দুই লিটারের একটা পানির বোতল আর পুরাতন পত্রিকা হাতে নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে আছি। বালিকা আসবে, তাকে রিসিভ করে ঘাসের উপর পত্রিকা বিছিয়ে খেতে বসবো। বালিকার অন্যতম প্রিয় কাজ বিভিন্ন রান্না শেখা এবং আমাকে গিনিপিগ বানিয়ে সেসব রান্না টেস্ট করানো। তবে সবসময় সে অবশ্য নয় দশমিক পাঁচ আউট অব্ দশ ডিজার্ভ করে। দুয়েকবার যে ফেল মার্ক পাবার রান্না করে না, তা না। তবে স্বজনপ্রীতি করে পাশ মার্ক দিয়ে দেই প্রতিবার, একটা মাত্র গার্লফ্রেন্ড তো। নাহলে আবার আজীবনের জন্য তার রান্না খাওয়া থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষিত হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
আজকেও বালিকা রান্না করে, বিরাট এক টিফিন ক্যারিয়ার আর হটপটে খাবার ভরে আমার সামনে উপস্থিত হলো। কান পর্যন্ত বিস্তৃত একটা হাসি দিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারটা নিজের হাতে নিয়ে নিরিবিলি জায়গা খুজে বসে গেলাম। খাবার মতো পবিত্র কাজে দেরি করা ঠিক না।
বালিকা যথেষ্ট গোছানো, আমাকে পানি আর পত্রিকা আনতে বলেছে। নিজে ব্যাগের ভেতর টিস্যু, ওয়ান টাইম প্লেট, গ্লাস নিয়ে এসেছে। হটপটে গরম ভাত। টিফিন ক্যারিয়ারের উপরের বক্সে চিকন করে লেবু কাঁটা, দুটো পেয়াজ আর কাঁচামরিচ, গোল গোল করে কয়েক পিস শষা; সেসবে আবার কাঁটা চামচ দিয়ে আঁচর কাটা। লবন যাতে ছড়িয়ে না যায়, তাই কাগজে মোড়ানো একটু লবন। আরেকটা কাগজে দুটো মিষ্টি পান মোড়ানো। এবার দ্বিতীয় বক্স খুললাম, সেটাতে ঘিঁয়েভাজা আলুভাজি, আমার প্রিয় ঢেড়স ভাজি, আর আলুভাজার পর ওই ঘিঁয়ে ডিম-আলুর ভর্তা মাখানো। পরের বক্সে দুটো ইলিশ মাছের টুকরা আর আরেকটা বক্সে খাসির কলিজা ভুনা। এই বাটিটা খুলতেই ক্ষুধা দ্বিগুণ হয়ে গেলো।
কষ্ট করে গত কয়েকঘন্টার রান্না, দশমিনিটেই চেটে-পুটে শেষ করে দিলাম। নাহলে বালিকা আবার ভাববে মজা হয়নি বলে পুরোটা খাইনি। তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলাম,
- চা খাবে?
: হলে খারাপ হতো না। তবে কোথায় পাবো? আশেপাশে তো কেউ নেই।
- দাড়াও ব্যাবস্থা করছি।
বলেই আমার ব্যাগ থেকে একটা ফ্লাক্স বের করলাম। বালিকার চা খাবার বদভ্যাস আছে। তার সাথে থেকে থেকে আমারো একই অবস্থা। মধ্যরাতে চা খেতে ইচ্ছা করে। তাই ফ্লাক্স কিনে ফেলেছি। আমার মেসের সামনে মোহাব্বত ভাই দারুন চা বানায়। প্রতিদিন রুমে যাবার সময় এক ফ্লাক্স ভর্তি করে নিয়ে যাই। আজকে মেস থেকে বের হবার সময় মোহাব্বত ভাইয়ের কাছ থেকে ভর্তি করে নিয়ে আসলাম। বালিকা বললো,
: ওয়াও। তুমি নিয়ে এসেছো! ফ্লাক্স কিনলে কবে?
- এইতো কয়েকদিন আগে। রাতে মোহাব্বত ভাইয়ের দোকান বন্ধ তাই সন্ধ্যার সময় কিনে ভরে রাখি।
: একটু চা বানিয়েও খেতে পারো না? তুমি এতো অলস কেন?
- ধুর! কার ঠ্যাকা পড়ছে চা বানাতে। আর আমি চা বানাতেও পারিনা। তোমার মতো কর্মঠ, সুরাধুনী বউ থাকলে দুনিয়ার সব লোক অলস হয়ে যাবে।
: দাড়াও তোমাকেও কর্মঠ বানানোর প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছি।
- কি দরকার? ভালোই তো চলছে। আর আমি কিন্তু একেবারে যে অলস তা না। এই যে দেখো, চা এনেছি, কাপ এনেছি, ঢেলে দিচ্ছি। নাও খাও
চায়ে চুমুক দিতে দিতে বালিকা বললো,
: জানো, আমার রুমমেটের বয়ফ্রেন্ড যে কি ভালো!!!
- কেন? কি করছে? তোমার রুমমেটকে দশটা জামা কিনে দিছে?
: না।
- পার্লারে নিয়ে গিয়ে বাইরে তিনঘন্টা ওয়েট করছে?
: না।
- এ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশনের স্লাইড করে দিছে?
: আরে না।
- তো কি করছে?
: আমার রুমমেট অসুস্থ ছিলো, তারপর ও নিজে রান্না করে নিয়ে এসেছে।
- ধুর! এটা কিছু হলো? আমার গার্লফ্রেন্ড তো আরোও ভালো। আমি পুরোপুরি সুস্থ, তবুও আমাকে নিয়মিত রান্না করে খাওয়ায়। লক্ষ্মী একটা মেয়ে বলতে পারো।
: গার্লফ্রেন্ডরা ভালোই হয়। খারাপ হয় বয়ফ্রেন্ডরা। তারা খুব অলস। জানো, আমার বয়ফ্রেন্ড কোনোদিন রান্না করে আমাকে কিছু খাওয়ায়নি।
- বলো কি! আমি যতদুর জানি, তোমার বয়ফ্রেন্ড খুব ভালো মানুষ। হাজারে একটা এরকম পাওয়া যায়না। ঠিক আছে, তোমাকেও একদিন রান্না করে খাওয়াবো। বলো কবে অসুস্থ হবা।
: কার কবে অসুখ হয় আগে থেকে জানা যায়? অসুখ না হলে বুঝি রান্না করে গার্লফ্রেন্ডকে খাওয়ানো যায় না?
- তাহলে বলো কবে খাবা?
: কালকে।
- কালকেই! ঠিক আছে। কালকে তোমাকে খাওয়াবো। বলো, কোন রেস্টুরেন্টে খাবা।
: রেস্টুরেন্ট কেন? রান্না করতে হবে।
- আল্লাহ্! বিশ্বাস করো, আমি ভাত ছাড়া কিচ্ছু রান্না করতে পারি না। শুধু ভাত কিভাবে খাবা?
: আমি জানি না। কালকে তুমি রান্না করে নিয়ে আসবা, এটা ফাইনাল।
- এই, কয়েকদিন সময় দেয়া যায় না? ধরো, রান্না-টান্না শিখে তোমাকে একদিন হুট করে দাওয়াত দিয়ে চমকে দিলাম। কি বলো?
: না। কালকেই চমকাবো।
- তাহলে কিন্তু তোমার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগতে পারে।
: প্রয়োজন হলে তাই হবো। তবু তোমার রান্না করতে হবে।
- তাহলে অন্ততপক্ষে আধা লিটার পানিতে একমুঠ গুড় আর এক চিমটি লবন দিয়ে স্যালাইন বানানো শিখে রেখো। কখন প্রয়োজন পড়ে বলা তো যায় না।
- আচ্ছা।
একে বলে খাল কেঁটে কুমির আনা। ভাব ধরে রাজি হয়ে বিপদ ডেকে এনেছি। এখন কি করি? আমি রান্না করলে যে কেউ খেয়ে বমি করে দেয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ছেলেরা যখন তখন বমি করলে সমস্যা নাই, তবে অবিবাহিত মেয়ে যদি বাজে রান্না খেয়ে, বাসায় গিয়ে বমি করে মামলা অন্য দিকে মোড় নিতে পারে। মেসে খালা না থাকলে আমি হোটেলে খাই। একবার রান্না করেছিলাম, রুমমেট এক লোকমা খাওয়ার পর আমার জরিমানা হয়েছে। হোটেলে গিয়ে আবার খেয়ে তার সহ আমার ডাবল বিল দিতে হয়েছে। যাইহোক, গার্লফ্রেন্ড যেহেতু আমার তাকে সর্বাত্মক খুশী রাখার যাবতীয় দায়িত্বও আমার। কথা যখন দিয়েছি কিছুতো রান্না করে নিয়ে যেতেই হবে। একবার ভাবলাম, মেসের খালাকে বলি রান্না করে দিতে - পরে নিজের নামে চালিয়ে দিবো। কিন্তু সাহসে কুলালো না। এই মেয়ের সাথে মিথ্যা বললে, আমি ধরা পড়ে যাই। আর রান্না নিয়ে মিথ্যা বললে ধরা পড়বোই। লবন মরিচ ঠিক থাকলেই সন্দেহ করে ফেলবে।
পরদিন রান্না-টান্না করে ফোন করলাম। বললাম, "দুপুরবেলা প্লেট নিয়ে হাজির থেকো। রান্না হয়ে যাবে।" সেও আবেগে আপ্লুত হয়ে বলে ফেললো, "ওয়াও! তুমি এত্তোগুলো ভালো।"
তারপর এত্তোগুলো ভালো আমি টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে, টিফিন ক্যারিয়ার আর ফ্লাক্স ব্যাগে ভরে রওয়ানা দিলাম। গিয়ে দেখি সে রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে আছে। মুখটা হাসিহাসি। আমি শিওর, হাসিহাসি মুখটা কান্নাকান্না হতে সময় লাগবে না। উপরের দিকে তাকিয়ে 'ফি আমানিল্লাহ' বলে আর 'দোয়া ইউনুস' পড়তে পড়তে সামনে এগিয়ে গেলাম। মাঠের দিকে ঢুকে ছায়াময় একটা গাছে কাক আছে কিনা চেক করে ঘাসের উপর পত্রিকা বিছিয়ে বসে পড়লাম। এতো আয়োজন করে রান্না করতে কষ্ট হলেও, গাছের নিচে এই সংসার সংসার খেলাটা খারাপ লাগছে না।
: এই আমি না খুব এক্সাইটেড।
- কেনো?
: তুমি আমার জন্য রান্না করে এনেছো। এটা ভাবতেই ভালো লাগছে। কি রান্না করেছো?
- বলা যাবে না। সারপ্রাইজ।
: তুমি রান্না করেছো, এটাই আমার কাছে সারপ্রাইজ মনে হচ্ছে। তো খাবার কোথায়?
- ব্যাগে।
: আল্লাহ্! ব্যাগে রেখেছো কেনো? তেল ভরবে তো।
- না না। সমস্যা নাই। তেল ভরার কোনো সম্ভাবনাই নাই।
প্রথমে ব্যাগ থেকে প্লেট বের করলাম। ধুয়ে টিফিন ক্যারিয়ার থেকে ভাত বেড়ে নিলাম। এবার ফ্লাক্স বের করলাম। বালিকা বললো,
: ফ্লাক্স বের করছো কেনো?
- আমি তো তরকারি রান্না করতে পারি না। তাই আজকে দুধ-ভাত খাবো। এক লিটার মিল্ক-ভিটা কিনে গরম করে ফ্লাক্সে করে নিয়ে এসেছি। তবে ভাতটা আমি রান্না করেছি। খুব মজা হয়েছে।
: তোমার কি মনে হয়, আমি তোমার সাথে গাছতলায় বসে এখন দুধ-ভাত খাবো?
- শুধু দুধ-ভাত খেতে না পারলে সমস্যা নাই। বুদ্ধি করে এক হালি সবরি কলাও কিনে এনেছি। আচ্ছা, তুমি কলা দিয়ে দুধ-ভাত মেখে খাও তো, নাকি? খুব মজা না?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:০৭