ব্লাড ডোনেট করলে আপনি যতটা একজনের উপকার করবেন তারচেয়ে বেশি তৃপ্তি পাবেন নিজে নিজে। এটা সত্যিই খুব আনন্দের একটা অনুভূতি যে কারো গায়ে আমার রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। কারোও জীবন রক্ষায় আমিও ক্ষুদ্র একটা অবদান রেখেছি।
রক্তদান করা আমাদের জন্য অনেক মামুলি একটা ব্যাপার হলেও গ্রামের অপরিচিত একজন বৃদ্ধের কাছে এটা অনেক কিছু। সামান্য রক্তদানের কথা তারা মনে রাখেন আজীবন। কিছুদিন আগে একলোক আমাকে ফোন করে বললেন, "বাবা, আমি আপনার ভৈরবের আঙ্কেল। আমার কথা মনে আছে? ওই যে ঢাকা মেডিকেলে একদিন আমাকে রক্ত দিছিলেন।"
এবার আমার মনে পড়লো। জীবনে কত জনকেই তো রক্ত দিয়েছি, কারো কথাই মনে রাখিনি। মনে রাখার প্রয়োজনও মনে করিনি। কিন্তু, তিনি আজীবন আমার কথা মনে রাখবেন। তিনি আরোও বললেন যে তিনি একটা কাজে ঢাকা এসেছেন। আমার যদি একটু সময় হয়, আমি টিএসসি, সূর্যসেন হল যেখানেই বলি, তিনি আসবেন। আমার সাথে দেখা করে এক কাপ চা খেতে চান।
আরেক আন্টি আছেন, নূরজাহান আন্টি। উনাকে রক্ত দিয়েছিলাম সেই তিনবছর আগে। তিনি এখনও মাঝেমাঝে ফোন করে আমার খোজখবর নেন। উনাকে যেদিন রক্ত দিলাম, সামান্য এই কাজে উনি আমার প্রতি কৃতজ্ঞতায় কেঁদেকেটে একাকার করলেন। আমার লজ্জা লাগা শুরু করলো। এই কান্না দেখার মাঝেও একটা সুখ আছে।
এরকম প্রচুর স্মৃতি আছে।
কেউ কিন্তু বিক্রি করার জন্য রক্ত চায় না। রক্ত চায় বাঁচার জন্য। আমি রক্ত দিলে কেউ একজন বাঁচবে, এতে পরিচিত, অপরিচিতের কী আছে?
পরিচিত অনেককেই দেখেছি রক্ত দিতে তারা খুব অনাগ্রহী। দিব্যি খাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে, সুস্থ জীবন-যাপন করছে, কিন্তু কেউ রক্ত চাইলেই বলবে যে সে আসলে আনফিট, কিছুদিন আগেই সে রক্ত দিয়েছে। কিন্তু, এটা যে ডাহা মিথ্যা কথা অনেকক্ষেত্রেই আমি জানি। কিন্তু, কিছু বলার থাকে না।
আল্লাহ্ না করুক, আমার খুব দেখার শখ যে, এদের আপনজন অসুস্থ হলে, প্রয়োজনের সময় রক্ত পাওয়া না গেলে এরা কী করে। তবে ভালো মানুষ প্রচুর আছে। এরা কারোও রক্ত লাগবে শুনলেই শত জরুরী কাজ ফেলে দে ছুট। আমার এক বন্ধুকে একবার বললাম, এক ছোটভাইয়ের মাকে ব্লাড দিতে। ব্লাড-গ্রুপটা কিছুটা রেয়ার ছিলো। সে প্রথমে বললো যে সে অসুস্থ। এবং সে সত্যিই অসুস্থ ছিলো। একটু পর আবার ফোন করে বললো, "রিয়াদ, তোমরা ব্লাড খুজো। যদি না পাও তাহলে আমাকে বলো, মায়ের জন্য তো, আমি অসুস্থ হলেও দিবো।" পরে কিন্তু তার ব্লাড আর লাগেনি। অন্যদিক থেকে ম্যানেজ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তার এই কথা আমার আজীবন মনে থাকবে।
অনেকেই আছে নিজে রক্ত দিতে পারবে কিন্তু সেটা না দিয়ে, ফেসবুকে "রক্ত চাই" বলে পোস্ট দিবে। নিজে দিলেন না কেনো জিজ্ঞেস করলে বলবে, "আরে নেটে তো ব্লাড এ্যাভেইলেবেল। ফেসবুকে পোস্ট দিলেই পাওয়া যায়।" ভাবটা এমন যেন, ফেসবুক থেকে ডাউনলোড দিয়ে ব্লাড পাওয়া যায়। নিজের শরীর থেকে দেয়ার কী দরকার? এমনও দেখেছি নিজের মাকে নিজে ব্লাড দিতে পারে কিন্তু দিবে না। তাদের নাকি ভয় লাগে। ফেসবুকে পোস্ট দিবে।
রক্ত দেয়া খুব সহজ কাজ। আঠার বছর বয়স আর ওজন পঞ্চাশ কেজি হলে যে কেউ চারমাস পরপর রক্ত দিতে পারে। অনেকেই নিজেক রোগা-পাতলা দাবি করে রক্ত দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
আমার দিকে দেখেন। আঠার বছর হবার পর গত সাত বছরে আমি ব্লাড ডোনেট করেছি ষোলবার। যতবার কনফার্ম করার পরে আর ব্লাড লাগেনি সেসব দিতে পারলে এতোদিনে অন্ততপক্ষে বিশবার তো হতোই। আমার ওজন পঞ্চাশের বেশি হলেও আমি কিন্তু আন্ডার ওয়েট।
কী মনে হচ্ছে? আমি শো-অফ করছি? এখন থেকে ব্লাড ডোনেট করা শুরু করে আপনিও শো-অফ করেন। শো-অফের এই ক্লাবে আপনাকে স্বাগতম।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১০:০৪