বাংলা রূপ : ঋতো আহমেদ
টি এস এলিয়টের সাক্ষাৎকার (প্রথম অংশ)
দ্বিতীয় অংশ
হল
কখনো কি আপনি কারও কবিতা পূনর্লিখনে সহায়তা করেছেন? এই ধরুন এজরা পাউন্ড?
এলিয়ট
নির্দিষ্ট করে কিছু মনে পড়ছে না। তবে, অবশ্যই গত পঁচিশ বছরে আমি অনেক তরুণ প্রজন্মের কবির পান্ডুলিপিতে প্রচুর পরামর্শ দিয়েছি।
হল
আপনার মূল, অপরিমার্জিত ওয়েস্ট ল্যান্ড এর পান্ডুলিপিটি কি এখনও আছে?
এলিয়ট
জানতে চেও না। অনেক কিছুর মধ্যে এটাও একটা ব্যাপার যা আমি জানি না। অমীমাংসিত রহস্য। আমি এটি বিক্রি করে দিয়েছিলাম জন কুইনের কাছে। তাকে একটি অপ্রকাশিত কবিতার নোটবুকও দিয়েছিলাম, কারণ সে বিভিন্ন বিষয়ে আমার সাথে আমায়িক ছিল। এরপর আর ওগুলো দেখিনি। তারপর সে মারা গেলে ওরা আরো প্রকাশনায় আর যায় নি।
হল
ওয়েস্ট ল্যান্ড থেকে কি কি জিনিস পাউন্ড বাদ দিয়েছিলেন? সে কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অংশ বাদ দিয়েছিলেন?
এলিয়ট
সম্পূর্ণ অংশ, হ্যা। জাহাজ-ডুবির একটা লম্বা অংশ ছিল। অন্য আরো কিছুর মতো এই অংশ নিয়ে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু কি’ মনে হয় আমি ইউলিসিস এর জাহান্নামের গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। এরপর আরো একটি অংশ যেখানে ধর্ষণের চিত্র ফুটিয়ে তোলা ছিল। পাউন্ড বললেন, “কোনো মানে হয় না যেটা অন্য কেউ লিখে গেছে সেটা আবার লিখা। চেষ্টা করো নতুন ভিন্ন কিছু লিখতে।”
হল
এই কাটছাঁট কি কবিতার কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো কে বদলে দিয়েছিল?
এলিয়ট
না। তেমন কিছু না। একই জিনিসের প্রলম্বিত সংস্করণ বলা যায়।
হল
গঠন বিষয়ে কবিতাটি নিয়ে আমার একটি প্রশ্ন আছে। থট্স-এ (Thoughts) ল্যাম্বেথ এর পর, আপনি অস্বীকার করেছিলেন যে সমালোচকদের অভিযোগ ছিল ওয়েস্ট ল্যান্ড-এ আপনি “একটি প্রজন্মের মোহমুক্তি” ব্যপারটি ব্যক্ত করেছেন। কিংবা আপনি মানেননি ওটা আপনার উদ্দেশ্য ছিল। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি, এফ আর লেভিস বলেছেন, কবিতাটি কোনো অগ্রগতি দেখায় না; অন্যদিকে, আপনার পরবর্তী কবিতাগুলো লিখার পর, বর্তমান সমালোচকদের মতে ওয়েস্ট ল্যান্ড হচ্ছে খ্রীষ্টিয়। আমি অবাক হবো যদি এটা আপনার ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে।
এলিয়ট
না, এটা আমার সচেতন অভিপ্রায়ের অংশ ছিল না। থট্স-এ লেম্বেথের পর, পজেটিভ নয় বরং নিগেটিভ বোধক অভিপ্রায়েই বলতে চেয়েছি, বলতে চেয়েছি ওটা আমার উদ্দেশ্য নয়। অবাক লাগে, ‘উদ্দেশ্য’ বলতে কী বুঝায় আসলে! একজন তার বুকের পাথর নামাতে চায়। হয়তো সে ভালো করে জানেও না কী সেটা, যতক্ষণ না নামাতে পারে। কিন্তু আমি 'উদ্দেশ্য’ ব্যপারটিকে আমার কোনো কবিতায় ব্যবহার করতে পারিনি। এমনকি অন্য কোনো কবিতায়ও না।
হল
আপনি আর পাউন্ড-কে নিয়ে আপনার কেরিয়ারের প্রথম দিককার কিছু বিষয়ে আমার আর একটা প্রশ্ন আছে। কোথাও পড়েছিলাম আপনি আর পাউন্ড একসময় ভেবেছিলেন কোয়াট্রেন(চার লাইনের কবিতা) লিখবেন, প্রথম দশকের শেষের দিকে হয়তোবা, কেননা ভেবেছিলেন দীর্ঘ কবিতা অনেক হয়েছে।
এলিয়ট
আমার মনে হয় সেটা পাউন্ড বলেছিলেন। কোয়াট্রেন লিখার পরামর্শ উনার ছিল। তিনি আমাকে ‘এমাক্স এত কামেস’ (Emaux et Camees: ফরাসি কবি থিওফিল গতীয়র-এর একটি কাব্যগ্রন্থ, ১৮৫২) পড়তে দিয়েছিলেন।
হল
আপনার আকার/আকৃতি ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা সত্যি অবাক করে। আপনি কি কী লিখবেন এটা ঠিক করার আগেই এর আকৃতি ঠিক করে নিতেন?
এলিয়ট
হ্যা, কিছুটা সেরকমই। আমরা প্রথমে গতীয়র কবিতা ভালো করে পাঠ করি তারপর ভেবে দেখি, “আমার কি এমন কিছু বলার আছে যা এই আকার-এ লিখলে যথার্থ হবে?” এবং কিছু নিরীক্ষা চালাই। আকার বিষয়বস্তু তে গতি নিয়ে আসে।
হল
তাহলে প্রথম দিককার লিখায় দীর্ঘ কবিতা কেন আপনার?
এলিয়ট
আমার প্রথম কবিতাগুলো, অবশ্যই, লাফোর্গের মতো দীর্ঘ করার প্রচেষ্টা ছিল। মানে হলো, ছন্দময় ছোট বড় নানা আকৃতির পংক্তি, বিভিন্ন জায়গায় চলে আসা অনিয়মিত ছন্দ, এইসব। আসলে ওগুলো এতো মুক্তও ছিল না। বিশেষত এজরা যাকে বলতো ‘এমিগিজম’। তারপর, অবশ্য, এর পরের পর্বে আছে আরো একটু মুক্ত গদ্য ছন্দ, যেমন “ড়াপসোদি অন আ উইন্ডি নাইট”। জানিনা এরকম গঠন আগেই ভেবে রেখেছিলাম কিনা। শুধু জানি লিখে ফেলেছি।
হল
কখনো কি মনে হয়েছে, হয়তোবা, কোনো কিছুর বিরুদ্ধে লিখছেন, এইসমস্ত গঠন-ফঠন কিছু না? যেমন ধরুন কবি লরিয়েটের বিরুদ্ধে?
এলিয়ট
আরে না, কী বলেন, মোটেই না। আমি মনে করি না কেউ বারবার বদলাতে চেষ্টা করবে, বরং সে খুঁজবে কোনটি তার জন্য সঠিক। একজন সত্যি কবি লরিয়েটের কবিতা উপেক্ষা করে গেছেন, তিনি রবার্ট ব্রিজ। আমার মনে হয় না বর্তমান কে ছুঁড়ে ফেলে কোনো ভালো ও মহৎ কবিতা হয়ে উঠতে পারে। কেবল সরিয়ে রাখে। মানুষ পথ খুঁজে ফিরে যে পথে সে কিছু বলতে পারবে। “যে পথ পাই সেটাই যে সেই পথ এমন নাও হতে পারে।”
হল
মনে হয় এটা “প্রুফক”-এর পর আর “জেরনশন” এর আগে ফরাসিতে যে কবিতাগুলো লিখেছিলেন, যা আপনার ‘কবিতা সংগ্রহ'তে আছে। কীভাবে লিখলেন ওগুলো! আর কিছু লিখেছিলেন কি?
এলিয়ট
না ভাই, আর লিখতে চেষ্টা করিনি। ওই ব্যপারটা অনেকটা অদ্ভুত একসাথে সব ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। তখন মনে হচ্ছিল আমি সম্পূর্ণ ফুরিয়ে গেছি। কিছু দিন কিছুই লিখতে পারিনি। উন্মুখ হয়ে উঠেছিলাম। চেষ্টা করলাম ফরাসিতে কিছু লিখি। পেরেছিলামও সে সময়। তখন কবিতা কে তেমন গুরুত্বসহকারে নিইনি। এমনকি ওই ফরাসি কবিতাগুলোও। সত্যিই, তখন লিখতে না পারা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত হইনি। দেখতে চেয়েছিলাম আমি কী করতে পারি। এভাবে কয়েকমাস পেরিয়ে যায়। ওগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো গুলোই প্রকাশিত হয়। অবশ্যই বলতে হবে এজরা পাউন্ড ওগুলো পড়েছিলেন আর এডমন্ড ডুলাক নামের এক ফরাসী ভদ্রলোক, যাকে আমরা লন্ডনে চিনতাম, কিছুটা সাহায্য করেছিলেন। আমরা কিছু বাদ দিয়েছিলাম। মনে হয় তা এখন আর নেই। তারপর আবার হঠাৎ করেই ইংরেজীতে লিখতে শুরু করি। ফরাসি তে লিখার সব ইচ্ছে শেষ হয়ে যায়। আমি মনে করি এই ব্যাপারটি আবার নতুন করে আমাকে শুরু করতে সাহায্য করেছিল।
হল
আপনি কি বিগত শতাব্দীর দুই আমেরিকান কবির মতো ফরাসি সিম্বলিস্ট কবি হতে চেয়েছিলেন?
এলিয়ট
স্টুয়ার্ট মেরিল আর ভিলে-গ্রিফিন এর কথা বলছেন? হার্ভার্ড এর পর যখন প্যারিসে একটি রোমান্টিক বছর কাটিয়েছি তখন করেছিলাম। তখনকার চিন্তা ভাবনা ছিল ইংরেজী ছেড়ে দেব আর প্যারিসে স্থিতু হ’য়ে ধীরে ধীরে ফরাসি তে লিখা লিখি শুরু করবো। কিন্তু ওটা ছিল বোকার মতো চিন্তা, যদিও দোভাষী হিসেবে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে আমি খুব ভালো করছিলাম, শুধু মাত্র এই কারণে যে আমি ভাবিইনি কেই দোভাষী কবি হতে পারে। আমার কোনো ধারনাই ছিল না কেউ একই সাথে দুই ভাষাতেই ভালো কবিতা লিখতে পারে। আমি মনে করি কবিতার জন্য কেবলমাত্র একটি ভাষা বেছে নেয়া উচিৎ, আর অন্য ভাষাগুলো সব অন্য কোনো বিষয়ের হতে পারে। ইংরেজী ভাষা ফরাসি ভাষার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক সমৃদ্ধ। অন্যভাবে বলতে গেলে, সম্ভবত আমি ফরাসির চেয়ে ইংরেজীতেই ভালো করেছি, এমনকি ফরাসিতে ওই দুই কবির চেয়ে স্বচ্ছন্দ হোতামও।
হল
আমি কি জানতে পারি কবিতা নিয়ে এখন কী পরিকল্পনা করেছেন?
এলিয়ট
না, সেরকম কোনো পরিকল্পনা নেই। এ মুহূর্তে শুধু ভাবছি কীভাবে দ্যা এল্ডার স্টেটসম্যান এর কাজটা শেষ করবো। লন্ডন ছেড়ে আসার আগে কেবলমাত্র প্রুফ চূড়ান্ত করে এসেছি। কয়েকটি বিষয়ে কিছু গদ্য লিখা আরকি। একধাপ পরের বেশি আমি ভাবি না। আমি কি আর একটা নাটক লিখবো অথবা আরো কিছু কবিতা লিখতে চাই? এরকম প্রশ্নের উত্তর হলো আমি জানি না, যতক্ষণ না আমার লিখতে ইচ্ছে হয়।
হল
আপনার কি অসমাপ্ত কোনো কবিতা আছে মাঝে মাঝে খুলে দেখেন?
এলিয়ট
সে রকম বেশি কিছু নেই, না নেই। নিয়ম হলো, অসমাপ্ত কিছু থাকলে, সেখান থেকে ভালো অংশ নিয়ে অন্য কোথাও ব্যবহার করে ফেলা। কাগজে লিখে ড্রয়ারে ফেলে রাখার চে মনের মধ্যে গেঁথে রাখি। যদি কাগজে ফেলে রাখি তাহলে তা যা তা-ই থেকে যাবে, এর চে যদি মনে মধ্যে স্মৃতি তে রাখি, তাহলে পরবর্তীতে সেটা বদলে গিয়ে নতুন কিছু হয়ে যেতে পারে। আগে যেমন বলেছি, মার্ডার ইন দ্যা ক্যাথিড্রেল থেকে বাদ পড়া অংশের সূত্র থেকে বার্ন্ট নরটন-এর শুরু। মার্ডার ইন দ্যা ক্যাথিড্রেল থেকে বুঝতে পেরেছি কবিতা হিসেবে কোনো পংক্তি যতোই ভালো হোক না কেন, যৌক্তিকতা না থাকলে ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই। যেমন মার্টিন ব্রাউনি তখন প্রয়োজনীয় ছিল। তিনি বললেন, “এখানে দারুণ সুন্দর কিছু পংক্তি আছে, কিন্তু মঞ্চের ঘটতে যাওয়া ঘটনার সাথে এগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”
হল
আপনার এমন কোনো ছোট কবিতা আছে কি যেগুলো আসলে বড় কোনো কবিতার বাদ পড়া অংশ? মনে হয় দুটি আছে, যেমন “দ্যা হলো ম্যান”।
এলিয়ট
ওহ, ওগুলো ছিল প্রাথমিক খসড়া। প্রথম দিককার। অন্যগুলো বিভিন্ন সাময়িকী তে প্রকাশ করেছি। কিন্তু কবিতা সংগ্রহ তে নেই। আপনি নিশ্চই বলছেন না এক জিনিস একই বইএ দুবার আছে।
হল
লক্ষ করা গেছে আপনি প্রায়ই বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করে কবিতা লেখেন। শুরুতে এগুলো কি আলাদা আলাদা হিসেবে লেখেন? আমি নির্দিষ্টভাবে “এশ ওয়েডনেসডে”র কথা বলছি।
এলিয়ট
হ্যা, যেমন “দ্যা হলোম্যান”, এই কবিতা অন্য একটি কবিতা থেকে এসছে। যদ্দূর মনে পড়ে, কমার্স বা অন্য কোথাও প্রকাশিত “এশ ওয়েডনেসডে” এর কয়েকটি অংশের প্রথম বা দ্বিতীয় খসড়া হবে হয়তো। তারপর ধীরে ধীরে দেখা গেল একটা পূর্ণ কবিতার অবয়ব দাঁড়িয়ে গেছে। এই হলো একটি উপায় যেভাবে আমার মন কাজ করেছে বছরের পর বছর কাব্যিকভাবে—ভিন্ন ভিন্ন লিখে তারপর ভেবে দেখেছি এক করা যায় কিনা, অদল বদল করে, এভাবেই একটি সম্পূর্ণতায় নিয়ে আসা বলা যায়।
হল
আপনি কি এখন এমন কিছু লিখেন যা “ওল্ড পোজাম”-এর “বুক অব প্রাকটিক্যাল ক্যাটস" অথবা "কিং বোলো” এর মতো?
এলিয়ট
...
(চলবে..)
সূত্র : প্যারিস রিভিউ
ঋণ স্বীকার : এমদাদ রহমান
ছবি : অন্তর্জাল
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:০৪