তীক্ষ ধাতব শব্দ, শীষের মতো। ঘুম ভেঙ্গে বহ্নি প্রথমে বুঝতে পারেনি এই শব্দের উৎস কোথায়। হাত বাড়িয়ে মাথার কাছে রাখা সেল ফোন নিয়ে দেখলো “Flash Flood Warning!!!” শব্দটা বন্ধ করতেই কানে এলো জলের অবিশ্রান্ত বয়ে যাবার শব্দ, জলস্রোতের কুলকুল ধ্বনি। জানালার ব্লাইন্ড খুলতেই কাচের ওপাশে কি বিষণ্ণ একটা দিনের মুখ!!
অঝোর ধারায় বৃষ্টি; Flood Warning তো আসবেই। ক্যালিফোর্নিয়ায় এমন দেশের মতো ঝুম বৃষ্টি কদাচিৎ হয়। দোতলার জানালা দিয়ে Highway 1 এর ওপাশে ভেজা ভেজা গাঢ় সবুজ পাহাড় দেখা যাচ্ছে। এ দেশে এই রাজ্যে বড় হলে ষড়ঋতুর রচনা অন্যভাবে লিখতে হতো। এখানে শীতকাল মোহময়ী সবুজ; বৃষ্টির জল গাছপালা আর মৌন পাহাড়দের গায়ে সবুজ রঙ লেপে দেয়। গ্রীষ্মই বরং রোদে পোড়া রুদ্র সন্ন্যাসিনী; গেরুয়া রঙের বাদামী পাহাড় আর প্রকৃতি।
বৃষ্টির রুপালী ঝরোকার দিকে তাকিয়ে বহ্নির ঠিক বিষন্ন লাগছে না; মন কেমন করছে। কোন কোন দিন মন কেমন করে; বহ্নির মনে হয় কি যেন নেই, কে যেন নেই। অথচ কি যে নেই, কে যে নেই সে কথাটা মন ঠিক জানে না। কেউ আসবে না জেনেও কারো জন্য অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করে। আজ ঠিক তেমন একটা দিন; কারো বা কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা নেই জেনে অস্থির হবার দিন।
আজ রবিবার। মাত্র সকাল সাতটা; সাপ্তাহিক ছুটির দিন; কাজে যাবার তাড়া নেই। প্রতীক্ষাহীন দীর্ঘ একাকী একটা দিন পড়ে আছে। কিন্তু ছেলেবেলার রবিবারগুলো কি আলো ঝলমলে ছিলো!! সারা সপ্তাহের কাজের শেষে একটাই ছুটির দিন। মা আর বহ্নি অন্য সব দিনের মতোই বেশ সকাল সকাল উঠে যেত; অন্যদিন সাতটা আর রবিবারে খুব দেরী হলে আটটা। মা না উঠলে কেন যেন সংসারের চাকা স্থবির হয়ে থাকে। বহ্নিও উঠে যেত; অন্যদিন মা অফিসে যায় আর ও স্কুলে। এই দিনটা ও আর মা নাস্তার টেবিলে একটু বেশী সময় নিয়ে বসে থাকে; মা ধীরে ধীরে চা ঠান্ডা করে খায় আর ও কথার ঝুড়ি খুলে বসে। ওর অকারন উচ্ছাস, ছেলেমানুষী বকবক শুনতে শুনতে মা মৃদু হাসেন; ঠান্ডা চায়ে চুমুক দেন।
নাস্তা শেষে মা রান্নাঘরে তদারকি করতে যান বা আসবাবপত্রের ধুলো ঝাড়েন। বহ্নি মায়ের পেছনে পেছেন ঘুরতে থাকে; কখনো আঁচলের প্রান্ত ধরে থাকে। মা আঁচলে টান পড়লে বলেন “পাগলী একটা…পেছনে পেছনে ঘুরছিস কেন?” বহ্নি কথা না বলে মাকে জড়িয়ে ধরে। “ছাড় বলছি…কাজ আছে তো…” “থাকুক…মা তুমি এতো নরম কেন?” মায়ের গায়ে যে কি সুন্দর গন্ধ!!! বহ্নির ছাড়তে ইচ্ছা করে না। বেড়াল ছানার মতো সারাবেলা পায়ে পায়ে ঘুরতে ইচ্ছা করে। কিন্তু একটু পরেই পড়তে বসতে হয়।
পড়ার টেবিলে বসে আকাশ পাতালে বিচরন; কল্পনার ঘোড়ার লাগাম ছোটানো। আর মনে মনে অপেক্ষা। একটু বেলা হতেই রোদের তেজ বাড়ে; বহ্নির ঘরে আলো ঝলমল দিন আছড়ে পড়ে। ঘরের দেয়াল সমুদ্রনীল আর জানালার পর্দাগুলোও; চারতলার সেই ঘরটাতে কেটেছে বহ্নির পুরোটা কৈশোর আর যৌবনের কিছু সময়। নয়টা থেকে দশটার মধ্যেই ডাক শোনা যায় “বুড়িইইইই...এই বুড়ি...” বহ্নি পাখির ডানায় ভর করে মুহূর্তেই মা বাবার শোবার ঘরে। বাবা বিছানায় চাদর জড়িয়ে আধশোয়া; বাবা হাসতেই ও ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবার ওপরে। একটুক্ষন জড়িয়ে থাকা; বহ্নির এখন অনেক কাজ। বাবা ডান গাল বাড়িয়ে দিলেন; একটা চুমু দিয়ে উঠতে নিতেই বাবা আঙ্গুল দিয়ে বাম গাল দেখালেন। “উহহহ বাবা...উম্মাহ!!!” চুমু দিয়েই দৌড়।
পাশের ঘর থেকে বাবাকে খবরের কাগজ এনে দিলো বহ্নি। আজ রবিবার তাই দুটো খবরের কাগজ; বাংলার সাথে ইংরেজী সংবাদপত্রও আছে। বাবা কাগজ পড়া শুরু করতেই বহ্নি টেপ রেকর্ডারে ক্যাসেট দিলো। প্লে বাটন টিপতেই হেমন্তের ভরাট গলা শান্ত সকালের নৈশব্দ ভাংলো “এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন/ কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ..." “বাবা গান ঠিক আছে...নাকি মান্না দে দেব?” “নারে...একদম ঠিক!! কি ভাবে বুঝলি যে আজ আমার হেমন্তের গান শুনতে ইচ্ছা করছিলো?” “বাবা তুমি গান শোনো...আমি মাকে বলে আসি তোমার জন্য নাস্তা রেডি করতে...আসছি...”
বাবা ঘুম থেকে না উঠলে দিনটা ঠিক রবিবার মনে হয় না; এখন দিনটায় একটা ছুটি ছুটি গন্ধ এসেছে। মাকে নাস্তার কথা বলে এসে বহ্নি বাবার পাশে বিছানায় আসন গেঁড়ে বসলো। এখন বাবার সাথে সাথে উকি মেরে খবরের কাগজ পড়বে ও। তবে এ সময়টা ঝামেলারও। বাবা ইংরেজী কাগজ পড়ার সময় কঠিন সব শব্দের মানে জিজ্ঞাসা করবেন; না পারলে বলবেন ওর নতুন শব্দের খাতা নিয়ে আসতে; সে খাতায় আবার মানে সহ সব শব্দগুলো লিখতে হবে। তারপরেও বহ্নির বাবার সাথে এ সময়টা ঘেষাঘেষি করে বসে থাকতে ভালো লাগে। বাবার গায়ের গন্ধের সাথে সিগারেটের গন্ধ মিশে থাকে। বহ্নি জানে বাবা অনেক সিগারেট খায় বিশেষ করে যে রাতগুলোতে বাবার ঘুম আসে না। শুধু বাবার জন্যই এখনো সিগারেটের গন্ধ বহ্নির কি যে ভালো লাগে!!!
বাবা এ সময়টা বহ্নির সাথে দেশের অবস্থা, সংবাদপত্রের বিভিন্ন খবর নিয়ে খুব মন দিয়ে আলাপ করেন। বহ্নি অনেক কিছুই বোঝে না; না বুঝেই মাথা নাড়ে। আগ্রহে উৎসাহে বাবার চোখ ঝলমল করতে থাকে। বহ্নির এ সময়টা নিজেকে বড় বড় মনে হয়; বাবা কি সুন্দর ওর মতামত নেন আর না বুঝে কথা বললেও রাগেন না, কি আদর করে বুঝিয়ে বলেন। তবে কোন কোন রবিবারে বাবার কথা বলতে ভালো লাগতো না; চুপচাপ চোখ বন্ধ করে গান শুনতেন আর মাঝে মাঝে পছন্দের জায়গাগুলোতে বলতেন “আহা...আহা!!!”
রবিবারে প্রায় সারাদিনই ওদের বাসায় গান বাজতো। যে গানগুলোকে এখন সবাই বলে “পুরোণো দিনের বাংলা গান” তখন সে গানগুলো নতুনই ছিলো। এই গানগুলোর কাছেই বহ্নির ভালোবাসতে শেখার প্রথম পাঠ। মান্না দের আবেগী গলায় “চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি..." শুনে কিশোরী বহ্নি কতো পূর্ণিমা রাতে কাচভাঙ্গা জ্যোৎস্নায় ভেবেছে কোন একদিন কেউ বলবে “কোন জোছনায় বেশি আলো এই দোটানায় পড়েছি।“ উনিশে উথাল পাথাল প্রেমে পড়া বহ্নি মনে মনে বলেছে “পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি..নয়ন মেলে পাবার আশায় অনেক কেঁদেছি/ এই নয়নে পাবো বলেই নয়ন মুদেছি।“ “পথের কাঁটায় পায় রক্ত না ঝরালে কী করে এখানে তুমি আসবে! কফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে?” ঠিক কতখানি ভালোবাসলে এমন তীব্র শ্লেষে তা উচ্চারণ করা যায়?
মাঝে মাঝে বহ্নিকে বাবা আদর করে “বনলতা” ডাকতেন; বাবার প্রিয় কবি জীবনানন্দের সেই “বনলতা সেন।“ “নাম রেখেছি বনলতা যখন দেখেছি/ হয়ত বা সেই ক্ষণেই তোমায় ভালবেসেছি।“ গানটা তো বহ্নির জন্যেই গাওয়া। শ্যামল মিত্রের একটু নীচু খাদের গলায় “যদি কিছু আমারে শুধাও/ কি যে তোমারে কব?/ নীরবে চাহিয়া রব/না বলা কথা বুঝিয়া নাও...” শুনে বহ্নি কতোদিন ভেবেছে ওর মানুষটা কি এমনই চাপা স্বভাবের হবে। অভিমান হলে বহ্নি বলবে “‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না” আর অভিমান ভাংলে সে কি বলবে “সেইতো আবার কাছে এলে/ এতদিন দুরে থেকে বলোনা কি সুখ তুমি পেলে?“
ভালোবাসার মাদকতা তালাত মাহমুদের “রূপের ঐ প্রদীপ জ্বেলে কী হবে তোমার/ কাছে কেউ না এলে আর/ মনের ঐ এত মধু কেন জমেছে/ যদি কেউ না থাকে নেবার...“ না শুনলে কি জানতো বহ্নি? কিশোরের রোমান্টিক গলা “পৃথিবী বদলে গেছে/ যা দেখি নতুন লাগে। তুমি আমি একই আছি/ দুজনে যা ছিলাম আগে“ সুরে সুরে বহ্নিকে বলে দিয়েছিলো ভালোবাসা দুজন মানুষকে সমস্ত পৃথিবী থেকে আলাদা করে দেয়। খুব প্রিয় ছিলো “শুধু একদিন ভালোবাসা মৃত্যু যে তারপর তাও যদি পাই, আমি তাই চাই/ চাইনা বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর ..” বহ্নি অবশ্য তার ভালোবাসার মানুষের কাছে শুনতে চেয়েছে “আমার একদিকে শুধু তুমি পৃথিবী অন্যদিকে/ এদিকে একটি একটি প্রদীপ, সূর্যটা ওদিকে, আমি তোমারই দিকটা নিলাম...” কি বিপুল বিশাল স্পর্ধিত উচ্চারণ!!
আবেগের রঙধনুর রঙ চেনালো তো এই গানগুলোই। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে বহ্নি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলো যে বাস্তবে ভালোবাসা এমনটা নয়, এটা গল্পে কবিতায় গানে সম্ভব, বাস্তবে সম্ভব নয়। অথচ তাও কি পরিমাণ ভালো লাগতো গানগুলো শুনতে! যে এলোমেলো উড়নচণ্ডী বহ্নি জীবনের বাঁকে বাঁকে বহুবার বলেছে “আমি কাঁদলাম বহু হাসলাম এই জীবন জোয়ারে ভাসলাম/ আমি বন্যার কাছে ঘূর্ণির কাছে রাখলাম নিশানা/ ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা...” সেই বহ্নির এখনো গানগুলো ভালো লাগে। এখনো এই গানগুলো বহ্নির মাঝে স্বপ্ন বোনে, যাচিত বিভ্রম আনে, আশ্রয় দেয়, আনন্দ বা আকাঙ্খারা পাখা মেলে...কন্ঠস্বরেরা যে যাদু তৈরী করে...ভালো না লেগে আর উপায় কি?
আশির দশকের শেষে বহ্নিদের বাসায় ভিসিআর এসেছে; তারও অনেক পরে নব্বইয়ের মাঝামাঝি স্যাটেলাইট চ্যানেল। বহ্নি আগে নেপথ্যের কন্ঠগুলোকে চিনেছে; পরে সেই গানগুলোতে ঠোট মেলানো অভিনেতা অভিনেত্রীদের। উত্তম কুমারকে চেনার আগেই ও হেমন্ত বা মান্না দে কে চিনতো; আর সুচিত্রা সেনকে চেনার আগেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বা লতা মুঙ্গেশকার বা আশা ভোশঁলেকে। ওই যে সিনেমাটা যেখানে উত্তম হচ্ছেন আঁকিয়ে; তিনি স্কেচবুকে সুচিত্রার ছবি আঁকতে থাকেন; আর সুচিত্রা সেন ট্রেতে করে চা-নাস্তা নিয়ে বাঁকা কোমর দুলিয়ে হেঁটে আসেন; উত্তমের ঠোঁটে মান্না দে তুমুল গেয়ে ওঠেন “তোমার দেহের ভঙ্গিমাটি যেন বাঁকা সাপ/ পায়ে পায়ে ছড়িয়ে চলো যৌবনেরই ছাপ...”; পুরো রুপালী পর্দায় মান্না দের কন্ঠের যাদু কি তীব্র মাদকতা তৈরী করে!!!
রাফির সাথে ওর পরিচয় সেই ছোটবেলায়; “চাহে কোই মুঝে জংলী কহে...”র জংলী শাম্মি কাপুরের সাথে দেখা হলো অনেক বছর পরে বা “কাশ্মির কি কলি”র শর্মিলা ঠাকুরের সাথে। মুকেশ যে রাজ কাপুরের সব গানে কন্ঠ দেয় সেটা বাবার কাছে অনেক গল্প শুনলেও রাজ কাপুর বা কাপুর পরিবারের মানুষদেরকে বহ্নি রুপালী পর্দায় দেখেছে অনেক বড় হবার পরে।
ছুটির সকালে বহ্নি যে গানই বাজাতো বাবা বলতেন “বুড়ি আজ না এই গানটাই শুনতে ইচ্ছা করছিলো...” বহ্নির যে কি খুশী লাগতো!!! ও ঠিক ঠিক বাবাকে বুঝে ফেলেছে। বোকা ছিল তো; এখন জানে বাবা ভালোবাসতেন বলেই এমনটা বলতেন!! জানালার বাইরে একটু আলো আলো দিন; বহ্নি উঠে সিডি প্লেয়ার চালালো। সেই ছোটবেলার রবিবারের মতো গান বেজে উঠলো “ওগো বর্ষা তুমি ঝরো না গো অমন জোরে…কাছে সে আসবে তবে কেমন করে…”
বহ্নি অপেক্ষা করছে এখন...বাবা বলবে “কি ভাবে জানলি আমার এই গানটাই আজ শুনতে ইচ্ছা করছিলো?” আজ এই মন কেমন করা দিনে বহ্নি ওর বাবার জন্য অপেক্ষা করবে।
© শিখা (৩১শে জানুয়ারী, ২০১৬)
বিঃ দ্রঃ প্রিয় গানগুলো নিয়ে লেখার ইচ্ছা অনেক দিনের। তবে অনেক গানই ইচ্ছা থাকলেও গল্পে আনতে পারিনি বা এখন মনে পড়ছে না। Hopefully this post will make you nostalgic and bring back some memories related to favorite songs.
নিজাম আপনার জন্য এই লেখাটা পোষ্ট করলাম। শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৮ রাত ১০:২৬