বহ্নির মেজাজ খারাপ লাগছে। তিন দিন ধরে বৃষ্টি। এ বছরতো প্রকৃতি ছোট্ট বালক (El Niño); সারাক্ষণ কারণে অকারণে খালি চোখের জল ঝরাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার শীতকেলে বৃষ্টিতে আকাশ থেকে জল বেয়ে শীত নেমে আসে। রাত বেড়েছে অনেক; ঘুম আসছে না; আজ ছুটি থাকলেও বহ্নি সারাদিন ঘর থেকে বের হয়নি। শীতকালে বৃষ্টি হলে নিজেকে কেন যেন কয়েদী মনে হয়। কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করে না, কেবল মন কেমন করে। বৃষ্টি ওকে বড় অস্থির, আর উচাটন করে।
বিছানার পাশে মস্ত বড় দেয়াল জোড়া জানালা; ব্লাইন্ড তোলা। কাঁচের ওপাশে রুপসী হাইওয়ে ওয়ান; গাড়ীর হুসহাস শব্দ আর জলের কূলকুল বয়ে চলার আওয়াজ। ঘষা আলোতে জানালার কাঁচে জলের আকাঁবুকি দেখতে ভালোই লাগছে। জলের বিন্দুদের ছোঁযাছুয়ি খেলা; ছোঁয়া মাত্র হুড়মুড়িয়ে গড়িয়ে পড়া; ঠিক যেন পার্কে ঢেউতোলা স্লাইড বেয়ে নামা। জলের বিন্দুরাও কি পরষ্পরের প্রেমে পড়ছে? এভাবেই তো দুজন মানুষ কাছাকাছি আসার পরে সারা দুনিয়া ভুলে প্রেমে পড়ে।
মাঝে মাঝে জোর বাতাসে বৃষ্টির ঝাপটা মুছে দিচ্ছে কাঁচে আঁকা জলের কাব্য। এই বৃষ্টি টিনের চালে গুরু গম্ভীর আওয়াজ তোলা ঝমঝমে বৃষ্টি না; সে বৃষ্টিতে চীৎকার করে কাঁদা যায়; জলের আওয়াজ ঢেকে দেয় সব দুঃখ। এই বৃষ্টি রিমঝিম বৃষ্টিও না; সে বৃষ্টিতে রিক্সায় হুড ফেলে ভালোবাসার হাত ধরা যায়। এই বৃষ্টি চারপাশে বিষন্নতার ঘেরাটোপ আর একাকীত্বের গরাদ তৈরী করে।
জলবিন্দুদের কাছে আসার খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎই জানালায় বরফিকাটা গ্রীল। ক্লাস নাইনে পড়া কিশোরী মেয়েটা বৃষ্টি নামাতে দৌড়ে এসে জানালার পাল্লা বন্ধ করতে গিয়ে থমকে গেছে। বনানী কলোনীর চারতলা বিল্ডিংয়ের পাশে কংক্রিটের ভেজা রাস্তা; ছাই সাদা রঙের রাস্তা শেষে কলোনীতে ঢোকার বিশাল দুয়ার। স্ট্রীট লাইটের হলদে আলোয় মায়াবী সন্ধ্যা; বৃষ্টির গুঁড়ো গুঁড়ো জলে কুয়াশার মায়াজাল। সেই ভেজা ভেজা আলো আধারিতে এক যুবক একাকী হেঁটে যাচ্ছে; পিঠে কালো বুকব্যাগ; ঝুকে ঝুঁকে হাঁটছে মানুষটা; বড় ক্লান্ত। কেন কে জানে? ব্যাগের ভারে নাকি জীবনের ভারে? কি বিষন্ন নিঃসঙ্গ একজন মানুষ!!!
বহ্নির ইচ্ছা করেছিলো সব ফেলে ওই অজানা মানুষটার হাত ধরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে হাঁটে। স্মৃতিরা আসলেই বড় উচ্ছৃঙ্খল। আজও এমন বৃষ্টি নামলে বহ্নির সব কিছু ফেলে, এই সাজানো সংসার, সন্তান, নিজের মানুষ, সব ফেলে ওই অজানা যুবকের হাতে হাত রাখতে ইচ্ছা করে।
মানুষটা জানেও না; সে মানুষটাকে বহ্নি চেনেও না। অথচ সেই জলরঙ্গা সন্ধ্যার বিষন্ন একাকী যুবক এতো এতো বছর পরেও বৃষ্টি নামলেই ওকে অধিকার করে। এ সময়টা বহ্নির নিজেকে বড্ড অচেনা মনে হয়; ভীষন ভয় লাগে।
আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কি দেখবে বহ্নি? বৃষ্টিভেজা রাতে সব পেছনে ফেলে পলায়নপর ওই মানুষটা কি ও নিজেই?
© শিখা রহমান (০৩/১১/২০১৬) (ছবি ইন্টারনেটে সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:৫২