somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বোয়িং ৭০৭

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রত্যেকের স্বপ্ন থাকে উড়ে যাওয়ার।খুব নামীদামি এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭০৭ এ করে যেদিন পা বাড়িয়েছিলাম দূরদেশের পথে ভেবেছি অতীত ঝেড়ে ফেলবো। ঝলমলে কেবিন ক্রু আর স্বপ্নের দেশের স্বপ্নযাত্রায় দুচোখ বন্ধ করে শেষবারের মতো ভেবেছি সাতান্ন হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট দেশটার কথা। হ্যাঁ শেষবার,কারণ এই মরা দেশে আমি আর ফিরব না। ধুলাবালি,কাদা,খরা বন্যার দেশে আমি আর ফিরছি না। সুন্দরী মেম বিয়ে করবো,কিছুদিন পর কোলজুড়ে ফুটফুটে দুটো বাচ্চা আসবে,তারা আধো আধো গলায় আমায় বাপি বলবে,মা কে যা ইচ্ছে বলুক গে. মাম্মি অথবা মা-কী এসে যায়?আর আমার বাবা মা?পৃথিবীতে বাবা মা কারও চিরস্থায়ী নয়। মরার দেশে থাকা অথবা কবরে থাকা একই ব্যাপার।বাবা মার বয়স হচ্ছে। এতো বয়সে মানুষ বেঁচে থাকে কেন?বিদেশিনী মেম দেখে  অক্কা পাওয়ার জন্য?বুড়ো মানুষ ,অনেক তো দুনিয়া সামলেছ। বলি এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও না বাপু। আমার বউ বিদেশিনী হোক,ফিরিঙ্গি হোক কি আসে যায়?

না কিছুতেই কিছু আসে যায় না। দেশে থাকতে খুব রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতাম। স্কুল জীবনে থাকতেই ছাত্র সংসদ করেছি,শত শত ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন দেখিয়েছি দেশের রাজনীতি বদলাবার।একসময় সত্যিই ইচ্ছে ছিল বিলেতের পাঠ চুকিয়ে দেশে ফিরে যাবার।সেই ইচ্ছে এখন আটলান্টিকের তলায় শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। ওই মরার দেশে ফিরে গিয়ে কি হবে?বন্ধুবান্ধব ছুটে আসবে গলা জড়িয়ে ধরতে,বাপি ঘনঘন দরজা খুলে দেখবে এসেছি কিনা,মা ঘড়ি দেখবে ফ্লাইটটা এই পৌছুল বলে। কদিন ভীষণ হুলস্থুল হবে। আর সেই মেয়েটা যাকে হাত ছুঁয়ে বলেছিলাম ফিরে আসবো এই পথ ধরে,সেই মেয়েটার কি ইচ্ছে হবে আমাকে লুকিয়ে এসে একবার দেখে যাওয়ার? না,সে জানবে কি করে?তার সঙ্গে সব চুকিয়ে দিয়েছি বহু আগেই। বিলেতে আসার পর আমার ব্যস্ততা বেড়েছে কয়েকগুণ,শুধু সময় হয়েছে যত্ন করে ছুড়ে ফেলে দেবার তাকে।আমারো দুঃসময় আসে,যখন অনেক রাতে দুঃখবিলাস রোগে ধরে,যখন আমার ভয়াবহ রাইটার্স ব্লক ধরে যায়,আমার কিছু মেয়েদের ব্যবহার করতে হয়। এ এক অমানুষিক আনন্দ। ওর আগেও আরও দুটো মেয়েকে করেছি। ইমোশনাল এক্সপ্লয়েটেশনের সবচাইতে বড় সুবিধা হল কোন প্রমাণ থাকে না,প্রমাণ থাকলেও কিছু করার থাকে না।প্রয়োজন ফুরোলে  সাদা কাগজে লিখে দেয়া একটা স্যরি মোর দ্যান এনাফ। এই মেয়েটাকে মনে আছে কারণ মেয়েটা  একরকম ঝামেলা সৃষ্টি করে ফেলেছিল প্রায়!আমার তখনকার প্রেমিকার সামনে। এসে বলে কিনা আমাকে ভালবাসে আর আমিও নাকি ওকে ভালবাসি!মেয়েগুলো বড্ড বোকা।আরে আমি আমার তিন বছরের পুরনো প্রেমিকাকে পর্যন্ত অস্বীকার করতে চাই আর তুমি মেয়ে কোথাথেকে এসে জুটলে?আচ্ছামতো বকে দিয়েছি।মেয়েটা নাকি কেঁদেছিল খুব।
শেষমেষ কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,শুধু যোগাযোগটা থাক? আমার ওসব কান্নায় গলে যাবার মতো বিলাসিতার সুযোগ ছিল না।সম্পর্কটাকে গলা টিপে মেরে বিছানায় শুয়ে থাকা মেমকে দেখিয়ে দিয়েছি আমি তাকে  কত ভালবাসি।

কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার কোনদিন বিলেতি মেম বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না! করতে হল কারণ আমি সমাজকে,পরিবারকে কিছু একটা দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যে আমি হারিনি। আমার বড় বোন যেভাবে হেরে গিয়েছিল আমি সেভাবে হারিনি। আমি কোনদিনসমাজের কাছে  হারতে শিখিনি আর এখানেও আমার জেতার একমাত্র উপায় ছিল প্রথা ভেঙ্গে দেখানো,সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আলাদা কিছু করে দেখানো এবং সুখী হওয়া। বড় বোনের উপর রাগ থেকে আমি একটার পর একটা মানুষকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে এগিয়ে গেছি আর পৃথিবীকে দেখিয়ে গেছি আমার বিচারে কোন ভুল নেই এবং আমি সুখী!
আমার ছোট্ট এপার্টমেন্ট এ তিনটে ফুটফুটে বাচ্চা ঘুরে বেড়ায়। দেখতে হয়েছে মায়ের মতো ,বাঙালি ভাবটা কম। ভালই হল। কে চায় সেই ব্লাডি ইন্ডিয়ান তকমা সারাজীবন গায়ে জুড়ে রাখতে?

আজকাল আর সেভাবে দেশের সাথে যোগাযোগ হয়ে ওঠে না। সেদিন খাবার টেবিলে বউ বলল,চল ঘুরে আসি তোমার দেশ থেকে।চমকে উঠে বললাম,হ্যাঁ ডার্লিং কেন নয়?বাচ্চাগুলো চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দুহাত এরোপ্লেনের মতো মেলে দিয়ে সারা ঘর দৌড়ে বেড়াতে লাগল,বাংলাডেশ,বাংলাডেশ বলে। আমি কর্নফ্লেক্স মুখে দিয়ে ভাবলাম কি আছে ওই মরার দেশে ফিরে যাওয়ার মতো?আমরা অবশ্য ফিরে যাচ্ছি না,ঘুরতে যাচ্ছি। কিন্তু ঘোরার জন্য আমেরিকায় বহু জায়গা আছে। বউ বোধহয় আমার ভাবনাটা ধরতে পেরেই বললো,দেশে তোমার বন্ধুরা আছে,মা বাবা আছে। ওদের সাথে দেখা করিয়ে দেবে না?বন্ধুরা আছে না,ছিল। এক জন এক জন করে ব্যবহার করা শেষে প্রত্যেককেই আমার ছুড়ে ফেলে দিতে হয়েছে।কারও সাথে আমার ব্যবসায়িক টানাপোড়েন,কেউ বা আমার প্রেমিকার দিকে নজর দিয়েছিল,কেউ আমার গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস মিটিং এর মাঝখানে ছেলেবেলার গল্প ফেঁদে বসেছিল বলে তাকে তক্ষুনি আনকালচার্ড বলে ঠেলে ফেলে দিতে হয়েছিল আর বাকিরা আমার সাথে এক কাতারে দাড়ানোর উপযুক্তই ছিল না। সেইসব করেছিলাম বলেই আজ আমি 'আমি ' হতে পেরেছি। আমার ঘরে সুন্দরী মেম আছে ,পকেটে টাকা আছে স্বপ্নের দেশের সিটিজেনশিপ আছে। তোমরা তো একেই বোধহয় সুখ বল,তাই না?আমার জীবনে নস্টালজিয়ার কোন স্থান ছিলনা এবং আজও নেই। শুধু খাবার টেবিলে বউয়ের বলা কথাটাই আজ আবার ভাবতে বসালো পুরনো কথা।ভাবতে ভাবতেই আমি বারে ঢুকি। পুরনো অভ্যেস। বারের কোনায় বসে থাকা মেয়েটাকে পরিচিত মনে হয়। হয়তো কোনদিন আমার প্রয়োজন মেটাতে দরকার পড়েছিল ওকে। নেশা হয়ে গেছে বড্ড আজ। বউটাই তো যত্তসব ঝামেলা করল.সকাল সকাল অতীত মনে না করালে তো দিব্যি ছিলাম। ভাবতে ভাবতেই গাড়ির দিকে এগোই আমি.মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সাহায্যের জন্য ফোন করব?আমার কোনদিন সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। আর তাও ধুলো কাদার মাখানো এক ঝাঁক স্মৃতির ভয়ে মাতাল হয়ে এখন সাহায্য চাইবো। গিয়ারটা দ্রুত বদলে ফেলে বলি,নেভার!কিন্তু সামনে ওইযে ওরা আবার আসছে। মুভির পর্দার মতো সরে যাচ্ছে সব। আমার সাদা স্কুল ড্রেস,আমার বিতর্কের মঞ্চ,ওইযে বাপির পায়ের শব্দ,ওইযে সেই মেয়েটা -কি যেন নামটা,ওইযে বোয়িং ৭০৭ ঢাকা এয়ারপোর্টের মাটি ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ খুব আনন্দ হল এইতো এক্ষুনি আমিও গাড়ি নিয়ে এই দেশের মাটি ছেড়ে উড়ে যাব আকাশে। একবার শুধু ওই দেশটায় ফিরে যাব মা। মা,আমি আসছি। হঠাত্ বিকট একটা শব্দ হয়ে থেমে গেল সব স্বপ্ন,সেই ধুলোবালিমাখা স্কুল ড্রেস,সেই বন্ধুপাগল আমি,সেই মেয়েটার প্রথমবার হাত ছুয়ে বলা ভালবাসি.গাড়িটা রাস্তার ধারে উল্টে পড়ে আছে। কয়েকজন সম্ভবত আমাকে টেনে বার করার চেষ্টা করছে। আচ্ছা আমি কি মরে গেছি?

একটা বোয়িং ৭০৭ এ চেপে স্বপ্ন ধরতে যাওয়া আর মরে যাওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে কি?কই আমার তো মনে হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৪২
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×