‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’। বাংলাদেশের বাউল-সাধক শাহ আব্দুল করিমের একটি অমর গান। এই গানের মাধ্যমে হয়ত তিনি তার আমলের/জেনারেশনের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার চেস্টা করেছেন। এমনিভাবে আমরা যদি দাদা-দাদী, নানা-নানী বা যেকোন বয়োবৃদ্ধ মানুষের সাথে আলাপে বসি তাহলে উনাদের মুখ থেকে প্রায়শঃ একটা স্বগোক্তি বেরিয়ে আসে, ‘আহারে! আমাদের যুগ কতই না সুন্দর ছিল’!
আমার বেলায় কেন যেন এর বিপরীতটাই ঘটেছে বারবার। যেমন, যখন স্কুলে পড়ি তখন আমাদের সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী বেশ হতাশ হয়ে বলতেন, “তোমাদের এই ব্যাচটাই আমার দেখা সবচেয়ে খারাপ”। এই ধারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও বহাল থেকেছে। যদিও মনে মনে আমরা নিজেদের সেরাই ভাবতাম।
আসলে সব প্রজন্মের মানুষেরই একটি সাধারণ প্রবণতা হলো, নিজেদের সময়কে সেরা মনে করা। তাই ৮০ পেরোনো একজন বৃদ্ধকে যেমন বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের সময়ই ছিল সেরা’, একইভাবে একজন মধ্যবয়সী তা-ই মনে করেন। আবার বর্তমান তরুণ প্রজন্মও মনে করে, তাদের সময়টাই সেরা। আসলে কোন সময় বা প্রজন্ম সেরা, সেটি নিয়ে বিতর্কের যেন শেষ নেই। নিরপেক্ষভাবে একজন ইতিহাসবিদ, গবেষক বা সমাজবিজ্ঞানীর জন্য এককভাবে একটি সেরা প্রজন্ম নির্ধারণ করাও তাই কঠিন।
তবে একবিংশ শতাব্দীর আগে-পরে জন্ম নেওয়া মিলেনিয়াল প্রজন্মকে নিয়ে যেমন বিতর্কটা একটু বেশিই। অনেক গবেষকের মতে, এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ হলো মিলেনিয়াল প্রজন্ম। ‘খারাপ’ এ প্রজন্মের সঙ্গে কীভাবে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, সেটি নিয়েও চলছে গবেষণা।
মিলেনিয়ালদের নিয়ে চলা এ বিতর্কের সমাধান টানতে একটি উদ্যোগ নিয়েছে মার্কিন ম্যাগাজিন ‘দ্য আটলান্টিক’। ম্যাগাজিনটি একটি প্রবন্ধে মিলেনিয়ালসহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পাঁচটি প্রজন্মের নামকরণের কারণ ও বৈশিষ্ট্য তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছে। সেখানে পাঁচটি প্রজন্মের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এভাবে:
গ্রেটেস্ট জেনারেশন: আক্ষরিক অর্থে বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় ‘সবচেয়ে মহৎ প্রজন্ম’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রজন্মকে যেমন এ দেশে সূর্যসন্তান বলা হয়, ঠিক তেমন প্রজন্মই হলো গ্রেটেস্ট জেনারেশন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হয়ে যাঁরা যুদ্ধে অংশ নেন ও শহীদ হন, তাঁরাই এ প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীরদের সম্মান জানাতে মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক টম ব্রোকা ‘গ্রেটেস্ট জেনারেশন’ নামটি প্রথম ব্যবহার করেন। তারপর থেকেই নামটি সবাই ব্যবহার করতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়কে গ্রেটেস্ট জেনারেশনের সময়কাল ধরা হয়।
‘আমরাই সেরা’ এই হিসেব ত চুকে গেল মনে হচ্ছে। কেননা ‘গ্রেটেস্ট জেনারেশন’ ত পেয়ে গেলাম। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না।
বেবি বুমারস: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে বলা হয় বেবি বুমারস। আধুনিক ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আলোচিত প্রজন্ম বেবি বুমারস। যুদ্ধের কারণেই অনেক পুরুষ মারা যান। অনেক নারী যুদ্ধাপরাধের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। এসব কারণে সে সময় বিশ্বজুড়ে একটি সামাজিক বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়। যুদ্ধফেরত অনেক পুরুষই অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এতে ওই সময় শিশু জন্মহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এসব কারণে ওই সময়ে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত বেশ কিছু তফাত চোখে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের শুমারি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বেবি বুমারস প্রজন্মের বর্তমান বয়স ৫২ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে।
‘যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ’। ‘বেবি বুমারস’দের কথা জেনে আমার ত তাই মনে হচ্ছে। ভাগ্যিস এর মধ্যে পড়িনি।
জেনারেশন এক্স: ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে বলা হয় জেনারেশন এক্স। বেবি বুমারস-পরবর্তী প্রজন্ম হওয়ায় এদের ‘বেবি বাস্ট’ বলা হয়। এই প্রজন্মকে অনেক ইতিহাসবিদ বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার প্রজন্ম নামেও অভিহিত করেন।
আমরা অনেকেই হয়ত ‘জেনারেশন এক্স’ বা বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার প্রজন্মের সন্তান। দেখা যাচ্ছে, আমাদের সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী খুব একটা বাড়িয়ে বলেন নি।
জেনারেশন ওয়াই: ১৯৭০-এর মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ২০০০ সালের আগে জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে বলা হয় জেনারেশন ওয়াই। এই প্রজন্মকে অন্তর্বর্তীকালীন একটি প্রজন্ম হিসেবে ধরা হয়। কারণ, তারা জেনারেশন এক্সের মতো হতে পারেনি, আবার মিলেনিয়াল প্রজন্মের সঙ্গেও খাপ খাওয়াতে পারেনি।
জেনারেশন এক্স এবং জেনারেশন ওয়াই এর সীমা নিয়ে একটা সূক্ষ প্যাচ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদের অবস্থা ‘না ঘরকা না ঘাটকা’র মত। সবচেয়ে বিপদস্ত প্রজন্ম।
মিলেনিয়ালস: গবেষক নিল হাউ ও উইলিয়াম স্ট্রাউস মিলেনিয়াল প্রজন্মের নামটি প্রথম ব্যবহার করেন। ১৯৮২ থেকে ২০০৪ সাল সময়ের মধ্যে জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে বলা হয় মিলেনিয়াল প্রজন্ম। একটি গবেষণা অনুযায়ী, মিলেনিয়াল প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ডিজিটাল জ্ঞান। তবে এর সঙ্গে মানবিক গুণাবলি অর্জনেও যত্নশীল এই প্রজন্ম।
পেয়ে গেছি ‘ডিজিটাল জেনারেশন’।
এরপর কি?
মিলেনিয়াল প্রজন্মের পরবর্তী ১০ বছরে যারা জন্ম নিয়েছে, তাদের নাম এখনো ঠিক করতে পারেননি ইতিহাসবিদেরা। এই প্রজন্মের মেয়াদ কত ধরা হবে এবং কী নাম দেওয়া হবে, সেটি নিয়ে এখন গবেষণা চলছে। তাদের গবেষণা চলতে থাকুক।
ইতিহাসবিদেরা এই প্রজন্মের নাম ঠিক করতে না পারলেও আমাদের চেস্টা করতে দোষ কোথায়। কি বলেন? আমরা এই প্রজন্মের নাম দিলাম ‘জেনারেশন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং’। আমার ধারণা বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে ও এরচেয়ে যুতসই নাম আর পাওয়া যাবে না।
সবশেষে ‘দ্য আটলান্টিক’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোন প্রজন্ম সবচেয়ে খারাপ—এটি আসলে নির্ধারণ করে গণমাধ্যম।
বিঃদ্রঃ ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা আটলান্টিক ম্যাগাজিন ও ইন্টারনেট অবলম্বনে এই প্রতিবেদনটি তৈরী করেছিল। আমি কিছু এদিক-সেদিক করে হুবহু তুলে দিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১২:১১