ছোট্টবেলার সন্ধ্যাগুলো অন্যরকম ছিলো। তখনতো আর চব্বিশ ঘণ্টা টেলিভিশন চলতো না, একটাই মোটে টিভি চ্যানেল ছিলো, সেই বাংলাদেশ টেলিভিশন। সন্ধ্যাবেলায় পড়া না থাকলে সমস্যা…কি করি কি করি!! কাজ না থাকলেই দুষ্টুমি; রান্নাঘরে গিয়ে কাজের মাঝে বিরক্ত করা; অথবা মাঝে সাঝে বাবা মায়ের চোখ এড়িয়ে জানালার বা বারান্দার গরাদ বেয়ে ওঠা নামা করা; বারান্দার এমাথা ওমাথা দৌড়াদৌড়ি করে ফুলদানী বা ঘরসাজানোর জিনিষ ভাঙ্গা। মোটকথা আমার কাজ না থাকলে আমার চাইতেও বাসার অন্যান্যদের বিশাল সমস্যা!!
বাবা তাই পড়া না থাকলে কবিতা পড়তে দিতেন। মাঝে মাঝে মু্খস্থ ধরতেন; হাত পা নেড়ে চোখ বড় বড় করে বাবার কাছে আবৃত্তিও শিখতাম কখনো। সত্তরের দশকে শৈশব পেরোনো সবারই দুটো কবিতা মুখস্ত আর আবৃত্তি বাঁধা ছিলো; রবি ঠাকুরের “বীরপুরুষ” আর নজরুল ইসলামের “কাঠবেড়ালী।“
“বীরপুরুষ” আবৃত্তি করতে আমার বেশ লাগতো। “মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে/ মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।“ সামনে হাত ঘুরিয়ে “অনেক দুরে…” বলামাত্র কিভাবে যেন মন আসলেই অনেক দূরে কোন তেপান্তরের মাঠে চলে যেত। গহীন কোন অরন্যে মায়ের পালকির পাশে আমি, একটু গা ছমছম। টগবগিয়ে রাঙ্গা ঘোড়ায় সওয়ার; পাগড়ি মাথায় আর কোমরে তরবারী।“রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে/ রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।“ আবৃত্তি করার সময় আসলেই কোথাও ঘোড়ার খুরের শব্দ, ধুলোর গন্ধ পেতাম।
“হারে রে রে রে রে।“ করে আসা ডাকাত দলকে মহা উদ্যমে কচুকাটা করার পরেই একটু মনখারাপ হতো। মা বলছেন “ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল! কী দুর্দশাই হত তা না হলে।" কেউ বলেনি কিন্তু তারপরেও জানতাম মাকে রক্ষা করার জন্য কোন খুকীদের সাথে পাঠানো হয় না; খুকীরা মায়ের সাথে পালকিতে থাকে। খোকারাই মাকে রক্ষা করে, খোকাদেরকেই পাড়ার লোকে বলে “ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।“
হাত পা নেড়ে মাথা দুলিয়ে আবৃত্তি করা সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ দু’জন বীরপুরুষের মা। 'বীরপুরুষ' কবিতায় হিরো ছোট্ট ছেলেটি, সেই কেন্দ্রে, মা পরিধিতে৷ লেখালেখি ব্যাপারটাকে যতোটা ভাবতে পছন্দ করি ততোটা সরল কোন প্রক্রিয়া নয়। প্রতিটি লেখার পেছনে থেকে যায় পশ্চাৎপট, থেকে যায় সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী বা নিজস্ব অভিজ্ঞতা, ধরা পড়ে সময়।
সময় বদলেছে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী খুব ধীরগতিতে বদলাচ্ছে। হয়তো তাই এই বিংশ শতাব্দীতে মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতায় পরিধি থেকে কেন্দ্রে এসে দাঁড়ান বীরপুরুষের মা।
“একলা মা আর একলা ছেলে
ডাকাতগুলো দেখতে পেলে
কী হবে বল্ বীরপুরুষ খোকা?
তুই করবি যুদ্ধ, আর আমি রইব বোকা!
স্পষ্ট বলছি তা হবে না আর
তুই ওদের তির ছুঁড়লে আমিও দেব মার৷”
এখনও দেয়াল ভাঙ্গেনি; তবে ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে কয়েদখানার অন্ধকারে আলো এসেছে। আজ জানালার ফ্রেমে আটক চৌকনা টুকরো আকাশ; কোন একদিন ছাদ ভেঙ্গে আকাশ এসে দাঁড়াবে কয়েদখানায়। সন্ধ্যা বেলায় বাবার সামনে আবৃত্তি করার সময়ে কোন ছোট্টমেয়ে আসলেই টগবগিয়ে ঘোড়ায় চড়ে মাকে বা বাবাকে আগলে রাখবে; তরবারী খেলায় হারিয়ে দেবে “হারে রে রে রে রে…“ করে আসা ডাকাত দলকে। ভাবতে ভালো লাগে অদূরেই সেই দিন যখন কবিতার কেন্দ্রে এসে দাড়াবে ছোট্ট কোন মেয়ে...পাড়ার লোকে মাকে অথবা বাবাকে বলবে “ভাগ্যে খুকী ছিলো তোমার সাথে...”
© শিখা (১৬ই অক্টোবর, ২০১৭)