ঘটনা একঃ
কামরুন ও নাহার (ছদ্মনাম) ধানমন্ডিস্থ এক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তারা উভয়েই মোহাম্মদপুর এলাকায় বসবাস করেন। তাদের নিজস্ব প্রাইভেটকার নেই। যাতায়াতের বাহন হিসেবে তাদের রিকশাই ভরসা। নিজেদের সুবিধা ও নিরাপত্তার স্বার্থে তারা একত্রে রিকশায় যাতায়াত করেন। বেশ ভোরে তারা বাসা থেকে বের হন। বাসা থেকে স্কুলে পৌঁছা পর্যন্ত দু’জনের পরিবারই বেশ উদ্বিগ্ন থাকে। কারণ ইদানিং ধানমন্ডি এলাকায় ছিনতাইয়ের হার আশংকাজনকহারে বেড়ে গেছে। সেদিনও যথারীতি তারা রিকশাযোগে স্কুলের দিকে যাত্রা করেন। রিকশা যখন ধানমন্ডিস্থ ‘বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ’ এর সামনে আসে তখন একটা প্রাইভেটকার থেকে এক যুবক চিলের মত ছোঁ মেরে কামরুনের ভ্যানিটি ব্যাগটি বাগিয়ে নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে। ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা হতবিহ্বল, বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। রাস্তার লোকজন কিছু বুঝে উঠার আগেই সব শেষ। যাইহোক, চরম হতাশা ও ভীতি নিয়ে ওরা স্কুলে পৌঁছে।
ঘটনার ঘন্টা দেড়েক পর কামরুনের মোবাইলে একটা কল আসে। অপর পাশ থেকে এক পুরুষ কন্ঠ বলে, ‘আপনার ব্যাগটা সংসদ ভবনের কাছে আছে। এসে নিয়ে যান’। আহ! কি দরদী ছিনতাইকারী রে! নতুন মুসিবত মনে করে ওদের পাল্টা প্রস্তাব দেয়া হয়, ‘যদি উপকার করতেই চান তাহলে ব্যাগটা স্কুলে পৌঁছে দেন’। ওরা অবশ্য এর জবাব না দিয়ে মোবাইল সুইচড অফ করে ফেলে।
এর ঠিক ২/৩ সপ্তাহ পর একই কায়দায় নাহারের ভ্যানিটি ব্যাগ হেঁচকা টানে ছিনিয়ে নেয় মোটর সাইকেল আরোহী এক ছিনতাইকারী। এক মাসের মধ্যে দু’জনেই ছিনতাইকারীদের কবলে পরে তারা অতিশয় ভীত ও শংকিত জীবন-যাপন করছেন। তাদের ভয় আরও বেড়ে যায় এই ভেবে যে, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা বার বার ঘটতে পারে। চরম ভয় ও উৎকণ্ঠা তাদের পেয়ে বসেছে।
ঘটনা দুইঃ
জাতীয় পরিচয়পত্র আনার জন্য বরিশালে যান হেলেনা বেগম ও মনিরুল ইসলাম দম্পতি। গ্রাম থেকে তা সংগ্রহ করার পর ২৬ জানুয়ারি ভোররাত চারটায় লঞ্চে করে আসেন সদরঘাট। এরপর সেখান থেকে লোকাল বাসে করে ধানমন্ডির ৭ নম্বর সড়কে নামেন তাঁরা। হেঁটে কলাবাগানের বাসায় যাওয়ার সময় হঠাৎ একটি প্রাইভেট কার থেকে কেউ একজন হেলেনার ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়। আচমকা টানে তাল সামলাতে না পেরে ওই প্রাইভেট কারের নিচে পড়েন হেলেনা। চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী নিহত হেলেনা বেগমের স্বামী মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক মিনিটের মধ্যে আমার জীবনের সব সুখ কেড়ে নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। আমার চোখের সামনে ওরা খুন করেছে। ওরা মানুষ না। ওরা চাইলে আমার স্ত্রীকে না মেরে ব্যাগ নিয়ে চলে যেতে পারত। আমার স্ত্রীকে যেভাবে হত্যা করেছে, ওদেরও তেমনভাবে ফাঁসি দেওয়া হোক।’
কি ভয়ানক অবস্থা! প্রাইভেটকারযোগে ছিনতাই করে দেশের মুখই উজ্জ্বল করছে এই কুলাঙ্গারের দল। যে দেশে ছিনতাই হয় গাড়িযোগে সে দেশকে আপনি গরিব বলবেন কি করে? এরা আসলে নেশাখোর।
ইদানিং ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে সময়ে-অসময়ে রিকশারোহীদের কাছ থেকে হেঁচকা টানে ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোরের সময়টুকু ছিনতাইকারীদের জন্য মোক্ষম সময়। তাই ভোরের ঢাকা মানেই এখন আতঙ্কের বিষয়। ঐ সময়ে জনসমাগম কম থাকে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতাও শিথীল থাকে। ছিনতাইকারীরা প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসযোগে আরোহীদের টার্গেট করে পিছু নেয়। এরপর সুযোগ বুঝে আক্রমণ করে। এ সময় সাধারণ পথচারীরাও ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন।
এসব ছিনতাইয়ের ঘটনায় টাকা-পয়সা, গয়না-গাটি বা মোবাইল তো হারানোর সাথে সাথে রিকশা থেকে পড়ে কেউ কেউ আহত হন। এমনকি কোন কোন হতভাগ্যকে এতে জীবনও দিতে হয়েছে। এসব অপ্রত্যাশিত, উটকো বিপদাপদ থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। কথা বলে, সাবধানের মার নেই। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের উপর পুরোপুরি নির্ভর না করে নিজেদেরও কিছু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী। যথা,
১. রিকশায় যাতায়াতের সময় অবশ্যই হুড তুলে রাখুন, বিশেষ করে ভোরের দিকে অবশ্যই। এতে পেছন থেকে আচমকা ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান মারা সহজ হবে না;
২. রিকশায় বসে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে না রেখে দু’পায়ের মাঝে রাখুন। এর ফলে দুর্ভাগ্যবশত ছিনতাই হলেও কোন দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে;
৩. রিকশায় একা চললে দামী মোবাইল, টাকা, গয়না ইত্যাদি ছোট সাইজের ভিন্ন একটা ব্যাগে রাখুন। এই ব্যাগটি নিজের কোলের উপর রাখুন। একা চলাফেরা করলে দামী জিনিষ বহন না করাই উত্তম;
৪. রিকশায় চলাচলের সময় মোবাইলে কথা বলা পরিহার করুন;
৫. যাতায়াতের পুরো সময় চোখ-কান খোলা রাখুন। অন্যমনস্ক থাকবেন না;
৬. বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ভোরের সময়ে রাস্তায় বের না হওয়াই উত্তম। বাধ্যবাধকতা থাকলে বাসযোগে গন্তব্যে যাওয়া অধিকতর নিরাপদ।
সবশেষ কথা, মানুষ তার প্রয়োজনে রাস্তায় বের হবেই। এজন্য মানুষকে অবশ্যই সংকোচহীনভাবে পথ চলতে হবে। সে জন্য দরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। ছিনতাইকারীরা যেহেতু প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস নিয়ে ছিনতাইকর্মগুলো করে থাকে সেহেতু তাদেরকে চেনা মুশকিল। এ জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করে ছিনতাইকারী গ্রুপগুলোকে চিহ্নিত করে ধরাশায়ী করতে হবে। এ জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
ছিনতাইকারী ধরতে পুলিশের ফাঁদঃ
আশার কথা হল, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ছিনতাই প্রতিরোধ ও জনসাধারণের নিরবচ্ছিন্ন চলাচল নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করতে ফাঁদ পাতা পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে।
ছিনতাইয়ের সম্ভাব্য সময় যেমন- সন্ধ্যা ও ভোররাতে পুলিশ সদস্যদের সিভিল পোশাকে সতর্কতার সঙ্গে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী (ল্যাপটপ, ক্যামেরা, দামি মোবাইল ফোন ইত্যাদি) দিয়ে রিকশায় ঘোরাঘুরি করে ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জনসাধারণের তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের সহায়তায়সহ অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের সেবা প্রাপ্তির লক্ষ্যে ‘জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯’ এর কার্যক্রম চালু করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
খুশির খবর হল, ছিনতাইকারীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হওয়া হেলেনা বেগম হত্যা মামলার প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ঢাকার আদালতে ওই ছিনতাইকারী খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। পুলিশ তাদের গোটা চক্রকেই গ্রেফতার করার প্রক্রিয়ায় আছে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে ধানমন্ডি তথা সকল অঞ্চলে এ ধরণের অপরাধের মাত্রা অনেক কমবে বলে মনে করি।
ভিডিওটি দেখুন
সবাই নিরাপদে থাকুন এই কামনা করি।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৩