নানা বাড়িতে জন্ম। আর আমার জন্মসূচিকাগার থেকে সেই নদীর দুরত্ব প্রায় দুশো গজের মতো। ছোটবেলায় নানা বাড়িতেই আমার বেড়ে ওঠা। যেই নদীর কথা আমি বলছি, তার পাশেই ছিল আমার স্কুল। মরা নদী হিসেবে খ্যাত এই নদীই কেড়ে নিয়েছিল আমার সাত মা-খালার পরে জন্ম হওয়ার একজন মামাকে। সেই থেকে নানা-নানী বিকারগ্রস্ত। স্কুল থেকে যেদিন আমি আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে শিখলাম, বাড়িতে এসে সবার আগে নানাকে মুখস্থ শুনালাম, তখন নানার ভেতরে ছেলে বিয়োগের মর্মর ব্যথা তার চোখ গলে গলে পড়ছিল।
তখন আমি নানাবাড়িতেই থাকতাম। দুঃসম্পর্কের মামাত ভাইদের সাথে স্কুল ফাঁকি দিয়ে যেতাম মহিষ চড়াতে। সেই নদীর ঘাটপাড়ে। নিয়মিত যেতে লাগলাম। একবার তো সেখানকার খুদে সাঁতারু দলে ভর্তি হলাম বিনা ফিতে। গাঁয়ের ছেলেদের সঙ্গে ঘণ্টা চারেক নদীতে দাপাদাপি করা আমার দৈনন্দিন রুটিন হয়ে গেল। বর্ষার ভেজা মাটিতে কাটা স্লাইড দিয়ে পানিতে গড়িয়ে পড়া আর শীতে জেগে ওঠা বালুচরে গড়াগড়ি দিয়ে শীতল শরীর তপ্ত করার জন্য প্রতিদিন আমাদের ডাক দিয়ে যেত এই নদী। তবে জীবনে কোনো সুখই চিরস্থায়ী নয়। গ্রামে কয়েক বছর বসবাস করে নানির আদরে আমি মহা মাস্তান ও গাঁইয়া হয়ে গেছি বলে খবর রটে গেল। ফলে সন্ত্রস্ত বাবা-মা আমাকে শহরে নিয়ে গেল। হঠাৎ করেই জীবন থেকে হারিয়ে গেল তরল কাদামাটি,ধবল বালুচর আর মরা নদীর গজরানো পানি।
আজ ‘নদী বাঁচলে বাঁচবে বাংলাদেশ’ কথাটি শুনে যেন মুহুর্মুহু করে উঠল দেহমন। পুরাতন সেই স্মৃতিরা চারা দিয়ে উঠল। যেন হাজার বছর মোমি করে রাখা পুতুল সহসা জীবন ফিরে পেল। কিন্তু মাঝেমধ্যে খুব জানতে ইচ্ছে করে, আসলে কি নদী বাঁচলে বাঁচবে বাংলাদেশ? আমরা জানি, বইয়ের পাতায় বহুত পড়েছি— আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশের ভূখণ্ড নদীবিধৌত। কমবেশি সাতশত দশটি নদীর মিলিত দৈর্ঘ্য প্রায় পঁচিশ হাজার কিলোমিটার বলেই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডকে নদীমাতৃক কিংবা নদীবিধৌত বলা হয়। এদেশের অলি-গলিজুড়ে ঝুঁপির ভেতর থাকা সুপ্ত সাপের মতো শুয়ে আছে আমাদের এসব নদী। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর সংহতির চলমান স্রোতধারা এই নদী। প্রকৃতপ্রস্তাবে এদেশের নদী-ঐতিহ্য আমাদের জীবনধারার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। নদীকেন্দ্রিক জীবনাচার,দিনাতিপাত এদেশের মানুষকে হাসিকান্নায়,সুখ-দুঃখে জীবনের উষ্ণ-জীবন্ত পরশে আপ্লুত করে, সমৃদ্ধ করে। জীবনকে অর্থবহ করে। মানুষ জীবনের মর্ম খুঁজে পায়। জীবনকে উপভোগ করে। নদীর ভাঙাগড়া,জীবনের চড়াই-উৎরাইকে সমার্থক করে তুলে। এদেশে নদী একটি ঐতিহ্য। আমাদের সাতশত দশটি নদীর সাতান্নটি মাত্র অভিন্ন নদী। যার তিনটি ছাড়া বাকি চুয়ান্নটি পার্শ্ববর্তী ভারতের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে। এদের ভিতর সুরমা-মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা এর মোট ড্রেনেজ এলাকা ১.৭৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। শুধু সুরমা-মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীর মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় ১৩৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি সাগরে পতিত হয়। এদের ভিতর আবার সুরমা-মেঘনা নদীর মাধ্যমে বছরে ১৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মাধ্যমে ৭০০ বিলিয়ন ঘনমিটার এবং পদ্মা-গঙ্গার মধ্য দিয়ে ৫০০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। ভারত কর্তৃক ফারাক্কা,তিস্তাসহ সকল ট্রান্স বাউন্ডারি প্রবাহগুলোতে একপেশে বাঁধ ও পানি নিয়ন্ত্রণের অবকাঠামো নির্ণয় করে পানি প্রত্যাহার করার ফলে ভিন্ন ঋতুতে, বিশেষ করে শীতকালে বাংলাদেশের নদীগুলোর পানি বিপজ্জনক মাত্রায় প্রবাহ সংকটে পড়েছে। পানির উচ্চতা বিভিন্ন নদীতে আশংকাজনকভাবে নিচে নেমে গেছে।
এ সৃষ্ট ব্যবস্থা বাংলাদেশের প্রবহমান জলাশয়কে বিশেষ করে নদনদীকে দারুণ জীবনমরণ সংকটে ফেলে দিয়েছে। বলা যায়, নদীমাতৃক এই দেশে এখন নদীরাই বিপদে আছে। দেশের আড়াই শতাধিক ঐতিহ্যবাহী,নান্দনিক নদ নদী মরে গেছে। অনেকগুলো বেদখল হয়েছে। অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে। এভাবেই দেশের প্রায় ৯৯% নদী তাদের গভীরতা,আকার আকৃতি হারাচ্ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ। হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য। নদীসংস্কৃতি,নদী-জীবনধারা, নদীকেন্দ্রিক জীবনাচার। অস্তিত্বের সাথে ঐতিহ্য দারুণভাবে বিপন্ন। বিপন্ন ঐতিহ্য পরিবেশ বিপন্নতাকে দারুণভাবে জানান দিচ্ছে। সারা বছর। ঐতিহাসিকভাবে নদী ঐতিহ্যে আমরা সমৃদ্ধ। আমাদের আছে সরল নদী, অভিন্ন নদী, আঞ্চলিক নদী, আন্তর্জাতিক নদী, আন্তঃসীমান্ত নদী। আছে স্বাধীন নদী, সীমান্ত নদী। গঙ্গা,ব্রহ্মপুত্র,গোমতি, সুরমা, কুশিয়ারা, মহানন্দা, তিস্তা, নাফ, কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, বাঁকখালী প্রভৃতি আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের নদ নদী। জাতীয় নদীর সংজ্ঞায় দু একটি নদী থাকলেও আমাদের সুনির্দিষ্ট জাতীয় নদী নেই। হালদাকে জাতীয় নদীর স্বীকৃতির দাবি আছে।
এদেশে প্রাচীন শহর আছে। শহরের পাশে নদী আছে। অর্থাৎ নদীকেন্দ্রিক শহর আছে। ঐতিহ্যের লালন ও চর্চা আছে। এভাবেই রাজশাহী শহরটি গড়ে উঠেছে গঙ্গা বা পদ্মার পাড়ে। ঢাকা মহানগরী এক সময় বুড়িগঙ্গার প্রাণবন্ত প্রবাহের নান্দনিকতা নিয়ে গড়ে উঠে। তিলে তিলে সমৃদ্ধ হয়। ময়মনসিংহ প্রাচীন শহর গড়ে ওঠে ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষে। এভাবে করতোয়ার পাড়ে বগুড়া, ইছামতির পাড়ে পাবনা, কর্ণফুলীর তীরে চট্টগ্রাম,পশুর নদীর পাড়ে খুলনা, গোমতির পাড়ে কুমিল্লা, মেঘনার পাড়ে ভৈরব, সুরমা পাড়ে সিলেট নগরী গড়ে ওঠে। মানুষ বাড়ায় সাথে শহর-নগরের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। আয়তন বেড়েছে। কর্মচঞ্চলতা বেড়েছে। একই সাথে প্রায় সমভাবে বেড়েছে পার্শ্ববর্তী নদ-নদীগুলোতে বিড়ম্বনা। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, বগুড়ার করতোয়া, পাবনার ইছামতি, কুমিল্লার গোমতি এসবের উদাহরণ। কোনটি মরে গেছে। কোনটি প্রবাহ হারিয়ে ফেলেছে। কোনটি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। কাসালং,কীর্তনখোলা, কান্তি, কীর্তিনাশা, কুকুয়া, কুমার আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। চিত্রা, চেংগি, চিরি, বিলাই চুনার বা ছোট ঢেপা, ছোট পদ্মা, ছোট ফেনি, ছোট যমুনা প্রভৃতি আমাদের অস্তিত্বের অংশ। তিতাস, তিস্তা, তুরাগ, তুলসী, তুলসীগঙ্গা, তেঁতুলিয়া, তোরষা আমাদের জীবনাচারের অনুষঙ্গ। নাফ, নিতাই, নারোদ, নান্দা, নীল কমল, নীলকুমার অথবা পদ্মা, পশুর, পাগলা, গঙ্গা, পাণ্ডো, পাথরঘাটা, পানগুচি, পায়রা, পুনর্ভবা, পুটিমারি প্রভৃতি নদীকে আমাদের ঐতিহ্য ও অহঙ্কারের লক্ষ্যে পরিণত করে তাদের সংরক্ষণে আমরা যথাযথভাবে এগিয়ে আসছি না। ঐতিহ্য হারিয়ে ইতিহাস রচনায় মাহাত্ম্য নেই। আমাদের কর্মকাণ্ড, উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা, নিষ্ক্রিয়তা শত নদ নদীপ্রবাহকে দারুণভাবে বিপন্ন করে তুলছে। হারিয়েছি অনেক। ঐতিহ্য তলানিতে এসে মিশেছে। পানিরাজনীতি, পানিসংকট আমাদের গ্রাস করতে তেড়ে আসছে। জীবনযাত্রার উন্নতির সাথে সাথে প্রতিনিয়ত আবর্জনার পরিমাণ বাড়ছে আর সেই সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে পানিদূষণ। কারণ, এদেশের আবর্জনা ও বর্জ্যের বেশিরভাগ যাচ্ছে নদী কিংবা সাগরে। সারা বিশ্বের কথা বাদ দিলে শুধু বাংলাদেশেই আছে অনেক নদী,যেগুলো নামে নদী হলেও আদতে নদী নয়। এগুলোকে অনেকটা মৃত বা আবর্জনার নদীই বলা চলে। আর আবর্জনার কারণে মরে যাওয়া নদী দেখতে হলে খুব দূরে যেতে হবে না।
অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, শহরঘেষা নদীগুলো নগরায়নের পয়ঃ ও রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদী-জলাশয়েই পতিত হয়। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের চারদিক দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো পয়ঃ ও রাসায়নিক বর্জ্যে এতটাই দূষিত হয়ে পড়েছে,এসব নদীর পানি অনেক আগেই ব্যবহারের উপযোগিতা হারিয়েছে। চাক্তাই খাল,রাজাখালি খাল ইত্যাদি রীতিমতো বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এর দূষণের বড় কারণ কালুরঘাট এর শিল্পকারখানা। আবার রাজধানী ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার জন্য ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকলেও আজো স্থানান্তর সম্ভব হয়নি। সাভারের যে এলাকায় স্থানান্তর করা হবে সে এলাকায় এখনো ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করা হলেও চালু করা সম্ভব হয়নি,আবার যে অর্ধতরল বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে পাওয়া যাবে সেটার কোনো পরিকল্পনা তৈরি হয়নি। জানা গেছে, প্রতিদিন হাজারীবাগ থেকে ২১ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় পতিত হয়। বুড়িগঙ্গা কেন, বালু, তুরাগ, কর্ণফুলী, শীতলক্ষায়ও প্রতিদিন নির্বিচারে তরল বর্জ্য পতিত হচ্ছে। দেশের অন্যান্য নগরী ও শিল্পাঞ্চলের আশপাশের নদী-জলাশয়ও একই পরিস্থিতির শিকার। তাছাড়া পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বিচার করলেও বাংলাদেশের অবস্থান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের মাটির ওপরের ও নিচের দু’ধরনের পানির অবস্থাই সংকটপূর্ণ। মাটির নিচের পানি উত্তোলনের প্রবণতা অনেক বেশি। প্রতি বছর ভূগর্ভ থেকে যে পানি উত্তোলন করা হয়,যার ৫০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে, ৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কলকারখানায়, অবশিষ্ট গৃহস্থালির কাজে। ভূগর্ভস্থ থেকে এত গরিষ্ঠহারে পানি তোলার কারণে পরিবেশগত ঝুঁকিও বাড়ছে দিন দিন। তাই বিপন্ন বা মরণাপন্ন নদীগুলোকে বহুমুখী সমস্যার হাত থেকে বাঁচাতে আমাদেরকেই সচেতন হতে হবে। নির্ধারিত স্থান ছাড়া শিল্পাঞ্চল করা অনুচিত ও বেআইনী, কাজেই সংজ্ঞাহীন বিষয় বিচার বিশ্লেষণ করে অবিলম্বে নদী দখল ও দূষণমুক্ত করে বাঁচাতে হবে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। ময়লা আবর্জনা ও বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। তবেই বাঁচবে নদী, বাঁচবে বাংলাদেশ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১১:০৩