হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। এটি নিছক একটি নাম নয়। এটি একটি বিশ্বাসের নাম। একটি মহান ধর্মবিশ্বাস তথা ইসলামের মহান প্রবর্তকের নাম। তিনি সর্বযুগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। সবার মতে, তিনি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর এই বিশেষত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেই চূড়ান্ত সফলতা অর্জন। তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল তেমনই রাজনৈতিক জীবনেও।
শুধু মানুষ নয় স্বয়ং মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রেরিত সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ "বার্তাবাহক"কে উচ্চতম সম্মানিতস্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রাহমাতুল্লিল আলামিন বা সমগ্র বিশ্বের রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। শ্রদ্ধার সাথে মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় রাসুলকে ‘হাবিব’ নামে ডেকেছেন। সমগ্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় রাসুক (সাঃ) কে কিভাবে সম্মানিত করেছেন সেটাই আজকের আলোচ্য বিষয়।
মহান রাব্বুল আলামিন সমগ্র কুরআনে একবারও আমাদের প্রিয় রাসুলকে [ﷺ] সরাসরি "মুহাম্মদ" (যেমন, হে মুহাম্মদ) বলে ডাকেননি!! সুরা আল ফাতিহা থেকে আল-নাস পর্যন্ত কোথাও এর নজীর পাওয়া যাবে না। অথচ অন্যান্য নবী-রাসুলগণের (আঃ) বেলায় কিন্তু তেমন ঘটেনি। আল্লাহতায়ালা তাঁদের সরাসরি নাম ধরেই ডেকেছেন। যেমনঃ
"হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী উদ্যানে বসবাস কর। (৭:১৯)
‘হে নূহ, তোমার ও তোমার সাথে যে উম্মত রয়েছে তাদের উপর আমার পক্ষ থেকে শান্তি ও বরকতসহ অবতরণ কর।" (১১:৪৮)
“হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিয়েছো৷"(৩৭:১০৫)
"হে দাঊদ! নিশ্চয় আমি তোমাকে যমীনে খলীফা বানিয়েছি। (৩৮:২৬)
"হে মুসা! তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর।” (২০:১৯)
"হে ইয়াহ্ইয়া! দৃঢ়তার সাথে এই গ্রন্থ (তাওরাত) ধারণ কর"। (১৯:১২)
"হে যাকারিয়া," "আমি তোমাকে এক পুত্রের সুসংবাদ দান করছি এবং তার নাম হবে ইয়াহিয়া’। (১৯:৭)
কিন্তু যখনই আমাদের প্রিয় রাসুল [ﷺ] কে ডাকার প্রয়োজন বোধ করেছেন তখন মহান আল্লাহ সরাসরি নাম ধরে না ডেকে দারুণ সব উপাধিতে ডেকেছেন। যেমন, “ইয়া আয়্যুহাল মুদ্দাসসির”, “ইয়া আয়্যুহাল মুযযাম্মিল”, “ইয়া আয়্যুহাররাসুল”, “ইয়া আয়্যুহান্নাবি”।
যেমনঃ
“হে নবী! আল্লাহকে ভয় কর এবং কাফিরদের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করনা”। (৩৩:১)
“হে বস্ত্রাবৃত! রাতে নামাযে দাঁড়াও তবে (রাতের) কিছু অংশ বাদে” (৭৩:১-২)
”বলুন হে প্রিয় হাবীব! যুদ্ধেপ্রাপ্ত সম্পদের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল [ﷺ]।” (আন্-ফাল-১)
“হে প্রিয় রাসুল, আমি আপনাকে চাক্ষুস স্বাক্ষী, জান্নাতের সুসংবাদদাতা ও জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শনের ক্ষমতা দিয়ে প্রেরণ করেছি (আল-ফাত্হঃ ৮-৯)
“হে প্রিয় রাসুল, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী - এমন কাউকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুলের বিরুদ্ধাচরণকারীর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনকারীরূপে পাবেননা।” (মুজাদালাহ-২২)
সুবহানআল্লাহ!!!
আর যখন আল্লাহতায়ালা নবীর [ﷺ] পবিত্র নাম “মুহাম্মদ” ব্যবহার করার একান্ত প্রয়োজন বোধ করেছেন তখন নামের সাথে রিসালাত যোগ করে দিয়েছেন। যেমন,
“মুহাম্মাদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়; তবে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী”। (৩৩:৪০)
রাসুলে করিম (সা.)-এর উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহপাক বলেন, 'ওয়া রাফা’না লাকা যিকরাক'। অর্থাৎ, আমি আপনার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি। (সূরা আল-ইনশিরাহ, আয়াত-৪)
কতইনা মর্যাদা দেয়া হয়েছে নবী [ﷺ] কে!! আযান, সালাত, কালিমা, খুৎবা, মানব ইতিহাস, আল্লাহ এবং সকল ফেরেশতা তার নামের পর সালাম পাঠ করে, এমনকি সালাতের ভিতরে পাঠ করা হয় “আল্লাহুম্মা সাল্লিয়ালা মুহাম্মাদ ওয়ালা আলি মুহাম্মাদ”। কোরআনুল কারিমে এসেছে 'নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরূদ পাঠ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করো এবং তাঁকে যথাযথভাবে সম্মান করো।' (সুরা আল-আহযাব, আয়াত-৫৬)
সুবহানআল্লাহ!!!
রাসুল (সা.)-এর শানে অনেক মহান কবিও অসাধারণ কিছু রচনা লিখে গেছেন। যেমন নাতে রাসুল (সাঃ) এর শ্রেষ্ঠ রূপকার আল্লামা জামির ভাষায়, “হে জ্যোতির্ময়! হে মানব-শ্রেষ্ঠ! আপনার পূত চেহারার দীপ্তি থেকেই চাঁদ আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে। আমরা আপনার যথোপযুক্ত প্রশংসা করতে অক্ষম; বরং সংক্ষিপ্তভাবে আমরা এটিই বলতে পারি আল্লাহর পর তাঁর সৃষ্টিকুলে আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহান”।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) এর শানে পারস্যের অমর কবি মোসলেহউদ্দিন শেখ সাদী (রহঃ) রচয়িতা সুবিখ্যাত ও সুপরিচিত নাত:
সুখ্যাতির ঐ শীর্ষশিরে উঠেছিলেন মোদের নবি
মানবগুণের পূর্ণতায় তিনি ধরার ধ্যানের ছবি।
চরিত্রের মাধুরিমায় জুড়ি তাঁর নাইকো কোথাও
তাঁর নুরের রৌশনীতে জমাট আঁধার হলো উধাও।
আসুন সেই নবির ‘পরে আমরা সবাই দরুদ পড়ি
তাঁর জীবনের আলোকেতে আমরা মোদের জীবন গড়ি।
[বালাগাল উলা বিকামালিহি, কাশাফাদ দুযা বিজামালিহি, হাসুনাত জামিউ খিসালিহি, সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি” এর ভাবানুবাদ।]
আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে মানুষ আল্লাহর নবী (সাঃ) কে খোলাখুলি ভাবে অপমান করতে চায়। তারা খোলাখুলি ভাবেই তা করে। কিন্তু একটি কথা সবার মনে রাখা উচিত আল্লাহর নবী (সাঃ) কে অপমান করা ততটাই নিরর্থক, যতটা হল সূর্যের দিকে থুতু মারা।
আমাদের নবী [ﷺ] এর সম্মান যেকোনো বিদ্রূপের চেয়ে বহুগুণ ঊর্ধ্বে। কেউ যত খুশি অপমান করার করুন এটা বিশ্বাসীদের মনে তার প্রতি যে ভালোবাসা আর সম্মান আছে তাকে আরও বৃদ্ধিই করবে। আর তাদের এইসব চেষ্টাই এটা প্রমাণ করে যে, আমরা আমাদের নবী (সাঃ) কে কতোটা ভালোবাসি।
দরুদঃ
আসুন, আমরা মোস্তফা চরণের অনুরক্ত ভক্ত ও সেবক-সেবিকাগণ- পবিত্র দরুদ শরীফ পাঠ করতে করতে এই প্রসঙ্গের উপসংহার করিঃ
‘হে আল্লাহ তায়ালা, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজনের ওপর তুমি শান্তি ও বরকত নাযিল করো, যেমন শান্তি ও বরকত নাযিল করেছিলে হযরত ইবারাহীম (আঃ) ও তাঁর পরিবার-পরিজনের ওপর। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসা ও মর্যাদার অধিকারী’।
আসুন, আমরাও এই সুরে সুর মিলিয়ে বলিঃ “আমিন!”
কৃতজ্ঞতায়ঃ লেখার বেশীরভাগ অংশ নেয়া হয়েছে নোমান আলী খান এবং নাম না জানা এক বিদেশী শায়খের আলোচনা থেকে। বাদবাকী অন্যান্য সুত্র থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:২৮