‘লতিফুল ইসলাম শিবলী’ নামটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম!
বইটা আমি কিনেছি ‘দারবিশ’ নামটা দেখে আর পরিচিত বেশ কয়েকজনের কেনা বইয়ের তালিকায় বইটার উপস্থিতি দেখে, যাদেরকে আমি খুবই উচ্চ মানের পাঠক হিসাবে গণ্য করি!
যারা ষাট এর দশকে বড় হয়েছে, তারা স্বয়ং এমেরিকায় ভিয়েতনামবিরোধী যুদ্ধের বিরুদ্ধে ৬০ মিলিয়ন তরুনের দেশব্যাপি অহিংস বিপ্লব দেখেছে, যেখানে হিপ্পিরা জটাধারী চুল আর এ্যান্টিকালচারের (অবাধ সেক্স, ড্রাগস, রক এন রোল) শ্লোগান দিয়ে দেশব্যাপি ঘুরে বেড়িয়েছে। ভারত দেখেছে একদল স্বপ্নবান যুবকের বিপ্লব প্রতিষ্ঠার ‘ব্যর্থ’ চেষ্টা, শেষে শুধু নকশাল হবার অপরাধে অঘোরে প্রাণ দিতে হয়েছে অজস্র মেধাবী যুবককে! ৭০ এর দশকে বেড়ে উঠা যুবকেরা এই কারণে নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান মনে করে যে, তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে, একটা দেশের জন্ম দেখেছে আর দেখেছে রাজনীতির উত্থান-পতন।
আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে বড় হয়েছি, আমাদের গর্বের জায়গা দুটো, গণতন্ত্রের উত্থান আর ব্যান্ড সংগীতের বিপ্লব! যদিও তার বহু আগে ব্যান্ড সংগীত দুনিয়াব্যাপি তরুনদের হৃদয় দখল করে নিয়েছে। আমাদের এখানে এসেছে বেশ পরে...
দিন নেই, রাত নেই আমরা আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, আজম খান শুনি! তার সঙ্গে একটু সিনিয়র হয়ে যাওয়া সোলস, রেঁনেসা শুনি। বিশ্বাস হয় কীনা জানি না, বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত শুনেও আমাদের রক্ত টগবগ করতো! আমরা সকাল-বিকাল ‘সুস্মিতার সবুজ ওড়না’র প্রেমে পড়তাম, আর ‘কষ্ট পেতে ভালবাসতাম’!
যেসব গীতিকার এসব অসাধারণ সব গান আমাদের সামনে হাজির করতেন, তাদের একজন লতিফুল ইসলাম শিবলী! মনে আছে তার লেখা ‘জেল থেকে বলছি’, ‘তুমি আমার প্রথম সকাল’, ‘হাজার বর্ষারাত’ অথবা ‘আমি কষ্ট পেতে ভালবাসি’র কথা? বইয়ের ফ্ল্যাপে যখন এসব তথ্য দেখলাম, আমি খানিকটা নড়েচড়ে বসলাম! নিজের অজ্ঞতার জন্যে হাসি পাচ্ছিল খুব! সেই প্রিয় গীতিকারের উপন্যাস হাতে আসলে আরও একবার রক্ত টগবগ করে উঠবে- সে তো অবশ্যম্ভাবী! যাই হোক, ‘দারবিশ’ উপন্যাস প্রসঙ্গে আসি...
সেক্স, ড্রাগস এন্ড রক এন রোল– এই তিনটি নিষিদ্ধ শব্দ ছিলো ষাট, সত্তর আর আশি দশকের হতাশাগ্রস্থ আমেরিকান তারুণ্যের আশ্রয়। যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ আর শীতল যুদ্ধে অস্থির টালমাটাল আমেরিকা, সেই সময়ে অভিমানী এক তরুণ ঢাকা থেকে চলে গিয়েছিলো আমেরিকার সান-ফ্রান্সিসকোতে ডাক্তারি পড়তে। এটা সেই সান-ফ্রান্সিসকো যাকে বলা হত ‘এন্টি কালচার’ বা হিপ্পি আন্দোলনের রাজধানী।
জামশেদ নামের বাংলাদেশী সেই তরুনও হিপ্পিদের দলে ভিড়ে যায়, যার চোখে কোন স্বপ্ন নেই, অথচ বুকে আফরোজা নামের এক নারীর ভালবাসা। ভিয়েতনাম বিরোধী শান্তি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে করতেই তার চোখে পড়ছিল পুঁজিবাদের গভীর অসঙ্গতি! সেই আন্দোলনেই পরিচয় হয় প্রখর বুদ্ধিমতি আর রাজনীতি সচেতন মেলিনি নামের এক তরুনীর সাথে! তারপর প্রেম এবং রাশিয়ার চর উপাধি পাওয়ার ‘অপরাধে’ পালিয়ে বেড়ানো। চোরাই পথে মেক্সিকো পালানোর সময় জামশেদ ধরা পড়ে যায়, মেলিনি পালাতে পারে বটে তবে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না।
সাত বছর জেল খেটে ফিরে আসে জামশেদ! কিন্তু তার হৃদয়জুড়ে শুধুই মেলিনি। টেক্সাসের পথে পথে, মেক্সিকোর সীমান্তে খুঁজে বেড়ায় মেলিনিকে! কিন্তু সেই স্থির, স্বচ্ছ নদীর জলও ফিরিয়ে দেয় জামশেদকে... এই সাত বছর জুয়া খেলে কাটায় জামশেদ আর রোজগার করে প্রচুর টাকা!
এই গল্প জামশেদ তারই সেক্রেটারি, রোদেলা নামের এক তরুনীকে বলতে থাকে, যার সন্জু নামের একটা বয়ফ্রেন্ড আছে এবং যাকে জামশেদ তার অপূর্ণ স্বপ্নের পূর্ণতার কারিগর বলে মনে করে! ওদিকে রোদেলার সাথে জামশেদের সম্পর্কটা আসলে কী - এই ভেবেই সন্জু তার জীবনটা প্রায় শেষ করে দিতে যাচ্ছে!
বইটা পড়তে গিয়ে শিবলী’র সাথে আমিও যেন টেক্সাসের পথে পথে হাঁটছি, মনে হয় সান ফ্র্যান্সিসকোর হিপ্পিদের আমিও একজন, বারিধারার পুরনো একটা বাড়ির আমিও সদস্য। একেবারে তরতাজা গল্প। বাংলাদেশের অংশটুকু সিনেমাটিক মনে হয়, বাকিটা নতুন!
সারা বই জুড়ে লেখক ভালবাসার গল্প বলেছেন। বলেছেন, ভালবাসলে গোটাটা বাসতে। হৃদয়ের দখল নেয়া রাজ্য দখলেরও চেয়েও কঠিন! বলেছেন, ভাল থাকতে হলে ক্ষমা করে দিতে হবে আর ভুলে যেতে হবে, তা না হলে বেঁচে থাকাটাই নরকতূল্য হয়ে যায়। লেখক নিজে একজন গীতিকবি বলেই সম্ভবত: গোটা বইয়ে কাব্যের একটা সংশ্লেষ পাওয়া যায়! স্বত:স্ফুর্ত গল্প বলার ঢং, টানটান উত্তেজনা...দারুণ লাগে!
নালন্দা থেকে বের হওয়া, ১১০ পৃষ্ঠার বইটার দাম ৩০০ টাকা। দামটা একটু বেশিই! তবে বইটা পড়ার পর সেটা আর মনে থাকে না। পড়ে দেখতে পারেন!
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১৭ দুপুর ২:০৩