somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি এবং ইনোসেন্স

২৮ শে এপ্রিল, ২০১৫ ভোর ৬:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেকদিন ধরে মনে হচ্ছিলো নিজের লেখনীর একটা নিজস্ব ভাষার প্রয়োজন। পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্ত্র নাকি ভাষা। দিনে দিনে মনে হচ্ছে কথাটি অনেকাংশেই সত্য। যতো দিন যাচ্ছে, একটু একটু করে প্রাকৃতিক নিয়মে মস্তিষ্কের সেলে বেশী তথ্য আর স্মৃতি সঞ্চিত হচ্ছে ততোই বুঝতে পারছি আমরা ( আমরা বলতে সাধারণ জনগণ, শাসকদের নিঃসঙ্গতার নিজস্ব গল্প নিশ্চয়ই আছে কিন্তু তারা এতো মানুষকে একইসাথে নিঃসঙ্গ এবং নির্বাক করে রাখে যে তাদের একাকীত্ব নিয়ে ভাবার মতো উদারতা দেখানোকেই আমার কাছে অপরাধ বলে মনে হয়) এক তীব্র অচলায়তনের মধ্যে প্রতিনিয়ত খাবি খাচ্ছি। এর থেকে মুক্তি কোথায়? ভাষায় নিশ্চয়ই? আমার বর্তমানে তাই মনে হয়। আমাদের প্রাত্যহিক পারস্পরিক যোগাযোগের অবয়বটিও নিশ্চয়ই আমাদের কাঙ্খিত নয়, তা আমাদের সন্তুষ্টির খোরাক যোগাতে পারেনা। পারলে প্রতি রাত্রে আমরা নিজ নিজ নিঃসঙ্গতা এবং গ্লানিকে সাথে নিয়ে আরো একটি দিন ক্লীবের জীবন কাটাবার জন্য প্রস্তুত কি করে হই? গোটা পৃথিবীতে কি মাত্র একজনই নবারুণ আছে যে কন্ঠের প্রতিটি অংশকে তেজদীপ্ত করে বলে উঠতে পারে “বাঞ্চোদগুলা মানুষ নাকি এমিবা?” আমি তা বিশ্বাস করিনা। একজন নবারুণের জন্ম হওয়া মানেই কোটি কোটি কন্ঠ তার মতো করেই ফুঁসে উঠতে চায়, তারই ভাষায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তারা অপেক্ষা করে। কষ্ট এবং আশার সেই অপেক্ষার মাঝে জীবনের বড় অংশ প্রবাহিত হতে হতে একসময় শারীরিকভাবে তারা অস্তিত্বহীন হলেই কি তাদের অপেক্ষার মৃত্যু হয়? হতে পারে? নিশ্চয়ই নয়। অপেক্ষা, ইনোসেন্স, স্মৃতি, ভাবনা এবং দৃষ্টি এসবের কখনো মৃত্যু হয়না। তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। একজন থেকে আরেকজনে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

উপরের কথাটি শুনেছিলাম শফিকের কাছ থেকে। মুহূর্তটি পর্যন্ত আমার মনে আছে। আবাহনী মাঠের শেষের কোনায় দাঁড়িয়ে আমরা গল্প করছিলাম এক যুগ হয়ে গেলো। চুইঙাম চিবুতে চিবুতে কথা প্রসঙ্গে শফিকের মুখে শোনা কথাটি। বলেছি না যে উপরের ৫টি জিনিস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়ায়? শফিক কথাটি শুনেছিলো তার বাবার কাছ থেকে। উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা কতো কিছু গ্রহণ করতে পারি। করিও। শফিক অন্য কিছু গ্রহণ করতে পারুক কি না পারুক বাবার কাছে শোনা কথাটি ঠিকই গ্রহণ করেছিলো।

আমাদের গল্পের আসলে কোন শেষ নেই। প্রতিটা মানুষের চোখে-মুখে অজস্র দেখা-অদেখা গল্পের সারাংশ থাকে। কাটাবনে এক বন্ধুর সাথে এক সন্ধ্যায় অপেক্ষা করছিলাম। আমার বন্ধু তার বাবার কবরের জন্য এপিটাফের অর্ডার দিয়েছে। ভদ্রলোকের মৃত্যুর ৪ বছর পরে। যার কাছে অর্ডার দিয়েছিলো তার কাছ থেকে গ্রহণ করার পরে দেখি ৫ কেজি ওজনের সাদা রঙের সেই এপিটাফটি অত্যন্ত সাধারণ কিছু কথায় মন্ডিত। জন্ম, জন্মস্থান, মৃত্যুর তারিখ এইতো। এপিটাফের ব্যাপ্তি এটুকুই। কিন্তু শুধুমাত্র এতোটুকুর মধ্যেই কি একজন মানুষের জন্ম,মৃত্যুর ইতিবৃত্তান্ত মোদ্দাকথা তার সমগ্র জীবনের সারাংশ লেখা হয়ে যায়? আমি কোনভাবেই তা মনে করিনা। আমার বন্ধুর ৫৩ বছর বয়সী সেই পিতা নাকি ডাইরী লিখতেন। আমার বন্ধু ভদ্রলোকের মৃত্যুর পরে সেই ডাইরী আবিষ্কার করেছিলো। আমাকে কথা দিয়েছে তার বাড়ি এলে সেই ডাইরী আমাকে পড়তে দেবে। আমি না হয় সেই ডাইরী পড়বোই। তার প্রতিটা অক্ষর শৈশবেই শিখে নেওয়া বর্ণমালার জ্ঞানের কারণে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে ধরা দেবে। কিন্তু যেই জীবন্ত সময়ে আমার বন্ধুর পিতা নিজের মনের তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর কথাটি নিজের ব্যক্তিগত খাতায় লিখে রাখছেন তার স্পন্দনকে অনুভব করবো কিভাবে? সেই সুযোগ আমাদের দেওয়া হয়নি। ঈশ্বর দেননি নাকি অন্য কোন বৈজ্ঞানিক কারণ সেই তর্কের নিশ্চিত কোন সিদ্ধান্তে নিশ্চয়ই পৌঁছানো যায়। কিন্তু তাতে কি হবে? ডাইরীটি পড়তে গিয়ে কি বছর তিরিশ আগেকার সময়ের সেই ইনোসেন্স, স্পন্দনকে উপলব্ধি করতে পারবো? কখনো যদি খোদ নিজের ৪০ বছর আগেরকার পুরনো লেখাই পড়বার সুযোগ হয় তাহলেও কি সেই সময়কে স্পর্শ করতে পারবো অতীতে একসময় যার মাঝেই সমগ্র ডুবিয়ে বেঁচে ছিলাম? পারবোনা তো। অসীম ক্ষমতাধর মানুষের ক্ষমতার ব্যাপ্তি কতো প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু সে চাইলেই বছর তিরিশেক আগের সময়ের গন্ধ, স্পর্শকে অকৃত্রিমভাবে অনুভব করতে ব্যর্থ। জীবনানন্দের দ্বারস্থ হতে হয়। “এই পৃথিবী একবার পায় তারে, আর কোনদিন পায় নাকো।” শুধু কি মানুষ? স্মৃতিও কি এর অন্তর্ভুক্ত নয়? অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত। সেই কারণেই প্রতিটি স্মৃতির স্বাতন্ত্র্যতায় এতোটা গন্ধ ছড়িয়ে থাকে। যাপনের।

একবারি বলেছি যে স্মৃতি, ইনোসেন্স এসবের কোন মৃত্যু হয়না। আবার বলছি যে এগুলোর আদি এবং অকৃত্রিম রুপকে আমরা পরক্ষণেই আর স্পর্শ করতে পারিনা। শুনতে অবশ্যই স্ববিরোধী শোনায় সন্দেহ নেই। কিন্তু উভয়ই তো সত্য। ইনোসেন্সের কথাই যখন আসলো তখন নয় বছর আগেরকার স্মৃতিতেই ফিরে যাই। অল্পবয়স্কা এক সুন্দরী স্কুলশিক্ষিকার প্রেমে পড়েছিলাম। বয়স ছিলো ১৮, নূন্যতম পড়াশোনা না করেও প্রতিটা মডেল টেস্ট দিতে যেতাম শুধুমাত্র সে পরীক্ষায় গার্ডে পড়বে এই সত্যকে বুকে ধারণ করবার আনন্দ নিয়ে। মাঝেমধ্যে বিকালে তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম নিজেকে আড়াল করে। সন্দেহ নিয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করা এক কি একাধিক অচেনা অজানা চোখজোড়ার কখনো যে মুখোমুখি হইনি সেটা নয়। কিন্তু তারা আমার ভেতরকার হৃদস্পন্দনের কনামাত্র না জেনেও আমাকে তার মাঝে থাকতে দিয়েছিলো। মানুষের জীবনে এমন প্রেমের অনুভূতি কয়টাই বা আসে যেখানে তার স্মৃতি সম্পূর্ণ মেখে নিয়ে বাড়ি ফেরার পরে মাস্টারবেট করবার কথা চিন্তাই করা যায়না? আমার এসেছিলো। অন্তত একটি হলেও। এই অর্জনকে ফ্যালনা মনে করবার দুঃসাহস কিংবা মূঢ়তা কোনটার কাছেই আমি পরাজিত হতে ইচ্ছুক নই। প্রেমিকের দম্ভ? নাহ, পরাজয় মানতে নারাজ এই মানসিকতার পেছনে একটাই দম্ভ ক্রিয়াশীল, তা হলো স্মৃতির দম্ভ। ইনোসেন্সের দম্ভ।

আমাদের বাঁচতে চাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গের পরিমাণ ক্রমশ এতোটাই কমে আসছে যে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে গেলে শিউরে উঠতে হয়। আমি প্রায়শই শিউরে উঠি। তখনই বেছে বেছে শোনা, দেখা, অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে ভাবতে ইচ্ছা করে এমন সব স্মৃতিকে বের করে আনি। ঘটে যাওয়া মুহূর্তের আদি অকৃত্রিম ইনোসেন্সের ঘ্রাণকে শুঁকে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করি। আমি জানি সেই আদি অকৃত্রিম রুপকে আর কখনোই ফিরে পাওয়া যাবেনা। কিন্তু এই যে তাকে স্পর্শ করতে চাওয়ার ব্যর্থতা এর মধ্যেও কি যে এক মিষ্টি সুখদায়ক অনুভূতি, আমার ইচ্ছা করে প্রতিটা মুহূর্তে এমন ব্যর্থতায় অবগাহন করি।

স্মৃতি এবং ইনোসেন্সের এই স্ববিরোধী যাত্রার মাঝে প্রতিদিন কতো গল্পই না রচিত হচ্ছে, হয়। আমরা এভাবেই প্রতিনিয়ত জীবনের কাছে ফিরে আসি, পুনরায় জীবন থেকে পালিয়ে দূরদূরান্তে ছুটে যেতে হবে বলে।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×