাঠের উপর দিয়ে পার হয়েছিলাম, যা তৎক্ষণাৎ মেরামত করে ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম ডান দিকের গ্রামের বাড়ীগুলো তে আগুন জলতে শুরু করেছে। গ্রামের শেষে জওয়ান’রা নারিকেল এর ছোবড়া ব্যাবহার করে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিল। যা ছিল খুবই দাহ্য এবং তা রান্নার কাজে ব্যাবহার করা হতো।

গ্রামের প্রবেশ মুখে নারিকেল গাছের ফাঁকে হাত পা ছড়িয়ে পরে থাকা একটা দেহ দেখতে পেয়েছিলাম। রাস্তার অন্যপাশের গ্রামের ধান এর ক্ষেত এ আগুনের ছাপ দেখা যাচ্ছিল। অসংখ্য বাঁশ ঝাড়, মাটির ঘর পুড়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী আসার আগে শয়ে শয়ে গ্রামবাসী পালিয়ে গিয়েছিল আর যারা পালাতে পারে নি তাদের অবস্থা হয়েছিলো নারিকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে পরে থাকা দেহগুলোর মতো।

গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে মেজর রাথর আমাকে বলছিলেন যে, এসবের জন্য এরাই দায়ী। আমি তাকে বলেছিলাম, অল্প সংখ্যক বিপ্লবীর ঘটানো এ কাজের জন্য নিরীহ মানুষের প্রতি এইভাবে প্রতিশোধ নেয়াটা আসলে ভয়াবহ। তিনি কোন উত্তর করেননি এর।

কয়েক ঘণ্টা পর চাঁদপুর থেকে আসার পথে আমরা যখন আবার হাজিগঞ্জ দিয়ে পার হচ্ছিলাম, আমি আমার এই “হত্যা আর পোড়ানোর” বীভৎসতার প্রথম চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।

সেদিন বিকেলে হয়ে যাওয়া উষ্ণমণ্ডলীয় ঝড়ের পরবর্তী অবস্থার ভিতরে ছিলাম আমরা তখনও। ঘন মেঘ শহরের আকাশ চিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদ গুলোর গায়ে অদ্ভুত সব অবয়ব তৈরি করে রেখেছিলো।

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ক্যাপ্টেন আজহার ও আমাদের পেছনে পাহারায় খোলা জীপ এ বসে থাকা ৪ জন জওয়ানের উর্দি গুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
আমরা যখন একটা বাক পার হলাম তখন দেখতে পেলাম মসজিদ এর বাইরে দাড় করিয়ে রাখা ট্রাক এর এক বহর। আমি গুনে দেখলাম, মোট ৭ টা ট্রাক। সব গুলো সেনাবাহিনীর যুদ্ধকালীন পোশাক পরা জওয়ান এ ভরা। ট্রাক এর সারির প্রথমে একটা জীপ দাঁড়ানো। রাস্তার অন্যপাশে দুই জন মানুষ আরেকজনের নেত্রীতে রাস্তার পাশের শ’খানেক দোকান ঘরের একটার দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। মেজর রাথর যখন তার টয়োটা জীপ’টা দাড় করলেন ঐখানে ততক্ষনে কড়ি কাঠের দরজাটা ঐ দুইজনের সম্মিলিত চেষ্টায় হাল ছেড়ে ভেঙে যাওয়া শুরু করেছে।

“কোন অকাজ করছ তোমরা?”, মেজর রাথর চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন। তার উত্তরে তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচা লোকটি জবাব দিল, “মোটা”, “তোমার কি ধারণা, আমরা কোন অকাজটা করতে পারি?”

কণ্ঠস্বর টা চিনতে পেরে রাথর তার মুখে একটা বিস্তারিত হাঁসি ফুটিয়ে তুললেন। এবং আমাকে জানালেন, “ইফতি”, 12th frontier force এর মেজর ইফতিখার।

রাথর: “আমি ভেবেছিলাম কেউ হয়তো লুটপাট করছে”।
ইফতিখার: “লুটপাট? না, আমরা হত্যা আর আগুন লাগানোর কাজ এ নিয়োজিত”। হাতের ইশারায় ইফতিখার দোকান ভাঙার কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।

রাথর: “কতজনকে পেয়েছিলে?” ইফতিখার মৃদু হাঁসি দিলেন।
রাথর: “আহা! বলে ফেলো, কতজনকে পেয়েছিলে?”
ইফতিখার: “মাত্র ১২ জন। এবং খোঁদার রহমত এ আমরা সৌভাগ্যবান ছিলাম যে তাদেরকে পেয়েছি। আমরা এই ১২ জনকেও পেতাম না, যদিনা আমি আমার মানুষদের পেছন দিক দিয়ে না পাঠাতাম”।

মেজর রাথর এর কাছ থেকে বাহবা পেয়ে তখন ইফতিখার বিস্তারিত বলা শুরু করলেন যে, কিভাবে তিনি হাজিগঞ্জ এ অনেক খোঁজাখুঁজির পর শহরের শেষ প্রান্তে এক বাড়িতে পালিয়ে থাকা এই ১২ জন হিন্দু কে পেয়েছিলেন। তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিলো। এখন মেজর ইফতিখার তাদের মিশনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ছিলেন, “আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া”।

এর মধ্যে দোকান এর দরজা খুলে গেছিলো। দোকানের ভিতরে আমরা দেখতে পেলাম এমন সব জিনিস যা এ অঞ্চলে “ঔষধ ও মনহরি” দোকানের আওতায় পরে। বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড এ নিচে ইংরেজি তে লেখা “Ashok Medical & Stores”। তার নিচে রং দিয়ে লেখা “প্রফে. এ এম বোশ”। হাজিগঞ্জ এর অন্যান্য মানুষদের মতো জনাব বোশ ও দোকান বন্ধ করে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

দোকানের সামনের কাঠের শেলফ এ সাজানো ছিল কিছু ওষুধ, কাশির সিরাপ, কয়েক বোতল আমের জুস, অণুবর্তিত অলঙ্কার, সুতি সুতার বান্ডিল ও ইলাস্টিক। ইফতিখার শেলফের গায়ে লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন। পাতলা কাঠ দিয়ে তৈরি শেলফ টা ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেল। এরপর তিনি একটা শেলফ থেকে কিছু পাঁটের তৈরি ব্যাগ আরেকটা থেকে কিছু খেলনা তুলে নিলেন। আরেকটা তাক থেকে এক বান্ডিল রুমাল ও এক রোল লাল কাপড়। সব মেঝেতে অন্য সব জিনিসের সাথে ছুড়ে ফেলে দিলেন।

ইফতিখার এইসব একসাথে করে আমাদের টয়োটাতে বসে থাকা এক জওয়ান এর কাছ থেকে এক বাক্স ম্যাচ চেয়ে নিলেন। জওয়ান এর নিজের একটা ইচ্ছা জেগে উঠেছিলো। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে সে দোকানের ছাদের সাথে ঝুলতে থাকা একটা ছাতা পেরে নিচ্ছিলেন। ইফতিখার তাকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কঠোর ভাবে মনে করিয়ে দিলেন যে, লুট-তরাজ কোন নির্দেশ নাই, করা যাবে না।

ইফতিখার আগুন লাগিয়ে দিলেন খুব তাড়াতাড়ি। জ্বলতে থাকা পাঁটের ব্যাগ গুলোকে দোকানের একদিকে ছুড়ে দিলেন আর লাল কাপড়ের রোল গুলোকে আরেক দিকে। দোকানটা দাউ দাউ করে জ্বলা শুরু করে দিল। কয়েক মিনিটের ভেতরে আগুন যখন ছড়িয়ে পড়লো তখন বন্ধ দরজার ভেতর থেকেও আগুনে জিনিশপত্র পোড়ার শব্দ আমাদের কানে আসতে শুরু করলো। এইভাবে আগুনের লেলিহান শিখা বাম এর দিক দোকানে ছড়িয়ে পরবর্তী দোকান গুলো কেও গ্রাস করে নিল।

এরমধ্যে রাথর অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করায় চিন্তিত হয়ে পরেছিলেন। সেকারনে আবার আমরা ঐখান থেকে চলতে শুরু করেছিলাম। পরের দিন যখন আমার মেজর ইফতিখারের সাথে দেখা হয়েছিলো, তখন তিনি আমাকে বলছিলেন যে, “আমি মাত্র ৬০ টা বাড়িতে আগুন লাগাতে পেরেছিলাম। বৃষ্টি যদি না থাকতো, তাহলে রক্তের স্তুপ বানায় দিতাম”।

মুদাফফরগঞ্জ থেকে কয়েক মাইল দূরে এক গ্রাম এ যাওয়ার সময়, মাটির দেয়ালের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকা একজন মানুষ কে দেখে আমরা থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। এক জওয়ান সতর্ক করছিলো যে হতে পারে এটা বন্দুকধারী ফৌজি। কিন্তু ভালো ভাবে দেখার পর বোঝা গেল যে, আসলে একজন সুন্দরী হিন্দু বালিকা। সে সেখানে তাকে ছেড়ে যাওয়া মানুষদের একাকীত্ব নিয়ে বসে ছিল এবং সৃষ্টিকর্তা জানেন কিসের জন্য সে অপেক্ষা করছিলো ঐখানে।

একজন জওয়ান ১০ বছর ধরে East Pakistan Rifles এ আছেন এবং সে কাজ চলার মতো বাংলা বলতে পারতো। তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো মেয়েটিকে গ্রামের দিক চলে যেতে বলার জন্য। তার উত্তরে মেয়েটি কিছু বলেছিল, কিন্তু সে যেখানে ছিল সেখানেই বসে থাকলো। তাকে দ্বিতীয়বারের মতো চলে যেতে বলা হোল। আমরা যখন ঐ স্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম তখনও মেয়েটিকে আগের জায়গাতেই বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল। আমাকে জানানো হোল যে, “তার আসলে যাওয়ার কোন জায়গা নেই, নেই কোন প্রিয়জন, না কোন ঘর ফিরে যাওয়ার”।

হত্যা করা ও আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার অভিজানের একজন অফিসার মেজর ইফতিখার। সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা ঢুকতেন ঐসব এলাকাতে হিন্দু ও নাশকতাকারীদের (অফিসিয়ালি মুক্তিযোদ্ধাদের এই নামেই দাকা হতো) ইচ্ছামত হত্যা করার এখতিয়ার নিয়ে ও সেনাবাহিনী যেইসব জায়গা তে হামলা চালিয়েছিল সেসব একবারে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য।

এক একজন মানুষ মারতে তিনটা গুলি.............................................

এই লম্বু পাঞ্জাবী অফিসার তার কাজ সম্বন্ধে আলাপ করতে ভালবাসতেন। কুমিল্লা সার্কিট হাউজ এ যেতে যেতে ইফতিখার আরেকদিনের বীভৎসতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন আমাকে।

“আমরা এক বৃদ্ধ কে পেয়েছিলাম”, তিনি আমাকে বলছিলেন। “জারজ টা মুখে দাড়ি রেখে ঈমানদার মুসলমান সেজেছিল ও একটা মুসলিম নাম ও নিয়েছিল, আব্দুল মান্নান। কিন্তু আমরা তাকে ডাক্তার দের মতো অনুসন্ধান করে তার মুখোশ খুলে দিয়েছিলাম”। ইফতিখার বলে যাচ্ছিলেন, “আমি তাকে তখনই ঐখানে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার সাথে থাকা মানুষেরা অন্য প্রস্তাব দিল, এইরকম একটা জারজ কে মারার জন্য তিনটা গুলি দরকার। তখন আমি তার অণ্ডকোষে একটা গুলি, একটা পেটে আর শেষটা সরাসরি মাথায় করে হত্যা করি তাকে”।

যখন আমি তাকে ছেড়ে আসছিলাম তখন মেজর ইফতিখার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর দিকে রওয়ানা করছিলেন তার আরেক “হত্যা-আগুন লাগানো” অভিজানে। এই অভিজানের বিপরীতে বাঙ্গালিদের কাছে দুইটাই সুযোগ ছিল। যারা পালিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারতো আর যারা পালাতে না পারতো, তারা অধিনস্ত চাকরের মতো তাদের জীবন ভিক্ষা এর ব্যাপারে যেরকম আরজি জানাতো তা তাদের বেঁচে থাকার আকুতিটাকে আরও হাস্যকর করে তুলতো।

চাঁদপুর এ এরকম প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।
অতীতে মেঘনা নদীর ধারের এই গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর তা এখানে গড়ে ওঠা পুরুষ কেন্দ্রিক ব্যাবসা কেন্দ্র গুলোর জন্য বিখ্যাত ছিল। নদীর ধার দিয়ে বেধে রাখা হাজার হাজার ছোট নৌকা গুলোকে দেখে দূর থেকে মনে হতো কোন এক আলোর স্বপ্নপুরী। ১৮ এপ্রিল চাঁদপুর জনমানব শূন্য হয়ে গেছিলো। কোন মানুষ ছিল না, না ছিল কোন নৌকা। বড়জোর পুরা জনবসতির শতকরা ১জন হয়তো ছিল। বাকিরা, বিশেষ করে হিন্দুরা যারাই আসলে ঐখানকার জনবসতির অর্ধেক অংশ ছিল, পালিয়ে গিয়েছিল।

অদ্ভুতভাবে তারা তাদের বাড়িতে, দোকানে, বাড়ির ছাদে হাজার হাজার পাকিস্তানী পতাকা ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিলো মানুষ ছাড়া কোন জাতীয় দিন এর উদযাপন চলছে এখানে। এটা এখানকার মানুষহীন নির্জনতাটাকেই আরও বড় করে প্রকাশ করছিলো। পতাকা গুলোই সেটাকে প্রকাশিত করে তুলছিলো।

কোনভাবে এইরকম কথা প্রচলিত হয়ে গেছিলো যে, পাকিস্তানী পতাকাবিহীন যেকোনো স্থাপনা সেনাবাহিনীর কাছে শত্রু ভাবাপন্ন এবং যার প্রেক্ষিতে তারা সেটা ধ্বংস করে ফেলবে। কিভাবে পতাকা টা বানানো হয়েছে এটা বিষয় ছিল না, বিষয় ছিল তাতে বাঁকা চাঁদ আর তারা আছে কিনা। সে কারণে বিভিন্ন মাপের, আকারের ও রঙের পতাকাতে ভরে গিয়েছিল।
জুন ১৩, ১৯৭১
অ্যান্থনি মাস্কারেনহাস
দ্যা সানডে টাইমস

আব্দুল বারী ছিল দুর্ভাগা।
হাজার হাজার পূর্ব বাংলার আরও লোকেদের মতো সেও পাকিস্তানি সেনা বহরের সামনে দিয়ে দৌড়ে পালানোর মতো মারাত্মক ভুল টা করেছিল। ক্ষীণকায় ২৪ বছরের এক যুবক, তাগড়া জোয়ান সৈন্যদ্বারা পরিবেষ্টিত। মৃত্যু ভয়ে কাঁপছিল সে, কারণ হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে গুলি করা হবে।

“আমরা তাকে মেরেই ফেলতাম, যখন সে দৌড় দিয়েছিল”, G-2 অপঃ নবম ডিভিশন এর মেজর রাথোর গল্পচ্ছলে আমাকে জানাচ্ছিলেন; আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম কুমিল্লা থেকে ২০ কিমি দূরের মুদাফারগঞ্জ এর কাছের একটা ছোট্ট গ্রাম এর সীমানায়। “তোমার কারণেই আমরা ও কে তল্লাশি করছি। তুমি এখানে নতুন আর আমি দেখছি যে তুমি উদ্বিগ্ন।”

প্রবল উৎকণ্ঠার সাথে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “মেরে ফেলা কেন তাকে?”
“কারণ সে হতে পারে একজন হিন্দু বা বিপ্লবী, হয়তো একজন ছাত্র বা আওয়ামী লীগার। তারা জানে আমরা এদেরকে খুঁজছি এবং তারা পালিয়ে বিশ্বাস ঘাতক হতে চায়।”
“কিন্তু কেন তুমি এদের মেরে ফেলছ? আর কেনই বা হিন্দুদের সনাক্ত করছ??”,আমি আবারো উদ্বেগ এর সাথে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
“আমার তোমাকে মনে করায় দেয়া উচিত... তারা কিভাবে পাকিস্তান কে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা নিয়েছিল”, রাথোর আমাকে রাগান্বিত ভাবে বলছিলেন। “এখন যুদ্ধ এর কারণে আমরা এদেরকে শেষ করে দেয়ার সুযোগ পেয়েছি।”


রক্তের প্রথম দাগ..................

উষ্মার সাথে তিনি বলছিলেন, “আমরা শুধুমাত্র হিন্দু পুরুষদের এরই হত্যা করছি। আমরা সৈনিক, বিদ্রোহীদের মতো কাপুরুষ না। তারা আমাদের নারী এবং শিশুদের হত্যা করছে।”
আমি প্রথম রক্তের কালো দাগ এর আভাস পাচ্ছিলাম, যেটা পরবর্তীতে সমগ্র পূর্ব বাংলার সবুজ ভূমিতে ছড়িয়ে পরেছিল। প্রথমে এটা ছিল হত্যাযজ্ঞ অবাঙ্গালীদের দ্বারা বাঙ্গালিদের প্রতি হিংসার পাশবিকতায়। এখন এই হত্যাযজ্ঞ ইচ্ছাকৃত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা চালিত।

এই হত্যাযজ্ঞের শিকার শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠীর মাত্র ১০% হিন্দুরাই ছিল না, ছিল হাজার হাজার মুসলিম বাঙ্গালীও। এদের মধ্যে ছিল বিশ্ব বিদ্যালয়-কলেজ এর ছাত্র শিক্ষক, আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলের কর্মী; এবং ২৬ শে মার্চ স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সৃষ্টি করার অসফল স্বপ্নে শহীদ হওয়া ১৭৬০০০ বাঙালি সেনা ও পুলিশ সদস্য।

এপ্রিল এর শেষ দিকে পূর্ব বাংলায় আমার অবস্থানের ১০দিনে আমি আমার অবিশ্বাসী চোখে যা দেখেছিলাম বা কানে যা শুনেছিলাম তাতে এটা আমার কাছে খুব ভালো ভাবে প্রতীয়মান হয়েছিল যে এই হত্যাযজ্ঞে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর কমান্ডারাই একক ভাবে অংশগ্রহন করেছিল না। শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারাই পূর্ব বাংলায় এই হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল না।

২৫ শে মার্চ এর রাত এ, বাঙালি সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যারা পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত ছিল তারা পৈশাচিক পাশবিকতায় অবাঙ্গালীদের আক্রমণ এবং হত্যা করেছিল। হাজারখানেক অসহায় মুসলিম পরিবারকে ক্ষমাহীন ভাবে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছিল, যারা অনেকেই ১৯৪৭এর দেশ ভাগের দাঙ্গার সময় বিহার থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল। নারীদের কে ধর্ষণ অথবা তাদের স্তন কে বিশেষ ছুরি দ্বারা ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল।

এই ভয়াবহতা থেকে শিশুরাও রেহাই পেয়েছিল না, ভাগ্যবান তারা ছিল যাদের কে তাদের বাবা-মা’র সাথেই হত্যা করা হয়েছিল। অন্য হাজারখানেক অভাগাদের ভাগ্যে ছিল ক্ষুপরে তুলে ফেলা চোখ এবং অঙ্গহানির মাধ্যমে অন্ধ-বিকলাঙ্গ বাকি জীবন।

২০,০০০ এর ও বেশি অবাঙ্গালী’র মৃতদেহ পাওায়া গেছে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর এর মতো বড় শহর গুলো তে। সত্যিকার পরিসংখ্যান টা হয়তোবা ১,০০,০০০ যেটা আমাকে পূর্ব বাংলার সবখানেই বলা হয়েছিল। অসংখ্য অবাঙ্গালী’র কোন হদিস’ই ছিল না।


পাকিস্তান সরকার এই প্রথম ভয়াবহতাটার চিত্র টাই তুলে ধরেছিল সারা বিশ্ব এর কাছে। কিন্তু তারা এর পরের দ্বিতীয় এবং ভয়াবহতম, যখন তাদের সেনাবাহিনী হত্যা শুরু করল, এটা গোপন করছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা ব্যাক্তিগত ভাবে হিসাব করে দেখে যে, মহামারী ও অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়া দের বাদ দিয়ে ও উভয় পক্ষ ২,৫০,০০০ মানুষ কে হত্যা করেছে।

দেশ এর অর্ধেক এর ও বেশি মানুষের প্রাদেশিক বিভক্তির এই প্রায় সফল চেষ্টার জবাবে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এর সেনা সরকার তাদের নিজস্ব নিয়মে পূর্ব বাংলার এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছিল।

“আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার এই হুমকিকে চিরতরে নস্যাৎ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যদিও এর জন্য ২০ লক্ষ মানুষ কে হত্যা করতে হয় এবং এই প্রদেশকে একটা উপনিবেশ হিশেবে ৩০ বছর শাসন করতে হয়।”, ঢাকা ও কুমিল্লার ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা আমাকে এটা অনেকবার বলেছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা ঠিক এই কাজটাই করছে পূর্ব বাংলায় অত্যন্ত ভয়াবহতার সাথে।

চাঁদপুর থেকে ঘুরে আসার পর আমরা অস্তমিত সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছিলাম (পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা রাতের বেলা বাইরে বের হতো না পূর্ব বাংলায়), তখন Toyota Land Cruiser এর পেছনে বসে থাকা এক জওয়ান চিৎকার করে বলছিল, “সাহিব, একটা মানুষ দৌড়ায়!!”
মেজর রাথোর সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছিলেন এবং একি সাথে দরজার দিকে তাক করা চীন এর তৈরি হাল্কা মেশিনগান হাতে নিয়েছিলেন। ২০০ গজ সামনে একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছিল হাঁটু সমান ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে বড় পদক্ষেপে দৌড়াচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই! গুলি কর না, সে নিরস্ত্র, সাধারণ একজন গ্রামবাসী”। রাথোর আমাকে কুৎসিত হাঁসি দিয়ে সতর্কীকরণ ফাঁকা গুলি করেছিল একটা।
মানুষটি যখন সবুজ গালিচার মাঝে হামাগুরি দিয়ে লুকানোর চেষ্টায় রত, ততক্ষনে দুই জওয়ান রউনা দিয়েছে তাকে ধরে নিয়ে আসার জন্য।

কাঁধ এর পেছনে রাইফেল বাঁট এর আঘাত এর সাথে প্রশ্নবান শুরু হয়েছিল...
~ “কৌন হ্যাঁয়?”
- “মাফ করবেন সাহিব! আমার নাম আব্দুল বারী। আমি ঢাকা নিউ মার্কেটের একজন দর্জি।”
~ “ঝুট নাহি বোলো, তুম হিন্দু হো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
- “কারফিউ এর সময় হয়ে আসছে, সাহিব! আমি আমার গ্রাম এর দিক এ যাচ্ছিলাম।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো। কিউ ভাগ রাহা থা?”
এর উত্তর পাওয়ার আগেই তিনি এক জওয়ান কাছে থাকা অস্ত্র কেড়ে নিলেন এবং আরেক জন লোকটার লুঙ্গি টেনে খুলে ফেলে নিলেন। তার রুগ্ন নগ্ন শরীরটাতে মুসলিম দের অবশ্য করনীয় খৎনার পরিষ্কার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল।
অন্তত এইটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছিল যে, বারী হিন্দু ছিল না।
জবাবদিহি চলছিল...
~ “বোলো মেরেকো, কিউ ভাগ রাহা থা?”
বারী ভীত সন্ত্রস্ত চোখ নিয়ে ভয়ার্ত হয়ে কাঁপছিল, উত্তর দিতে পারছিল না। সে হাঁটু গেড়ে বসে পরেছিল। বারী কে টেনে তার পায়ের উপর দাড় করাতে করাতে এক জওয়ান বলছিল, “উসকো ফৌজি লাগ রাহি হে, স্যার” (‘ফৌজি’ একটা উর্দু শব্দ, যেটা বাঙালি বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে ঘৃণাভরে ব্যাবহার করা হতো)
“হতে পারে”, আমি রাথোর কে বলতে শুনছিলাম।
আব্দুল বারীকে রাইফেল এর বাঁট দিয়ে বার বার আঘাত করতে করতে তাকে একটা দেয়াল এর দিকে চাপানো হচ্ছিলো। তার ভয়ার্ত চিৎকার এর শব্দে অন্ধকারে একটা কুটির এর কোণা থেকে এক যুবক এর মাথা উকি দিচ্ছিল। বারী বাংলায় চিৎকার করে কিছু বলেছিল। উৎসুক মাথাটা হারিয়ে গিয়েছিল।
কিছুক্ষন পর একজন শ্মশ্রুমুণ্ডিত বৃদ্ধ কুটির থেকে বের হয়ে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। রাথোর এবার তাকে ধরে বসলো।
~ “তুম ইয়ে আদমি কো জানতে হো?”
- “হ্যাঁ, সাহিব। সে আব্দুল বারী।”
~ “ওঃ ফৌজি হেয় কিয়া?”
- “না সাহিব, সে ঢাকা’র একজন দর্জি।”
~ “সাঁচ বাতাও মেরেকো।”
- “খোঁদার কসম সাহিব, সে একজন দর্জি”

কয়েক সেকেন্ড এর নিরবতা ছিল। রাথোর লজ্জা পেয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল, যখন আমি তাকে বলছিলাম, “বিধাতার দোহাই, তাকে যেতে দাও। এর পরও আর কি প্রমান দরকার তার নিষ্পাপতার?”
কিন্তু জওয়ানেরা তখনও খুশি ছিল না এবং তারা বারী’র চারপাশে ঘুরছিল। আমি যখন তার হয়ে আরেকবার বলেছিলাম তখনই মাত্র রাথোর তাকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এর মধ্যে সে আঘাতে ভয়ে কুঁকড়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার জীবনটা রক্ষা পেয়েছিল।

অন্যরা এতো ভাগ্যবান ছিল না...
ছয় দিন ধরে কুমিল্লায় হেড কোয়ার্টার এ, ৯ম ডিভিশন এর অফিসার দের সাথে আমি যখন ঘুরেছিলাম তখন আমি হত্যা’র বিভিন্ন রুপ দেখছিলাম। আমি দেখেছিলাম হিন্দু দের গ্রাম থেকে গ্রামে, এক বাড়ি থেকে এক বাড়ি ঘুরে খুজে বের করতে। এবং “short-arm inspection” নামক এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন বের হতো যে তাদের খৎনা করানো নাই তখন তাদের কে হত্যা করা হতো।
কুমিল্লাতে সার্কিট হাউজের দেয়ালের ভিতর থেকে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলা পুরুষদের চিৎকার শুনতে পেতাম আমি। আমি ট্রাক ভর্তি অন্য ভাবে মৃত মানুষদের এবং এই মৃত দেহ গুলো কে অন্ধকারের মধ্যে কারফিউ এর মধ্যে মানবতার খাতিরে মানুষদের ট্রাকে বোঝাই করতে দেখেছি। আমি সাক্ষী হয়েছি সেনাদের “হত্যা ও আগুন লাগানোর” মিশন এর, বিপ্লবীদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা শহরে-গ্রামে এটা শুরু করতো।

আমি দেখেছি পুরা গ্রাম ধ্বংস করে ফেলতে শাস্তি স্বরূপ। আর আমি রাতে অফিসার দের মেস গুলো তে অবিশ্বাসীর মতো শুনতাম, বীরত্বগাথার মতো, সম্মানিত অফিসাররা গর্বের সাথে দিনের হত্যার গল্প করছে।
“কিতনা কাতাল কিয়া আজ?” উত্তর গুলো আমার স্মৃতিতে দাগ রেখে যেতো।
এরকম যখন ঘটছিলো, তখন যেকোনো পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার এর এই ব্যাপারে উত্তর ছিল এরকম যে, “এটা করা হচ্ছে পাকিস্তানের ঐক্য, সাম্যবাদ রক্ষা করার জন্য।” যদিও এটা এখন সুদূর পরাহত। হাজার মাইল এর ভারত দ্বারা বিভক্ত, একটা দেশ এর দুই অংশ কে একত্রিত রাখার এই সামরিক ব্যাবস্থা, বরং নীতিগত ভাবেই বিভক্তি কে অবশ্যম্ভাবী করছিলো।

পূর্ব বাংলা কে পাকিস্তানের সাথে শুধুমাত্র কঠোর সামরিক শাসন এর মাধ্যমেই রাখা যেতো। কিন্তু সেনাবাহিনীতে প্রাধান্য ছিল পাঞ্জাবীদের, যারা প্রথাগত ভাবেই বাঙালিদের ঘৃণা এবং অপছন্দ করতো।

বিভক্তি এখন এতোটাই নিশ্চিত হয়ে গেছিল যে, স্ব-ইচ্ছায় খুব কম বাঙালিকেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে দেখা যেতো। এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল যখন আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে। আমার কাছ থেকে চলে যাওয়ার আগে সে বলছিল যে, “আমি দুঃখিত! সময় পালটে গেছে, তুমি ও L যেই পাকিস্তান কে জানতে, সেটার এখন আর তেমন না। আমাদের এটা কে ভুলা যাওয়া উচিৎ।”

কয়েক ঘণ্টা বাদে এক পাঞ্জাবী অফিসার আমাকে বলছিল, সেনা পাঠানোর আগে অ-বাঙ্গালীদের কিভাবে হত্যা করা হয়েছে; “১৯৪৭ এর দেশভাগ এর দাঙ্গার সময় শিখ রা আমাদের সাথে যেমন আচরন করেছিল, তার থেকেও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে তারা। আমরা কিভাবে এটা ভুলে যাবো বা মাফ করে দিবো।”

হিন্দু নিধন..................

নির্মম এই সামরিক অপারেশনের দুইটা বিশেষ দিক ছিল। প্রথমত, দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তিগণ যেটাকে উল্লেখ করতো ‘শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া’ হিসেবে, যা ছিল গনহত্যার ইতিহাস বিকৃতি। এবং দ্বিতীয়ত, ‘পুনঃ একত্রীকরণের চেষ্টা’।
পূর্ব বাংলা কে পশ্চিম পাকিস্তানের বশীভূত উপনেবিশ বানানোর এই প্রয়াস কে এইভাবেই ব্যাখ্যা করা হতো। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া এবং ‘দুষ্কৃতকারী’ ‘বিশ্বাসঘাতক’ এর মতো শব্দগুলোকে সমানে উপস্থাপন করা হতো বিশ্বের কাছে। দেশভাগের এই মতবাদ কে নিঃশেষ করা, ঔপনিবেশিকরণ এবং হত্যাই ছিল আসলে ব্যাস্তবতা।

হিন্দু নিধন এর প্রক্রিয়াটাকে বৈধকরণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রধান, লেঃ জেঃ টিক্কা খান বেতার ভাষণে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেটা আমি শুনেছিলাম ১৮ এপ্রিল। তিনি বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমরা, যারা পাকিস্তান তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তারা এটাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের এই দাবীকে দমিয়ে রাখা হয়েছে, কিছু সংখ্যক হিংস্র আক্রমণাত্মক লোকের বল প্রয়োগ, জীবন ও সম্পত্তির প্রতি হুমকি প্রদানের মাধ্যমে। যেটা আওয়ামী লীগ কে ধ্বংসাত্মক পন্থা অবলম্বনের দিকে ধাবিত করেছে।”

অন্য আরও অনেকে এই বৈধকরণের এর ব্যাপারে আরও খোলাখুলি ভাবেই বলত।
কুমিল্লাতে অফিসারস মেস এ ৯ম ডিভিশন হেড কোয়ার্টার এর কর্নেল নাইম আমাকে বলেছিলেন, “হিন্দুরা তাদের টাকা দিয়ে মুসলিম জনতা কে দমন করে রেখেছে। তারা রাষ্ট্রটাকে রক্তশূন্য করে ফেলেছে; বর্ডার এ ইন্ডিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে খাবার আর টাকা দিয়ে। শিক্ষক শ্রেণীতে তারাই বিরাজ করছে আর তাদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য কলকাতা পাঠায়। এটা এমন এক অবস্থায় পৌছেছে যে, বাঙালি সংস্কৃতি আসলে হিন্দু সংস্কৃতি; আর পূর্ব পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত হয় কলকাতার মাড়ওয়ারি ব্যাবসায়ি দ্বারা। আমাদের এইসব ঠিক করে এই রাষ্ট্রকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে আর তাদের বিশ্বাস কেও।”

অথবা মেজর বশির এর কথা বলা যায়। সে পদবীধারী একজন ছিলেন। সে ছিলেন ৯ম ডিভিশন এর SSO কুমিল্লা তে। তিনি নিজে ২৮ জন কে হত্যা করেছিলেন এবং গর্ব করতেন এইটা নিয়ে। যা ঘটেছিলো তার ব্যাপারে তার নিজের একটা ব্যাখ্যা ছিল।
“এই যুদ্ধ হচ্ছে খাঁটি আর ভেজাল এর মধ্যে”, এক কাপ ভেষজ চা খেতে খেতে তিনি আমাকে বলছিলেন। “এখানকার মানুষদের মুসলিম নাম আছে এবং তারা তাদের মুসলিম বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু অন্তরে তারা হিন্দু। আপনি বিশ্বাস করবেন না, জুম্মার নামাজে ক্যান্টনমেন্ট মসজিদ এর মৌলবি ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী হত্যা করলে সে জান্নাতে যাবে। আমরা ঐ বেজন্মা টা কে শিক্ষা দিয়েছি আর অন্যদেরও খুঁজছি। বাকি যারা থাকবে তারাই শুদ্ধ মুসলমান। আমরা তাদেরকে উর্দুও শেখাবো।”

সবখানে আমি অফিসার ও অন্যদের দেখেছিলাম, নিজেদের কে ভালো করার জন্য নানা ভাবে নিজেদের কে অলঙ্কৃত করতে তাদের এই খারাপ কাজ কে ঢাকতে। আইনসিদ্ধ করার জন্য মিথ্যার বেসাতি করতো। যদিও তারা জানে যে, তারা ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে একটা রাজনৈতিক সমস্যা কে মোকাবেলা করতে, যেটা ছিল বাঙালি রা নির্বাচন এ জিতেছে আর তার শাসন করতে চায়।
পাঞ্জাবীরা... ১৯৪৭ এ পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে, সরকার কে নিয়ন্ত্রন করতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তারা তাদের ক্ষমতার কোন বিলোপ দেখতে চায় নি। সেনাবাহিনী তাদেরকে সহায়তা করেছিলো।

অফিসার রা ব্যাক্তিগত ভাবে বিশ্লেষণ করতো যে যা করা হয়েছিল তা সেনাবাহিনী নামার আগে অ-বাঙ্গালী হত্যার প্রতিকার স্বরূপ। কিন্তু বাস্তবিকে এই প্রতিকার ব্যাবস্থা অনিয়ন্ত্রিত অথবা হঠাত ঘটে যাওয়া কিছু ছিল না। এটা পরিকল্পিত ছিল।


জেনারেল টিক্কা খান ক্ষমতা নিলেন....................................

এটা পরিষ্কার ছিল যে এই “শুদ্ধিকরণ” শুরু হয়েছিল ঠিক যে সময় জেনারাল টিক্কা খান পূর্ব বাংলার ক্ষমতা নিলেন ভদ্র, আত্মস্থ অ্যাডমিরাল আহসান এর কাছ থেকে এবং সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রন বিচক্ষন লেঃ জেঃ সাহিবজাদা খান এর কাছ থেকে, তখনই।

সময়কালটা ছিল মার্চ এর প্রথম দিকে। বাঙ্গালিরা যেটা থেকে আশা করেছিলো অনেক সেই সংসদ অধিবেশন বাতিল হওয়ার পর শেখ মুজিব এর প্রশাসনিক অবাধ্যতার আন্দোলন বেগ পাচ্ছিল। (......)

ঢাকা’র পূর্বাঞ্চলীয় পাঞ্জাব কমান্ড কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নির্ধারণে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। [এখানে উল্লেখ্য যে, খান এরা দায়ী ছিল না এই সময় কাল এ; খান পাকিস্তান এ প্রচলিত সাধারণভাবে অনেকের’ই নাম এর শেষাংশ] ২৫শে মার্চ এর সন্ধ্যায় ঢাকাতে যখন সেনাবাহিনী নামছিল পরের দিন সকালে বিদ্রোহ দমনের নামে আক্রমন করার জন্য তখন তাদের অনেকের কাছেই তালিকা ছিল যে কাদেরকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে।

এ তালিকা তে ছিলেন হিন্দুরা, মুসলিমদের একটা বড় অংশ; ছাত্র, আওয়ামী লিগার, অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং শেখ মুজিব এর আন্দলনের উল্লেখযোগ্য অনেকেই। এইটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছিলো যে, সেনাবাহিনী জগন্নাথ হল এর দিক থেকে মর্টার হামলা করবে, যেখানে হিন্দু ছাত্ররা থাকতো। দুইটা হিন্দু কলোনি যা রমনা রেসকোর্স এর মন্দির কে আবর্তিত করে ছিল এবং তৃতীয়টি পুরনো ঢাকার প্রাণ কেন্দ্র শাঁখারীপট্টি, এগুলোকে কে ধ্বংস করে দেয়াটাই উদ্দেশ্য ছিল এই হামলার। যার কোন যোক্তীকতা ছিল না।

এবং এরও কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না যে, ২৬-২৭ মার্চ এর দিবা-রাত্রির কারফিউ এর ভিতরে কিভাবে ঢাকা এর একটা বড় অংশ, ও পাশের শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জ এর হিন্দু জনগোষ্ঠী উধাও হয়ে যাবে। একইভাবে, মুসুলমান হত্যার কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না যারাও কারফিউ এর ভিতরে ঘোরাঘুরি করেছিলো। পরিকল্পিত এই অভিযান থেকে এই মানুষ গুলো কে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং শুধুমাত্র হিন্দুদের ওপরই এই ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছিল।

১৫ এপ্রিল ঢাকা তে ঘোরার সময়, ইকবাল হল ছাত্রাবাস এর ছাঁদ এ আমি ৪ জন ছাত্রের পচিত-গলিত ছিন্ন মস্তক দেখেছিলাম। কেয়ারটেকার জানিয়েছিল যে তাদের কে ২৫ মার্চ রাত এ হত্যা করা হয়েছিল। দুই সিঁড়িতে ও চারটা ঘরে আমি রক্তের গাঢ় দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। ইকবাল হলের পেছনে এক আবাসিক বাড়ি কে সেনাবাহিনী তস-নস করে দিয়েছিল।

দেয়াল গুলোতে বুলেট এর অসংখ্য গর্ত এবং একটা পচা গন্ধ সিঁড়িঘর থেকে ভেসে আসছিলো যদিও খুব ভালভাবে ডি, ডি, টি পাউডার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রতিবেশিরা বলছিল, এক ঘণ্টা আগেই ২৩ জন নারী ও শিশু এর লাশ কে সরানো হয়েছে এখান থেকে। ২৫ মার্চ রাত থেকে ছাঁদ এ লাশগুলো পড়ে থেকে পচন ধরা শুরু হয়েছিল। অনেক বার প্রশ্ন করার পর আমি বের করতে পেরেছিলাম যে এরা সবাই আশেপাশের হিন্দু বস্তি এর বাসিন্দা ছিল। সেনা যখন নামা শুরু হয়েছিল রাস্তায়, তখন তারা এই বিল্ডিং এ আশ্রয় এর আশায় একসাথে ছিল।

এটাই গনহত্যা, যা করা হয়েছিল খুব সাধারণ ভাবে নিপুনতার সাথে।

১৯ এপ্রিল সকালে, কুমিল্লা শহরের Martial Law Administrator মেজর আঘা এর অফিস এ বসে থেকে আমি দেখছিলাম, অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে শাস্তি গুলো নির্ধারণ করার আদেশ দেয়া হচ্ছিলো। পুলিশ এর একজন বিহারি সাব-ইন্সপেকটার, পুলিশ এর কাছে আটককৃত আসামীদের একটা তালিকা তাকে দেয়ার পর, পেন্সিল এর কয়েক খোঁচায় উনি তালিকায় থাকা চার জনের নামে টিক দিলেন।
“এই চার জন কে সন্ধ্যায় আমার কাছে নিয়ে এসো”, তিনি বলেছিলেন। আবারো তিনি তালিকায় দিয়ে তাকিয়ে আরেকবার একটা টিক দিলেন পেন্সিল দিয়ে বললেন, “......এই চোর টা কেও এদের সাথে নিয়ে আসবে”।



মৃত্যুদণ্ড: ঠাণ্ডা পানীয় পান করতে করতে ..................................

এক গ্লাস ডাব এর পানি পান করতে করতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছিলো। আমাকে জানানো হয়েছিলো যে, আসামীদের মধ্যে দুই জন ছিলেন হিন্দু, তৃতীয় জন ছাত্র এবং চতুর্থ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন সংগঠক। চোর হিসেবে যা কে সম্বোধন করা হচ্ছিলো, সে ছিল সেবাস্তিয়ান নাম এ একজন, যাকে ধরা হয়েছিলো সে যখন তার এক হিন্দু বন্ধুর ঘরের জিনিশপত্র নিজের ঘরে সরাচ্ছিল।

পরবর্তীতে সন্ধ্যায় আমি এই মানুষ গুলো কে দেখেছিলাম, তাদের হাত ও পা হাল্কা করে দড়ি দিয়ে বাধা ছিল, সার্কিট হাউজ এর দেয়াল এর পাশের রাস্তায় পড়ে ছিল তারা। কারফিউ শেষ হওয়ার ঠিক পরেই ৬ টা এর দিকে, তাদের হাড্ডি ও মাংসের উপর পড়তে থাকা কাঠের মুগুরের মতো লাঠির আঘাতের শব্দের আর্তনাদ এক ঝাঁক উড়ে যাওয়া ময়না পাখীদের শব্দ গুলো কে মিলিয়ে দিচ্ছিল।

বালুচ রেজিমেন্ট এর ক্যাপ্টেন আজমত এর ব্যাপারে দুইটা ঠাট্টা প্রচলিত ছিল। একটা ছিল এর মধ্যে ৯ম ডিভিশন এর commanding officer মেজর জেনারেল শউকত রেজা এর ADC হিসেবে তার চাকরি, এবং অপরটা হচ্ছে তার উপর চাপানো তার সহকর্মীদের নানাবিধ খারাপ আচরন।

এটা বলা হতো যে আজমত ছিলেন ঐ দলের একমাত্র অফিসার যিনি এখনো কোন “হত্যা” করেননি। মেজর বাশির নির্দয়তার সাথে বলছিলেন।

“আসো আজমাত”, এক রাতে বাশির বলছিলেন, “আমরা তোমাকে পুরুষ করে তুলবো। কাল আমরা দেখব যে তুমি কিভাবে ওদের ভাগাও, এটা খুবই সহজ”।
বিষয়টা বোঝানোর জন্য বাশির তার এক লম্বা চওড়া ভাষণ দিয়ে দিলেন। SSOহিসেবে দায়িত্ব ছাড়াও বশির ছিলেন অফিসার (শিক্ষা) প্রধান কার্যালয়ে। তিনি ছিলেন একমাত্র পাঞ্জাবী অফিসার যাকে আমি দেখেছিলাম গড় গড় করে বাংলা বলতে পারতেন।

বশির এর সাথে সেইদিন সকালে একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক তার ভাই যে কিনা কুমিল্লা আওয়ামী লীগ এর একজন সংগঠক, তার ব্যাপার এ খোঁজ করতে এসেছিলেন। যা কে কয়েক দিন আগে সেনাবাহিনী চিরুনি অভিজানের সময় ধরেছিল বলে আশঙ্কা করছিলেন ভদ্রলোক। “ধড় গ্যায়া” বশির তাকে জানিয়েছিলেন যে, সে পালিয়ে গেছে। বৃদ্ধ লোকটা বুঝতে পারছিলেন না যে তার ভাই ভাঙ্গা পা নিয়ে কিভাবে পালিয়ে গেল। আমারও বোধগম্য হচ্ছিলো না বিষয়টা। বশির তখন আমাকে এই “ধড় গ্যায়া” এর বিষয় টা পরিষ্কার করলেন যে, রেকর্ড এ দেখানো হবে যে, পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
আমি পরে আর জানতে পারিনি যে, ক্যাপ্টেন আজমত কাওকে হত্যা করতে পেরেছিলেন কিনা...

বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা যারা ফেনী তে ঢুকেছিল, তারা ব্রিজ ও culvert ধ্বংস করে, ৯ম ডিভিশন কে চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিমি দূরে কুমিল্লা মহাসড়কে আটকিয়ে রেখেছিলো। ঢাকা এর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড থেকে জেনারেল রেজা কে চাপ এ রেখেছিলেন দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপার এ, যাতে মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়ে যেতে না পারে ঐ পথে। আবার উত্তরের সাথে যোগাযোগের এই পথ টা খোলা রাখাও জরুরি ছিল এই কারণে যে, অতীব প্রয়োজনীয় মালামাল গুলো চট্টগ্রাম বন্দর এ এসে জমা হচ্ছিলো।

এসব কারণে জেনারেল রেজা স্বভাবতই বিরক্ত ছিলেন অনেক। তিনি ঐ এলাকায় প্রায় প্রতিদিন বিচরন করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ফেনী তে ঘাঁটি করা ব্রিগেড কে নির্দেশাবলী দিতেন। ক্যাপ্টেন আজমত একইভাবে জেনারেল এর ছায়া হিসেবেই ছিলেন। আমি তাকেয়ার কখনোই দেখিনি।

মে মাসের ৮ তারিখে ৯ম ডিভিশন ফেনী ও তার আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার করতে পেরেছিল। গোলাগুলি আর বোমাবাজির ভিতরেই বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাশের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এইরকম বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এইসব বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের পালিয়ে যাওয়া ৯ম ডিভিশন এর G-1, কর্নেল আসলাম বেগ এর কাছে চরম আশংকার আর বিরক্তের।
তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন, “ভারতীয়রা তাদেরকে অবশ্যই ঐখানে থাকতে দেবে না। এটা ভারতের জন্য বিপদজনক হবে। তারা শুধু সীমান্তের ঐ পাড়েই থেকে এইদিক এ ঢোকার চেষ্টা চালায় যেতে থাকবে। যদি না আমরা তাদের হত্যা করি, তাহলে দীর্ঘ সময় ধরে আমরা বিপদের মাঝে থাকব”।

লে, কর্নেল বেগ ছিলেন একজন জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার, যিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর চীন এ বিশেষ প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন। এইটা ছিল সেই সময় যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী চীন এর তৈরি অস্ত্রশস্ত্রে পরিবর্তিত হচ্ছিলো। তাকে বলা হতো একজন গর্বিত পারিবারিক মানুষ হিসেবে। তিনি আবার তোষামোদকারীদের ও পছন্দ করতেন। তিনি গর্বের সাথে আমাকে জানিয়েছিলেন যে হেডকোয়ার্টার এর বিপরিত দিকের পুকুরে ফুটে থাকা বড় বড় Scarlet জলপদ্ম গুলোকে তিনিই নিয়ে এসেছিলেন চীন থেকে। মেজর বশির তাকে ভালোবাসতেন। একজন অফিসারের গোপনীয়তা বজায় রাখার রীতি কে ভঙ্গ করে মেজর বশির আমাকে বলছিলেন, একবার তারা এক মুক্তিযোদ্ধা কে ধরেছিলেন, তাকে নিয়ে কি করা হবে এটা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিলো।

যখন সবাই নানা জায়গায় ফোন করে কি করা যায় সেই ব্যাপার এ ব্যাস্ত ছিলেন, তখন তিনিই বিষয়টা সমাধান করেছিলেন। “ধড় গ্যায়া”। গর্তের ভিতর থেকে শুধু মানুষটার পা বাইরে বেরিয়ে ছিল।

এপ্রিল এর শেষে আমি যখন কুমিল্লা গিয়েছিলাম, তখন কুমিল্লাতে ফুটে থাকা অসাধারণ সব প্রাকৃতিক শোভা এর ভিতরে এইরকম বীভৎসতা কল্পনা করাটা কষ্টকর ছিল আসলে। বিপুল সবুজ গালিচার মতো দূরের সীমানা পর্যন্ত বিছিয়ে থাকা রাস্তার দুই পাশের সবুজ ধানখেত গুলোর সৌন্দর্য গুলো গাঢ় লাল এর ছোপ ছোপ দাগ এ ভরে গিয়েছিল। এটাকে মনে হতো গোল মোহর এর মত,ভাল ভাষায় বললে বলা যায়, “অরণ্যের দাবানল” যেইটা পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্ফুটিত হচ্ছিলো। গ্রামের আম ও নারিকেলের গাছ গুলো ফল এ ভরে গিয়েছিল। তেরিয়ার জাতের কুকুরের সমান মাপের ছাগলের পথে ঘাটে বিচরন আসলে বাংলার প্রাকৃতিক প্রাচুর্যতাই প্রকাশ করতো। তারা মাকে শিখিয়েছিল যে, তুমি শুধু একভাবেই এগুলোর মধ্যে ছেলে-মেয়ে আলাদা করতে পারবে, আর তা হোল সব মাদী ছাগল গুলোর পেট এ বাচ্চা।

আগুন লাগান আর হত্যা ছিল তাদের প্রতিশোধের প্রতিরূপ.................................

বিশ্বের ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা গুলোর মধ্যে একটা, কুমিল্লা শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গ মাইলে ১৯০০ জন। যেখানে একমাত্র মানুষেরই দেখা মিলতো না।
কয়েক দিন আগে ঢাকাতে আমার সাথে থাকা রক্ষীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সব বাঙ্গালিরা কোথায়”? সে চাতুর্যের সাথে উত্তর দিয়েছিলো যে সবাই গ্রামের দিকে চলে গেছে।

এখন এই গ্রামাঞ্চলেও কোন বাঙালি ছিল না। কুমিল্লা শহরও ঢাকার মতো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। লাকসাম এ যাওয়ার রাস্তায় নীরব সব গ্রাম পার হয়েছিলাম, এবং মাইল দশের ভিতর বিচরন করা গ্রামবাসি কে দুই হাতের আঙ্গুলে গোনা যাবে।
কিন্তু সেনা দেখা যেতো, শ’য়ে শ’য়ে গম্ভীর মুখাবয়বের খাকি পোশাক পরিহিত, যাদের প্রত্যেকের সাথে একটা করে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। যেভাবে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাতে তারা রাইফেল গুলো তারা কখনোই হাত ছাড়া করতো না। রাস্তা গুলো সব সময় রুঢ়, যখন তখন গুলি করে দেয়ার মতো সেনাদের দ্বারা পাহারা দেয়া হতো। যেখানেই সেনাবাহিনী ছিল, সেখানেই কোন বাঙালি ছিল না।

সামরিক আদেশে, রেডিও ও সংবাদপত্রে সারাক্ষন গোপন ষড়যন্ত্রকারীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হতো যদি তারা ধরা পরে। যদি কোন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা বা ব্রিজ ধ্বংস অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে তার চারপাশের ১০গজের মধ্যে অঞ্চল গুলোর বাড়ি গুলো কে ধ্বংস করা হতো আর সেখানে থাকা মানুষ গুলোকে হত্যা করা হতো।

বাস্তবিকই অবস্থা আরও ভয়াবহ ছিল যা কোন ভাষায়ই বর্ণনা করা সম্ভব না। এইরকম ভয়াবহতায় বাঙ্গালিদের ভীত করে দিয়েছিলো।

এর একটা উধাহরন পাওয়া গিয়েছিল, যখন আমরা হাজিগঞ্জ এ যাচ্ছিলাম রাস্তা দিয়ে যেটা চাঁদপুরের সাথে মিলেছিল। ১৭ এপ্রিলের সকালে। কয়েক মাইল আগে হাজিগঞ্জ এর, একটা ১৫ ফুট লম্বা ব্রিজ কে আগের রাত এ মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করেছিলো, যারা তখনও হয়তো ঐ অঞ্চলেই ছিল।

মেজর রাথর তখনই একদল সেনাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শাস্তিযোগ্য ব্যাবস্থা নিতে। লম্বা লম্বা ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা গিয়েছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়া ব্রিজ এর আশেপাশের পৌনে এক মাইল জায়গা জুড়ে সব দিক থেকে। আমরা সতর্কতার সাথে বিছানো কাঠের উপর দিয়ে পার হয়েছিলাম, যা তৎক্ষণাৎ মেরামত করে ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম ডান দিকের গ্রামের বাড়ীগুলো তে আগুন জলতে শুরু করেছে। গ্রামের শেষে জওয়ান’রা নারিকেল এর ছোবড়া ব্যাবহার করে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিল। যা ছিল খুবই দাহ্য এবং তা রান্নার কাজে ব্যাবহার করা হতো।

গ্রামের প্রবেশ মুখে নারিকেল গাছের ফাঁকে হাত পা ছড়িয়ে পরে থাকা একটা দেহ দেখতে পেয়েছিলাম। রাস্তার অন্যপাশের গ্রামের ধান এর ক্ষেত এ আগুনের ছাপ দেখা যাচ্ছিল। অসংখ্য বাঁশ ঝাড়, মাটির ঘর পুড়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী আসার আগে শয়ে শয়ে গ্রামবাসী পালিয়ে গিয়েছিল আর যারা পালাতে পারে নি তাদের অবস্থা হয়েছিলো নারিকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে পরে থাকা দেহগুলোর মতো।

গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে মেজর রাথর আমাকে বলছিলেন যে, এসবের জন্য এরাই দায়ী। আমি তাকে বলেছিলাম, অল্প সংখ্যক বিপ্লবীর ঘটানো এ কাজের জন্য নিরীহ মানুষের প্রতি এইভাবে প্রতিশোধ নেয়াটা আসলে ভয়াবহ। তিনি কোন উত্তর করেননি এর।

কয়েক ঘণ্টা পর চাঁদপুর থেকে আসার পথে আমরা যখন আবার হাজিগঞ্জ দিয়ে পার হচ্ছিলাম, আমি আমার এই “হত্যা আর পোড়ানোর” বীভৎসতার প্রথম চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।

সেদিন বিকেলে হয়ে যাওয়া উষ্ণমণ্ডলীয় ঝড়ের পরবর্তী অবস্থার ভিতরে ছিলাম আমরা তখনও। ঘন মেঘ শহরের আকাশ চিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদ গুলোর গায়ে অদ্ভুত সব অবয়ব তৈরি করে রেখেছিলো।

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ক্যাপ্টেন আজহার ও আমাদের পেছনে পাহারায় খোলা জীপ এ বসে থাকা ৪ জন জওয়ানের উর্দি গুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
আমরা যখন একটা বাক পার হলাম তখন দেখতে পেলাম মসজিদ এর বাইরে দাড় করিয়ে রাখা ট্রাক এর এক বহর। আমি গুনে দেখলাম, মোট ৭ টা ট্রাক। সব গুলো সেনাবাহিনীর যুদ্ধকালীন পোশাক পরা জওয়ান এ ভরা। ট্রাক এর সারির প্রথমে একটা জীপ দাঁড়ানো। রাস্তার অন্যপাশে দুই জন মানুষ আরেকজনের নেত্রীতে রাস্তার পাশের শ’খানেক দোকান ঘরের একটার দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। মেজর রাথর যখন তার টয়োটা জীপ’টা দাড় করলেন ঐখানে ততক্ষনে কড়ি কাঠের দরজাটা ঐ দুইজনের সম্মিলিত চেষ্টায় হাল ছেড়ে ভেঙে যাওয়া শুরু করেছে।

“কোন অকাজ করছ তোমরা?”, মেজর রাথর চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন। তার উত্তরে তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচা লোকটি জবাব দিল, “মোটা”, “তোমার কি ধারণা, আমরা কোন অকাজটা করতে পারি?”

কণ্ঠস্বর টা চিনতে পেরে রাথর তার মুখে একটা বিস্তারিত হাঁসি ফুটিয়ে তুললেন। এবং আমাকে জানালেন, “ইফতি”, 12th frontier force এর মেজর ইফতিখার।

রাথর: “আমি ভেবেছিলাম কেউ হয়তো লুটপাট করছে”।
ইফতিখার: “লুটপাট? না, আমরা হত্যা আর আগুন লাগানোর কাজ এ নিয়োজিত”। হাতের ইশারায় ইফতিখার দোকান ভাঙার কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।

রাথর: “কতজনকে পেয়েছিলে?” ইফতিখার মৃদু হাঁসি দিলেন।
রাথর: “আহা! বলে ফেলো, কতজনকে পেয়েছিলে?”
ইফতিখার: “মাত্র ১২ জন। এবং খোঁদার রহমত এ আমরা সৌভাগ্যবান ছিলাম যে তাদেরকে পেয়েছি। আমরা এই ১২ জনকেও পেতাম না, যদিনা আমি আমার মানুষদের পেছন দিক দিয়ে না পাঠাতাম”।

মেজর রাথর এর কাছ থেকে বাহবা পেয়ে তখন ইফতিখার বিস্তারিত বলা শুরু করলেন যে, কিভাবে তিনি হাজিগঞ্জ এ অনেক খোঁজাখুঁজির পর শহরের শেষ প্রান্তে এক বাড়িতে পালিয়ে থাকা এই ১২ জন হিন্দু কে পেয়েছিলেন। তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছিলো। এখন মেজর ইফতিখার তাদের মিশনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ছিলেন, “আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া”।

এর মধ্যে দোকান এর দরজা খুলে গেছিলো। দোকানের ভিতরে আমরা দেখতে পেলাম এমন সব জিনিস যা এ অঞ্চলে “ঔষধ ও মনহরি” দোকানের আওতায় পরে। বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড এ নিচে ইংরেজি তে লেখা “Ashok Medical & Stores”। তার নিচে রং দিয়ে লেখা “প্রফে. এ এম বোশ”। হাজিগঞ্জ এর অন্যান্য মানুষদের মতো জনাব বোশ ও দোকান বন্ধ করে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

দোকানের সামনের কাঠের শেলফ এ সাজানো ছিল কিছু ওষুধ, কাশির সিরাপ, কয়েক বোতল আমের জুস, অণুবর্তিত অলঙ্কার, সুতি সুতার বান্ডিল ও ইলাস্টিক। ইফতিখার শেলফের গায়ে লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন। পাতলা কাঠ দিয়ে তৈরি শেলফ টা ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেল। এরপর তিনি একটা শেলফ থেকে কিছু পাঁটের তৈরি ব্যাগ আরেকটা থেকে কিছু খেলনা তুলে নিলেন। আরেকটা তাক থেকে এক বান্ডিল রুমাল ও এক রোল লাল কাপড়। সব মেঝেতে অন্য সব জিনিসের সাথে ছুড়ে ফেলে দিলেন।

ইফতিখার এইসব একসাথে করে আমাদের টয়োটাতে বসে থাকা এক জওয়ান এর কাছ থেকে এক বাক্স ম্যাচ চেয়ে নিলেন। জওয়ান এর নিজের একটা ইচ্ছা জেগে উঠেছিলো। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে সে দোকানের ছাদের সাথে ঝুলতে থাকা একটা ছাতা পেরে নিচ্ছিলেন। ইফতিখার তাকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কঠোর ভাবে মনে করিয়ে দিলেন যে, লুট-তরাজ কোন নির্দেশ নাই, করা যাবে না।

ইফতিখার আগুন লাগিয়ে দিলেন খুব তাড়াতাড়ি। জ্বলতে থাকা পাঁটের ব্যাগ গুলোকে দোকানের একদিকে ছুড়ে দিলেন আর লাল কাপড়ের রোল গুলোকে আরেক দিকে। দোকানটা দাউ দাউ করে জ্বলা শুরু করে দিল। কয়েক মিনিটের ভেতরে আগুন যখন ছড়িয়ে পড়লো তখন বন্ধ দরজার ভেতর থেকেও আগুনে জিনিশপত্র পোড়ার শব্দ আমাদের কানে আসতে শুরু করলো। এইভাবে আগুনের লেলিহান শিখা বাম এর দিক দোকানে ছড়িয়ে পরবর্তী দোকান গুলো কেও গ্রাস করে নিল।

এরমধ্যে রাথর অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করায় চিন্তিত হয়ে পরেছিলেন। সেকারনে আবার আমরা ঐখান থেকে চলতে শুরু করেছিলাম। পরের দিন যখন আমার মেজর ইফতিখারের সাথে দেখা হয়েছিলো, তখন তিনি আমাকে বলছিলেন যে, “আমি মাত্র ৬০ টা বাড়িতে আগুন লাগাতে পেরেছিলাম। বৃষ্টি যদি না থাকতো, তাহলে রক্তের স্তুপ বানায় দিতাম”।

মুদাফফরগঞ্জ থেকে কয়েক মাইল দূরে এক গ্রাম এ যাওয়ার সময়, মাটির দেয়ালের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকা একজন মানুষ কে দেখে আমরা থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। এক জওয়ান সতর্ক করছিলো যে হতে পারে এটা বন্দুকধারী ফৌজি। কিন্তু ভালো ভাবে দেখার পর বোঝা গেল যে, আসলে একজন সুন্দরী হিন্দু বালিকা। সে সেখানে তাকে ছেড়ে যাওয়া মানুষদের একাকীত্ব নিয়ে বসে ছিল এবং সৃষ্টিকর্তা জানেন কিসের জন্য সে অপেক্ষা করছিলো ঐখানে।

একজন জওয়ান ১০ বছর ধরে East Pakistan Rifles এ আছেন এবং সে কাজ চলার মতো বাংলা বলতে পারতো। তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো মেয়েটিকে গ্রামের দিক চলে যেতে বলার জন্য। তার উত্তরে মেয়েটি কিছু বলেছিল, কিন্তু সে যেখানে ছিল সেখানেই বসে থাকলো। তাকে দ্বিতীয়বারের মতো চলে যেতে বলা হোল। আমরা যখন ঐ স্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম তখনও মেয়েটিকে আগের জায়গাতেই বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল। আমাকে জানানো হোল যে, “তার আসলে যাওয়ার কোন জায়গা নেই, নেই কোন প্রিয়জন, না কোন ঘর ফিরে যাওয়ার”।

হত্যা করা ও আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার অভিজানের একজন অফিসার মেজর ইফতিখার। সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নিষ্ক্রিয় করার পর তারা ঢুকতেন ঐসব এলাকাতে হিন্দু ও নাশকতাকারীদের (অফিসিয়ালি মুক্তিযোদ্ধাদের এই নামেই দাকা হতো) ইচ্ছামত হত্যা করার এখতিয়ার নিয়ে ও সেনাবাহিনী যেইসব জায়গা তে হামলা চালিয়েছিল সেসব একবারে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য।

এক একজন মানুষ মারতে তিনটা গুলি.............................................

এই লম্বু পাঞ্জাবী অফিসার তার কাজ সম্বন্ধে আলাপ করতে ভালবাসতেন। কুমিল্লা সার্কিট হাউজ এ যেতে যেতে ইফতিখার আরেকদিনের বীভৎসতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন আমাকে।

“আমরা এক বৃদ্ধ কে পেয়েছিলাম”, তিনি আমাকে বলছিলেন। “জারজ টা মুখে দাড়ি রেখে ঈমানদার মুসলমান সেজেছিল ও একটা মুসলিম নাম ও নিয়েছিল, আব্দুল মান্নান। কিন্তু আমরা তাকে ডাক্তার দের মতো অনুসন্ধান করে তার মুখোশ খুলে দিয়েছিলাম”। ইফতিখার বলে যাচ্ছিলেন, “আমি তাকে তখনই ঐখানে হত্যা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার সাথে থাকা মানুষেরা অন্য প্রস্তাব দিল, এইরকম একটা জারজ কে মারার জন্য তিনটা গুলি দরকার। তখন আমি তার অণ্ডকোষে একটা গুলি, একটা পেটে আর শেষটা সরাসরি মাথায় করে হত্যা করি তাকে”।

যখন আমি তাকে ছেড়ে আসছিলাম তখন মেজর ইফতিখার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর দিকে রওয়ানা করছিলেন তার আরেক “হত্যা-আগুন লাগানো” অভিজানে। এই অভিজানের বিপরীতে বাঙ্গালিদের কাছে দুইটাই সুযোগ ছিল। যারা পালিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারতো আর যারা পালাতে না পারতো, তারা অধিনস্ত চাকরের মতো তাদের জীবন ভিক্ষা এর ব্যাপারে যেরকম আরজি জানাতো তা তাদের বেঁচে থাকার আকুতিটাকে আরও হাস্যকর করে তুলতো।

চাঁদপুর এ এরকম প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।
অতীতে মেঘনা নদীর ধারের এই গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর তা এখানে গড়ে ওঠা পুরুষ কেন্দ্রিক ব্যাবসা কেন্দ্র গুলোর জন্য বিখ্যাত ছিল। নদীর ধার দিয়ে বেধে রাখা হাজার হাজার ছোট নৌকা গুলোকে দেখে দূর থেকে মনে হতো কোন এক আলোর স্বপ্নপুরী। ১৮ এপ্রিল চাঁদপুর জনমানব শূন্য হয়ে গেছিলো। কোন মানুষ ছিল না, না ছিল কোন নৌকা। বড়জোর পুরা জনবসতির শতকরা ১জন হয়তো ছিল। বাকিরা, বিশেষ করে হিন্দুরা যারাই আসলে ঐখানকার জনবসতির অর্ধেক অংশ ছিল, পালিয়ে গিয়েছিল।

অদ্ভুতভাবে তারা তাদের বাড়িতে, দোকানে, বাড়ির ছাদে হাজার হাজার পাকিস্তানী পতাকা ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছিলো মানুষ ছাড়া কোন জাতীয় দিন এর উদযাপন চলছে এখানে। এটা এখানকার মানুষহীন নির্জনতাটাকেই আরও বড় করে প্রকাশ করছিলো। পতাকা গুলোই সেটাকে প্রকাশিত করে তুলছিলো।

কোনভাবে এইরকম কথা প্রচলিত হয়ে গেছিলো যে, পাকিস্তানী পতাকাবিহীন যেকোনো স্থাপনা সেনাবাহিনীর কাছে শত্রু ভাবাপন্ন এবং যার প্রেক্ষিতে তারা সেটা ধ্বংস করে ফেলবে। কিভাবে পতাকা টা বানানো হয়েছে এটা বিষয় ছিল না, বিষয় ছিল তাতে বাঁকা চাঁদ আর তারা আছে কিনা। সে কারণে বিভিন্ন মাপের, আকারের ও রঙের পতাকাতে ভরে গিয়েছিল।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×