somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শিখা রহমান
কবিতা প্রেমী; একটু এলোমেলো; উড়নচণ্ডী; আর বই ভালবাসি। শব্দ নিয়ে খেলা আমার বড্ড প্রিয়। গল্প-কবিতা-মুক্ত গদ্য সব লিখতেই ভালো লাগে। "কেননা লেখার চেয়ে ভালো ফক্কিকারি কিছু জানা নেই আর।"

জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই অধিক সুন্দর

০১ লা মে, ২০১৮ রাত ১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.

“আফা!! ভাইয়ার জন্য ফুল নিবেন না?” মহাখালীর রেল ক্রসিংয়ের কাছে জ্যামে গাড়ীতে বসে থাকা অরনী একটু চমকে গেলো। একটু হাসিও পেলো, ওকে দেখেই কি বোঝা যাচ্ছে যে সে একজন ভাইয়ার? জ্যামে আটকালে গাড়ীর জানালায় সবসময়েই টোকা পড়ে। ও সাধারনত তাকায় না; তাকালেই ফকিরদের কাকুতি মিনতি বেড়ে যায় আর ওর মন গলে যায়। ও টাকা না দিয়ে পারে না। অনেকবার এ জন্য শাহেদের কাছে বকুনি খেয়েছে “ভিক্ষা দিয়েতো তুমি ওদের কাজ না করার ইচ্ছাটাকে বাড়িয়ে দিচ্ছো…ওদের কাজের ব্যবস্থা করা দরকার…দীর্ঘস্থায়ী পুনর্বাসন…” অরনী জিজ্ঞাসা করতেই পারে যে কি ব্যবস্থা আছে কিন্তু আরো কিছুক্ষন লেকচার শুনতে হবে বলে চুপ করে থাকে।

আজ ও আরো জানালার টোকা শুনে তাকাচ্ছে না কারণ আসার পথে ভিক্ষা দিতে দিতে ও সব খুচরো টাকা শেষ করে ফেলেছে। শাহেদ সাথে নেই বলে ও যেই ভিক্ষা চেয়েছে তাকেই ইচ্ছে মতো টাকা দিয়েছে। জানালায় নাক চেপে দাঁড়িয়ে আছে একটা দশ বারো বছরের ছেলে; খালি গা; উস্কুখস্কু ঝাকড়া চুল; বড় বড় চোখ; খুবই মিষ্টি একটা চেহারা। গায়ের রঙ কোন একসময় উজ্জল থাকলেও এখন রোদে পুড়ে আর ময়লার আস্তরে ঢেকে গেছে। তার দুপাশে কাছাকাছি বয়সের আরো দুজন। অরনী কাঁচ নামিয়ে বললো “এই তোমার নাম কি?” “হৃদয় আফা…” ও উত্তর দেয়া শেষ করতে না করতেই অন্য দুজন কোথায় জানি দৌড়ে চলে গেলো।

- ওরা কি ভয় পেলো নাকি?
- না আফা...ওরা আনসার ক্যাম্পে খাওন আনতে গেলো।
- তুমি যাবে না?
- ওইখানে প্রেত্যেকদিন খালি ভাত আর ডাইল দেয়...ডাইলও পানির মতোন...খাইতে ভালা লাগে না আর...মাজে মাজে সবজী দেয়...তখন খাইতে মজা লাগে।

- তাহলে কি আজ খাবে না?
- আফা আপনি এই ফুল কয়টা কিন্যা লন...মাত্র ৫০ টেকা...আমি তাইলে দোকান থে আজ ভাত আর মুরগীর গোস্ত কিন্যা খামু...
- কিন্তু আমার কাছে যে আজ টাকা নাই রে...
- নেন না আফা...নেন না...

অরনীর খুব খারাপ লাগছে, এতো মিষ্টি করে বলছে।

- এই ছেলে শোন তুমি আমার সাথে বাসায় চলো...আমি ফুলের দাম দেবো আর তোমাকে মাংস দিয়ে ভাতও খেতে দেবো? যাবে?
ছেলেটা একটু দ্বিধাগ্রস্থ।
- মুরগীর গোস্ত? আফনার বাসা কই?
- হ্যা...মুরগীর মাংস আর সবজীও। এইতো বনানী এগারো নম্বরে...যাবে?
- আইচ্ছা...কিন্তু ফুলের দাম ১০০ টেকা দিয়েন আফা...

অরনী হেসে ফেললো “আচ্ছা দেবো...গাড়ীতে ওঠো...” ড্রাইভার অনেকক্ষন থেকেই বিরক্ত মুখে ওদের কথাবার্তা শুনছে। এতোক্ষনে সে বললো “আপা এইসব পুলাপান রে আস্কারা দিয়েন না…এরা বড় বজ্জাত…” “লিটন ভাই…এতো চিন্তা করেন না তো…এইটুকু ছেলে আবার কি করবে?” আপার মাথা একটু আউলা, মানা করে লাভ নাই। ড্রাইভার লিটন নিঃশ্বাস ফেলে হৃদয়কে বললো “ওই ছেমড়া সামনে আমার পাশে আইসা বস...” প্যাসেঞ্জার সিটে টাওয়েল বিছাতে যেতেই অরনী বললো “আমাকে টাওয়েলটা দেন লিটন ভাই... হৃদয় আমার পাশে পেছনে বসুক।“ লিটন হতাশ চোখে তাকিয়ে টাওয়েলটা দিলো; আপা বড় ঝামেলা করে।

২.

ভাগ্যিস আজ শাহেদ বাসায় নেই!! থাকলে হৃদয়কে বাসায় নেয়া যেতো না। ও ঠিক ঠিক বকা দিতো। এমনিতেই অরনী অনেক বকা খায় ওর এলোমেলো কাজের জন্য। একবার একটা লোক জ্যামের মধ্যে এসে গাড়িতে লিফট চেয়েছিলো; অরনী লিটন ভাইকে দরজা খুলে দেবার কথা বলতেই শাহেদ খুব রেগে গিয়েছিলো “আশ্চর্য!!! তুমি রাস্তার একটা উটকো লোককে হুট করে গাড়ীতে তুলবে? লোকটা যদি গাড়ীতে উঠে ছোরা বা বন্দুক ধরে? তখন কি করবে শুনি?” “বাহ...তা করবে কেন? লোকটা বললো না যে তার বাবা খুব অসুস্থ হাসপাতালে যেতে হবে...আমরা তো ওই দিকেই যাচ্ছি...তাই না?” “Grow up Oroni please…Life is not that simple. একটু ম্যাচিওরড হওয়ার চেষ্টা করো।“ অরনী বোঝে না যে ম্যাচিউরিটি বাড়ানোর জন্য এতো চেষ্টা কেন? সময়ের সাথে সাথে একসময় তো ম্যাচিউরিটি আসবেই।

অরনী চারপাশের দুনিয়া থেকে একটু ঘেরাটোপে বড় হয়েছে। একমাত্র মেয়ে; বাবা মা ছাড়াও আগলে রাখার জন্য পাঁচ বছরের বড় ভাই। ও খুব কমই কোথাও একা গেছে। বাবা, মা বা ভাইয়া সবসময় সাথে গেছে বা নামিয়ে দিয়েছে আবার পরে তুলে নিয়েছে। ওর আসলেই পৃথিবীর বা মানুষের জটিলতার সাথে কমই পরিচয়। কিন্তু ঠিক সেই কারনেই ওর মধ্যে এক ধরনের সরলতা আছে যা মনকে ছুঁয়ে যায়; গুমোট দিনগুলোতে যেন হঠাৎ এক পশলা হাওয়া।

শাহেদের কথা মনে হতেই অরনীর একটু মন খারাপ হলো। এতো রাশভারী মানুষটা; ওদের মাত্র মাস ছয়েক হলো বিয়ে হয়েছে; এখনো মধুচন্দ্রিমার গন্ধমাখা সময়টা। বছর আটেকের বড় এই মানুষটাকে ও এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। অরনী একটু আল্লাদী; একটু অস্থির; একটু ছেলেমানুষ আর খোলামেলা। শাহেদ ঠিক তার উল্টো; উচ্ছাস কম; বেশ অন্তর্মুখী একজন মানুষ। বিয়ের পরে একদিন ওর বুকের কাছে গুটিসুটি হয়ে এলোমেলো কথা বলতে বলতে অরনী খেয়াল করলো মানুষটা মোটেও শুনছে না, হাতে বই ধরে মন দিয়ে পড়ছে।

- এইইই যে আমাকে তোমার কেমন লাগে? ইশশ্ বই পড়া থামাওতো...
শাহেদ বই নামিয়ে খুব নির্বিকার ভাবে বললো “তোমাকে আমার বিড়ালের মতো লাগে...আদরে নষ্ট বিড়াল...”
অরনী উঠে বসেছিলো “মানে কি?”
- মানে আবার কি? সারাক্ষণ এতো ঘেঁষাঘেষি আমার পছন্দ না।

অরনীর এতো রাগ লেগেছিলো; ও মনে মনে বললো “তুই কি? নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে একটা শিয়াল...পাঠশালার মাষ্টার মশাই...ছোটলোক শিয়াল...“ রাগ হলে ও শাহেদকে মনে মনে তুই করে বলে...মুখের ওপরে বলা...ওরে বাপরে!!

শাহেদ আসলেই মাষ্টারি করে, একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিক্সে এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। ডক্টরেট করে দেশে ফেরার পরেই অরনীর সাথে বিয়ে হলো। খুবই ডেডিকেটেড একজন শিক্ষক; পড়াশোনা তার ধ্যানজ্ঞান। মাঝে মাঝে অরনীর মনে হয় শাহেদের জীবনে বা মনে কি ওর জন্য কোন জায়গা খালি আছে?

সেদিন শাহেদ বললো “শোনো মেয়ে আমি না একটা বই লিখবো ভাবছি...” “তাই!! কিসের বই? গল্প, উপন্যাস না কবিতা?” শাহেদের কপালে ভাঁজ পড়ল, অরনী মনে মনে প্রমাদ গনলো “উহহ হু!!” “আশ্চর্য!! এসব আমি লিখবো কেন? আমার ইচ্ছা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখবো। কিভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা যায়? রাজনৈতিক আর সামাজিক বিভিন্ন ইস্যু কিভাবে মানুষের জীবনের মানদন্ডকে নিয়ন্ত্রন করে? বর্তমানকে অতীতের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে হবে...না হলে ভবিষৎ প্রেডিক্ট করবে কি ভাবে? কার্যকরী নীতি নির্ধারণ হবে কি ভাবে?” আরও অনেক কিছু বলেছিলো...ঝাড়া পয়তাল্লিশ মিনিট। এই একটা ব্যাপারেই শাহেদের কথার ফুলঝুড়ি ফোটে...চোখ মুখ আগ্রহে ঝলমল করতে থাকে। অরনী কথাগুলো না বুঝলেও মুগ্ধ হয়ে শাহেদকে দেখে। ইশশ্ ওর কথা ভেবে যদি শাহেদের চোখে এমন আলো ঝিলিক দিতো!!

বিয়ের পরে এই প্রথম শাহেদ আর অরনী একসাথে নেই। শাহেদ দু’দিনের জন্য ঢাকার বাইরে একটা সেমিনারে গিয়েছে; অবশ্য আজ রাতেই চলে আসবে। যাওয়ার দিন অরনীর খুব মন খারাপ লাগছিলো; বলবে না বলবে না করেও বলে ফেললো “আমি না তোমাকে খুব মিস করবো!!”

- তোমার এই মিসিং দিন দিন বাড়লেতো প্রব্লেম। আমার কাজের চাপ কিন্তু দিন দিন বাড়বে।
অরনীর ঠোঁট ফুলে গেছে অভিমানে; চোখে হালকা জলের পর্দা তিরতির করে কাঁপছে।
- প্রব্লেম হবে না। আমি মিস করবো। তুমি তো আর করবে না।
- কিছু কিছু মানুষ আছে যারা মিস ইউ বলার পরে পাল্টা শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, জোরাজুরি করে। তুমিতো দেখি তাদের দলে।

- জোরাজুরি করলাম কই? তুমি বললে প্রব্লেম হবে তাই বললাম...
- কিছু কিছু ব্যাপার বুঝে নিতে হয়, কিছু কিছু জিনিষ বোঝা যায়। সবসময় এতো হুলস্থুল করে বলার দরকার নেই। সবসময় বলা যেমন ভালো না, আবার একদম না বলাও ভালো না। মাঝে মাঝে বলা ভালো। আমি মাঝামাঝির দলে।
- একটু বলেছিতো কি হয়েছে? তোমাকেতো বলতে বলিনি...
- আমিতো শুনতে চাইনি।

অরনীর একটু জেদ চেপে গিয়েছিল “কিন্তু আমি বলতে চেয়েছি।“ মানুষটা কপালে ভাঁজ নিয়ে বাসা থেকে বিদায় নিলো। কেন যে ও এমন করলো? অরনীর মন দু’দিন থেকে বেশ খারাপ।

৩.

তিনতলার এপার্টমেন্টে উঠে কলিং বেল বাজাতেই আয়েশার মা দরজা খুলে দিলো। আয়েশার মা বেশ বয়স্ক আর বিশস্ত; অরনীর শ্বশুরবাড়ীর পুরোনো লোক।

- বউমা সাথে এইটা কে?
- ওর নাম হৃদয়...নামটা সুন্দর না খালা?
- তা বুঝলাম কিন্তু ওরে পাইলেন কই?
- রাস্তায়...রেললাইনের কাছে ফুল বিক্রি করে। আমার কাছে ফুল কেনার টাকা ছিলো না তো তাই বাসায় নিয়ে আসলাম।
- কি যে করেন আপনি? এইসব রাস্তার টোকাইরে কেউ বাসায় আইনা তুলে? ট্যাকা দিয়া শীঘ্রই বিদায় করেন।
- বিদায়ের আগে ওকে ভাত খেতে দেন...কি তরকারী আছে? আমার সাথে খেতে দেন আর কাল রাতের মাংসটাও গরম করে টেবিলে দিয়েন।

আয়েশার মা গরগর করতে করতে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিলো “ছেলের বিয়া টিকলে হয়...আউলা মাথা বউ লইয়া কি সংসার করা যায়? ওই ছেমড়া এদিকে আয়।“ “না খালা...আপনি খাবার রেডি করেন। ও ড্রয়িং রুমে থাক...আমি একটু হৃদয়ের সাথে গল্প করি...”

- আফা...ফুলগুলা কই রাখুম?
- এই সেন্টার টেবিলের ওপরে রাখো...বসো...তোমার গল্প শুনি.....আরে মাটিতে না চেয়ারে বসো...
- না আফা আমার গায়ে অনেক ময়লা...আমি এই কার্পেটে বসতেছি...

- তোমার বাবা মা কোথায়?
- আমার অবুঝ বয়সে মা মারা যাওনের পর বাপ বিয়া করছিলো। সৎ মা ঠিক মতোন খাওন দিত না। পড়তে চাইছি পড়তেও দেয় নাই। বাপ তো আমারে মাইরা ঘর থাইক্যা বার কইরা দিয়া আর খোঁজই নেয় নাই। তাই টোকাই হইছি।
- একা একা থাকো ভয় লাগে না?
- নাহ্ ওই যে আমার সাথে দুইজনরে দ্যাখলেন না...আমরা খুব ভালা ফেরেন্ড...একসাথে থাকি...
- তোমরা সবাই ঢাকার?
- আমার বাসা আছিল খিলক্ষেতে। নরসিংদী থেইক্যা আসছে শাহ আলম। আর ওই সুমন নীলফমারীর।

- ওরা কেন টোকাই হলো?
- অভাবের ঘর আফা। অদের বাপ মা খাওন চাইলে কইতো ঘর থাইক্যা বার হইয়া যা। তাই রাগ কইরা একদিন বাইর হইয়া ট্রেনে উইঠা এইহানে চইল্যা আইছে।
- তোমাদের কোথায় দেখা হলো?
- রেল স্টেশনে দেখা হইছে আফা। আমরা রেললাইনের পাশে রাইতে একসাথে ঘুমাই। দিনের বেলা শুইলে স্টেশনের পুলিশ তাড়া করে। যা মশা আফা...রাতের বেলাও একটু শান্তিতে ঘুমাইতে পারি না...আরো দুনিয়ার পোকা মাকড় গাঁয়ের ওপরে হাইট্যা বেড়ায়। পোকার যন্ত্রণায় ঘুমানো যায় না।

অরনীর মায়া লাগছিলো; এত্তোটুকু একটা ছেলের কি কষ্ট!! একা একা সমস্ত পৃথিবীর মুখোমুখি; এই শিশুবয়সেই রূঢ় বাস্তবতার সাথে কি কঠিন যুদ্ধ! একটু জিজ্ঞাসা করতেই কি খুশী হয়ে গড়গড় করে বলে যাচ্ছে “আফা একেতো শান্তি মতন ঘুমাইতেই পারি না। তার উপরে ঘুমাইলে তো চোর আইসা শার্ট-প্যান্ট খুইলা লইয়া যায় গা, পকেটের টাকা চুরি কইরা লইয়া যায়গা। পকেটে তো ১০ টেকাও রাখন যায়না। স্টেশন ভর্তি চোর। দেহেন না আমার গায়ে শার্ট নাই।“

- খাওয়া দাওয়া কি আনসার ক্যাম্পেই করো?
- ওরাতো আফা খালি একবেলা খাওন দেয়...
- তাহলে অন্যবেলা কোথায় খাও?
- কামাই কইরা কিন্যা খাই আফা। তয় সবদিন হয় না। রেললাইনের পাশে থেইকা বোতল কুড়াই। পচিঁশ টাকা কেজি কইরা বেচি। দুই দিন ধইরা বোতল টোকাইলে এক বস্তা হয়। তহন একশ, একশ বিশ টেকার মত বেচা হয়। মাঝে মাঝে মাইনষের মালও টাইনা দেই। তয় কুলিরা দেখলে মারে। তাই মাল টানার কাজ বেশি করতে পরিনা।

আর আজতো দ্যাখলেনই ফুল বেচতেছিলাম। তয় ফুল সবসময় পাওন যায় না। আশেপাশের বাসা থনে চুরি করি। যখন খিদা লাগে রে আফা দুনিয়া আন্ধার! আমারতো বেলী ফুল গুলারে মালা না গাইথা ভাত মনে কইরা খায়া ফেলতে ইচ্ছা করে।
- বড় হলে কি করবে? তখনতো আর এভাবে চলবে না।

- আমার কিছু হইতে ইচ্ছা করে না। তয় লেখা পড়া করনের ইচ্ছা হয় খুব। এই যে কি সোন্দর সোন্দর সব বই, খবরের কাগজ, সাইন বোর্ড...সব পইড়া ফেলতে ইচ্ছা করে।
- তুমি থাকবে এ বাসায়? আমি পড়া শিখিয়ে দেবো।

বড় বড় চোখের তারায় ব্যঙ্গ কি ঝিলিক দিলো “না আফা খোলা আকাশের তারা না দ্যাখলে ঘুম আসে না। রাস্তায় থাইকা অব্যাস হয়া গেছে, বাসায় বেশীক্ষণ থাকলে দমবন্ধ লাগে। রাস্তায় বড় হইতাছি, রাস্তায়ই থাকতে অইবো। পেটের কষ্ট সহ্য করতে হইবো। কেউ কিচ্ছু দিব না আমগো।“

কি আগ্রহ করে খেলো ছেলেটা...ক্ষুধার্ত মানুষের তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া দেখতেও ভালো লাগে। খেতে বসে আবার কাঁচা মরিচ চেয়ে নিলো “বুজলেন আফা মাঝে মাঝেই শুদাই লবন মরিচ ডইলা ভাত খাইতে খাইতে ঝাল খাওন অব্যাস হয়া গেছে। খালাম্মা আপনার মুরগীর মাংসটা ভালো হইছে তবে একটু লবন কম হইছে...বেশী না সামান্য কম।“ আয়েশার মার রাগী চেহারা দেখে খাওয়ার সময় বিষম খাওয়ার জোগাড় হলো অরনীর।

৪.

অরনী চুপচাপ বিছানায় হাঁটুতে মুখ রেখে বসে আছে। সন্ধ্যা নেমে গেছে, প্রায় সাতটা বাজে। শাহেদের সাথে কথা হয়েছে; আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই বাসায় পৌঁছে যাবে। অরনীর মাথায় হৃদয়ের ওই কথাটা ঘুরছে “আমারতো বেলী ফুল গুলারে মালা না গাইথা ভাত মনে কইরা খায়া ফেলতে ইচ্ছা করে।“

ছেলেটাকে ও দুইশ টাকা আর শাহেদের একটা পুরোনো শার্ট দিয়ে দিলো। পরার পরে দেখতে মজা লাগছিলো; মস্ত লম্বা শার্টের ঝুলে ছেলেটাকে বাউল বাউল দেখাচ্ছিলো। অরনী হৃদয়কে আর থাকতে বলেনি; ছেলেটার কথায় এমন একটা দৃঢ়তা ছিলো যে ও জানতো বলে লাভ নেই। তবে কখনো ইচ্ছে হলে আসতে বলেছে; কিন্তু অরনী জানে ও আর কখনোই আসবে না। আজ হঠাৎই শাহেদের কথাগুলো খুব ঠিক মনে হলো; ওর লেকচারগুলোও খারাপ মনে হলো না; ঝাপসা ভাবে হলেও শাহেদের সমাজ বদলের স্বপ্নটা অরনী বুঝতে পারছে।

বাসায় আসতে আসতে শাহেদ রাস্তা থেকে একটা বেলী ফুলের মালা কিনলো। কি সুন্দর একটা বিষণ্ণ গন্ধ!!! অরনী পছন্দ করে। শাহেদের এ দু’দিন ওর জন্য কেমন জানি খালি খালি লেগেছে, একটু মন খারাপও, বই পড়ার সময় বার বার আনমনা হয়ে গেছে। রাতে ঘুমানোর সময় মনে হয়েছে বুকের কাছটা একটু ঠাণ্ডা লাগছে; কেউ ঘেঁষে এসে ওম দিলে মন্দ হতো না।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে ডিনারের পরে শোবার ঘরে শাহেদ অপেক্ষা করছিলো। অরনী আয়নার সামনে মস্ত এলোখোঁপা খুলতে দাড়াতেই ও জড়িয়ে ধরলো “তোমাকে মিস করেছি আমার বিল্লীটা!!” শাহেদের বুকে নাক ঘষতে ঘষতে আর আদরে গলে যেতে যেতে অরনী বললো “বলতে হবে না...আমি বুঝে নেবো...আমি জেনে গেছি ফুলের চেয়ে শাদা ভাতই বেশী সুন্দর!!!”

© শিখা (১লা জানুয়ারী, ২০১৬)

বিঃ দ্রঃ কবিদের কাছে ঋণখেলাপী হতেই হবে মনে হচ্ছে। গল্পের নাম মহাদেব সাহার কবিতার নামে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৮ ভোর ৬:৫৬
২৬টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×