১.
“শুধু বাবু ভালোবাসে? বাবুর বাবা ভালোবাসে না?” রঞ্জনের ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। কি যে সব কথাবার্তা!! অরনী ওর চোখ এড়িয়ে টেবিলের ওপাশে জানালায় চোখ রাখলো। জুলাই মাসের পড়ন্ত দুপুর; এখন প্রায় তিনটা বাজে। বাইরে ঝকঝকে রোদের দিকে তাকালে ঘুমঘুম লাগে। ঢাকা গত পাঁচ বছরে খুব বদলে গেছে; নতুন সব আকাশচুম্বী অট্টালিকা; নতুন সব দোকান; আর চেনা মানুষগুলোও কেমন অচেনা।
ধানমন্ডির এই বহুতল শপিং কমপ্লেক্সের চারতলায় ফাস্টফুডের রেস্টুরেন্টে ওরাই মনে হচ্ছে সবচেয়ে বয়স্ক যুগল। আশেপাশে একগাদা স্কুলড্রেস পরা ছেলেমেয়ে হৈ চৈ করে খাচ্ছে।
- মেয়ের নাম কি রেখেছিস?
“নিঝুম...” বলেই একটু লজ্জা পেলো অরনী; একটু বিষন্ন।
- তোর মনে আছে?
ও আর রঞ্জন ঠিক করেছিলো মেয়ে হলে নাম রাখবে “নিঝুম” আর ছেলে হলে “নীল”। অরণী আবারো জানালার বাইরে ধানমন্ডি লেকের ছায়াছায়া শ্যাওলা রঙ্গা একটু রোদে ঝিলিক দেয়া জলে চোখ রাখলো। ও জানে রঞ্জন এখন গাঢ় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে; ওই চোখে চোখ রাখার সাহস ওর নেই; সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে।
“অরু!!!” ডাক শুনে ওর ভেতরে কেঁপে উঠলো। “তুই না আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছিস!!” অরনী এতোক্ষন পরে রঞ্জনের দিকে ভালো করে তাকালো; চোখের নীচে কালি পড়েছে; উড়ু উড়ু স্বপ্নীল চোখ ক্লান্ত; দীর্ঘ পল্লব গালের হনুতে ছায়া ফেলেছে; যথারীতি শেভ না করা নীলচে খোঁচা খোঁচা দাড়ি; ধারালো চিবুক আর সেই অদ্ভুত সুন্দর পাতলা ঠোঁটজোড়া। ওজন অনেক কমে গেছে; কেমন দুঃখী আর অসুস্থ দেখাচ্ছে ওকে।
- তোর শরীর এত্তো খারাপ হয়ে গেছে কেনো?
- সুন্দরী!!! তুই যে উড়াল দিয়ে আমেরিকা চলে গেলি...আমার যত্ন কে নেবে?
আবারো ফাজলামি!!! রঞ্জনের সাথে কথা বলাই ঝামেলা। “স্যার...ম্যাডাম...আপনাদের অর্ডার?” ওয়েটার আসাতে রক্ষা...না হলে রঞ্জুর মুখ যা খারাপ!! “ঝাল ফ্রাইড চিকেন দেন আমাকে আর ম্যাডামকে চিকেন শর্মা। কিরে এখনো শর্মা পছন্দ করিস তো?” অরনী হাসিমুখে মাথা নাড়ালো।
- স্যার এনি ড্রিঙ্কস?
- হুউউ...আমাকে কড়া মিষ্টি করে এককাপ দুধ চা আর ওকে লস্যি।
রঞ্জন কি তাহলে এখনও!!! না থাক...পরে জিজ্ঞেস করবে।
২.
ফোনের ওপাশে রঞ্জুর জড়ানো গলা “অরু...আমার জন্য একটু খাবার কিনে নিয়ে আয় না...”
- একটু পরেই ল্যাব আছে তো...
- একটা ল্যাব না করলে কি হবে? প্লিজ প্লিজ নিয়ে আয় না...খিদায় মরে যাচ্ছি যে...আমার লক্ষী অরু মনি!!!
এভাবে বললে কেউ মানা করতে পারে? দুপুরের ল্যাব বাদ দিয়ে অরনী খাবার কিনে রওনা হলো। ভার্সিটি থেকে ধানমন্ডি বেশী দূর না; রঞ্জু কয়েক দিন হলো হল ছেড়ে ওর মামার বাসায়। মামার সাথে ট্যুরে মামী প্রায়ই ঢাকার বাইরে বেড়াতে যান; রঞ্জন তখন বাসার পাহারাদার।
কলিংবেল বাজাতেই রফিক দরজা খুলে দিলো “আফা...ভালা আছেন?” ওকে এ বাসার সবাই বেশ ভালো ভাবেই চেনে। রঞ্জনের সাথে ওর প্রায় তিন বছরের সম্পর্ক; দু’জনে একই ডিপার্টমেন্টে সহপাঠী। একসাথে শুরু করলেও রঞ্জু এক বছর পিছিয়ে গেছে; অরনীর এটাই শেষ টার্ম।
শোবার ঘরে ঢুকতেই “অরু এলি? ঝাল চিকেন এনেছিস তো?” বিছানায় এলোমেলো চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছে রঞ্জন। বক্স খুলে গপাগপ খাওয়া শুরু করলো; সারাদিন শেষে রাস্তার ধারে রিক্সাওয়ালারা যেমন প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে খায় তেমনটা।
- জানিস কাল রাতের পরে আর খাইনি...
- জানি...অন্য জিনিষ খেয়েছিস নিশচয়ই...
- হুউউ...কালকের জিনিষটা ভালো ছিলো রে!! খুবই ভালো কোয়ালিটির গাঁজা। আগে বুঝলে আর সাথে ডাইল খেতাম না। একদম আউট হয়ে গেলাম!!! একটু আগে ঘুম ভাংতেই কি যে খিদা...মরে যাচ্ছিলাম...তুই প্রান বাঁচালি...
অরনী রাগ হতে যেয়েও কিছু বললো না; লাভ নেই; অনেক বলেছে। ও খুব চুপচাপ মেয়ে; কেউ ভাবেনি ও রঞ্জনের মতো এলোমেলো দুরন্ত একটা ছেলের প্রেমে পড়বে। যখন রঞ্জু নেশা শুরু করলো সবাই বলেছিলো সরে আসতে। কিন্তু অরনী যে নেশার সাথে বাজি ধরেছিলো। দু’বছর হয়ে গেলো; ও কি হেরে যাচ্ছে?
অরনীর মা বাবা ইতিমধ্যেই বিয়ের কথা বলছেন।
- রঞ্জু!! বাবা মা না আমেরিকায় থাকা এক ইঞ্জিনীয়ার পাত্রকে মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছেন।
- ভালো তো বিয়ে করে ফেল...আমেরিকা থেকে মাঝে মাঝে ডলার পাঠাস।
কথা শেষ হতে না হতেই রঞ্জুর শরীর কাঁপা শুরু করলো। আগে ও শুধু গাঁজা খেতো; খেতে খেতে আর নেশা ধরে না; তখন শুরু হলো গাঁজার সাথে ডাইল। হাত পা কাঁপা, খিঁচুনি এইসব ডাইলের কারনে। অরনী মেঝেতে রাখা রঞ্জুর ব্যাকপ্যাক থেকে ফেন্সিডিলের বোতল বের করে ওর হাতে দিতেই পুরো বোতল একটানে শেষ। ও বিছানার পাশের টেবিল থেকে রঞ্জুকে চকলেট দিলো; রান্নাঘর থেকে বেশী চিনি দিয়ে দুধ চা বানিয়ে নিয়ে এলো। ও শিখে গেছে; ডাইলের পরে কড়া মিষ্টি খেলে নেশা জমে ভালো।
“কাঁদছিস কেনো অরু মনি?” বিছানার পাশে বসে থাকা অরনীর চোখ থেকে চাদরের ওপরে নিঃশব্দ জলের ফোঁটা। রঞ্জন ওকে একহাতে টানতেই অরনী পাখির ছানার মতো ওর বুকের মাঝে গুটিসুটি; কান্না ভিজিয়ে দিতে লাগলো রঞ্জুর বুক। অরনী হেরে গেছে; ওর ভালোবাসা নেশার কাছে হেরে গেছে।
- আহ্হা...কাদঁছিস কেনো খামোখা? আমার নেশাটা নষ্ট করবি না তো!!!
নাহ্...অরনী রঞ্জুর দামী নেশা নষ্ট করবে না। ও কান্না গিলে মিথ্যে বললো “এখানে আসার সময় আমার সাথে না রিক্সাওয়ালা খুব খারাপ ব্যবহার করেছে...তাই!!”
- আমাকে ডাকলি না কেনো?
রঞ্জন দু’হাতে ওর কান্না ভেজা মুখ তুলে ঠোঁটে চুমু খেলো “আজ তো তোকে রাজকন্যার মতো লাগছে!!! আমার রাজকন্যা...তোর সাথে যদি কক্ষণো কেউ খারাপ ব্যবহার করে আমাকে বলবি...আমি বকে দেবো!!! কাঁদে না সোনা...”
অরনীর এত্তো কষ্টের মাঝেও হাসি পেলো; রঞ্জু না এটা রঞ্জুর নেশা কথা বলছে; অরনীর দরকারের সময় ওকে বুঝি কখনো পাওয়া যায়!!!
৩.
- রঞ্জু!! তুই এখন কোথায় কাজ করছিস?
রঞ্জন ওর দু’বছর পরে পাশ করে বেরিয়েছে; আমেরিকায় থাকলেও অরনী বন্ধুদের কাছে থেকে টুকটাক খবর পায়।
- মামার ফার্মে আছি। অন্য কোথাও আমার পোষাবে না রে...বেশী কাজ করতে ভালো লাগে না।
- চল উঠি...খাওয়ানোর জন্য থ্যাঙ্কস!!
- তুই তো আমাকে সারা জীবন খাইয়েছিস...আজ একবার না হয় আমি খাওয়ালামই...
বাইরে বেরুতেই রোদের ঝলক; গরম হাওয়ার ধাক্কা। রিক্সা খুঁজতে খুঁজতে কিছুটা পথ চুপচাপ হাঁটা; অরনী ভাবছিলো রিক্সা না পেলেই ভালো, অনেকদিন পরে পাশাপাশি হাঁটা চলুক না আরো কিছুক্ষণ। রিক্সা ঠিক করে দিয়ে রঞ্জন বললো “অরু...আমাকে একশ ডলার দেতো!!! তোর কাছে ডলার আছে না?”
- তোকে তো কিচ্ছু গিফট দেইনি...এই নে তোর জন্য দুইশ ডলার।
- কিন্তু রঞ্জু!! তুই কি এখনো??
- নেশা পাল্টেছি রে...বড়লোকি নেশা ধরেছি...হেরোইন!!
অরনীর ব্যথিত মুখের দিকে তাকিয়ে ও বললো “নেশার ব্যাপার তুই বুঝবি না...চাইলেই ছাড়া যায় না!!!”
রঞ্জন চলে যাচ্ছে; ও কখনো পেছন ফিরে তাকায় না। অনেক আগে অরণীর দেয়া ছাই রঙ্গা পাঞ্জাবী পড়েছে; রঞ্জনকে মনে হচ্ছে একখন্ড ঝোড়োয়া মেঘ।
অরনী ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ফিসফিস করে বললো “বুঝবো না কেন রঞ্জু? নেশা তো আমিও করি...ভালোবাসার নেশা!!!”
© শিখা (৯ই নভেম্বর, ২০১৫)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৮ রাত ১:৫৮