যত্তসব বাজে(ট) কথা!
‘বাজেট আসছে’ - শৃুনলেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলে আসা দিনগুলির কথা মনে পড়ে!
মে মাস আসলেই আরেক দফা বিড়ি সিগারেটের দাম বৃদ্ধি এবং বন্ধু-বান্ধবদের শুকনো মুখ! এ প্রসঙ্গে আমাদের দুই গ্রাম পরের হালিম কাকার কৌশলটা মন্দ ছিলনা! বাজেটের মাস দুয়েক আগে জমজমাট ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। নির্বাচন শেষে আবিস্কার করা গেল যে, হালিম কাকার খাটের নিচে মাটির কলসি ভর্তি আকিজ বিড়ি! শুকনো ত্যানা দিয়ে মুখ আটকানো। ঘটনা কী? জানা গেল, সামনেই বাজেট! অবধারিতভাবেই বিড়ির দাম বাড়বে আরেক দফা। আপদকালীন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন দলের মিছিলে অংশগ্রহণ বাবদ বিড়ির এই মজুত! হালিম কাকাতো ফ্রি বিড়ির মজুত রেখেছিলেন, কিন্তু বাজেটকে সামনে রেখে রুই-কাতলার মজুত যারা রাখেন, তাদের নামধাম কখনোই জানা হয়না আমাদের!
বাজেট নিতান্তই বড়দের জিনিস। বড় লোকদেরও বটে! জ্ঞানী-গুনীদের কারবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক বাজেট বক্তৃতা হয়, সেখানে আবার জ্ঞানগর্ভ আলোচনাও হয়। টেলিভিশনগুলো চুল-দাড়ি পাকাদের ডাকে। তারা কী কী যেন ‘ডিমান্ড’ আর ‘সাপ্লাই’ নিয়ে ত্যানা প্যাঁচায়। পত্রিকার পাতায় চক্রাবক্রা আঁকাআকি শুরু হয়। ওগুলোকে নাকি ‘গ্রাফ’ বলে! আর দরিদ্র মানুষেরা বুঝে, অর্থমন্ত্রীর হাতে ওই কালো ব্রিফকেস মানে জিনিসপত্রের আরেক দফা দাম বাড়া। বাজার দৌড়াচ্ছে। এখন তাকেও দৌড়াতে হবে!!! তবে অর্থমন্ত্রী গতকাল বিকেলে ৩ লাখ চল্লিশ হাজার কোটির টাকার যেটা ঘোষণা করেছেন, সেটা যে বাজেট তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এই বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বুশের মহান বাণী আছে। তিনি বলেছেন, ’এটা নিশ্চয়ই একটা সত্যিকারের বাজেট, কারণ এতে অনেক সংখ্যা দেখা যাচ্ছে।’
বাজেট মানে করের বোঝা! আয় করবেন আপনি, আর কেটে রাখবে সরকার!
ছোট্ট ছেলেটা বিধাতার কাছে রোজ প্রার্থনা করে, ‘বিধাতা, আমাকে মাত্র ৫০০টা টাকা দাও। আমার আর কিছু চাই না।’ কিন্তু টাকা আর আসে না। তারপর বুদ্ধি করে একদিন সে বিধাতাকে একটা চিঠি লিখল। সেই চিঠি ডাকঘরে পড়ে রইল কিছুদিন। তারপর একদিন সহৃদয় কোনো একজন পড়ে থাকা চিঠিটা খুলে পড়লেন এবং পাঠিয়ে দিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে। আশ্চর্য ঘটনা হলো, সেই চিঠি গিয়ে পড়ল শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর হাতে। তিনিও মজা করে ২০০ টাকা পাঠিয়ে দিলেন, সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর একটা স্বাক্ষর। ২০০ টাকা পেয়ে মহাখুশি ছেলেটি। হাত তুলে মোনাজাত ধরে অভিযোগ করল, ‘বিধাতা, টাকাটা অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে কেন পাঠালে, তিনি তো ৩০০ টাকা ট্যাক্স কেটে রেখেছেন।’
ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করলে বৃঝা যায়, দুনিয়ার তাবৎ কৌতুক মনে হয় অর্থনীতিবিদদের নিয়েই। একজন গণিতবিদ, একজন হিসাবরক্ষক, আরেকজন অর্থনীতিবিদ আবেদন করেছেন একটা পদের জন্য। তাঁরা একে একে হাজির হলেন ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে।
- দুই আর দুই যোগ করলে কত হয়? প্রশ্নকর্তা গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করছেন।
- গণিতবিদ বললেন, দুই আর দুইয়ে চার হয়।
- হিসাবরক্ষক বললেন, দুই আর দুই যোগ করলে গড়ে চার আসবে। তবে টেন পারসেন্ট এদিক-ওদিক হতে পারে।
- আর অর্থনীতিবিদ ঝুঁকে বসলেন প্রশ্নকর্তার দিকে। স্যার, আপনিই বলুন, দুই আর দুইয়ে ঠিক কত হলে আপনার সুবিধা হয়!
অর্থনীতিবিদদের বুদ্ধিশুদ্ধিও সর্বজনবিদিত! তিন গণিতবিদ আর তিন অর্থনীতিবিদ ট্রেন ভ্রমণে বেরিয়েছেন। তিন গণিতবিদ তিনটা টিকেট কিনলেও, তিন অর্থনীতিবিদ মিলে টিকেট কিনলেন মোটে একটা। গণিতবিদেরাতো অবাক। টিটি যখন চেক করতে আসলেন তিন অর্থনীতিবিদ দৌড়ে বাথরুমে ঢুকলেন। টিটি বাথরুমের দরজা ধাক্কালেন, আর একজন হাত বের করে টিকেট দেখালেন। টিটি চেক করে চলে গেল। পরদিন গণিতবিদেরা একই কৌশল ধরলো আর অর্থনীতিবিদেরা টিকেটই কাটালোনা। টিটি আসছে দেখে গণিতবিদরো দৌড়ে বাথরুমে ঢুকলেন। দরজার বাইরে টোকা পড়লো। একজন টিকেট বের করে ধরার সাথে সাথে ঘাপটি মেরে থাকা অর্থনীতিবিদ সেই টিকেট নিয়ে পাশের বাথরুমে ঢুকে গেলেন।
যাই হোক। আনন্দের কথা হলো আমাদের অর্থমন্ত্রী মোটেও অর্থনীতির ছাত্র নন। তিনি ইংলিশ লিটারেচারের ছাত্র! একজন সাহিত্যের ছাত্র একটা দেশে বাজেট ঘোষণার রেকর্ড করলেন। মোট ১০ বার! এটি কার সৌভাগ্য অার কার দূর্ভাগ্য- আলোচনার দাবি রাখে! তবে এবার পত্রপত্রিকায় দেখলাম, ‘দু:সাহসী/উচ্চবিলাসী’ বাজেট নিয়ে আসছেন অর্থমন্ত্রী! অাগে পত্রিকায় দেখতাম, আরো সাহসী মুনমুন, সানি লিওন এবার আরো সাহসী চরিত্রে! কিছুকাল পরে এই সাহসের মানেটাও বুঝতাম! আশা করি অর্থমন্ত্রীর ব্যাপারটাও বুঝা যাবে!!!
বাজেট আসলে প্রতিবারই মনে হয়, এবার ভালো কিছু হবেই হবে। যাঁরা আশাবাদী, তাঁরা আশায় থাকেন। ‘গরিবদের আর যতই কষ্ট থাক না কেন, একটা বড় সুবিধা আছে। গরিব থাকার জন্য কোনো খরচা লাগে না।’ স্কটল্যান্ডের এই প্রবাদটা মানলেই তো আক্ষেপ কমে অাসে! অথবা আদার ব্যাপারির জাহাজের খবর না নেয়ার মতোই, দরিদ্র মানুষেরা বাজেট নিয়ে মাথা না ঘামানোই মঙ্গল! চলুন আরেকটা গল্প শুনি:
হঠাৎ লোকসানের মুখে পড়া এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি কর্মচারীদের বার্ষিক বোনাসের বাজেট বাঁচাতে একটা নোটিশ টাঙাল— আপনি যদি দামি কাপড় পরে অফিসে আসেন, তাহলে আমরা বুঝব আপনি খুবই সচ্ছল, বোনাসের এই সামান্য ক’টা টাকা না হলেও আপনার চলবে। আপনি যদি আজেবাজে কাপড় পরে অফিসে আসেন, তাহলে আমরা বুঝব, আপনি ফালতু খরচ করেন। তাই বার্ষিক বোনাসের টাকা আপনাকে দেওয়া হবে না। কেননা আপনি সেটাও উড়িয়ে দেবেন। আপনি যদি একদম ঠিকঠাক কাপড় পরে অফিসে আসেন, সে ক্ষেত্রে আমরা বুঝব, আপনি বেশ ভালোই আছেন। তাহলে বোনাসের টাকা নিয়ে করবেনটা কী শুনি?
সারমর্ম হলো, এই যে বাজেট নিয়ে এত বাগাড়ম্বর, এর সবই ধনীদের জন্য। যারা ভালো আছে তাদের জন্য। আর যাদের করের টাকায়, শুক্লের টাকায় এই বাজেট তারা রাস্তায় হয়রাণি হবে, প্যাঁদানি খাবে, পেট্রোল বোমা খাবে। অথবা চুপ থাকো!
আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু, দ্রিঘাংচু নামক একটা স্যাটায়ার অনলাইন পোর্টালেরও সম্পাদক, গত বছর বাজেট ঘোষণার দিন আমাকে ফেসবুকের ইনবক্সে ধরলো, ’বন্ধু, তুমিতো অর্থনীতির ছাত্র। বাজেট নিয়ে আমাকে একটা লেখা দাও!’ আমি রীতিমত হতভম্ব, ব্যথিত! এত এত বিষয় ভুলে গিয়ে ও শুধু আমার অর্থনীতিতে পড়ার অংশটুকুই মনে রাখলো???
শেষ করার আগে বাজেট নিয়ে লেখা সেই বিখ্যাত ছড়া-
‘বাজেট বাজেট মরার বাজেট
বাজেট আলুর দম
বড়র পাতে পড়ল বেশি
ছোটর পাতে কম।’
সবাইকে বাজেট মোবারক! ঝাঁঝ টের পাচ্ছেন না?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:২৮