somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শিখা রহমান
কবিতা প্রেমী; একটু এলোমেলো; উড়নচণ্ডী; আর বই ভালবাসি। শব্দ নিয়ে খেলা আমার বড্ড প্রিয়। গল্প-কবিতা-মুক্ত গদ্য সব লিখতেই ভালো লাগে। "কেননা লেখার চেয়ে ভালো ফক্কিকারি কিছু জানা নেই আর।"

মুখোশের আড়ালে

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৩:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রাত কয়টা বাজে এখন? মনে হচ্ছে ভোর কাছে চলে এসেছে; গলির নেড়ি কুকুরগুলোও চুপ হয়ে গেছে। আনুশা আর আরেকটি দীর্ঘ ঘুমহীন রাত্রি। একটি দিনকে অন্যদিন থেকে পৃথক করে যে নিদ্রা, সেই যদি অন্তর্হিত হয়, তবে কাঁধে যে কি অখন্ড সময়ের বোঝা চেপে বসে। আনুশা এ বোঝা টেনে বড় ক্লান্ত; সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে নির্ঘুমতা। একশ’ কেন লক্ষ থেকে উল্টোদিকে শূণ্য পর্যন্ত গুনে সেই কখন শেষ করেছে, তবু ঘুম আসে না। লক্ষ এতো কম কেন?

কর্মব্যস্ত সারাদিন; দিন গড়িয়ে রাত নামলে বড় ক্লান্ত লাগে। অথচ বিছানার নরমে পিঠ রাখলেই নিদ্রা উধাও। পাশে রাহাত কি দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে!!! শোবার পরে ভালোবাসাবাসি না হলে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যায়। রাহাতকে বড্ড হিংসা হয় এ সময়টাতে আনুশার। মধ্য তিরিশেই আনুশাকে অনিদ্রা রোগ ধরলো; এখনো যে অন্তত আরো দু’দশক বাঁচার ইচ্ছে আছে। কিন্তু কুড়ি বছর নিদ্রাহীন কাটাতে হবে ভাবলেই যে ওর মরে যেতে ইচ্ছা করে।

রাতের অন্ধকারে মুখোশ খুলে পড়ে; নিজের মুখোমুখি বসা; নিজের কাঠগড়ায় নিজে। দীর্ঘ সময়ে কার নিজের কাছে জবাবদিহি ভালো লাগে? আনুশারও লাগে না। স্বপ্ন-প্রেম, কামনা-বাসনা, স্মৃতি-বিস্মৃতির জটাজলে বন্দী ওর রাত্রির পৃথিবী। দুঃখ খুব জাগরণ ভালোবাসে। সব ভুলে যাওয়া কষ্টেরা ভিড় জমায়; আনন্দের সাধ্য কি দুঃখের সাথে পাল্লা দেবে? আকাশে মা থাকেন অনেকদিনই; আনুশা মাঝে মাঝে মায়ের সাথে কথা বলে; মন খারাপের সাক্ষী থাকে বালিশের ভেজা শরীর।

একটু আগেই আনুশা পাশের ঘরে ছেলে দুটোকে দেখে এলো। ছোটোটা সাতে পড়েছে; এখনো ঘুমানোর আগে মায়ের শরীরের গন্ধ চাই। রাতে বিরেতে ঘুম না এলে আনুশা ওর পাশে গিয়ে শোয়; তুলতুলে গালে ঠোঁট চেপে রাখে অনেকক্ষণ; ছেলেটা টের পেলেই শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে। কি যে ভালো লাগে!!! শুধু এই মুহূর্তের জন্যই আনুশা হাজার বছর ঘুম ছাড়াও বেঁচে থাকতে পারবে।

কয়টা বাজে? আনুশা বালিশের পাশে রাখা ফোন হাতে নিলো। ঘুম না এলেও ইদানিং ও ফোন দেখতে চায় না। ফোন নিলেই যে ফেসবুক দেখা শুরু; আর একবার দেখা শুরু করলে কয়েক ঘন্টা সাবার। মাত্র বছর খানেক হলো ফেসবুক একাউন্ট খুলেছে আনুশা; তাও আবার স্কুলের বান্ধবীদের অনুরোধে। বান্ধবীরা একটা ফেসবুক গ্রুপ খুলেছে; এক বছরেই আনুশার প্রায় দেড়শ আন্তর্জালীয় বন্ধু। পনের বিশ জন আত্মীয় ছাড়া সবই সেই ছোট্টবেলার হারিয়ে যাওয়া বান্ধবীরা; সারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে সবাই ছড়িয়ে। বন্ধুদের ছেলে মেয়েদের, তাদের ভালোবাসার মানুষদের, তাদের বেড়ানো, তাদের সাফল্য, তাদের আনন্দিত মুখ দেখতে আনুশার খুব ভালো লাগে।

নির্ঘুম রাতগুলোতে ও মন দিয়ে সবাইকে দেখে। লাইক...লাইক...লাইক!!! সব লাইক!! বড় ছেলেটা তেরোতে পড়েছে; মায়ের ফেসবুক একাউণ্ট খুলতে সেই সাহায্য করেছে। একদিন আনুশা সব ছবিতে লাইক দিয়ে যাচ্ছে; বড়টা বলে “মা তোমার লাইকেরতো কোন দাম নেই...হি হি...তুমি তো দেখি সব কিছুই লাইক করো!!” আসলেই আনুশা সবই লাইক করে; না করার কি আছে? আনন্দিত সব হাসিমুখের ছবিতো ভালো না লাগার কিছু নেই।

তবে আনুশার নিজেকে একটু অপাংক্তেয় মনে হয়; বান্ধবীদের সাফল্যের গল্প পড়ে ভালো লাগলেও নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়। স্কুলে খারাপ ছাত্রী ছিলো না; প্রথম তিন জনের মধ্যে না থাকলেও প্রথম দশজনের মধ্যেতো থাকতো। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আগে মাটা হুট করে মরে গেলো; তারপরেও আনুশা পড়াশোনায় খারাপ করছিলো না। খুব ইচ্ছে ছিলো ডাক্তারি পড়ার; কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার সাথে সাথে বাবা বিয়ে দিয়ে হাত পা ঝাড়া হলেন। কিছু দিনের মধ্যে নিজেও আবার বিয়ে করলেন।

সে সব নিয়ে আনুশার তেমন কষ্ট নেই; নতুন মা বেশ ভালো। তবে ওর আর ডাক্তারি পড়া হলো না; কোনভাবে বি এ পাশ করলো। রাহাত ছোটখাটো ব্যবসা করে; ফার্নিচারের দোকান আছে। ডাক্তার না হলেও আনুশা একটা স্কুলে বা ব্যাঙ্কেতো চাকরীর চেষ্টা করতে পারতো। তবে ছেলে দুটো বড় না হলে সে চেষ্টা সম্ভব নয়; ব্যবসা এতো ভালো নয় যে বাসায় বাচ্চা দেখাশোনার জন্য লোক রাখতে পারবে। বাসার কিছু কাজ ছুটা বুয়া দিয়ে করালেও রান্না থেকে শুরু করে ছেলেদের স্কুলে আনানেয়া, ওদের পড়াশোনা আর যাবতীয় ঘরকন্নার কাজগুলো আনুশাই করে। তারপরেও কেন যে রাতে ঘুম আসে না?

রাত তিনটা বাজে প্রায়। আর দু’ঘন্টা; তারপরেই আজান; রাত্রির যবনিকা পতন। ইদানিং ফেসবুকে নতুন ফিচার...লাইক...লাভ...দুঃখী...রাগী...ওয়াও!!! আনুশা সময় দেখে ফেসবুকে ঢুকল; লাভ!! লাভ!! লাভ!! আনুশার হাসি পেলো; বড়টা দেখলে এখন বলতো “মা তোমার ভালোবাসারও তো দেখি কোন দাম নেই!!! সবাইকেই ভালোবাসো??”

ফেসবুকে ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো। সুশানা না? সুশানা চৌধুরী; বড় সুন্দর ছিলো দেখতে মেয়েটা; ধনী ঘরের মেয়ে; আভিজাত্য ছলকে পড়তো চলাফেরায়; একটু দাম্ভিক। আনুশার সাথে তেমন কথা হয়নি কখনো; তবে আনুশার ওকে খুব ভালো মনে আছে। অনেকটা দুর্গা প্রতিমার মতো দেখতে; ফর্সা ত্বকের নীচে সবসময় আলো ফুটে বেরোতো। হালকা বাদামী চোখ; আলো পড়লে মনে হতো দুটো মার্বেল বাসানো গাঢ় বাদামী পাপড়ির ছায়ায়। মাথা ভর্তি মেহেদী কালো ঘন চুল; কথা বলার সময় পাতলা গোলাপী ঠোঁট বেঁকে যেতো খুব সুন্দর; আর চিবুকে নায়িকাদের মতো একটা লালচে তিল। সুশানাকে ওর মনে হতো কোন রাজকন্যা; রুশদেশের উপকথার রাজপুত্র ইভান যার জন্য অপেক্ষা করে আছে।

সুশানা সঙ্গতকারণেই এখনো আনুশার ফ্রেন্ডলিষ্টে নেই। একটা পার্টির ছবি; সুশানাকে নীলসবজে শাড়িতে কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে!!! লিঙ্ক অনুসরণ করে ও পৌঁছে গেলো সুশানা্র ফেসবুকে; অনেকগুলো ছবিই বন্ধু না হলেও আনুশা দেখতে পাচ্ছে। এক ছেলে, এক মেয়ে, আর পাশে রাজপুত্র নিয়ে রাজকন্যা সুশানার আনন্দিত মুখের অনেক ছবি। কয়েকটা ছবি গত সপ্তাহেই তোলা; পাঁচশোর ওপরে লাইক। অনেকে মন্তব্য করেছে ‘Beautiful Family!!’ ‘Picture Perfect Family’ ‘Happy Family’…

কি অসম্ভব সুন্দর ছবিগুলো!! সুশানা গুলশানে থাকে; ওদের বাসার কাছেই আনুশার এক খালাশ্বাশুড়ী থাকেন। কথায় কথায় ওকে একদিন সুশানার গল্প বলেছিলেন। সুশানা রাজরানী হলেও দুয়োরানী; তার রাজপুত্রের একজন সুয়োরানী আছে যে। এই আলো ঝলমলে ছবিগুলো তো সেই সুয়োরানী দুয়োরানীর গল্প বলে না; সুখী দাম্পত্যের ছাপ একেবারে স্পষ্ট।

বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত দোলাচল অনুভব করল আনুশা; ছবি আর বাস্তবতার মধ্যে কোনও মিল নেইতো। ছবিগুলো মিথ্যে বলছে; আন্তর্জালের পৃথিবীতে কি তবে সবাই মুখোশ পড়ে আছে? মুখ আর মুখোশ যেন একাকার হয়ে গেছে। সকলেই কি তবে দেখাতে চায় সে অন্যের থেকে কত ভাল আছে? আনুশা ফেসবুক বন্ধ করে পাশে ঘুমন্ত রাহাতের বুকে মাথা রাখলো।ওর মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি; এই মানুষটা মিথ্যে নয়; এই জীবনটা আনুশার সত্যি পৃথিবী। এখন ওর ঘুম পাচ্ছে। আনুশা পেয়ে গেছে ঘুম-নগরীর চাবি।

© শিখা (০৩/২৯/২০১৬) [ছবি ইন্টারনেটে সংগৃহীত]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৩:৫০
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×