somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভ্রমণ ভাবনা

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি সবসময়ই ঘুরে বেড়ানো ভালোবাসা এক মানুষ। বিদ্যালয় জীবনে যতগুলো পিকনিক হয়েছে তার সবগুলোতেই অংশ নিয়েছি। আমাদের বিদ্যালয়ে সে সময় ক্লাস থ্রি তে না উঠলে ট্যুরে যেতে দিত না। আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি, তখন দাঁড়িয়ে থেকে দেখতাম, সবাই কত মজা করে ট্যুরের বাসে ওঠে। কিন্তু আমি উঠতে পারছি না।

তৃতীয় শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে আর কখনও এ সুযোগ ছাড়িনি। সবাই মিলে চলে গেছি সিংড়া ফরেস্ট, কিংবা নাটোরের গণভবনে,কিংবা হার্ডিজ ব্রিজ বা আরও একটু এগিয়ে শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের বাসভবন বা লালন ফকিরের মাজার।চাঁদভরা রাতের আকাশে কখনও ঘুরে বেড়িয়েছি ব্রক্ষ্মপুত্র জুড়ে। প্রতিটি ভ্রমণই অসম্ভব রকম উপভোগ্য ছিল আমার কাছে।

আর বিশ্ববিদ্যালয় এনে দিল দূর-দূরান্তের অকৃত্রিম সৌন্দর্যগুলোকে উপভোগ করার অবারিত সুযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই প্রথম দেখেছি নীল সাগর, ধূসর পাহাড়, মেঘ আর মানুষের হাত ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা।
দেখেছি চা-বাগান, আদিবাসী, দুধের মত সাদা জলের ঝর্ণা।

মানুষ যে কি করে বেড়াতে যাবার কথা শুনে ‘যাবো না’ বলে স্থির হয়ে থাকতে পারে, আমি তা বুঝতে পারি না। তবে হ্যা, কিছু মানুষ আছেন, তাদেরকে একথা বোঝানোর সাধ্য স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া বোধহয় আর কারও নেই। মার্ক টোয়েনের একটি উক্তি মনে পড়ছে। তা হল,
‘সব কিছুরই একটা সীমা আছে – লোহার আকরিককে শিক্ষা দিয়ে সোনা বানানো সম্ভব নয়’

আমি কাউকে ছোট করছি না। কিন্তু এ মানুষগুলোর রহস্য আমি ঠিক ভেদ করতে পারিনা।


ঘুরতে গিয়ে যে শিখতে পারেনা, তার ঘুরতে যাওয়া ব্যর্থ।

আমার সৌভাগ্য, আমি ঘুরতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছি।

একটি ভয়ঙ্কর শিক্ষার গল্প বলি আজ।

আমি মানুষের পিছলে পড়া দেখলে খুব মজা পেতাম। বিশেষ করে বর্ষাকালে ভেজা মাটির রাস্তায় হাঁটার সময় যদি কেউ পিছলে পড়ে যেত, আমার হাসি আর দেখে কে। যে মানুষটি পড়ে গেছে, তিনিও করুণভাবে আমার দিকে তাকাতেন। আমি তবুও হাসতাম।

আমার আবার অহংকারও ছিল যে, আমি কখনও পিছলে পড়ে যাই না।

একবার ঘুরতে গিয়েই আমার সে অহমিকাপতন হল, তাও হল আবার খুব করুণভাবে।

পিচ্ছিল পাথরের উপর হাটতে গিয়ে পড়ে যাই, ঠিক যেভাবে বর্ষাকালে ভেজা রাস্তায় মানুষের পা পিছলে যায়। পেছনে প্রচুর ব্যথা পাই। ঠিকমত উঠতে পারছিলাম না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি, সবাই আমাকে দেখে হাসছে। কেউ আমাকে সাহায্য করছে না। অনেক কষ্টে উঠে বসলাম। হাত দিয়ে দেখলাম, আমার পেছনের কিছুটা কাপড় ছিড়ে গেছে, আর হাত ভরে যাচ্ছে গাড় লাল রক্তে।

তারপর থেকে মানুষ কষ্ট পেলে আমি আর কখনওই হাসি না।


এবার একটা ভুতুড়ে গল্প বলি। এটি আমার বন্ধুর গল্প। পাঠক ক্ষমা করবেন।

আমার বন্ধুটি একবার চা-বাগানে বেড়াতে গিয়েছে। রাতে হাঁটতে বেড়িয়েছে একা একা। নির্জন চা-বাগান আর থমথমে অন্ধকারে আাঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে ওর ভালোই লাগছিল। আবেগ এসে এতটাই জড়িয়ে ধরল ওকে যে ও শুধু সামনের দিকে হেঁটেই যেতে লাগল।

যখন খেয়াল হল, তখন ও রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে।

ও ভয় পেতে শুরু করল। ওর কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

এক যুবক ভরাট গলায় ওকে ডাকল। অন্ধকারের ভেতর থেকে যেন হঠাৎ করে ও চলে এল। সে যুবকটি ওকে বাংলোয় পৌঁছে দিল। উপদেশ দিল, এত রাতে এভাবে না বেড়োনোর জন্য।

পরদিন খোঁজ নিয়ে ও জানতে পারল, ও ছেলেটি দিন দুয়েক আগে মারা গিয়েছে।

আমার বন্ধুটি খুব বিষন্ন হয়ে পড়ল। ভয়ও পেল।

পরদিন রাত। ও আবারও হাঁটছে। পাশ থেকে নাকি ছেলেটি আবার ওকে বলেছিল, ‘কি বাবু, আজকেও যাবেন নাকি, ওই কবরের কাছে।’

আমি এসব বিশ্বাস করি না। কিন্তু আবেগ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটা একবার আমি নিজেই বুঝেছি।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে নেমেছি। তখন ভরা জোয়াড়। আবেগ ভর করল আমাকে।আমি এগিয়ে যেতে লাগলাম। এগিয়ে গেলাম অনেক দূর। ওখানে আমার ঠাঁই নাই। হঠাৎ খেয়াল হল, এবার আমার ফিরে যাওয়া দরকার।

কিন্তু ফিরতে গিয়ে দেখি, জল টানছে। মানে ভাটা শুরু হয়ে গিয়েছে। আমি সাঁতার কাটার চেষ্টা করছি। পারছি না। হঠাৎ একবার মনে হল, এই বুঝি আমার শেষ সময়। এরপর অতল জলে হারিয়ে যাবো।

বিধাতা লিখে রেখেছেন আমি আরও কিছুদিন বাঁচব। তাই কূলে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।

বুঝেছিলাম, কোনটা বেশি দামি, আবেগ না জীবন।


আমি কাল আবারও ট্যুরে যাচ্ছি। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান। তিন দিন, চার রাতের ট্যুর। খুব সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ ট্যুর।

আনন্দের সাথে তাই সেই ভয়ানক আবেগটাও কাজ করছে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এ আমার তৃতীয় ট্যুর।

প্রথম বারের আয়োজক ছিল আমাদের ৩৬ ব্যাচের বড় ভাইয়া-আপুরা। তাদেরকে দেখেছি, দিন-রাত ছোটাছুটি করতে। ট্যুরে যাবার সময় যতই ঘনিয়ে এসেছে, তাদের মুখগুলো ততই শুকিয়ে গিয়েছে। বুঝতাম না, কেন এমন হয়।

এর পর গেলাম ৩৭ ব্যাচের বড় ভাইয়া-আপুদের আয়োজিত ট্যুরে।তারাও প্রচুর কষ্ট করেছে। ট্যুরের সময় যতই ঘনিয়ে এসেছে, তাদের খাওয়া-দাওয়া ততই কমে গিয়েছে, রাতের ঘুম কমে গিয়েছে।

এবার আমাদের আয়োজনে এই ভ্রমণ। আমার সৌভাগ্য আমাকে পুরোপুরি বুঝতে হচ্ছে না যে ট্যুর আয়োজন কতটা ঝামেলাময় কাজ, তবে আগুনের আঁচ ঠিকই গায়ে লাগছে। আমি দেখছি, আমার বন্ধু রাতে ঘুমোতে পারছে না, ঠিকমত খেতে পারছে না।

আমার এলাকায় একটি পারিবারিক কবরস্থানের একটি সাইনকবোর্ডে একটি কথা লেখা আছে। তা হল,
‘আজ তোমরা যেমন আছ
কাল আমরা তেমনি ছিলাম
কাল তোমাদের এমনি হবে
আজ আমরা যেমন আছি’

প্রথমদিন দেখার পর থেকে আমি কথাটাকে কখনওই ভুলতে পারিনা। অমোঘ সত্য কথা যে এত চমৎকার করে লিখে ফেলা যায়, এ কথাগুলো না পড়লে হয়ত অনুভবই করতে পারতাম না।

একসময় আমাদের বড়রা আমাদের জন্য চমৎকার ভ্রমণের আয়োজন করেছে। আমরা শুধু উপভোগ করেছি। এবার আমরা আয়োজন করছি, আমাদের ছোটরা উপভোগ করবে। এরপর আমাদের ছোটরা আয়োজন করবে, তাদের ছোটদের জন্য। এই তো নিয়ম।


শুধু মজা আর শিক্ষা নয়। বেড়াতে গিয়ে কিছু কষ্টময় অভিজ্ঞতাও হয়।

একবার এক মেয়ে ট্যুরে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন ওকে পাওয়া গেল, ওর সে কি কান্না!

একবার ট্যুরে গিয়ে আমরা বন্ধুরা খুব মজা করছি। হঠাৎ খবর এল, আমার এক বন্ধুর দাদি মারা গেছেন।
আমার সে বন্ধুটির সেদিনের চোখের জল আমি আজও ভুলতে পারি না।

একটি ভ্রমণকে আমি হাজারভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। একটি ভ্রমণ থেকে আমি চাইলেই হাজারটা শিক্ষা নিতে পারি।শুধু থাকতে হবে আমার গ্রহণ করার মানসিকতা।

আশা করছি, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ ভ্রমণটা বেশ আনন্দদায়ক হবে। আমি খুব আশাবাদী মানুষ। তাই আমার প্রায় লেখার শেষেই আমি ‘আশা’ শব্দটা রেখে দেই।

ব্যাপারটা বোধহয় খারাপ নয়, তাই না?
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×