somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শিখা রহমান
কবিতা প্রেমী; একটু এলোমেলো; উড়নচণ্ডী; আর বই ভালবাসি। শব্দ নিয়ে খেলা আমার বড্ড প্রিয়। গল্প-কবিতা-মুক্ত গদ্য সব লিখতেই ভালো লাগে। "কেননা লেখার চেয়ে ভালো ফক্কিকারি কিছু জানা নেই আর।"

স্মৃতিরা বড় উচ্ছৃঙ্খল

২৬ শে মে, ২০১৮ সকাল ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঝিমানো দুপুরবেলা; চারিদিক কেন যেন চুপচাপ হয়ে যায়; Highway 1 এ গাড়ি গুলোও যেন মনে হয় আস্তে আস্তে যাচ্ছে। সকালের কর্মচাঞ্চল্য হঠাৎই গতি হারায়। সকাল থেকে দুই বেনী ঝুলানো প্রকৃতি নামের যে দামাল মেয়েটা সারা পাড়া দাপিয়ে বেড়িয়েছে; এখন সে ক্লান্ত, মায়ের বকা খেয়ে টিপটপ হয়ে এখন সে ঘুম পাড়ানী সুরে পড়া মুখস্ত করছে। অফিস থেকে বেরিয়ে ষ্টেডিয়ামের কাছে বামে মোড় নিতেই California Boulevard এ উঠে গেলাম। California Boulevard আমাদের শহরের সবচেয়ে নয়নাভিরাম রাস্তা। দুপাশে সারি দিয়ে পাম (Palm) ট্রি। একটু আঁকাবাঁকা এই রাস্তা রেললাইনকে ডানপাশে রেখে সোজা চলে গেছে হাইস্কুল পর্যন্ত; রোদের ঝাঁঝালো গন্ধ ভরপুর এই মধ্য দুপুরে আমার গন্তব্য সেই হাইস্কুল; ছেলেকে তুলতে হবে।

পাম ট্রি বেশ সুন্দর; এরা পাতা গুলোকে ছেঁটে লম্বা কান্ডের মাথায় তুলে রাখে; ঠিক যেন ঝাঁকড়া চুলের টলমলে দামাল ছেলে। তবে ঝিমধরা দুপুরবেলা নারিকেল গাছ ছাড়া অসম্পূর্ণ; প্রখর রোদে পুকুরের টলটলে জলে ছায়া ফেলা, টিনের চালে শীতল মায়া তৈরী করা, ঝাঁ ঝাঁ রোদে চোখে সবুজ ছায়া ফেলা নারিকেল গাছ। সেন্ট্রাল রোডের নারিকেল গাছ ঘেরা ছায়াময় দোতলা বাড়িটার ওপরের তলায় আমরা ভাড়া থাকতাম। দুপুরবেলা মা বাবা অফিস ফিরে খেয়ে দেয়ে পাশের বেডরুমে একটু শুতেই পা টিপে টিপে আমি পালাতাম। নীচতলায় বাড়িওয়ালার তিনটা মেয়ে ছিলো আমার খেলার সঙ্গী। খুব শান্ত লিপি সবচেয়ে বড়, মাঝে ঝগড়াটি লিজু, আর আল্লাদী ছোটটা মুন্নি। লিপি আমার এক ক্লাস নীচে পড়তো।

বাসার সামনে লোহার গেট পেরিয়ে ঢুকলে বেশ খানিকটা ঘাসের গালিচা; এক পাশে মস্ত কাঠাঁল গাছ নুয়ে পড়েছে; অন্যপাশে কাগজি লেবুর গাছ। কাগজি লেবুর গন্ধমাখা কোনায় পানির কল, আর একটু জায়গা পাকা করে দেয়া হাড়ি বাসন ধোয়ার জন্য। সীমানা বেঁধে দেয়া সাদা রঙয়ের পলেস্তেরা ওঠা দেয়ালের এখানে ওখানে সিঁদুর রঙ্গা ইটের হাসি। পুরোনো দোতলা বিল্ডিং দুপাশে দেয়ালের গায়ে নিঃশ্বাস ফেলছে; মাত্র দেড় কি দু’হাতের তফাত।

তিনটা নারিকেল গাছ বাড়ির পেছনের দেয়াল ঘেঁষে। একটু ছায়া ঘেরা রহস্যময় এই কোণটা আমাদের একান্তই নিজস্ব; ঝিম ধরা দুপুরে কল্পনার ঘোড়া ছোটানোর জায়গা। আমরা চার বালিকা নির্জন ঘুম ঘুম পড়ন্ত দুপুরে এই জায়গায় বসে বসে খেলতাম; ইটের ভাঙ্গা টুকরো ঘষে ঘষে দেয়ালে বা পাকা মেঝেতে ছবি আঁকা ছিল আমাদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা। মাঝে মাঝে দুষ্টুমি পেয়ে বসতো আমাদের; কড়কড়ে রোদ মাথায় ছাদে উঠে যেতাম আমরা; ইটের টুকরো ছুড়ে মারতাম বাসার বাম পাশের বাড়ির টিনের চালে; ছুঁড়েই দ্রুত কার্নিশের নীচে বসে যেতাম। বিকট শব্দে দুপুরের নির্জনতা ভাঙ্গতো; আর ভাঙ্গতো দুপুরে ভাত ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসা ওই বাসার মানুষগুলোর আরাম।

একটু বেলা বাড়লে, আসরের আজানের পরে আমরা কানামাছি, এক্কা দোক্কা, এলাটিং বেলাটিং বা ছোঁয়াছুয়ি খেলতাম। কোন কোন দিন দেয়াল টপকে ওপাশের খোলা মাঠে চলে যেতাম আমরা। মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলতো বিকেলে, আমরা ইচ্ছেমত এ মাথা ও মাথা উদ্দেশ্যহীন দৌড়াতাম ঠিক ডানা মেলা প্রজাপতির মতো। বন্ধনহীন চিন্তাশুন্য হারিয়ে যাওয়া আমার ছেলেবেলা। যে জীবন তখনো জানিনি; সেই অযাপিত অনাবিস্কৃত জীবনকে না জানার আনন্দে আকাঙ্ক্ষারা কি সহজেই ডানা মেলতো আকাশের অভ্রে আর আবীরে!!!

নারিকেল গাছের ছায়াবীথি ছুঁয়ে আমার ঘর। সবুজ দেয়াল; আমার শোবার ঘরে বিছনার দুপাশের দেয়ালে জানালা। বামপাশের জানালা দিয়ে উকি দিলে টিনের চালে রুপালী ঢেউ; আর মাথার কাছে জানালা দিয়ে নারিকেল গাছের চিরল চিরল পাতা ঘরের মধ্যে ছায়াবাজির খেলা খেলছে; দুপুরের হলুদ রোদ কেটে কেটে সারা ঘরে আলোর বরফি। ক্লাস ফোরে পড়ার সময়ে আমার জন্ডিস হলো; স্কুল বাদ দিয়ে প্রায় দুই মাস বাসায়। প্রথম দিকের স্কুল ফাঁকির আনন্দ ফিকে হয়ে এলো খুব দ্রুত; সারাদিন বিশ্রাম; বিছানাতে শুয়ে বসে থাকা; তার ওপরে দিন রাত গ্লুকোজ পানি আর ডাবের জল। সারাদিন খুব একা লাগে; গল্পের বই পড়ে সময় কাটে, একাকীত্ব কাটে না।

বাবা মা অফিসে; আমি একমাত্র মেয়ে। মাঝে মাঝে ওরা তিন বোন আমাকে স্কুলের পরে দেখতে আসে। দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকে; ছোঁয়াচে রোগ। ওদের মলিন মুখ দেখে আমারো মন খারাপ হয়ে যায়। তখনো আমরা “মিস করি” বলতে শিখিনি। দুপুরে জেগে থাকলে বিছানায় বসে বসে নারিকেলের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ওদেরকে খেলতে দেখতাম। শরীরটাকে ঘরে রেখে মনটা চলে যেত নারিকেল গাছের ছায়ায়; বিকেল এলে দুরের মাঠে কলকাকলী কান পেতে শুনতাম আর তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে দৌড়াতাম।

প্রায় একমাস হয়ে গেল। একদিন বিকেলে এত্তো মন খারাপ লাগছে। বন্দিনী কেশবতী রাজকন্যার মতো লম্বা চুল থাকলে জানালা দিয়ে বিনুনী ঝুলিয়ে দিতাম; আর চুল বেয়ে চুপিচুপি খেলার সাথীরা সবার অগোচরে এসে আমার সাথে খেলত। তখনো বাঁকা দুনয়নে নেশা লাগেনি; আমার বন্ধুরা যে কোন রাজপুত্রের চেয়ে বেশী কাঙ্খিত ছিলো। চোখ ছলো ছলো দেখে বাবা বললেন “কিরে বুড়ি, ছাদে যাবি?” উহহ্ কত্তোদিন আকাশ দেখিনি; তপ্ত বাতাস আমার গাল ছুয়ে শীতল হয়নি; ঝমঝমে রোদে চোখ বন্ধ হয়ে আসেনি। আমার মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হতেই বাবা চিন্তিত “সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠবি কি ভাবে? শরীর যে দুর্বল!!!” দপ করে নিভে যাওয়া মুখ দেখে বাবা বললেন “চিন্তা করিস না। আমি কোলে করে নিয়ে যাব।“

বাসার দরজা পর্যন্ত হেঁটে গেলাম বাবার হাত ধরে। মনে হচ্ছিল বিরাট কোন এডভেঞ্চারে যাচ্ছি বাবার সাথে, চাঁদের পাহাড় বা আরন্যক। সিড়ির গোঁড়া থেকে বাবা কোলে নিলেন; একটু লজ্জা লাগছিলো, অনেক দিন কোলে উঠি না; কিন্তু আকাশ দেখার কাছে সব তুচ্ছ। মধ্য তিরিশ পেরোনো যুবক বাবা আমাকে নিয়ে ওপরে উঠতে একটু হাপিয়ে গেলেন; তার দ্রুত নিঃশ্বাস আর হাপরের মতো বুকের ওঠানামা বলে দিচ্ছিল সে কথা। সিড়ির শেষে বাবা একটু টালমাটাল হতেই আমি দু হাতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরেছিলাম; ভীষন ভয় পেয়েছিলাম পড়ে যাই যদি। বাবা কি পরম মমতায় বলেছিলেন “আমি কক্ষনো তোকে পড়ে যেতে দেব না রে মা!!!” ছাদে ওঠার পরেও আমি বাবার গলা ছাড়িনি; বাবা কষ্ট হলেও পুরোটা সময় আমাকে কোলে নিয়ে ছিলেন।

দুপুর আমার এজন্যই ভালো লাগে না, নির্জন দুপুর সব হারিয়ে যাওয়া সময়কে নিয়ে আসে। ভরা দুপুরের প্রখর রোদে মরুভূমিতে মরিচীকার মতোই পুরোনো সুখস্মৃতিদের সত্যি মনে হয়। কি জানি যাদু মন্ত্র বলে এই সময়ে সব হারিয়ে ফেলা মানুষগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। আজ এই মধ্য দুপুরের রোদের ঝাঁঝালো গন্ধ ভরা তপ্ত হাওয়া আমার বাবাকে উড়িয়ে নিয়ে এলো।

বাবা, আমি তখন পড়ে যাইনি, ছোট্ট কলা বেনী করা মেয়েটাকে তুমি কি মমতায় ধরে রেখেছিলে। এখন আমি বড় হয়ে গেছি; মধ্য বয়সিনী সংসারী সুখী রমনী; তাই কি তুমি আর আমার হাত ধরে নেই? কিন্তু বাবা তোমার রাজকন্যা যে তোমাকে ছাড়া বার বার হোঁচট খাচ্ছে। তুমি কথা রাখোনি, তুমি তোমার দেয়া কথা রাখোনি, তুমি বলেছিলে আমাকে কক্ষনো পড়ে যেতে দেবে না, কক্ষনো না!!! বাবা আর স্বপ্নে তোমার হাত ধরতে ভালো লাগে না; একবার এই ঘুমঘুম দুপুরে এই সুন্দরী পাম ট্রির নীচে এসে আমার আঙ্গুল ধরো না!!!

© শিখা (১১ই নভেম্বর, ২০১৫)

বিঃদ্রঃ আজকের দিনে বাবা চলে গেছেন। বাবাকে ঠিক চার বছর হলো দেখি না। ভালো থেকো বাবা। অনেক অনেক ভালো।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৮ সকাল ১১:২৪
২৪টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×