এই শহরের মানুষ সুযোগ সন্ধানী এবং এই শহরের প্রতি ইঞ্চি জুড়ে প্রেম । ফলে মানুষ উপলক্ষ্য খুঁজে । উপলক্ষ্য খুঁজে প্রেম প্রকাশের ।
শাহজাহানের ভিতরে প্রেম আছে । সে টের পায় কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না । স্কুলে থাকাকালীন সময়ে নাহারকে ছত্রিশটা লাভ লেটার লিখেও শেষ পর্যন্ত তার হাতে তুলে দিতে পারেনি । লজ্জা লজ্জা লাগতো । কলেজে এসেও তাই হচ্ছে । ঈশিতা নামের এক চিকন চাকন মেয়ের প্রতি তার প্রেম আছে । ঈশিতাকে দেখলে তার বাম পা কাঁপে । বুক ধকধক করে । চোখের মণি স্থির হয়ে যায় । এইসব যে অগাধ প্রেমের লক্ষণ । অথচ শাহজাহান প্রকাশ করতে পারছে না । সময় কাটে , লজ্জা ভাব কাটে না ।
আজ শাহজাহান প্রেম প্রকাশ করবে বলে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা অনেকাংশে বাস্তবায়নের পথে । সে ভেবে দেখেছে লজ্জা কাটানোর জন্য তার ভিতরের প্রেম ভাব বাইরে জোরালো আকারে প্রকাশ করতে হবে । সেটি সম্ভব সার্বজনীন প্রেম প্রকাশে ।
বিজয় দিবস উপলক্ষে তাদের জেলা শহরের নয়াখাল মাঠে দিন আজ ব্যাপী ফাংশনের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে নানান কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মহান বিজয় দিবস স্মরণ করা হচ্ছে । শাহজাহান সকাল থেকে মাঠে উপস্থিত । আজ তার গায়ে লাল পাঞ্জাবি । গালে সাদা লাল রঙ্গে লিখা - বিজয় । ঘাড়ে মাঝারি আকারের একটি জাতীয় পতাকা । মোবাইলে ছবি তুলে দেখেছে তাকে বেশ প্রেমিক প্রেমিক লাগছে । দেশ প্রেমিক ।
দিনের শুরু থেকে সে উৎসাহী । বুকের বা পাশে হাত রেখে পতাকা উত্তোলন দেখেছে , বড় বড় মানুষের ভাষণ শুনেছে গভীর মনোযোগে । জেলা পুলিশ , রেড ক্রিসেন্ট , স্কাউট সদস্যদের কুচকাওয়াজ দেখেছে । তবে তার সবচেয়ে ভালো লেগেছে মুকুল নিকেতন স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের অংশগ্রহণে ড্রিল পর্ব । কিভাবে কিভাবে যেন বাচ্চাগুলো সবুজ মাঠে শাপলা ফুল হয়ে ঢেউ দিয়ে দিল আবার দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ করে হয়ে গেল দোয়েল পাখি । শাহজাহান বিস্ময় । সে অনুভব করতে পারছিল তার প্রেম মূলত দেশের প্রতি । নাহার কিংবা ঈশিতা খণ্ডকালীন অনুভূতি ছিল । কিন্তু দেশ ! সেটা অন্যরকম । আসল ।
বিকেলে সম্মিলিত জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে । প্রচুর মানুষ মাঠে উপস্থিত হচ্ছে । শাহজাহান লক্ষ্য করলো এদের ভিতরে তার বহু পরিচিত ছেলে মেয়ে আছে । তারা সবাই জোড়া জোড়া বানিয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে এসেছে । শাহজাহানের খুব রাগ হয় ।
– এরা কি জাতীয় সংগীত গাইতে এসেছে নাকি মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে এসেছে । সে ভাবে । যত ভাবে তত মন খারাপ হয় । এমনটা করা ঠিক না । মেয়ে নিয়ে ডেটিং করতে নয়াখালে কেন আসতে হবে । রাঙ্গামোড়ের পার্কে চলে যা । নির্জন আছে । চুটিয়ে প্রেম কর । দেশের প্রেমে নিজের প্রেম কেন ডুকাবি হারামজাদা ! পরিচিত ছেলেগুলো খুব ভাব নিয়ে একটা মেয়ের হাত পাকড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । আর মেয়েগুলোয় না এমন কেন । শাড়ি গয়না পড়ে রঙ্গিল সাজে নয়াখাল মাঠে চলে এসেছে ! আরে বাবা , এইটা কি বিয়ে বাড়ি যে সাজুগুজু করে আসতে হবে ? শাহজাহানের এইসব ভালো লাগে না । এই ছেলে মেয়েগুলোর ভিতর দেশের প্রতি প্রেম নেই । এদের আছে শরীররের প্রতি শরীররের কামনা ।
ইতিমধ্যে প্রচুর মানুষ উপস্থিত হয়েছে । মানুষের মাথায় নয়াখাল মাঠ গিজগিজ কালো । অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই স্পিকারে জাতীয় সংগীত গাওয়া শুরু হবে । সবাই দাড়িয়ে আছে । প্রস্তুত । শাহজাহান মাঠের ডান পাশের কোনায় দাঁড়িয়েছে । তার এতো ভিড় ভালো লাগে না । শাহজাহানের ঠিক সামনে একটি মেয়ে দাড়িয়ে । মেয়েটির পড়নে টিয়া সবুজ শাড়ি , লাল পাড় দেয়া । মেয়েটি উচ্চতায় খাটো । অদ্ভুত বিষয় তার সাথে কোন সঙ্গী নেই । আশেপাশে যারা আছে তাদের কাউকে মেয়েটির সঙ্গী বলে মনে হচ্ছে না শাহজাহানের ।
লাউড স্পিকারে জাতীয় সংগীত শুরু হল । সবাই একসাথে সামনের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জাতীয় সংগীত গাইছে । শাহজাহান ঠিকমতো কোরাসে অংশ নিতে পারছে না । তার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে । টিয়া সবুজ শাড়ি পড়া মেয়েটির পিছন দিক তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে । যেন এক সমুদ্র ঢেউ তাকে ডুবিয়ে দিতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে । শাহজাহান খপ করে হাত দিয়ে দিল টিয়া সবুজ মেয়েটির পিছন অংশে ।
ভিড় , অনেক ভিড় । চারিদিকে জাতীয় সংগীতের মূর্ছনা । শাহজাহান ক্রমশ ভিড়ে মিশে যাচ্ছে ।
টিয়া সবুজ শাড়ি পড়া মেয়েটির চোখে পানি । তার খুব কষ্ট হচ্ছে তারপরও সে চিৎকার করে গাইছে –
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:০৫