somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রহস্যবাদী ইবনে-আরাবিঃ ইসলামী সুফিবাদের সবচেয়ে দূরকল্পী প্রতিভা।

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাছরাঙা টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে জনপ্রিয় তুর্কি ঐতিহাসিক অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ ‘দিরিলিস’। উসমানীয় খেলাফতের পত্তনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এই সিরিয়ালে। এর এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলেন ইবনে-আরাবি। তাঁকে আন্দালুসিয়ার সুফি দরবেশ ও প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে দেখানো হয়েছে যিনি এরতুগরুল ও তার বন্ধুদের সাহায্য করেন। কে ছিলেন ইবনে-আরাবি? কি তাঁর পরিচয়? আদৌ কি এরতুগরুলের সাথে তাঁর কখনো দেখা হয়েছিল? ইত্যাকার সব প্রশ্নের মিমাংসা নিয়েই আজকের আয়োজন। আশা করি সাথেই থাকবেন।

জীবনীঃ
ইবনে-আরাবির মূল নাম মোহাম্মদ এবং পারিবারিক নাম আবু আব্দুল্লাহ মোহম্মদ ইবনুল আলী ইবনুল মোহাম্মদ ইবনুল আরাবী। তিনি ১৭ রমজান, ৫৬১ হিজরি (২৭ অথবা ২৮ জুলাই ১১৬৫ খৃঃ)তারিখে তৎকালীন আন্দালুসিয়া বা বর্তমান স্পেনের মূর্সিয়া নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। আন্দালুসিয়া/মূর্সিয়া নগরীতে জন্ম বলে তাঁকে ‘আন্দালুসি’ ও ‘আল—মূর্সি’ও বলা হয়। তাছাড়া তিনি দামেস্কে মৃত্যুবরণ করায় ডাকা হয় ‘দামেস্কি’। অন্যদিকে ইয়েমেনের সুপ্রসিদ্ধ দাতা হাতেম তাঈ তাঁর পূর্বপুরুষ হওয়ায় ‘আল-হাতেমী’ এবং ‘আল-তাঈ’ উপনামেও তার প্রসিদ্ধি রয়েছে।

ইবনে আরাবী ছিলেন একজন আন্দালুসিয়ার সুফি সাধক, লেখক, ও দার্শনিক। সুফিতত্ত্বে তাঁর অনবদ্য অবদানের কারনে তিনি ‘শেখ আল আকবর মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী’ নামেই সমধিক পরিচিত। এছাড়া তিনি শেখুল আকবর বা জ্ঞানীকুল শিরোমণি, হুজ্জাতুল্লাহিল যাহিরা- আল্লাহর প্রত্যক্ষ্য সাক্ষ্য ও আয়াতুল্লাহিল যাহিরা- আল্লাহর আশ্চ্যর্য ইংগিত নামে সমধিক পরিচিত।



প্রাথমিক জীবনঃ


বাল্য ও শিক্ষাজীবন এই সেভিলেই কেটেছে তার।

ইবনে আরাবির পিতা আলী ইবনে মুহাম্মাদ মুর্সিয়ার স্বাধীন শাসক আবু আব্দুল্লাহের প্রশাসনের কাজ করতেন। পরবর্তীতে আল-মুওয়াহিদীন সুলতান প্রথম আবু ইয়াকুব ইউসুফ মুর্সিয়া, ভ্যালেন্সিয়া, লোরকা ইত্যাদি দখল করে নিলে ১১৭২ খ্রিস্টাব্দে ইবনে আরাবির পিতা সেভিলে স্থানান্তরিত হন এবং স্থানীয় প্রশাসনে উপদেস্টা পদে যোগদান করেন।

শিক্ষাজীবনঃ
একজন নামকরা প্রশাসক এবং প্রসিদ্ধ সুফির সন্তান হিসেবে ইবনে-আরাবি খুবই সংবেদনশীল, বুদ্ধিমান এবং সুশৃঙ্খল পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠেন। বাল্যকালেই তিনি আরবি ভাষা ও সাহিত্য এবং প্রথাগত ইসলামী জ্ঞানার্জনে নিয়োজিত থাকেন। সুফিবাদের প্রতি গভীর অনুরাগের কারণে বাল্যকাল থেকেই তিনি ইসলামের অন্তর্নিহিত বিষয়াবলী সম্মন্ধে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ইবনে-আরাবির মতে, তাঁর বয়স যখন পনের তখন তিনি জগদ্বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক এবং স্পেনীয় আইনজ্ঞ ইবন রুশদ এর সাথে সাক্ষাতলাভ করেন এবং ইসলামিক শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে ইবনে রুশদের চিন্তা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন।

অল্প বয়সে বিয়ের ফলে তিনি সেভিলের গভর্নরের করণিক সহকারী (clerical assistant) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তী দশকে তিনি তাফসির, হাদিস এবং ফিকাহ বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি জাহিরি আইনি চিন্তাধারার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তৎকালীন সেভিল এবং সেউতার শ্রেষ্ঠ ইসলামিক পন্ডিতদের নিকট তিনি শিক্ষালাভ করেন। তাঁর অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন আল-মুওয়াহিদীন যুগের ধর্মগুরু।

স্পেন ত্যাগঃ
৩০ বছর বয়সে তিনি স্পেন ত্যাগ করেন এবং উত্তর আফ্রিকা গমন করেন। তিউনিসে থাকাকালীনই তিনি ইসলামের পুবাঞ্চলীয় পবিত্রভূমি সম্পর্কে জানার গভীর ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। এভাবেই ১২০০ সালে তিনি ইসলামের পূর্বের পথে যাত্রা করেন এবং জীবনের বাকি জীবন তিনি এই অঞ্চলেই কাটান।

হজ্বব্রত পালনঃ
ইবনে আরাবি ৫৯৮ হিজরীতে হজ্জব্রত পালন করেন। তিনি তিন বছর মক্কায় বসবাস করেন। সেখানে অবস্থানকালে তিনি পারস্যের এক রহস্যবাদী ব্যক্তির সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয় এবং তার আকর্ষণীয় কিন্তু ধার্মিক কন্যা তাকে ‘তরজুমান আল-আশওয়াক্ব’ (The Interpreter of Desires) রচনা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল, যা একটি রহস্যময়-কাম-রোমান্টিক গীতিকাব্য। এ সময়ই তিনি তাঁর সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থ ‘আল-ফুতুহাত আম মাক্কিয়া’ (মক্কার রহস্যোদঘাটন) লেখা শুরু করেন।

বিরামহীন ভ্রমণ শেষে দামেস্কেঃ
এর পরের দুই দশক পর্যন্ত তিনি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে বিরামহীন দেশভ্রমণ শুরু করেন এবং ইসলামিক আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার সকল দিক সম্পর্কে গভীর জ্ঞানলাভ করেন। একে একে তিউনিসিয়া, মিশর, জেরুজালেম, বাগদাদ, মক্কা, মদিনা, আলেপ্পো, মসুল, সেন্ট্রাল এশিয়া ও তুরস্কের কিছু অংশ ভ্রমণের পর তিনি শেষ পর্যন্ত শিষ্যদের ছোট একটা দল নিয়ে ১২২৩ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কে থিতু হন। এখানেই তিনি সম্ভবত সদরুদ্দিন কুনাভি’র (যিনি পরে ইবনে আরাবির চিন্তাকে ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছেন) বিধমা মাকে বিবাহ করেন।

গভীর পান্ডিত্য অর্জনঃ
ইতিমধ্যে তিনি প্রথাগত ইসলামিক বিজ্ঞানের যথা, তফসীর, হাদীস, ফিকাহ, এবং ইলম আল-কালামের একজন সত্যিকারের ‘মাস্টার’ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। পাশাপাশি সুফিবাদের এক দিকপাল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। অতীতের অন্য অনেক মুসলিম পন্ডিতগণের মত তিনি ইসলামিক বিজ্ঞানের উপর এমন অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে, তাঁর ঘনিষ্ঠ শিষ্যরা তাঁকে ইসলামিক নীতি ও অনুশীলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্ব বলে মনে করতেন। যাইহোক, তাঁর অভ্যন্তরীণ গুণাবলী, আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং শক্তিশালী কল্পনা তাঁকে অন্যান্যদের থেকে আলাদা করেছিল। অন্য কথায়, ইসলামের রহস্যবাদ সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান ও বোঝার ক্ষমতা, তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি, ভক্ত-অনুসারীদের মৌখিক ও লিখিত উভয়ভাবে জানার অসাধারণ ক্ষমতা তাঁকে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে দূরকল্পী প্রতিভা ও লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

ইবনে-আরাবির চিন্তাধারাঃ
মধ্যযুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রহস্যবাদী ছিলেন ইবনে আরাবি। তিনি ছিলেন ইসলামী সুফিবাদের সবচেয়ে দুরকল্পী প্রতিভা। মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান জগতের ব্যবস্থার মতো দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রাচ্যেও মুসলিম ধর্মীয় চিন্তার ভিত্তিতে এক বিরাট সংগঠনের সূচনা হয়। ঔজ্জ্বল্যপূর্ণ (ইশরাকি) বা মেকী এমপেডোক্লিনের নিও-প্লেটনিক ও সর্বেশ্বরবাদী চিন্তার প্রতিনিধি ইবনে আরাবী সুফি আন্দোলনের দূরকল্পী দর্শনের কাঠামোগত আকৃতি দিয়েছিলেন। তাঁর মূখ্য রচনা হল হিকমত আল-ইশরাক (ঔঊজ্জ্বল্যের জ্ঞান)। ঐ চিন্তার অনুসারীদের এই নামে ডাকা হত। কারণ তাদের রহস্যতত্ব অনুযায়ী আল্লাহ ও শক্তির জগত হল আসলে আলোকরশ্মির সমষ্টি এবং তাকে মেনে নেবার যে প্রক্রিয়া তা আসলে বিভিন্ন ক্ষেত্রের শক্তির অন্তবর্তী মাধ্যমের দ্বারা ওপর থেকে ঔজ্জ্বল্য সৃষ্টির প্রণালী। অনুগামীদের কাছে ইবনে-আরাবী ছিলেন আল-শায়খ আল-আকবার বা মহান শিক্ষক। বিশালাকার অসংখ্য রচনাবলীর মাধ্যমে তাঁর দর্শনচিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়।

ইবনে-আরাবির জীবন রহস্যময় ভাবধারার চরম উৎকর্ষ এবং শরীয়তী গোড়ামীর এক অপূর্ব সংমিশ্রন। জানা যায়, মক্কায় অবস্থানকালে তিনি রাসূল (সাঃ) কে ফেরেশতা, নবীগণ ও আউলিয়াসহ আলমে মামুরে তখতে বসে থাকতে দেখেন এবং তার দ্বারা ইলাহী রহস্য উদঘাটন পূর্বক তত্ত্বকথা লিখতে আদিষ্ট হন।

বিচারশাস্ত্রের ক্ষেত্রে তার চিন্তাধারাঃ
ইবনে-আরাবি অন্যান্য ইসলামিক পন্ডিত যেমন, বড়পীর আব্দুল কাদির জ্বিলানী, জালালুদ্দিন রুমি, বাহা-আল-দ্বীন নকশাবন্দ, মুইন-আল-দীন চিশতি অথবা নাজম আল-দিন আল-কুবরার মত আলাদা কোন ‘তরিকা’ কিংবা কোন ‘মাযহাব’ প্রতিষ্ঠা করেননি। এর বিপরীতে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সকল শ্রম, সময় ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর রহস্যবাদী ধারণা ও চিন্তা-ভাবনাকে পাঠ্যপুস্তক এবং পাণ্ডুলিপির আকারে সংরক্ষণ করেছিলেন। তিনি অন্যান্য সুফির মত চারপাশে অসংখ্য ভক্ত-অনুসারী রাখতেন না। তিনি সামান্য কিছু ভক্ত-অনুরাগীকে তাঁর চিন্তা ও দর্শন শিক্ষা দিতেন। মূলতঃ তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল, একটি সমন্বিত রহস্যবাদী দর্শন প্রণয়ন করা, যাতে সেগুলো পড়ে সাধারণ মানুষ তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মেটাতে পারে।

বিচারশাস্ত্রের ক্ষেত্রে ইবনে-আরাবি তাঁর সমসাময়িক ইবন-হাজমের মত জাহিরি (আক্ষরিকতাবাদী) চিন্তাধারার প্রতিনিধি ছিলেন। প্রথাগত ইসলামিক বিজ্ঞানের একজন মাস্টার হওয়া সত্ত্বেও, তিনি ইসলামিক রীতিনীতি ও অনুশীলনে ‘জাহিরি’ এবং 'বাতেনী’ মতবাদকে আলাদা করতে আগ্রহী ছিলেন। দূরকল্পী বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তিনি বাতেনি (রহস্যবাদী) বলে গণ্য হতেন এবং দার্শনিক তত্বের জন্য তিনি ছিলেন এক সর্বেশ্বরবাদী ও অদ্বৈতবাদী ব্যক্তি। তার ‘ওয়াদাহাত আল-উজুদ’ (অস্তিত্বের ঐক্য) তত্ব তাঁর সে পরিচয়েরই সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর তত্বের মূল বক্তব্য ছিল আল্লাহর জ্ঞানের মধ্যে ভাব (আয়ান যাবিতা) হিসেবে সেই বস্তু বিরাজ করত, সেখান থেকেই সেই ভাবের জন্ম ও সেখানেই তার বিলুপ্তি। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে কোন কিছুর সষ্টি হয় না। আল্লাহ হল অন্তর্নিহিত বস্তু ও বিশ্বব্রহ্মান্ড হল তার বাহ্যিক প্রকাশ। নির্যাস ও তার বৈশিষ্ট্য, মানে আল্লাহ ও বিশ্বজগতের মধ্যে কোন বাস্তব পার্থক্য নেই। এখানেই মুসলিম রহস্যবাদ শেষ পযর্ন্ত সর্বেশ্বরবাদে পরিণত হয়। আল্লাহর প্রকাশ ঘটে মানুষের মধ্য দিয়েই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) ছিলেন পরিপূর্ণ মানুষ (আল-ইনসান আল-কামিল)। যিশুর মত মুহাম্মদও (সাঃ) ছিলেন কালিমাহ, বিশ্বের নিয়ন্ত্রণকারী সক্রিয় শক্তি। ইবনে আরাবির বিচারে প্রকৃত রহস্যবাদীর অবশ্যই একজন পথপ্রদর্শক থাকে সেটি হল তার অন্তর্নিহিত চেতনার আলো এবং তিনি সমস্ত ধমেই আল্লাহকে দেখতে পান।

আলোকভিত্তিক চিন্তাধারার সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি ছিলেন ইবনে আবারি। এই চিন্তার প্রভাব কেবলমাত্র পারস্য ও তুর্কি সম্প্রদায়ের মধ্যেই পড়েনি, তা এমনকি দানস স্কটাস, রজার বেকন ও রেমন্ড লুলের মত বিখ্যাত অগাষ্টিনিয়ান পন্ডিতদের মধ্যেও পড়েছিল।

ইবনে আরাবীর রচনাসমগ্রঃ



ইবনে-আরাবি উচ্চমানের লেখক ছিলেন। তাঁর লিখিত বইয়ের সংখ্যা অনেক। ব্রোকেলম্যান কমবেশ ২৩৯টি কাজের কথা উল্লেখ করেছেন। ৮৪টি বই সন্দেহাতীতভাবে ইবনে আরাবীর রচিত বা তাঁর দ্বারা সত্যায়িত, এই বিষয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণাতে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাঁর অনেকে জীবনীকারের মতে, ইবনে আরাবির বহু পান্ডুলিপি এখনো অপ্রকাশিত অবস্থায় আছে। তাঁর কিছু বিখ্যাত রচনা হলো:-

(১)‘ফুতুহাত আল-মক্কিয়া’(The Makkan Revelations) : এটি তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কর্ম। মক্কায় অবস্থানকালীন তিনি এটি রচনা করেছিলেন। এটি ৩৭ টি সফরে ৬টি ভাগে, ৫৬০টি অধ্যায়ে বিভক্ত। একে ধর্মীয় ও আধ্যাত্বিক জ্ঞানের বিশ্বকোষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই গ্রন্থে তিনি ইসলামী শরীয়ত, মারিফত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ফুতুহাত-এর ১৬৭তম অধ্যায়টির নাম কিমিয়া আল-সাআদাহ (সৌভাগ্যের পরশমণি)। এতে মানুষের স্বর্গে আরোহণ সম্মন্ধে একটি রহস্যময় রূপক কাহিনী আছে।

(২) ‘ফুসুস আল হিকাম’: তাঁর আরেকটি সুবিখ্যাত বই। অনেকেই এটিকেই ইবনে আরাবির সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করেন। এই বইটির উপর কমপক্ষে একশো’র বেশী মন্তব্য (Commentaries) লেখা হয়েছে। তিনি বইটি একটি স্বপ্নের মাধ্যমে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) হতে লাভ করেন আর সেভাবেই তিনি তা লিপিবদ্ধ করেন। বইটি ২৭ টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এতে ইবনে-আরাবীর সমগ্র শিক্ষার সংক্ষিপ্তসার রয়েছে।

(৩) ‘কিতাব আল ইসরা ইলা মাকাম আল আসরা’: অপ্রকাশিত গ্রন্থ। এই বইতে তিনি মহানবীর (সাঃ) মিরাজ বা নৈশযাত্রার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। আর এই সপ্তম স্বর্গে মহানবীর (সাঃ) ভ্রমণবৃত্তান্তের বর্ণনা তিনি করেছিলেন বিখ্যাত ইতালীয় কবি দান্তের বহু আগে।

৪) ওয়াহাদাত আল-উজুদঃ তাঁর অন্যতম আলোচিত রচনা। এই বইতে তিনি সৃষ্টি মাত্রই আল্লাহর সন্ধান করেছেন ওয়াহদাতুল ওয়াজুদ বা সর্বেশ্বরবাদ প্রচার করে। তিনি হুলুল বা মানুষে ঐশীরুপ দেখেছেন। এবং বিশ্বাস করেছেন যে, ইলাহীয়তে বা ঐশী সত্তার বিকাশ স্ফুরণ হয় আদামিয়াত বা মানবত্বে। আর ইত্তিহাতের ভিত্তিমূলে তিনি আদম (আঃ) কে সর্বপ্রথম আল্লাহর শারীরিক বিকাশ করে ধরেছেন। মানবীয় দৈহিক সত্তায় ঐশী সত্তার পূর্ণতম প্রকাশই আল্লাহর এক চিরন্তন রহস্য- মানুষের মাঝে নিজেরই মধুরতম বিকাশ বাসনার খেয়ালে সৃষ্টি লোকের সম্ভব হয়েছে। এই বইটি নিয়ে মুসলিম পন্ডিতদের মধ্যে বিস্তর বিতর্ক আছে।

(৪) ‘তরজুমান আল আশওয়াক’: এটি তার কবিতার বই যেটা নিজামকে উদ্দেশ্য করে তিনি রচনা করেন। (৫) ‘দাখায়িরুল আলাক’: তরজুমান আল আশওয়াকের একটি ভাষ্য।
(৬) ‘রিসালা রুহুল কুদস’: এতে তিনি তার সমকালিন বহু সুফির জীবন ইতিহাস সংকলন করেন।
(৭) ‘তানাজজুলাত আল মাওসিলিয়াহ’: এতে তিনি ধর্মীয় রীতিনীতির আধ্যত্বিক ব্যাখ্যা দেন।
(৮) ‘কিতাব আল আসফার’
(৯) ‘তাজ আর রাসাইল’ এছাড়াও আরো বহু রচনা রয়েছে।

এসব কাজের মধ্যে ‘ফুতুহাত আল-মক্কিয়া’ এবং ‘ফুসুস আল হিকাম’ বই দুটো তার সমগ্র শিক্ষার ভান্ডার। বই দুটো ইসলামি সুফিতত্ত্বের উপর রচিত অমূল্য রতনস্বরূপ।

ইবনে আরাবীর প্রভাব:
মুসলিম ইবনে আরাবীর প্রভাব ব্যাপক। এমন নয় যে সমস্ত মুসলিমরা ইবনে আরাবীকে চেনে এবং সবাই তার শিক্ষাকে মেনে চলছে। বরং ইবনে আরাবীর শিক্ষা বিভিন্নভাবে তার শিষ্য, অনুসারীদের মাধ্যমে সর্বত্র বিস্তৃত হয়। অটোমান তুরস্কে ইবনে আরাবীর সৎ-পুত্র সদরুদ্দিন কুনাভি এবং কুনাভির শিষ্যদের মাধ্যমে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, অটোমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে “ফুসুস আল হিকাম” পাঠ্যপুস্তকের মর্যাদা পায়। পারস্যে এবং হিন্দুস্থানে ফারসি ভাষার সুফি সাধকদের মাধ্যমে তার শিক্ষা বিস্তৃত হয়; নুরুদ্দিন আল জামি এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন। রুমি, হাফিজ, সাদি, জামি, কাসানী, কায়সারী, কুনাভি, শাবিস্তারী, লাহিজি, দারাশিকো, জিলী, ফকরুদ্দিন ইরাকি, আবদুল্লাহ বসনবি, আবদুল গনি নাবুলুসিসহ আরো হাজারো সুফি সাধকদের মধ্যে ইবনে আরাবীর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আর এদের মাধ্যমেই মুসলিম সমাজে ইবনে আরাবীর চিন্তা-চেতনা বিস্তৃত হয়। অনেকেই তাঁর শিক্ষার বিরোধিতা করেন কিন্তু কোন কিছুই তাঁর প্রভাবকে অতিক্রম করতে পারে নি। তিনি তার স্থানে আজও রয়ে গেছেন শেখ আল আকবর হিসেবে।

ইবনে আরাবীকে নিয়ে বিতর্কঃ
বহু শতাব্দি কেটে গেল, তবু ইবনুল আরাবীর এসব আশ্চ্যর্য মতবাদ নিয়ে মুসলিম ধর্ম তাত্ত্বিকদের মধ্যে বদানুবাদের শেষ হয় নাই। তাদের অনেকে এ বিষয়ে একমত যে, ইবনুল আরাবীর দুর্জ্ঞেয় মতবাদ সাধারন লোকের বোধগম্য নয়। এজন্য তার চিন্তা-চেতনায় আস্থা রেখেও তারা সেগুলির প্রচার নিষিদ্ধ করেছেন। তবু ইবনুল আরাবীর রচনাবলী মুসলিম জগতের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যে সাদরে ও সম্ভ্রমের সঙ্গে পঠিত হয়।

শেখুল আকবর ইবনুল আরাবী সম্বন্ধে মুসলিম আলেমরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। ইবনে তাইমিয়া, আল-তাফতাযানী ও ইব্রাহীম আল-বিকায় তাকে কাফের ফতোয়া দিয়েছেন এবং তার হুলুল বা নরদেবতা ও ইত্তেহাদ বা অদ্বৈতবাদ মত প্রচারের জন্য তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। ইবনে-আরাবির চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই করেছিলেন হযরত মুজাদ্দিদ আলফেসানী র.। তিনি ওয়াহাদাতুল ওজুদ ধারনার বিপরীতে ওয়াহাদাতুশ শহুদকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

তবে ইবনে-আরাবি ও শায়খ আহমাদ সিরহিন্দী থেকে আরেক ধাপ এগিয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি ইবনে আরাবীর ওয়াহাদাতুল ওজুদ ও শায়খ আহমাদ সিরহিন্দীর ওয়াহাদাতুল শুহুদের মধ্যে একটি সুন্দর সিন্থেসিস ও হার্মনি এনে দিতে পেরেছিলেন। এভাবে সূফি ভাবধারা ক্রমশ: পরিশুদ্ধ হয়ে অর্থোডক্স ইসলামের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে আল-কামুস রচয়িতা মজদুদ্দীন, জালালুদ্দীন সুয়ুতী, আব্দুর রাজ্জাক আল-কাশানী ও আব্দুল ওহাব শারানী তাকে একজন বিখ্যাত ওলী, সুফি ও সিদ্দীক হিসেবে অভিনন্দিত করেছেন। এবং জোর গলায় একথাও প্রচার করেছেন যে, ইবনে-আরাবির দ্বরা দ্বীন ইসলাম অনেকখানি উপকৃত হয়েছে। তাঁর মহিমা লোক সমাজে উদঘাটিত হয়েছে। আল্লামা জালালুদ্দীন বলেছেন, মহিউদ্দীন ইবনুল আরাবি আলেমকূলের শিরোমণি, আল্লাহ তাঁকে সব রকম হিকমত বা জ্ঞান দান করেছেন। ইবনুল জাওযী একদা তাঁকে বলেছিলেন: তোমার ফতুহাত আল-মক্কিয়াহ আমার তাযিয়ার ভাষ্য হিসেবে যথেষ্ট। সাহাবুদ্দীন সুহরাওয়ার্দী বলেছেন, মহিউদ্দীন হাকায়েক বা সত্যতার সমুদ্র বিশেষ।

ইবনে আরাবীর সাথে সত্যি কি আরতুগ্রুল গাজীর সাক্ষাত হয়েছিল?



এই নিয়ে বেশ বিভ্রান্তি বিদ্যমান। তবে ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় এরতুগ্রুল গাজীর সাথে মহান সুফি সাধক ইবনে আরাবীর সাক্ষাতের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। কারণ দুজনের জীবনকালে স্পস্ট ফারাক বিদ্যমান। আপনারা অনেকেই লক্ষ্য করে থাকবেন যে, দিরিলিস সিরিজের কাহিনী শুরু হয়েছে ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে; আর আমাদের মহান সাধক ইবনে আরাবী মৃত্যুবরণ করেন ১২৪০ সালে। এখন আপনারাই বলুন, কিভাবে দেখা হওয়া সম্ভব? অবশ্য কোন কোন সুত্রে জানা যায়, এরতুগ্রুল ১২৩০ সালে কায়ি গোত্রের নেতৃত্ব লাভ করেন। তবুও দেখা-সাক্ষাত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাহলে কেন এই কাহিনী? এর সদুত্তর জানা নেই। তবে একটা কারণ হতে পারে এই যে, অটোমান সুলতানগণ আধ্যাত্বিক গুরুদের বিশেষভাবে মান্য করতেন। উসমানীয় সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা, আরতুগ্রুল গাজীর ছেলে প্রথম উসমানের ধর্মীয় গুরু ছিলেন বিখ্যাত শাইখ এদিবালি। উসমান গাজি তাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন এবং তার মতামতকে গুরুত্ব দিতেন।

মৃত্যুবরণঃ



মহান জ্ঞান সাধক ইবনে আরাবি ২২ রবিউস-সানী ৬৩৮ হিজরিতে (৪ নভেম্বর ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ) ৭৫ বছর বয়সে দামেস্কের কাযি মুহিউদ্দিন ইবনে আল-জাকির বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। দামেস্কে তাঁকে দাফন করা হয়। পরে ১৬ শতকে অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম এর সময়ে ইবনে আরাবির স্মরণে একটি সমাধিস্তম্ভ নির্মাণ করেন এবং যেটি এখনো সগৌরবে টিকে আছে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

১। 'হিস্ট্রি অব আরবস'; লেখকঃ পি কে হিট্টি
২। 'দ্য মুসলিম ১০০'; লেখকঃ মুহাম্মদ মজলুম খান
৩। Click This Link
৪। http://markajomar.com/?p=3400
৫। Click This Link

৬। Click This Link
৭। Click This Link

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৮
১০টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×