ক্লাস থেকে বেরিয়ে মন খারাপ হয়ে গেলো। প্রতিদিন চারটায় ক্লাসে আসি শেষ বিকেলের আলো নিয়ে আর দু’ঘণ্টা পড়িয়ে যখন বাইরে পা দেই তখন চারপাশে অন্ধকারের ঘেরাটোপ। আজ সারাদিন বৃষ্টি; ঝিঝিঁ পোকার ডাকের মতো একঘেয়ে মন খারাপ করা শীতকেলে বৃষ্টি। ক্লাসরুম থেকে অফিস বিল্ডিং অনেক দূরে; বড্ড ক্লান্ত লাগছে। তবে কাগজপত্র আর ল্যাপটপের ভারি ব্যাগ নিয়ে প্রায় জনশুণ্য ক্যাম্পাসে বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোও লাগছে। ক্যালিফোর্নিয়ার এই ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আমি কখনো ছাতা নেই না। এ যেন ঠিক মেঘের ভেতরে দিয়ে হেটে যাওয়া; আলোর মতো জলের গুড়ো ছুয়ে যায়; জলের ভেতরে শরীর না ভিজিয়ে হেঁটে চলা।
ঘন সবুজ ঘাসের মাঝে সিঁথির মতো কংক্রিটের ছাইসাদা পায়ে হাঁটার পথ। একটু নীচু জায়গায় বৃষ্টির জল জমেছে; কাকচক্ষুর মতো এই ফুটপাথের নিজস্ব ছোট্ট পুকুর। আশেপাশে তাকিয়ে একটু লাফ দিলাম সেই জলে; এই মুহূর্তে আমি বেণী দোলানো সেই মেয়েটি যে সেন্ট্রাল রোডের দোতলা বাড়ির ছাদের কোনায় জলে লাফাচ্ছে। বৃষ্টি থেমেছে; জুলাই মাসের ঝুম বৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ভিজেছি আমি আর আমার সারাদিনের খেলার সঙ্গীরা, লিপি, লিজু আর মুন্নি। বাড়ীওয়ালার তিন মেয়ে; সবচেয়ে বড় লিপি আমার এক বছর নীচে পড়ে, আমি ক্লাস ফাইভে।
সিড়িঁ পেরিয়ে ছাদে পা দিলেই ডান পাশে বালুর স্তুপে বেশ কিছু মরচে পড়া রড আড়াআড়ি শুয়ে আছে। আমরা তখন সবেমাত্র বিজ্ঞানে চৌম্বিক ক্ষেত্র আর চুম্বকের গুণাগুণ শিখেছি। একদিন বাবা একটা ঘোড়ার খুরের মতো ছোট্ট চুম্বক নিয়ে এলেন; কি যে উত্তেজনা!! আমরা চারজন সারাদিন এখানে ওখানে সেই খুর লাগিয়ে চৌম্বিক গুণাগুন পরীক্ষা করছি। হাড়ি পাতিল, চামুচ, মগ, বালতি, পানির কল, ড্রয়িং রুমে সাজানো শোপিস, চেয়ালের হাতল, দরজার নব; বাসার সব কিছুতে চুম্বক ঘষার পরে আমাদের আনন্দযাত্রা ছাদে। বালুতে চুম্বক ধরতেই গুঁড়া গুঁড়া লোহার কণা উঠে এলো; উহ্ কি যে আনন্দ!! আনন্দে আর উত্তেজনায় আমরা ঝলমল করছিলাম। সারাদুপুর ছাদে বালু মেখে বাসায় গিয়ে মায়ের বকা খেয়েও মুখ হাসি হাসি; সেদিন রাতে সেই ঘোড়ার খুর জড়িয়ে ধরে ঘুমের দেশে যাত্রা। চাওয়া পাওয়া আর আনন্দগুলো কেন যে বড় হবার সাথে সাথে এতো জটিল হয়ে গেলো!!!
ছাদের মাঝামাঝি হঠাৎই ফুটখানেক উঁচু ইটের দেয়াল; পুরোনো সাদা শ্যাওলা ছাদের মাঝে একটু লাল বাদামীর ছোঁয়া। দেয়াল পেরিয়ে গেলে ছাদের মেঝেতে চার পাঁচটা পানির পাইপ; মাঝে মাঝে এক আধটা ইটের ওপরে পাইপগুলো রাখা আছে ঠিক যেন সার্কাসের তাবুতে টাঙ্গানো ট্রাপিজের দড়ি। ছাদের অন্য প্রান্তে দুটো চারকোনা পানির ট্যাঙ্ক; টিনের মলিন রুপালী ট্যাঙ্ক দুটো ফুটখানেক উঁচুতে ইটের ঘেরের ওপরে বসানো। ডান দিকের পানির টাঙ্কিটার চেহারা একটু রুক্ষ ছিলো; একটু রাগী রাগী, এখানে সেখানে একটু ট্যাপ খাওয়া আর জং ধরা। আমরা চার বালিকারা মনে মনে সেটাকে ছেলে টাঙ্কি আর বাম পাশের টিপটপ চেহারার টাঙ্কিটাকে মেয়ে ভেবে নিয়েছিলাম। মেয়েরা খুব ছোট বেলাতেই সংসার বুঝে যায়। সোঁদা গন্ধ ভরা সেই পুরোনো ছাদের শ্যাওলা পড়া কোনায় আমাদের কল্পনায় দুই পানির টাঙ্কি খোলা আকাশের নীচে সংসার পেতে বসেছিলো।
অল্প বৃষ্টি হলেই মেয়ে টাঙ্কির পাশে একটু নীচু সামান্য ঢালু জায়গায় পানি জমতো; আমাদের লাফানোর জায়গা। ছাদের এই কোনাটা সবসময় ছায়াময় রহস্যঘেরা; একটা মস্ত বড় গাছের সবুজ ডাল মুখ বাড়িয়ে তার পাতার ছায়া মেলেছে। ভরা রোদেও ঠান্ডা ঠান্ডা আলো আঁধার ঘেরা এই জায়গাটা বড্ড পিছল আর শ্যাওলা পড়া ছিলো। বাবা মা অনেকবার পড়ার ভয়ে সাবধান করেছে বলেই হয়তো ওই শ্যাওলা মাখা জায়গা আমাদের খুব পছন্দের ছিলো। নিষিদ্ধ সব কিছুই কি খুব নিজস্ব, গোপন সব কিছুই কি এখনো সেই বালিকাবেলার মতো কাম্য নয়?
সেদিনও ভেজা ফ্রক গায়ে আমরা সারা ছাদে খালি পায়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছি; অকারণ কোলাহল; অর্থহীন আনন্দ। বৃষ্টি শেষে মুখ ভার করা আকাশের নীচে আমরা চারজন আসলেই বলাকার মতো বন্ধনহীন আনন্দের ডানায় উড়ছি। হঠাৎই ছাদে দুষ্ট উপগ্রহের আবির্ভাব; আমার তিন বন্ধুর বড় ভাই লিটন, আমার চেয়ে দু’বছরের বড়। আমাদের খুবই অপছন্দ তার; এসেই সবসময় বোনদের প্রবল বকা দিয়ে খেলার আনন্দ নষ্ট; মাঝে মাঝে চুল টানা বা কিল চড় দিয়ে ওদের কাঁদিয়ে হাওয়া। আমার সাথে সে কখনো কথা বলেনি; বলবে সে আশাও নেই। দশ বছরের আমি বুঝে গেছি যে ছেলেরা মোটেও ভালো নয়; একটা দুটো নমুনা দেখে মনে মনে ছেলেদের বন্ধু হবো না ঠিক করে ফেলেছি। কি আশ্চর্য!! জীবনের স্রোতে সবসময় উল্টো সাঁতার কাটা হলো; বড় হতে হতে আর এখনো আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুগুলোই যে ছেলে!!
সেই কফি রঙ্গা ভেজা ভেজা মেঘলা দুপুরে অবশ্য সে আমাদেরকে বকেনি; কে জানে বর্ষার মেঘ হয়তো তার মনেও ছায়া ফেলেছিলো! লিটনও আমাদের সাথে খেলায় যোগ দিলো। লাইন করে বৃত্তাকারে সারা ছাদে আমরা দৌড়ে বেড়াচ্ছিলাম; আমার সামনে লিপি আর পেছনে সে। হঠাৎ সেই ছায়া ছায়া কোনায় শ্যাওলায় পা পিছলালো; খুব ভয় পাইনি; পড়ে পড়ে অভ্যাস ছিলো। কিন্তু পড়ার আগেই সে পেছন থেকে ধরে ফেললো; তার দু’হাত আমার কোমরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি দুটো উদ্বিগ্ন চোখ; ছাইরঙ্গা আকাশ আর সবুজ পাতা ছায়া ফেলেছে সেই চোখে। মেঘের ফাঁকফোকর গলে চুরি করে আসা সূর্যের আলো চোখে পড়েছে; ঠিক যেন সবুজ ছাই রেখাটানা ঝকঝকে মার্বেল।
সেই চোখ দুটোয় দুটো মার্বেল ছিল, ছোটবেলার খেলার মাঠে পড়ে থাকা দুটো ঝকঝকে মার্বেল। সেই চোখে কামনা ছিলো না, যেমনটা থাকে চেনা প্রেমিকের চোখে, অজানা পুরুষের দৃষ্টিতে। সেই মার্বেল চোখে আমি প্রথম বারের মতো নির্ভরতা দেখেছিলাম; প্রথমবারের মত মনে হয়েছিলো কারো ওপরে নির্ভর করতে পারলে বেশ হতো; কোন একটা মানুষ যার চোখ দুটো এভাবে বলবে “ভয় নেই...তুমি এলোমেলো দৌড়ে বেড়াও। পিছলালে ঠিক ঠিক ধরবো...আমি আছিতো!”
সারা জীবন সেই আমি সেই মার্বেল চোখ খুঁজে বেড়িয়েছি। যখন বয়ঃসন্ধিতে এক সাথে বেড়ে ওঠা বন্ধু হঠাৎ অবাক করে জড়িয়ে ধরেছিলো, আমি ওর চোখে সেই মার্বেল খুজেছিলাম। বাগানবিলাস ঘেরা বারান্দাতে বেতের অর্ধ চন্দ্রাকৃতি দোলনায় দোলার সময়ে মাত্র উনিশে পা দেয়া আমার পুরো পৃথিবীকে যখন কেউ দুলিয়ে দিয়েছিলো, আমি তার চোখে মার্বেল খুজেছিলাম। আমার মানুষটাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, সেই অস্বস্তিকর ভালোলাগার সময়গুলোতে তার চোখে আমি সেই মার্বেল খুজেছিলাম।
আমার মানুষটা যখনি আমার দিকে তাকায় শৈশবের সেই বর্ষার উতল হাওয়া ছুঁয়ে যায় আমাকে; তার মুগ্ধ চোখে শৈশবের সেই বৃষ্টিভেজা ছাদের মার্বেল দুটো থেকে আলো ছিটকে এসে পড়ে। আর হঠাৎ চমকে উঠে ভাবি “ছেলেটি কি সেই ছেলে?” আমার মানুষটাই সেই মার্বেল চোখের ছেলেটি; সে চোখে চোখ রাখলেই হুড়মুড়িয়ে চলে আসে আমার কৈশোর, আমার ছেলেবেলার স্বপ্ন। হাতের তালুতে সে প্রতিদিন এনে দেয় ঘুরন্ত লাটিম; যতক্ষণ লাটিম ঘুরে মনে হয় পুরো জগত আমার হাতের মুঠোয় ঠিক সেই ছোট্টবেলার মতো।
© শিখা (৩রা ডিসেম্বর, ২০১৫)
বিঃ দ্রঃ লেখাটা অনেক আগে প্রায় দু'বছর আগে ব্লগে পোষ্ট করেছিলাম। মুছে ফেলেছিলাম। শ্রদ্ধেয় ব্লগার খায়রুল আহসান ইদানিং এক মন্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন যে গল্পটা ওনার খুব ভালো লেগেছিলো। ওনার জন্যই লেখাটা আবার পোষ্ট করলাম। আগে পড়ে থাকলেও আবার না হয় পড়লেনই।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৮ রাত ৩:১৩