সহজ করে বলতে গেলে আদৌ আমার ঘর মোটেও বড় নয়।মা-মেয়ে নিয়েই ছোট্ট ঘর।কিন্তু একটা সময় ছিল বিশাল বিশাল ঘর না হলে আমি থাকতেই পারতাম না।সেটা অবশ্য বাবার সরকারী চাকরির সুবাদেই।অদ্রি অবশ্য এমন ভাগ্য নিয়ে আসে নি,সবাই যে একি রকম ভাগ্য নিয়ে আসবে এমন লেখাও নেই কোথাও।
সে যাই হোক,আমার অদ্রি ২রা ডিসেম্বরে চার বছরে পা দিবে।তাই এতো বেশি আবেগে ভেসে যাচ্ছি বার বার।মায়ের কাছে তার সব বাচ্চাই সমান,কিন্তু কঠিন হলেও সত্যি –মেয়ের জন্য আমার আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করে।সেটা কেবল মাত্র মেয়ে বলে নয়,এর মধ্যে আরো অনেক আবেগ লুকিয়ে আছে।
কনসিভ করার পর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম-আমাকে একটা সুস্থ বাচ্চা দিও এবং সেই বাচ্চাটা যেন অবশ্যই মেয়ে হয়।কোথায় যেন পড়েছিলাম-যার ঘরে মেয়ে সন্তান থাকে তার ঘরে নাকি ঐশ্বর্য বিস্তার করে।কিন্তু আমার ঘরে দীনতার কোন অভাব নেই,তবু স্বান্তনা একটাই-আমার ঘরে টূকটুকে একটা লাল পরী আছে ।সে অনর্গল কথা বলতে পারে,নাচতে পারে আর বড়দের মতোন গান গায়-“প্রেম করেছি বেশ করেছি ,করবোইতো।“বাংলা উচ্চারণে কখনো অদ্রির ভুল হয়নি,যে শব্দটা বলেছে পরিষ্কার ভাবেই বলেছে।
অদ্রি হাঁটতে শিখেছে আট মাসেই,হামাগুরী টাইপ হাঁটা না রীতিমতোন দুই পা ফেলে সোফা ধরে হেঁটেছে।আর ১০০ % লাভের সাথে কোমর দুলিয়ে নাচা সেতো এক বছর হতেই।খেয়াল করে দেখেছি-কোয়েল মল্লিকের ড্রেসের উপর তার কঠিন নজর।কখনো আমার ইচ্ছাতে সে কাপর পরে না,যা পরে একদম নায়িকা স্টাইল হতে হবে।এইতো সে দিন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল-মা আমি বড় হয়ে পুলিশ হবো?আমি খুব সিরিয়াস হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-তোমার কেন পুলিশ হতে ইচ্ছে করছে?সে মাইশা(ভাইয়ার মেয়ে) কে দেখিয়ে বললো-পুলিশ হয়ে মাইশাকে মারবো।পুলিশ হলে মানুষ মারা যায় এই তথ্য আমার এই টুকুন মেয়ে কই পেয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।আমি হাসতে হাসতে বললাম-তোমার যা ঢং তাতেতো পুলিশ না, নায়িকাই হওয়া দরকার।সেই থেকে অদ্রি খুব সিরিয়াস-সে নায়িকাই হবে আর কোয়েলের মতোন জামা কাপর পড়ে ছবি তোলা দ্বিগুন ভাবে বাড়িয়েও দিয়েছে আজকাল।সেলফী কি জিনিশ তা এইটুকুন মেয়েকে শেখানোর কোন দরকারই নেই।
ঘুম থেকে ওঠার পর তার প্রথম প্রশ্ন থাকে-মা ,আজ অফিসে যাবা?আমি ঘুরিয়ে পেচিয়ে উত্তর করি-অফিসে না গেলে তোমার জন্যে চকলেট কিনে আনবে কে?সেও কম যায় না-তাহলে আগে চকলেট কিনো তারপর অফিস যাও।বোঝ,যাওয়ার সময় একবার ভিসা দেখিয়ে বের হতে হয় ।আবার ফিরে এসেও ভিসা জমা দিতে হয়।মানে দিনে চকলেট ,রাতে আইসক্রীম বা চিপস।এখনতো মেয়ে আরো এক কাঠি সরেশ হয়েছে ,আমি অফিসের কাজে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হতেই তাকিয়ে দেখি কন্যা আমার ব্যাগ নিয়ে প্রস্তুত।কি আর করা ,যেখানেই যাই মেয়ে কোলের মধ্যেই আছে।মজার ব্যপার হচ্ছে সে কোথাও গেলে কিন্তু কান্নাকাটি করে না।বড়দের মতোন চামচ দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করে,বাসে –ট্রেনে সবার সাথে খোশ গল্প করে-কার নাম কি,কে কি করছে ,এই ধরণের গল্প এবং রাস্তার একটা হকার মিস করে না।
চার বছর হবার আগেই সবাই বচ্চাকে স্কুলে দেবার জন্য হুলস্থূল লাগিয়ে দেয়।কিন্তু এই বিষয় নিয়ে আমার মোটেও তাড়া নেই,মেয়ে আমার ইউটিউবে বসেই বেশ কিছু ছড়া রপ্ত করে ফেলেছে। তারমানে এই না যে সে সারাক্ষন পড়া লেখায় ব্যস্ত থাকে।তাকে বই কিনে দিলে দুই মিনিটের মধ্যেই সে তা ছিঁড়ে ফেলে,বলা যায় ডিজিট্যালি সে পড়া শোনা করবে, এনালগ পড়ায় তার কোন মন নাই।বাসার ভেতর যতোগুলো ডিভাইস আছে --মোবাইল, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ এমন কি টেলিভিশনের রিমোট তার ভয়ে অনেকটা ছাদের উপর থাকে।আরো একটা জিনিস থাকে প্রায় ছাদের কাছাকাছি-সেটা হচ্ছে আমার অর্নামেন্টস বক্স।এখন এমন অবস্থা হয়েছে সামান্য লিপস্টিক লাগিয়ে বাইরে যাবো তার কোন উপায় নেই,বক্স খুলেই দেখি কোনটার মাথাই নেই।লিপস্টিক কি নেইল-পলিশ সবই এখন মেয়ের আওতায় থাকে,আমি অনেকটা ফকির হালেই বাইরে বের হই।
আজকে আরো ভয়াবহ এক কান্ড ঘটে গেল,আমি গোসল করতে করতে শুনতে পাচ্ছি অদ্রি মোবাইলে বলছে –“মা শাওয়ার নিচ্ছে,মামা তুমি কিন্তু আমাদের বাসায় আসবা ।আর আমার জন্য আসার সময় আইসক্রীম নিয়ে আনবা।“আমি তাড়াতাড়ি মোবাইল হাতে নিলাম-অনলাইনে আছেন একটি টিভি চ্যানেলের বড় কর্মকর্তা।আমি ফোন কানে নিয়ে খুবই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম-কারন,তার কোন ভাবেই আমাকে ফোন করার কথা নয়।আমি সরি টরি বলে রেখে দিলাম।ফোন পাশে নিয়ে ঘুমাতে গেলেই আমি টের পাই সে ভাইবার অন করে বাবানকে(কাল্পনিক) ম্যাসেজ দেবার চেষ্টা করছে।সে লিখতে পারে না,কিন্তু ইমো ইউজ করতে পছন্দ করে।আর ভয়াবহ হলেও সত্যি যে সে বিশ্বাস করে তার বাবান খুব শীঘ্রই তার কাছে আসবে।আসার সময় অনেক গুলো পুতুল নিয়ে আসবে।
জন্মদিন আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ন একটা দিন,এই দিনটিতেই মানুষ প্রথম আলোর মুখ দেখে ।কিন্তু আমি কোন কেকের অর্ডার দেইনি এবার,এমন অনেক বাচ্চা আছে এই পৃথিবীতে যাদের মুখে এক বেলা খাবার জোটে না তার উপর কেক।আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে প্রতিবছর ২রা ডিসেম্বর হাজার খানেক বাচ্চা জোগাড় করে বড় একটা মাঠে গিয়ে কেক কাটতাম আর গ্যাস বেলুন ফুলিয়ে দিতাম আকাশে।
এই ভ্রমান্ডে একজনের আহবান আর একজনের কর্নগুহরে প্রবেশ করবে না- তা আমি জানি,আমি এও জানি এমন সুন্দর দিন আমার অদ্রির জীবনে কোন দিনই আসবেনা।তবু আমারা মা-মেয়ে স্বপ্নের ভেলায় চড়ে উড়তে থাকি কোন এক পংখীরাজের দেশে যেখানে আকাশ থেকে অসংখ্য তারা খসে পড়তে থাকে ,যেই তারাগুলোর নাম- ভালোবাসা।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৪৫