কলকাতায় চারদিন থাকার কথা শুনে বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। আমার যত তাড়না মনের মধ্যে তার কিছুমাত্র বাইরের সাথে মিলছিল না। ট্রেনের টিকেট চারদিন আগে পাওয়া যাবে না। কি করি? তাই বিমানের কথাটা মাথায় এলো। বিমানে যাওয়ার চিন্তা আমার মতো দারিদ্র মানুষের জন্য ঘোড়া রোগ। কিন্তু চারদিন হোটেলে থাকা-খাওয়া এবং সব শেষে চেন্নাই পর্যন্ত যাওয়া বা ভেলুর অবধি যাওয়ায় যে খরচ তা মিলিয়ে দেখলাম প্রায় বিমানের সমানই খরচ পড়ে। তাই বিমানের টিকেট কিনলাম। আর মাত্র সোয়া দু ঘন্টায় উড়ে গেলাম চেন্নাই।
আমরা রাস্তায় যেমন মুড়ির টিন বাসে অল্প পয়সায় যাতায়াত করি তেমনি আকাশ পথের মুড়ির টিনের খবর পেলাম প্লেনে চড়ার পর। পাশের যাত্রীর কাছ থেকে। বিমান ছাড়ার আগ মুহুর্তে টিকেট নিয়ে দরকষাকষি চালিয়ে তিনি আমার চেয়েও অর্ধেক ভাড়ায় চেন্নাইয়ে চলে এসেছেন। সিট খালি অবস্থায় বিমান উড়ানোর চেয়ে যে পয়সাই পায় তাই তো লাভ। ফলে অর্ধেক টাকায় উড়ে যাওয়া সম্ভব, একে বলে ফেয়ার। কিভাবে এটা করতে হয় তাই তিনি আমাকে শিখিয়ে দিলেন। তবে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, এই ফেয়ার পাওয়া যাবে মাত্র ডাল সিজেনে।
সে যাই হোক কলকাতার নতুন এয়ারপোর্ট দেখে তো 'চক্ষুু চড়ক গাছ'। এমন ঝাঁ চকচকে অবস্থা যে আমি চারপাশে হা করে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। ফুটকোর্ট, বার এবং ডিউটি ফ্রি শপ রয়েছে ভেতরে। যদিও ডিউটি ফ্রি বলতে কোন ডিউটি আমি বুঝতে অক্ষম, কারণ দাম তো শুনে মনে হলো এক্সট্রা ডিউটি'র দেকান। সে যাই হোক এমন একটা এয়ারপোর্ট দাম দিলেও মন খারাপ হয় না। প্লিজ সবই মাইন্ড করবেন না, আমার যা মনে হয়েছে তাই বললাম।
আমাদের ফ্লাইট ছিল সন্ধ্যা সোয়া সাতটায়। যথা সময়ে বিমন এলো এবং আমাদের সহ উড়াল দিল। সিটে আরাম করে বসে, আজকের দিনের বাংলাদেশ থেকে আনা পত্রিকাটা খুললাম। এমা, দেখি মালয়শিয়ান বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার খবরটা হেডলাইনে। মাঝ আকাশে এই প্রথম আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। বুঝলাম আমি্ আসলে যা মনে করি তার চেয়েও বেশি ভীতু, যদিও মৃত্যু এগিয়ে আসছে খুব কাছাকাছি, শেষ চিকিৎসা করতেই হয়তো যাচ্ছি, ঋণের টাকা নিয়ে।
চেন্নাই.........
চেন্নাই এক্সপ্রেসের কমবেশি ২৮ ঘন্টার জার্নিটা বিমানে সোয়া দুই ঘন্টায় সেরে ফেললাম টাকার জোড়ে। দুনিয়ার তামাশা মাঝে মাঝেই আমাকে অবাক করে। কলকাতার দমদাম এয়ারপোর্ট দেখে 'চক্ষু চড়ক গাছ' হয়ে ছিল, সেটা ছিল কিছুটা ঈর্ষার দৃষ্টিতে কিছুটা বিষ্ময় মেশানো; কিন্তু চেন্নাই এয়ারপোর্টে এসে সেটা হয়ে উঠলো 'ছানাবড়া'। প্যাসেজ ধরে এগোচ্ছি আর অপার বিষ্ময়ে দেখছি চারপাশ। অনেকের কাছে হয়তো এই অবস্থাকে আদেখলা বলে মনে হবে, কেউ টিটকারির সুরেও কিছু বলতে পারেন তবে আমার অবস্থা সত্যিই তেমনই। ভারতের বিষ্ময়কর দ্রুত ডেভলপমেন্ট দেখে আমি মুগ্ধ, বিষ্মিত। যেখানে চোখ যায় প্রথম দর্শনেই যে কোন মানুষের বুঝে নেওয়া সম্ভব এই দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিকে। তাই কলকাতায় যে ঈর্ষা আমার মনে জেগেছিল, চেন্নাই এসে সেটা মুছে গিয়ে মুগ্ধতা এসে ঠাঁই নিল মনে।
রাতের চেন্নই সিটি, এবং পরের দিন দিনের চেন্নাই সিটি দুটিই গুরুত্বপূর্ণ এই শহরের পরিচয় পাওয়ার জন্য। রাতের সিটিতে হোটেল খুঁজতে ভরসা করতে হলো টেক্সিওয়ালার উপর। সে তামিল এবং ইংরেজি জানে, হিন্দি জানে না। বিষয়টা আমার কাছে অবাক করেছে। অবশ্য মনে হয়েছে যে, সে হিন্দিতে কথা বলতে চায় না। আর আমি না জানি হিন্দি, না জানি ইংরেজি। শেষে হিন্দি-বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি ভাষায় তাঁর সাথে বাতচিত চলতে লাগলো। অবশ্য হিন্দি সিরিয়াল আর ফিল্ম দেখে দেখে আন্না বেশ হিন্দি রপ্ত করেছে, ওর ওপর পুরো ভরসা নিয়েই তো এখানে আসা।
ট্যাক্সিওয়ালা খুঁজে খুঁজে রাত বারোটার সময় এক আধা-বাঙালি এক হোটেলে উঠিয়ে দিয়ে গেল। হোটেল লবিতে প্রথম যে প্রশ্ন শুনতে হলো সেটা ছিল, 'আপনি বাংলাদেশি তো; পাটপোট ভিসা আছে নাকি চুরি করে এয়েচেন?'
মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। বললাম, 'অবশ্যই বৈধ পথেই এসেছি।আমার কাছে সমস্ত অথরাইজড কাগজপত্র আছে। লাগবে?'
কাউন্টার থেকে বলল, 'সব নয়, শুধু পাসপোর্টটি দিন; ওটার একটা জেরক্স কপি করতে হবে।'
এরা ত্রিপুরার বাঙালি। আমাকে আগেই একজন সাবধান করে দিয়েছিল ত্রিপুরার বাঙালি সম্পর্কে। তামিল নাডুতে এটা বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাস করে। এদের ব্যবহারে কোন বিনয় নাই, বরং বেয়াদব বলাই শ্রেয়। রাগটা আসলে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, কিন্তু সেটা এদের ব্যবহারেই নয়। আসলেই অবৈধ পথে আসা বাংলাদেশির চোরাই চেহারা দেখে। পাশেই একজন এমন ব্যক্তির দেখা মিলল। সে আলাপ জমানোর চেষ্টা করতেই আমি লাগেজ নিয়ে কেটে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম এদের পাছায় আর কপালে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া উচিত।
[চলবে.........]