গতকাল ছিল মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ভাষা শহীদদের স্মরণে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়েছে। বিষয়টি আমাদের জন্য সত্যি খুব গর্বের এবং সম্মানের। মহান ভাষা শহীদগণের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি।
আনুষ্টানিকতার ব্যাপারটা ভালই। তবে সামগ্রিকভাবে বিশ্বের বুকে মাতৃভাষা বাংলার অবস্থান কোথায়? আরো স্পস্ট করে বললে, বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বাইরে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বা প্রভাব কতটুকু? দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্ব পরিমন্ডলে বাংলার ভাষার গুরুত্ব, মর্যাদা, প্রভাব নাই বললেই চলে। এটি বিশ্বের বুকে স্রেফ ‘একটি দিবসেই’ সীমাবদ্ধ।
ভাষা মহান আল্লাহর শ্রেষ্ট নেয়ামত। ভাষার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং আল্লাহ। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে 'নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডল সৃষ্টি এবং তোমাদের স্ব স্ব (মাতৃ) ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য, তাঁর (আল্লাহর) নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম (৩০:২২)’। সারা বিশ্বে হাজার হাজার ভাষা আছে। শুধু ভারতেই প্রায় তিন হাজারের মত ভাষা বিদ্যমান। তবে সারাবিশ্বের অসংখ্য ভাষার মধ্যে মাত্র গুটিকয়েক ভাষাই ‘আন্তর্জাতিক ভাষা’ হয়ে ওঠে। সিংহভাগ ভাষাই নিজ গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। একটা ভাষা কিভাবে প্রভাবশালী এবং ‘আন্তর্জাতিক ভাষা’ হয়ে ওঠে?
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান মতে, মোটা দাগে একটা ভাষার ‘আন্তর্জাতিক ভাষা’ হয়ে ওঠার পেছনে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে তিনটি বিষয়, যথাঃ সামরিক শক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং অর্থনীতি। এই তিনটি উপাদান ছাড়া কোন ভাষাই বিশ্বের বুকে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় না। ইতিহাস এর সাক্ষ্য দেয়। এই তিনটি উপাদান যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান ছিল বলেই প্রাচীনযুগে হিব্রু, গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষা; মধ্যযুগে আরবি, ফার্সি, টার্কিশ, স্প্যানীশ বা পর্তুগীজ ভাষা খুবই প্রভাবশালী ছিল। স্ব স্ব সময়ে উল্লেখিত প্রতিটি ভাষাই বিশ্বের বহু অঞ্চলে প্রতাপের সাথে রাজত্ব করেছে। এমনকি এসব ভাষার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। আবার একই কারণে আধুনিক যুগে এসে ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ এবং অধুনা চাইনিজ ভাষা বিশ্বের প্রভাবশালী ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। ভাষার শক্তি, মাহাত্ব্য, মর্যাদা, প্রভাব সবকিছুই এই তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এর হেরফের হলে ভাষা তার অবস্থান ও মর্যাদা দ্রুত হারিয়ে ফেলে। উদাহরণস্বরুপ, এই ১৯৩৫ সালেও উপমহাদেশের সরকারী ভাষা ছিল ফার্সি; আবার এক সময় আরবীর প্রভাবে ফার্সির মত শক্তিশালী ভাষা পারস্য অঞ্চল থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল। এক সময় বিশ্বের সকল প্রান্তে ল্যাটিন আর গ্রীকের ব্যাপক প্রভাব ছিল। বোধগম্য কারণেই এখন সেটা নাই। আরবী ভাষা অবশ্য স্বমহিমায় টিকে আছে। কারণ এটা ধর্মীয় ভাষাও বটে। আবার বিপরীত উদাহরণও আছে। সামরিক শক্তি অপরিমেয় থাকা সত্বেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঘাটতি থাকায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চেঙ্গিস খানের মঙ্গোলীয় ভাষা কেউই গ্রহণ করেনি।
যাইহোক, আমাদের বাংলা ভাষা কি কখনো বিশ্বের বুকে প্রভাবশালী কিংবা ‘আন্তর্জাতিক ভাষা’ হয়ে উঠতে পারবে? ইতিহাসই এটা বলে দেবে। তবে আপাতদৃষ্টিতে এর দূরতম সম্ভাবনাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
তাহলে, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ কি বরাবর পিছিয়েই থাকবে? নিজেদের উন্নত করার অন্য কোন উপায় আছে কি? অবশ্যই আছে।
এজন্য আজকের বিশ্বে যে ভাষাটা ছড়ি ঘুড়াচ্ছে তা ভালভাবে রপ্ত করা আবশ্যক। আমরা সবাই জানি ইংরেজীই এখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ভাষা। তাই এটি উত্তমরূপে রপ্ত করার বিকল্প নেই। ইংরেজীর উপর ভর করেই আমরা বহুদুর এগিয়ে যেতে পারব। শুধুমাত্র ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা দেশে বা দেশের বাইরে বহু পিছিয়ে আছি। প্রবাসী ভাই-বোনদের দেখলেই বোঝা যায় ভাষার সীমাবদ্ধতা তাদের কতটা পিছিয়ে রেখেছে। তারা কঠোর পরিশ্রম করেও আয় করে সামান্য, আর অন্য দেশের মানুষ শুধুমাত্র ইংরেজী ভাষা ভাল জানার কারণে বড় বড় পদ-পদবি বাগিয়ে বেশী আয় করছে। এই সীমাবদ্ধতা না পেরোলে ভাষা দিবসের চেতনা বিশেষ কোন কাজে আসবে বলে আমার মনে হয় না।
চীনা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে। বাংলায় অনুবাদ করলে প্রবাদটির অর্থ দাঁড়ায় এমন: নতুন একটা ভাষা শেখা মানে হলো পৃথিবীটা একটা নতুন জানালা দিয়ে দেখা। সত্যিই তো! পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষা আছে, আর আমাদের সামনেও আছে অসংখ্য বন্ধ জানালা।
কাজেই শুধুমাত্র মাতৃভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধতা আমাদের দুনিয়াকে ছোট করে দিতে পারে। অস্ট্রীয় দার্শনিক লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন বলেছেন, ‘The limits of my language mean the limits of my world.” আর ভিন্ন ভাষা আমাদের ভবিষ্যত চলার পথকে আরও মসৃণ করতে পারে। ইংল্যান্ডের সমসাময়িক মনোবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক স্মিথ এর কথা এর সত্যতা মেলে। তিনি বলেছেন, “One language sets you in a corridor for life. Two languages open every door along the way.”
তাই আমাদের ইংরেজী বা অন্য কোন প্রভাবশালী ভাষা শেখায় মনোযোগী হতে হবে। একটা নতুন ভাষা আমাদের শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয় সামাজিকভাবেও লাভবান করবে। মহামতি নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, "যদি তুমি কারো সাথে তোমার ভাষায় কথা বল, তার কাছে যেতে পারবে; যদি তার ভাষায় কথা বল, তার হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারবে"।
এর মানে কিন্তু এই না যে, বাংলা ভাষার প্রতি আমার শ্রদ্ধা নেই। শ্রদ্ধা-ভালবাসা যথেষ্ট পরিমাণই আছে। আসলে আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে। আমাদের নিজেদের সামরিক শক্তি, শিক্ষা-দীক্ষা এবং অর্থনৈতিক শক্তি যেহেতু দুর্বল সেহেতু আমাদের অন্যের ভাষায় ভর দিয়ে নিজেদের বৈতরণী পার হতে হবে। আর অর্থনৈতিক শক্তি আমাদের ভাষাকেও শক্তিশালী করবে।
আমাদের সকল ভাষা শহীদগণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাদের আত্বার মাগফেরাতের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি।
সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১২:৩৭