আজকের দিনটা অন্য দিনের মত হলেও তার কাছে এই দিনের একটা বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সে ভোর রাত থেকেই না ভুল বলেছি মাঝ রাত থেকেই একটা উত্তেজনা অনুভব করছে।বুকের মধ্যে এমন ধুক ধুক শব্দ হচ্ছে যে মনে হয় খুব জোড়ে কেউ ড্রাম বাজাচ্ছে। তার ভয় হচ্ছে এই শব্দ শুনেই না আশে-পাশের মানুষগুলো জেগে যায়।আসলে এই দিনটাকে নিয়ে তার পরিকল্পনা দীর্ঘ দিনের।মানুষজন ঘুনাঅক্ষরে বুঝতে পারেনি-তার ভেতর আর বাইরের মানুষটাকে।
তখন বেশ ভোর, সবে মাত্র সূর্যটা উকিঁ দিয়েছে।সে পাশের মানুষের হাতটা তার উপর থেকে আস্তে উঠিয়ে নেয়।খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামে তারপর ও পুরানো খাটটা একটা আর্তনাদ করে ওঠে।শব্দটা যেন এমন, চলে যেও না।সে পা টিপে টিপে বাথরুমে ঢোকে এরপর শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে কিছু সময় চোঁখ বন্ধ করে দাড়িয়ে থাকে।স্রোতের মত জল গড়িয়ে পড়তে থাকে নিচে।যাক ধুয়ে যাক সমস্ত কিছু, কোন প্রমান না থাকুক আর।
কিন্তু হাতে যে বেশি সময় নেই, সে দ্রুত তৈরী হতে থাকে।ঘুমন্ত মানুষটার মুখের উপর আবার চোখ গেল তার। কোন মায়া,মমতা বা ভালবাসা কোন অনুভূতিই তার কাজ করছে না।একটাই চিন্তা যত দ্রত সম্ভব এখান থেকে বের হতে হবে।
সে হেটে যাচ্ছে একটা মেঠো পথ ধরে। দুপাশে সবুজ ধানের ক্ষেত,কেমন যেন শীষ দিয়ে দোলা দেয়। সে আজ ভীষন খুশি-দীর্ঘ দিন পরে বুক ভরে নি:শ্বাস নেয়।না-অবশেষে কাজটা সে ভাল করেই করতে পেরেছে।এখন পর্যন্ত কেউ মনে হয় বুঝতে পারেনি-ঘটনাটা কি?সময় যত গড়াচ্ছে তার আনন্দের পরিমানও বাড়তে থাকে।
এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে সে কোনদিন যেতে পারে তার কল্পনাতেও আসেনি।হাতে একটা টাকাও নেই, এত দূরের পথ সে একা যাবে তাও একটা ভাবনার বিষয়। কিন্তু তাতেও তার যেন কোন রকম দু:শ্চিন্তা হচ্ছে না।একটা স্বাধীন একটা মুক্ত মানুষ আপাতত এই চিন্তাতেই সে বিভোর।
অনেকটা পথ সে হেটে যাচ্ছে... একটু দূরেই একটা ছোট্ট বাজারের মত কিছু তার চোখে পড়ছে।যাক-অবশেষে কিছু পাওয়া যাচ্ছে, অন্তত কিছু খাবার তো এখানে পাওয়া যাবে। সে বেশ আশাবাদী হয়ে হঠে, কিন্তু হাতে কোন টাকা নেই কে তাকে খেতে দেবে? চিন্তা করতে করতে তার চোখ চলে গেল তার গলার লকেটটার দিকে।যদিও এটা বিক্রি করতে তার প্রচন্ড কষ্ট হবে তাতে কি আজ সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে পিছন ফেরা মানেই নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা।
স্বর্নের দোকনীর চোখ তাকে বেশ ঝালাই করে নেয়। বুঝতে চেষ্টাকরে এরমধ্যে কোন গড়মিল আছে কিনা? কিন্তু তার চেহারা,পোশাক দেখে আর কিছু বলতে পারে না। বেশ অনেক কম টাকা দিয়েই তাকে বেঁচতে হয় লকেটটা।এরপর একটা দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে আবার চলতে শুরু করে। এরমধ্যে মানুষের কাছ থেকে শহরে যাবার রাস্তাটাও সে যেনে নেয়।
ঐ তো একটু দূরেই একটা ছোট্ট বাসস্ট্যান্ড সে দেখতে পায়।ভ্যানটা এগিয়ে যেতে যেতে তার উত্তেজনা ও বেড়ে যেতে থাকে।আহ্,মুক্তির কি আনন্দ!কতদিন পর,কতটা ক্ষতহয়ে তার এই আনন্দ তা কি অন্যকেউ বুঝবে?
আজ এই অজপাড়া গায়ে একটা ছোট্ট বাসে এতগুলো গ্রাম্য মানুষের মাঝে নিজেকে বেশ সুখি মানুষ মনে হয়। তার নিজের কৃত কর্মের জন্য তার কোন দু:খবোধ কাজ করে না।সে মানুষের মধ্যে যেন মিশে আছে পরম আনন্দে।না- এখন পর্যন্ত তাকে কেউ অনুসরণ করে আসেনি,কেউ তার খোঁজ পায়নি।
বেশ কিছু সময় পর বাসটা হেলে দুলে চলতে শুরু করে। একটা স্নিগ্ধ বাতাসে উড়ে যায় তার দীঘল কালো চুল।সে এত সময় পর দীর্ঘ পরিশ্রমের ক্লান্তিতে শরীরটা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। একটা সুন্দর গান বাজতে থাকে বাসের মধ্যে....সে চলে যায় আবার পিছনের সেই কষ্টকর অতীতে।তাকে একসময় জোড় করে এক প্রভাবশালীর ছেলে তুলে নিয়ে যায়।তারপর জোড় করে বিয়েও করে,তাকে নিয়ে রাখে এক অজপাড়া গাঁয়ে- যেন কেউ তাকে খুঁজে না পায়।
প্রতিটা দিন তার কাটতো কষ্টে আর যন্ত্রনায়।সে মুক্তি পেতে চাইতো প্রতিদিন। তার অনেক দিনের পরিকল্পনার পর আজই সে পালাতে পারে অনেক চোখ ফাঁকি দিয়ে।সে জানে সামনের পথটা তার জন্য কষ্টকর। এই সমাজ,পরিবার এত সহজে তাকে মেনে নেবে না। তা হোক-আর একবার সে সুযোগটা পেয়েছে জীবনটাকে সাজিয়ে নেবার। কষ্ট তাকে কঠিন হতে শিক্ষা দিয়েছে-সে আর কিছুতেই ভয় পায়না।মায়ের মুখটা তার মনে পড়ে যায়। মা কি তাকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারবে?পারবে তাকে আগের মতই ভালবাসতে? আবার মনে হয়-মায়েরা সব পারে। বাস চলতে থাকে আর সে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ঘরে ফেরার স্বপ্ন দেখে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:৪৭