একজন অভিনেত্রী মঞ্চে দাঁড়িয়ে একাই একসাথে অনেকগুলো চরিত্র উপস্থাপন করে দর্শকদের মুগ্ধতা ধরে রাখতে পারেন তা শেষ বার বুঝেছিলাম ফেরদৌসী মজুমদারকে দেখে।সে অনেক বছর আগের কথা।আজ এতো দিন পর অবাক বিস্বয়ে তাকিয়ে রইলাম রোজী সিদ্দিকীর দিকে । অল্প সময়ের বিরতীর মধ্যে একটা মানুষ এমনভাবে পাঁচটি নারী চরিত্রে বিভিন্ন পোশাকে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন তা চোখের সামনে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।
পঞ্চনারী আখ্যান-জোলেখা, অন্তরা ,মনোরমা, মরিয়ম ,মমতাজ –তাদের জীবন চলার পথ নানান রকম হলেও একটা জায়গায় তাদের পরিচয় এক।তারা নারী,তারা সবাই এই পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার শিকার।কোন না কোন ভাবে তারা নিষ্পেশিত হন নীপিড়নের যাঁতাকলে, কেবল নির্যাতনের ধরনটাই আলাদা যা আজো ঘটে চলেছে এই সমাজে।এখান থেকে মুক্তির উপায় আদৌ কারো জানা আছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না।
এবার একটু পেছনে ফিরে যাই-গত ২০১৩ সালে প্রথমা প্রকাশিত “আলোর মিছিল” সংকলনে আমার নগ্ন মৃত্তিকা প্রথম আলোর মুখ দেখলো। এই উপন্যাসটা নিয়ে আমাকে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়েছিলো,এমন কি কোথাও প্রকাশ করা যাবে না বলেও বেশ একটা অনিশ্চয়তার মুখোমুখি ছিলাম। এখানে মিতা চরিত্রকে আমি পাঁচ ভাবে উপস্থাপন করেছি। কিশোর বেলায় সে তার শিক্ষক দ্বারা ধর্ষিতা হয়,পরবর্তীতে পরিবারের কাছে চরিত্রহীন উপাধিতে আখ্যায়িত হয়,তারপর প্রেমিক রুপী স্বামীর কাছে হয় অবহেলার শিকার,তারপর নিজের পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে সম্মুখিন হয় পুরুষ নামক দানবের লোলুপ দৃষ্টির ।অবশেষে স্বামীর বন্ধু যখন প্রেমিক হিসেবে আত্বপকাশ করতে আসে তখন সে বুঝতে পারে যাকে ঘিরে সে মুক্তির সাধ নিচ্ছে সে আসলে তাকে ব্যবহার করছে।পরিশেষে কেবলী একাকীত্ব তার সঙ্গী হয়, আর কেউ না।
এতো কথা বলার একটাই কারন –আমার ভীষন জানতে ইচ্ছে করছে পঞ্চনারী আখ্যান লেখার পর লেখক হারুন রশীদ কে কেউ কি প্রশ্ন করেছেন-এটা তার জীবন থেকে লেখা কোন গল্প কিনা।আমি জানি,তা কেউ করেন নি।কারন হারুন রশীদ একজন পুরুষ লেখক। এমন প্রশ্ন আসাটা অবান্তর। আমাকে এখোন অনেকেই প্রশ্ন করেন-নগ্ন মৃত্তিকার চরিত্রায়ন আমার জীবন থেকে কিনা? প্রশ্নটা করেন ,কারন আমি নারী বলেই।হয়তো পাঠকরা লেখিকার জীবনের বর্ননা উপন্যাসের পাতায় দেখতে চান। এটা আর মন্দ কি,কিছুতো ছায়া থাকবেই। বাস্তবতার ছায়া না থাকলে লেখালেখি করাটা প্রায় অসম্ভব।আমিতো আর কবিগুরু নই যে অন্যের অনুভুতি নিজের মধ্যে ধারন করতে পারবো।
তবে একটা কথা সবাইকেই পরীষ্কার বলতে চাই।সমাজের চেহারাটা অনেক খানি চাকচিক্য হয়েছে ঠিকই,মেয়েরা বসে আছে অনেক ক্ষমতাময় আসনে। কিন্তু নারী সেই নারী রুপেই পরে আছে, কেবল বদলে গেছে নির্যাতনের ধরন।
আজ আমি একা আছি।যতটা না উত্তর করতে হয় লেখার মান নিয়ে , তার চেয়েও বেশি উত্তর দিতে হয়-কেমন করে একলা থাকি,কিভাবে কাটে আমার সময়,বাসায় কে কে আছে,ইত্যাদি ইত্যাদি।
হারুন রশিদকে অনেক অনেক ধন্যবাদ যে পুরুষ হয়েও নারীর আত্মগ্লানির ইতিহাস এমন ভাবে তুলে ধরেছেন। মমতাজ মহলের আত্বকথনের যে বর্ননা এখানে উপস্থাপিত হয়েছে তা এক কথায় দুঃসাহসিক।যুগের পর যুগ ভালোবাসা নামক এক মিথ্যে চাদরে ঢাকা পরে আছেন মমতাজ, এই ভ্রান্তি থেকে মুক্তির যে আর্তনাদ তা অসম্ভব দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছে ঢাকা থিয়েটার। আমি সত্যি তাদেরকে এই কাজটির জন্য স্যালুট জানাই।আমি দিল্লী ঘুরে এসেছি, কিন্তু আগ্রা যাওয়ার ইচ্ছে আমার কোন দিনও হয় নি।তাজমহল আমার কাছে সব সময়ি একটি ভিতীকর জায়গা ছাড়া আর কিছু নয়।যিনি শ্রমিকদের কাজ শেষ হবার পর হাতের আঙ্গুল কেটে দেন তার কাছে ভালোবাসার নিদর্শন আসলে যে কেবলি নিজের মনের আনন্দের খোড়াক ছাড়া আর কিছু হতে পারে না,তা একটু ভাবলেই বোঝা যায়।
বৈষম্যের হাহাকার পেরিয়ে কবে আমরা মানুষ হতে পারবো সে চাওয়া আমাদের চির দিনের, এ যেন আজন্ম লালিত এক স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো।
নিঃশ্বাসে বিষের সুপোক্ত প্রলেপ ;
নিস্তেজ শরীরের মৃত চাহনী ;
কংক্রীটে বেড়ে ওঠা অভুক্ত যৌবন ।
কেবল আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে সমাজের অযৌক্তিক যুক্তি --
নিয়মের শৃংখলে দগ্ধ উর্বশী আত্মা ।
"মুক্তি চাই "--"মুক্তি চাই"-বিভৎস আর্তনাদ ;
কোথায় সে মুক্তির স্বাদ ?
অক্টোপাস হয়ে জড়িয়ে থাকে কঠিন আলিঙ্গনে ।
পরাজিত -পরাভূত বর্তমান শুধু হাতরে বেড়ায় স্বস্তির বাহুডোর ;
ন'টা -পাঁচটার দপ্তর যদিওবা ছুটির ঘন্টা শোনায় ,
বিসর্জিত অন্য সময় রক্ষিত -কর্তব্যের বেড়াজালে ।
সমর্পিত এক একটি মৃত্তিকা বিবর্তিত হয়
চাবি দেওয়া এক একটি গৌঢ়ী প্রতিমায়।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৩৫