“মা!! জানো কি হয়েছে?” বড় ছেলে বাসায় এসে ব্যকপ্যাক নামাতে নামাতে একথা বলতেই চমকে তাকালাম। অনেকদিন হয়ে গেলো ছেলেটা এমনভাবে বলে না। ছোটাটা এখনো স্কুল থেকে তোলার সময়ে গাড়ীতে উঠেই বলে “Guess what happened today Mamma?” আরেকটু বড় হলেই কথার এই ফুলঝুরি বন্ধ হয়ে যাবে জানি; নিজস্ব জগত তৈরী হবে। সেই জগতের সীমারেখা বেঁধে দেয়া; বুঝে পা ফেলতে হবে যেন তার সেই গোপন জগতে অনধিকার প্রবেশ না হয়।
“আজ যখন লাইব্রেরীর কাছে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে আসছিলাম তখন একটা শাদা ছেলে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে ইচ্ছে করে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো। পাত্তা না দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু সে ঘুরে দাড়ালো…আমাকে বললো ‘ধাক্কা দিলে কেন?’ আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম ‘আমি নয়...তুমি ধাক্কা দিয়েছো...’”
এতোদূর শোনার পরে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছে। বড়ছেলে খুব চুপচাপ, অন্তর্মুখী মানুষ; কিন্তু যখন রাগে তখন খুব রেগে যায় আর বড্ড জেদী। “তুই কি করলি? মারামারি করিসনি তো?” “নাহ!! সে তাকিয়ে ছিলো...তার চোখে চোখ রেখে আমিও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ...” “তারপরে?” আমার উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে ও হেসে দিলো “মাআআআ!!! ছেলেটা মারামারি বাধানোর জন্য মুখিয়ে ছিলো...তার হাতের আঙ্গুল মুঠো করা...চোখ নামিয়ে একটুপরে হেসেছি...বলেছি ‘No big deal..it’s alright!!’ আর তারপরে বাসে উঠে বাসায়। আমি তাকে দেখিয়ে দিয়েছি যে মানুষ হিসেবে আমি তার চেয়ে ভালো…এভাবেইতো মানুষের ধারনা বদলাতে হয়…মারামারি করে নয়!!”
চেপে রাখা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম “I am so sorry Baba!!” “ঠিক আছে...I am used to it!!” “used to it” শুনে মনে পড়ে গেলো যখন ওর বয়স বছর দুয়েক আমেরিকায় কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী প্রেগন্যান্ট শুনে অভিনন্দন জানাতে ফোন করেছিলাম। কুশলাদি জিজ্ঞাসা করার পরে এক পর্যায়ে সে বললো “শিখা...দোয়া কোরো যেন আমার বাচ্চাটা তোমার ছেলের মতো কালো না হয়!!” আমি খুব সহজে কাঁদি না আর কাঁদলেও কারো সামনে নয়। কিন্তু সেদিন তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিয়ে খুব কেঁদেছিলাম। আমার মানুষটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো।
বড় ছেলের জন্মের পর থেকেই শুনে আসছি “তোমরা দু’জনেতো এতো কালো নও ছেলেটা এমন রং পেলো কোথা থেকে?” যারা অরেকটু অনুসন্ধানী তাদের চিন্তার কম্পাস ঘুরেফিরে আমার মায়ের দিকে স্থির হতো “নানীর থেকে গায়ের রং পেয়েছে...” প্রচন্ড রাগ লাগতো; আমার প্রকৌশলী মা, কর্মজীবনে খুবই সফল একজন মানুষের সব অর্জন সেই গায়ের রঙে গিয়ে ব্যর্থ!! বছর পাঁচেক আগে বাংলাদেশ থেকে ফিরে বড় ছেলে বলেছিলো “মা...বাংলাদেশের মানুষ এত্তো রেসিস্ট কেন? ঠিক এখানকার মতো...”
যুক্তরাষ্ট্রের “Deep South” প্রদেশ মিসিসিপিতে আমার প্রথম চাকরী; ছোট ছেলের জন্ম সেখানেই। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এক আপা একদিন বাসায় ষ্ট্রবেরী নিয়ে এলেন; জানতেন যে আমি এই ফল পছন্দ করি না। বললেন “শোন...ভালো না লাগলেও প্রতিদিন ষ্ট্রবেরী খাবে...এতে করে বাচ্চার গায়ের রং ফর্সা হবে...তোমার ছেলেটার গায়ের রংতো তেমন উজ্জ্বল না!!” প্রবাসে প্রায় সাত বছর; ততোদিনে আমি আমেরিকানদের একটা কথা মনেপ্রাণে ধারণ করে ফেলেছিলাম “If you are not paying my bill then it is none of your business.”
হাসিমুখে বললাম “আপনি প্রেগন্যান্ট অবস্থায় অনেক ষ্ট্রবেরী খেয়েছেন...তাই না আপা?” ওনার থতোমতো মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম “আপনি বা ভাইয়াতো বেশ কালো কিন্তু আপনার ছেলেটা ফর্সা হয়েছে...” “না...না...ও এমনিতেই ফর্সা হয়েছে...” “তাহলে আমার বাচ্চাটাও এমনিতেই হবে...গায়ের রঙের কথা না ভেবে দোয়া করুন যেন একটা সুস্থ বাচ্চা হয়!!”
এক আফ্রিকান আমেরিকান সহকর্মী একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলো “আচ্ছা...তোমার গায়ের রংতো তেমন শাদা নয়...বিয়ের সময়ে কি এই হালকা তামাটে রং একটা ফ্যাক্টর ছিলো?” চমকে গিয়েছিলাম “কিভাবে জানলে?” সে হেসে বলেছিলো “আমাদের মধ্যেও যেসব মেয়েদের গায়ের রং তুলনামূলক ভাবে উজ্জ্বল তাদের কদর বেশী!!” মনে মনে বললাম “পৃথিবীতে আর কোন কালো মেয়ে থাকবে না কখনও/ গৌরী সেন ক্রিম মেখে প্রত্যেকেই তুখোড় গোলাপি/ যেসব পুরুষ খোঁড়া, বংশে খুঁতো,/ যেসব উন্মাদ,কিংবা ডিভোর্সি, অথবা দোজবরে/…এমন পাত্রের জন্য কালো কালো মেয়ে/ কীভাবে সাপ্লাই দেবে আমার সমাজ?”
মিসিসিপি খুবই racially segregated একটা প্রদেশ; বর্ণবাদ এই প্রদেশে প্রতিষ্ঠানিক। আবাসিক এলাকা শাদা কালো হিসেবে বিভক্ত; সেই হিসেবে বাচ্চাদের স্কুল গুলোও। মিসিসিপিতে biracial কাপল দেখিনি কখনো; বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পর্যন্ত শাদা কালো তকমা দেয়া। গায়ের রং এখানে খুব বড় একটা বিষয়। বড় ছেলে এই রংবিভক্ত প্রদেশে তার কিন্ডারগার্টেন স্কুল শুরু করলো। খুব অল্প দিনের মধ্যেই সে বলা শুরু করলো যে সে অন্যদের মতো যথেষ্ট ভালো নয় কারণ তার গায়ের রং ডার্ক। মাঝে মাঝেই বলতো “মা...আমি তোমার মতো হইনি কেন? তুমি ফর্সা!!”
ছোট ছেলের জন্মের সময়ে মনেপ্রানে প্রার্থনা করেছিলাম যেন সে কালো হয়; অথচ সে অনেকখানিই ফরসা...আমার চেয়েও!! হাসপাতালে ছোট ভাইকে দেখে আমার বড় ছেলে বলেছিলো “মা...ও আমেরিকায় জন্মেছে আর আমি বাংলাদেশে...ও আমেরিকান বলেই কি এমন ফর্সা?” প্রচন্ড কষ্ট হয়েছিলো...আর সেইদিনই ঠিক করে ফেলেছিলাম এই শাদা কালো অচিনপুরীতে আমার দিন শেষ।
ক্যালিফোর্নিয়ায় এখন আমাদের বসতি। এই বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছোট্ট শহর বড্ড শাদা; অন্য রঙের বা অন্য দেশের মানুষ এখানে ঠিক যেন কোন সুন্দরীর দুধশাদা শরীরে তিল। এখানে যখন কেউ বলে “You are exotic,” “Interesting” বা “real” তখন চেষ্টা করি কমপ্লিমেন্ট হিসেবে নিতে যদিও বেশীর ভাগ সময়েই কোথাও একটা সুর বাজে যা বলে “কি আশ্চর্য!! তুমি অন্য রঙের, অন্য দেশের হলেও তেমন খারাপ নওতো যেমনটা ভেবেছিলাম!!” এই দাড়ি, কমা, সেমিকোলনের দেশে আজীবন বিস্ময়সূচক চিহ্ন হয়েই থাকলাম।
মিসিসিপির মানুষেরা খুব খোলামেলা ভাবেই (কখনো কখনো খুবই গর্বিত ভাবে!!) বর্ণবাদী এবং বর্ণবিদ্বেষী। জিজ্ঞাসা করলে খুব সহজেই উত্তর পেয়েছি “আমরা বাপু এতো রেখে ঢেকে কথা বলতে পারবো না...আমেরিকার অন্য প্রদেশে তারা মুখোশ পরে...আমরা তেমন নই!!” আসলেই কিন্তু তাই...তবে সময় বদলে যাচ্ছে। কেন যেন ইদানীং মনে হয় পুরো আমেরিকাই মিসিসিপি হয়ে যাচ্ছে। কোন রাখঢাক নেই; বর্ণবাদ বা বর্ণবিদ্বেষের জন্য মানুষ আর লজ্জা পায় না।
ছেলেটা বড় হয়ে গেছে; ছোট্টবেলার মতো সামান্য বিষয়ে আর বলা হয় না। আজ অনেক দিন পরে ওকে বললাম “I am proud of you Baba!!”
“Hold on to me as we go
As we roll down this unfamiliar road
And although this wave, wave is stringing us along
Just know you're not alone
'Cause I'm gonna make this place your home
Settle down, it'll all be clear
Don't pay no mind to the demons
They fill you with fear
The trouble—it might drag you down
If you get lost, you can always be found
Just know you're not alone
'Cause I'm gonna make this place your home…”
I KNOW I WILL!!!
© শিখা (৫ই জুন, ২০১৭)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৮ দুপুর ১২:১৫