রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ নামে একটি কবিতা আছে। কবিতাটিতে রানী মাঘ মাসের শীতে আগুনের উষ্ঞতা নেবার জন্য গরীব প্রজাদের ঘরে-বাড়িয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। রানী ঠিকই উষ্ঞতা পায়, কিন্তু গরীব প্রজাদের ঘর-বাড়ি পুড়ে যায়। রানী কিন্তু বুঝতেই পারে না, সে প্রজাদের কি ক্ষতি করে ফেলেছে।
আবার ইটালির পঞ্চম রোম সম্রাট ক্লডিয়াস সিজার নিরো, রোম নগরী যখন আগুনে পুড়ছিল, তখন তিনি ৩৫ মাইল দূরে বসে মনের আনন্দে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। সংগীত,সুর আর বাঁশি ছিল তাঁর খুবই প্রিয়।
ঠিক কিভাবে প্রতিবাদ করব বুঝতে পারা যাচ্ছে না। ঠিক কতটা প্রতিবাদ করব তাও বুঝতে পারা যাচ্ছে না। আদৌ কোন প্রতিবাদী কথা লিখব কি না, তাও বুঝে উঠতে পারছি না। কিছু দুষ্কৃতিকারী যখন মানুষভর্তি বাসে বোমা মেরে ২৯ জনকে দগ্ধ করে দেয় এবং তার বিচার যখন সেই দেশের সরকার করতে পারে না, তখন সেই সরকারের কিভাবে নিন্দা করব, সেটাও বুঝে উঠা আমার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
বিগত দুই সপ্তাহের পৈশাচিকতায় মারা গেছেন অন্তত ৩০ জন মানুষ। যান-বাহনে আগুন লাগানো ও লংরুটে বাস না চলায় ক্ষয়-ক্ষতি পাঁচশ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ট্রেন প্রায়ই লাইনচ্যুত হচ্ছে। আগে নদীপথ নিরাপদ ছিল। এখন তো লঞ্চেও আগুন দেয়া হচ্ছে। এভাবে ঠিক কতদিন চলবে, তা কারও জানা নেই। সেই অবস্থা প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিয়ে যখন আমাদের মন্ত্রীরা বলে ওঠেন, যাত্রাবাড়ির সহিংসতা শুধুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা বলে ওঠেন, দেশের পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক, ঠিক তখনই আমার রবি ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ বা নিরোর বাঁশি বাজানোর কথা মনে পড়ে যায়।
এতসব পেট্রোল বোমা কোথা থেকে আসে। কারা এসব তৈরী করে। কারা এগুলো বহন করে। এগুলো তৈরীর উপাদানের যোগান কারা দেয়। দেশের গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ, র্যাব,বিজিবি- তারা কি করেন। চাইলে এমন হাজারটা প্রশ্ন আজ করা যায়। আগেও বহুবার বলেছি, এবং না বললেও সবাই নিশ্চই বুঝতে পারে যে, এগুলো আসলে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। এগুলো হচ্ছে সন্ত্রাস। তাই, এগুলোর দায় কেউ নেয় না। শুধু একে অন্যের দোষ দেয়।
আর যাদের মদদে এসব হচ্ছে, আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাদের শাস্তি দিতে পারব না। আমরা সবই ভুলে যাই, আমাদের কিছুই মনে থাকে না। আমর যেমন, ৯৬, ২০০১, ২০০৬ সবই ভুলে যাই, তেমনি ভুলে যাই ১৯৪৭,৫২,৬৯ কিংবা ৭১। ঠিক একই ভাবে এই নরহত্যা গুলোও আমরা ভুলে যাবো। আবার নির্বাচন হবে, আমরা আবার ওদেরকেই ভোট দেব। আমরা আবার মরব। সুপুরুষরা নাকি একবার মরে, বারবার নয়; ন্যাড়া নাকি একবার বেলতলায় যায়, দুই বার নয়। আমরা আর সুপুরুষ নই, আমরা বারবার মারা যেতে পছন্দ করি, আমরা ন্যাড়ার থেকে অধম। আমরা ন্যাড়া হয়ে বারবার বেলতলায় যেতে পছন্দ করি। ওরা সিংহাসনের জন্য মারামারি করে। আর অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমরা পুড়ি।
বি.এন.পি চেয়ারপার্সন এসবের দায় এড়াতে পারেন না, কোনভাবেই না। ওনার ছোট ছেলে মৃত্যু বরণ করলেন। উনি নিশ্চই বুঝতে পারছেন, প্রিয়জন মারা গেলে কেমন লাগে। আশা করব, এই বোধটুকু নিয়েই তিনি এগুবেন, তাঁর নির্দেশে যে রাজনৈতিক আন্দোলন, সেই আন্দোলনে ভাড়াটে আন্দোলনকারীরা যদি কোন মায়ের সন্তানকে পুড়িয়ে মারে, সে কষ্টটা তিনি আগে না বুঝলেও এখন নিশ্চই বুঝতে পারবেন। আত্মীয়-স্বজন হারিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও। তিনিও বোঝেন, কাছের মানুষের অকালমৃত্যু কেমন লাগে। তারপরও কেন তাঁদের মিলিত প্রচেষ্টায় সাধারণ মানুষগুলো মারা যাচ্ছে, এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।
ক্ষমতাসীনদের কাছে অনুরোধ, হয় আপনারা এই পৈশাচিকতা বন্ধ করুন, নয় তো ক্ষমতা থেকে সরে যান। মানুষের নিরাপত্তা দিতে না পারলে কোন সরকার, কোন প্রশাসন আর কোন প্রজাতন্ত্রেরই আমাদের দরকার নেই।
কবিগুরুর ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতাটিতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত রানীকে কঠোর শাস্তি পেতে হয়। তাকে বাড়ি-বাড়ি ভিক্ষে করে অর্থ জোগাড় করে প্রজাদের ঘরগুলো পুণরায় গড়ে দেবার দায়িত্ব দেন রাজা। আর লোভী নিরো কিন্তু জনতার রোষানলে পড়ে ধারালো ছুড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। গণতন্ত্রে কিন্তু রাজা সাধারণ মানুষ। তাই গণতন্ত্রের রাজারা চাইলে ‘সামান্য ক্ষতি’ বা নিরোর কাহিনীটির পুনরাবৃত্তি ঘটতেই পারে।
অতএব, সাধু সাবধান। মানুষকে বাঁচান। মানুষ আপনাদেরকে রাখবে। আমরা কখনওই এমন বাংলাদেশ চাইনি। আমাদের চাওয়া বেশি নয়। আমরা অল্পতেই খুশি। আপনারা দয়া করে এমন কিছু আমাদেরকে দেবেন না, যা আমরা কখনওই চাইনি।।