১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ,আইভানোভস্কি কনভেন্ট,রাশিয়া।
হঠাৎ করেই কনভেন্টে আবির্ভাব এক নানের। কোথা থেকে আসলেন, কিভাবে আসলেন কেউ জানে না, এমিনকি জানে না কনভেন্টের বেশিরভাগ নান, কর্মচারী ও অন্যান্যরাও।জানার মধ্যে শুধু নামটাই- ডোসিফিয়া। কিন্তু অসামান্য রূপসী এই নান নিজের পরিচয় তুলে ধরেন ধর্মকর্ম ও সেবাব্রতের মধ্য দিয়েই। পরিচিত হয়ে উঠেন কনভেন্টের বাইরেও। তার সাথে একবার সময় কাটিয়ে যাওয়া অনেকেই ফিরে আসত শুধু একটু সান্নিধ্যের আশায়। মহীয়সী এই নারী সেবা দিয়ে যান সেই ১৮১০ সাল পর্যন্ত। মৃত্যুর আগ পর্যন্তও তার প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার হয় নি, রয়ে গিয়েছিলেন এক রহস্যময় নান হিসেবেই।তার আচারব্যবহার, কথাবার্তা, গাম্ভীর্য ও মাধুর্যপূর্ণ চেহারার কারণে তার আশেপাশের লোকজন ধারনা করতেন তিনি ছিলেন নিশ্চয়ই রাজপরিবারের কেউ অথবা বিশাল কোন জমিদারবাড়ির কোন সদস্য।
৪ ডিসেম্বর,১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ, ফোর্ট পিটার এন্ড পল, রাশিয়া।
অনেকটা তড়িঘড়ি করেই আর বেশ গোপনীয়তার সাথেই একটা কবর খোরা হল ফোর্টে। কোন জাঁকজমক ছাড়াই শুধুমাত্র করণীয় প্রথাগুলো পালন করেই কবর দেয়া হয়ে গেল ফোর্টে থাকা এক বন্দিনীর। এই বছরের শুরুতেই এই ফোর্টে বন্দী হয়ে এসেছিলেন তিনি। দুরারোগ্য যক্ষ্মারোগে ভুগে মারা গেছেন তিনি। উপস্থিত একজন নিম্নশ্রেনীর কর্মচারীর মুখ থেকে অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে আসে 'ভাল থাকবেন প্রিন্সেস তারাকনোভা।'
১৫ডিসেম্বর, ১৭৪৫, সেন্ট পিটার্সবার্গ,রাশিয়া।
প্রিন্সেস এলিজাবেথ অফ রাশিয়া ও তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী ইউক্রেনিয়ান প্লেবয় আলেক্সেই রাজুমোভস্কির ঘর আলো করে আসে ফুটফুটে কন্যা- প্রিন্সেস তারাকনোভা। নতুন এই রাজকুমারী যে ভবিষ্যতের রাশিয়ান সাম্রাজ্যের একজন যোগ্য উত্তরসূরি হবে তা কেউ জানত না। কিন্তু ব্যতিক্রমি সব বৈশিষ্ট্যই দেখা যেতে থাকল তার মধ্যে। অসাধারণ সুন্দরী এই রাজকুমারীর বড় হওয়ার সাথে সাথে দেখা দেয় রাজপরিবারের সকল কাজেই উদাসীনতা।দুহাতে অর্থ খরচের অভ্যাস ও ঘুরে বেড়ানোর নেশা থেকেই উড়নচণ্ডী এই রাজকুমারী রাজ্য থেকে পালিয়ে ইউরোপে এসে পড়েন বিশ বছর বয়স পেরোনোর আগেই।
১৭৬৫ পরবর্তী সময়, মধ্যইউরোপ।
অসামান্য রূপসী প্রিন্সেস তারাকনোভা এইসময়ে বেশ অর্থকষ্টে পড়েন। ঘুড়ে বেড়ানোর শখও এসময় থিতিয়ে আসে, বুঝতে শেখেন যে তিনি যেভাবে চলে অভ্যস্ত সেভাবে চলতে হলে তার প্রয়োজন প্রচুর টাকা। এত টাকার যোগাড় এই মধ্য ইউরোপে
বসে যোগাড় শুধু একভাবেই করতে পারেন, আর তা হল একমাত্র তার রূপকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা। এই চিন্তা থেকেই তিনি প্রেম শুরু করলেন ইউরোপের বিভিন্ন ধনী ব্যবসায়ী ও জমিদারপুত্রদের সাথে। এসময় এলাকা পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিচয়ও পালটে ফেলতেন তিনি। পরিচিত ছিলে ফ্রাউলিন ফ্রাংক ও মাদাম ত্রেমুই নামেও।
১৭৭০পরবর্তী সময়, লিমবার্গ, ইউরোপ
তারাকনোভা এইসময়ে এসে সম্পর্ক গড়ে তোলেন লিমবার্গের কাউন্ট ফিলিপ ফার্দিনান্দের সাথে। এইসময়ে তিনি এতটাই খরচ করে বেড়াতেন যে টাকার জন্য তিনি ফার্দিনান্দের প্রস্তাবে তার রক্ষিতা বনে যান। অথচ এই সময়ে তিনি ছিলেন রাশিয়ার সাম্রাজ্যের যোগ্যতম উত্তরসূরি। রাশিয়াতে থাকলে তিনি হয়ত সম্রাজ্ঞীও হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি কখনওই আর রাশিয়া যাবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। রাজসিংহাসনে বসার কোন ইচ্ছাই তার ছিল না। এরকম সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন তা অবশ্য কখনও জানা যায় নি।
১৭৭৪, জার প্যালেস, রাশিয়া।
সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন ২ ডেকে পাঠালেন তার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও বিশিষ্ট সেনানায়ক আলেক্সেই গ্রিগ্রিয়েভিচ অরলভকে। এই অরলভের হাত ধরেই তিনি ক্ষমতায় আসেন আর ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার একটি কঠিন মিশন তিনি তাকেই দিতে চান। অরলভ আসলে তিনি জানান যে বর্তমানে তার চারপাশে অনেক শত্রু থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তাকে ক্ষমতা থেকে হঠাতে পারে মাত্র একজন, সে যদি এই রাজ্যের ক্ষমতা চায় তাহলে অনেকেই তার পক্ষ নিবে কারণ আসলেও সে এই সাম্রাজ্যের একজন উত্তরসূরি। সম্রাজ্ঞী অরলভকে নির্দেশ দেন যে তিনি যেন তাকে বন্দী করেন। অরলভ বলেন যে, ''মহামান্য সম্রাজ্ঞী, আমি তো এই মুহূর্তে ইউরোপে নিযুক্ত আছি।" জবাবে সম্রাজ্ঞীর উত্তর ছিল এই যে সেই মহিলাও এখন ইউরোপে।
ছবিঃ সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন ২
১৭৭৪-১৭৭৫, মধ্য ইউরোপ
ফিরে আসি প্রিন্সেস তারাকনোভার কাছে। এইসময়ে প্রিন্সেস তারাকনোভা ফার্দিনান্দ ফিলিপের রক্ষিতা হিসেবেই ছিলেন। বার বার তাকে বিয়ের কথা বললেও ফিলিপ তা সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। এমনকি ব্যবসার দোহাই দিয়ে তারাকনোভার অর্থবরাদ্দও কমিয়ে দিয়েছিলেন।সম্পর্কের এই চড়াই উৎরাইয়ের সময় তারাকনোভার দেখা হয় এক রাশিয়ান ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সাথে। ধীরে ধীরে তার ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়লে প্রিন্সেস এইসময়ে তাকে বিয়ের জন্য উতলা হয়ে পড়েন। সেই ব্যবসায়ী তাকে বলেন যে প্রিন্সেসকে আগে রাশিয়া পাঠিয়ে দিয়ে তিনি পরে রাশিয়া এসে তাকে বিয়ে করবেন। প্রিন্সেসকে তিনি রাশিয়াগামী জাহাজে উঠিয়ে দেন। এর পরপরই ওই ব্যবসায়ী একটি চিঠি লিখেন রাশিয়ান সম্রাজ্ঞীর উদ্দ্যেশ্যে যেখানে লেখা ছিল আপনার প্যাকেজটি পাঠানো হচ্ছে, যার খামের উপরে প্রেরকের সিলটি ছিল রাশিয়ান সেনানায়ক আলেক্সেই অরলভের!
১৭৭৫, লিভর্নো বন্দর, তুসকানি, রাশিয়া।
জাহাজ থেকে গ্রেপ্তার হন প্রিন্সেস তারাকনোভা। তার অপরাধ ছিল এই যে তিনি ছিলেন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের এর উত্তরাধিকারী (যেই উত্তরাধিকার তিনি কখনওই চাননি) আর সত্যি সত্যি ভালবেসেছিলেন একজনকে যাকে রাণী পাঠিয়েছিল তাকে গ্রেপ্তারের জন্য। জাহাজ থেকেই তাকে সরাসরি পাঠিয়ে দেয়া হয় পিটার এন্ড পল ফরট্রেসে।
সেখানেই সেই বছর তার মৃত্যু হয় যক্ষ্মারগে ভুগে।
ছবিঃবন্দিনী প্রিন্সেস তারাকনোভা
এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবার ধৈর্য শেষ এই ভেবে যে লিজেন্ড অফ ডোসিফিয়াতে আমি কেন প্রিন্সেস তারাকনোভার কথা লিখছি যে কিনা মারা গেছে ডোসিফিয়ার আবির্ভাবের ১০ বছর আগেই!
আসলে ' লিজেন্ড অফ ডোসিফিয়া ' আরও একটি নামে পরিচিত, তা হল ' লিজেন্ড অফ প্রিন্সেস তারাকনোভা '।
প্রকৃতপক্ষে প্রিন্সেস তারকনোভাই হলেন নান ডোসিফিয়া। ধারণা করা হয়, সম্রাজ্ঞী ক্যাথেরিন ২ এর রোষানল থেকে বাঁচতেই তাকে মৃত্যুর নাটক সাজাতে হয়েছিল এবং দশবছর গোপনে থাকার পর তিনি এক কনভেন্টে আস্তানা গাড়েন। আর এইকাজে তাকে সাহায্য করেন সেনানায়ক আলেক্সেই অরলভ। ধারণা করা হয় যে অভিনয় করতে গিয়ে তিনি সত্যি সত্যিই এই অসামান্য রূপসীর প্রেমে পড়ে যান। (যদিও অনেকে মনে করেন নিজের অন্যায় কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতেও তিনি একাজ করে থাকতে পারেন।)
ফুটনোটঃ
শুধুমাত্র অরলভ আর প্রিন্সেস তারাকনোভার সম্পর্কের কাহিনী নিয়ে মুভি আছে ৪ টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতটি হল পুরস্কারপ্রাপ্ত 'দ্যা রয়্যাল হান্ট' (রাশিয়া ১৯৯০)।
আমি একটাও দেখি নাই, ওয়াইফাই সংকটে ভুগছি গত কয়েকদিন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ২:০০