somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সাহসী সন্তান
{♥ যদি কখনো নিজেকে একা ভাবো, তাহলে ঐ দূর আকাশের অসীম সীমান্তের দিকে তাকিয়ে থাকো! কখনো নিরাশ হয়ে যেও না! হয়তো বা একটা বাজপাখিও তোমার দিকে উড়ে আসতে পারে! ♥}

ফিচারঃ- ভাওয়াল পরগনার অন্যতম আলোচিত রাজা, মেজো কুমার 'রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি'র সাতকাহন। তার জীবনের ট্রাজেডিময় মৃত্যুর ইতিহাস এবং রহস্যময় পূনরাবির্ভাবকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া যুগান্তকারী সেই দীর্ঘমেয়াদি মামলার ঐতিহাসিক কাহিনী!

১৪ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একজন মানুষ অথচ সে রুপকথার গল্পকে ভালবাসে না, পৃথিবীতে বোধ হয় এমন মানুষ একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না! আমরা বিভিন্ন ধরনের বাংলা অথবা ইংরেজি বইতে রুপকথার গল্প বা উপন্যাস পড়ে অনেক সময় বিস্মিত এবং বিমুগ্ধ না হয়ে পারি না। আমাদের আশে-পাশেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে যাদের অনেকেই হয়তো মনে করে থাকেন যে, রুপকথার গল্প বোধ হয় শুধু গল্পের বই আর ইতিহাসের পাতাতেই সব থেকে বেশি স্থান পায়। বাস্তবে হয়তো রুপকথার গল্পের খোঁজ পাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব! কিন্তু আমরা এটা ভুলে যাই যে, মানুষের এই বাস্তব জীবনেও এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটে, যা রুপকথার গল্পকেউ হার মানায়। আজ আমি আপনাদের সামনে ঠিক এমনই একটা ঘটনাকে উপস্থাপন করতে চলেছি, যে ঘটনাটি শুনলে হয়তো আপনার কাছেও মনে হতে পারে এসব গল্পও নিছকই একটা রুপকথা বই অন্যকিছু নয়। কিন্তু আপনি আমার উপস্থাপিত এই ঘটনাটিকে আর যাই ভাবেন না কেন, মিথ্যা ভাবলে কিন্তু প্রচন্ড রকমের ভুল করবেন! কারন আজ যে ঘটনাটি আমি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে চলেছি. সে ঘটনাটি একদমই জলজ্যান্ত সত্য একটি ঘটনা; যা এই বাস্তব জীবনে একজন মানুষের সাথে সংঘটিত হয়েছিল এবং যেটা ঘটেছিল আজ থেকে কয়েক'শ বছর আগে আমাদেরই এই সোনার বাংলায়! যে ঘটনাটিকে আমরা আজও পর্যন্ত 'ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা' নামে অভিহিত করে থাকি!

ভাওয়াল পরগনার মেজো কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি কে ঘিরে যে চাঞ্চল্যকর মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল, সেটাই মূলত ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা নামে পরিচিত। যা শুরু হয়েছিল ১৯৩০ সালে এবং শেষ হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। ১৬ বছর যাবত এ মামলার ফলাফল জানার জন্য সারা দেশের মানুষ শেষ দিন পর্যন্তও উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় করছিল। এই মামলার নায়ক ছিলেন ভাওয়াল পরগনার জমিদার বংশের মেজো কুমার, রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। রমেন্দ্র নারায়ণ রায় যখন ১৯০৯ সালের মে মাসে দার্জিলিং এ ছিলেন. ঠিক সেই সময় দীর্ঘদিন শারীরিক অসুস্থতা ভোগ করে অবশেষে দার্জেলিং শহরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু দীর্ঘ ১২ বছর পর অবশেষে ১৯২১ সালের ৪ঠা মে একজন সন্ন্যাসীর পরিচয়ে যখন তিনি আবারও ঢাকায় ফিরে আসেন, এবং নিজেকে কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ বলে ঘোষণা দেন, ঠিক সেই সময় থেকেই এই চাঞ্চল্যকর কাহিনীর সূত্রপাত ঘটে। তো পাঠক আসুন আর দেরি না করে আমরা এবার সেই ট্রাজেডিময় ঐতিহাসিক কাহিনীর মূল অংশে প্রবেশ করি........!!


ভাওয়াল রাজবাড়ীর পরিচিতিঃ- ভাওয়াল রাজবাড়ী অবিভক্ত ভারতবর্ষের বাংলা প্রদেশের ভাওয়াল এস্টেটে, যা বর্তমানে বাংলাদেশের গাজীপুর জেলায় অবস্থিত একটি রাজবাড়ী। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বহুকাল পূর্বে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীর হতে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা পার হয়ে সুসং পাহাড় পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের মধ্যে 'জয়ানশাহি' নামে একটি গহীন অরণ্য অঞ্চল ছিল। এর উত্তরাংশকে বলা হতো 'মধুুপুরের অরণ্য অঞ্চল' এবং দক্ষিণাংশকে বলা হতো 'ভাওয়ালের অরণ্য অঞ্চল'। ঐতিহাসিকগন মনে করেন, উত্তর-দক্ষিণে এই অরণ্য অঞ্চলের দৈর্ঘ্যে ছিল পঁয়তাল্লিশ মাইল এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্তে ছিল ছয় থেকে ষোল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। দ্বাদশ শতাব্দির পরবর্তী কালে প্রায় ছয়'শ বছর পাঠান ও মুঘলরা এদেশ শাসন করে। তাঁদের আমলে এই আরণ্যকের মাঝখানে গড়ে উঠে এক প্রশাসনিক অঞ্চল, যেটা সেখানকার স্থানীয় মানুষের কাছে 'ভাওয়াল পরগণা' নামে পরিচিত। ভাওয়াল পরগণার উত্তরে আটিয়া ও আলেপসিং পরগণা, দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা, পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদী ও মহেশ্বরদি পরগণা এবং পশ্চিমে কাশিমপুর ও দুর্গাপুর পরগণা অবস্থিত। বর্তমান গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকা জেলার কতেকাংশেও ছিল ভাওয়াল পরগণার অবস্থান।


বিংশ শতকের প্রারম্ভে এই ভাওয়াল রাজ এস্টেটকে নিয়ে একটি বিখ্যাত মামলা হয়েছিল, যা ভাওয়ালের জমিদার বংশের মেজো কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায়কে ঘিরে। যে মামলাটি অনেকের কাছেই 'ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা' নামে আজও বিখ্যাত হয়ে আছে। এছাড়া বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক 'উত্তম কুমার' অভিনীত 'সন্ন্যাসী রাজা' নামের বাংলা চলচ্চিত্রটিও তৎকালিন সময়ে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল, যার ঘটনা এই ভাওয়াল রাজবাড়িকেই কেন্দ্র করে। এই রাজবাড়ীর আওতাধীন ভাওয়াল এস্টেট প্রায় ৫৭৯ বর্গমাইল (১,৫০০ কিঃ মিঃ) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল, যেখানে প্রায় ৫ লক্ষেরও বেশি প্রজা বসবাস করতো। জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির ঠিক আগ মূহুর্ত্বে ভাওয়ালের জমিদার বংশের রাজ কুমার মেজো রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায় ও তার আরো দুই ভাই বড় কুমার রাজা রণেন্দ্র নারায়ণ রায় এবং ছোট কুমার রাজা রবীন্দ্র নারায়ণ রায় মিলে এই জমিদারীটি দেখাশোনা করতেন।


ভাওয়াল রাজ এস্টেট, পরিধি এবং আয়ের দিক থেকে পূর্ব বাংলায় নওয়াব এস্টেটের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারি হিসাবে বিবেচিত ছিল। ভাওয়াল জমিদার বংশের পূর্বপুরুষগণ মুন্সিগঞ্জের অন্তর্গত বজ্রযোগিনী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। এই বংশের জনৈক পুরুষ বলরাম সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভাওয়াল পরগনার জমিদার দৌলত গাজীর দেওয়ান হিসেবে কাজ করতেন। বলরাম এবং তার পুত্র শ্রীকৃষ্ণ তৎকালীন বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলী খানের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন এবং কৌশলে গাজীদের বঞ্চিত করে জমিদারি হস্তগত করেন।


রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে মুর্শিদকুলী খান বহু মুসলমান জমিদারকে বিতাড়িত করে তদ্স্থলে হিন্দু জমিদার নিযুক্ত করেন। অনেকে ধারনা করেন যে, ভাওয়ালের গাজীগণ মুর্শিদকুলী খানের এই নীতির কারণেই মূলত তাদের জমিদারি স্বত্ব হারান। এবং ১৭০৪ সালে শ্রীকৃষ্ণকে ভাওয়ালের জমিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকে এই পরিবারটি ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে এই জমিদারির অধিকারী ছিলেন। শিকারী বেশে রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং এর পরবর্তী সময়ে ভাওয়াল পরিবার বহু ছোটো-খাটো জমিদারি বা জমি ক্রয় করেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তিতে এই পরিবার একটি বিরাট জমিদারির মালিক হন।


১৮৫১ সালে পরিবারটি নীলকর 'জেমস ওয়াইজ' এর জমিদারি ক্রয় করে। এবং এই ক্রয়ের মাধ্যমেই পরিবারটি সম্পূর্ণ ভাওয়াল পরগনার মালিক হয়ে যায়। সরকারি রাজস্ব নথিপত্র থেকে এটি জানা যায় যে, ভাওয়ালের জমিদার ৪,৪৬,০০০/- (চার লক্ষ ছেচল্লিশ হাজার) টাকা দিয়ে ওয়াইজের জমিদারি ক্রয় করেন, যা ছিল সে যুগের মূল্যমানের বিচারে বেশ বড় একটি অঙ্ক। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, শ্রীকৃষ্ণ ওরফে কৃষ্ণ নারয়ণের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র জয়দেব নারায়ণ এই জমিদারিটি লাভ করেন। পরবর্তিতে জয়দেব নারায়ণের নামানুসারে স্থানীয় পীরবাড়ি মৌজার নাম বদলিয়ে নতুন নাম রাখা হয় জয়দেবপুর হিসাবে। জয়দেব নারায়ণের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইন্দ্র নারায়ণ এবং তৎপুত্র কীর্তি নারায়ণ পরবর্তিতে এই এস্টেটের জমিদার নিযুক্ত হন। কীর্তি নারায়ণের পর তৎপুত্র লোক নারায়ণ এবং তাঁর মৃত্যুর পর তৎপুত্র গোলক নারায়ণ বংশানুক্রমে এই জমিদারিটি লাভ করেন। গোলক নারায়ণের মৃত্যুর পর তৎপুত্র কালি নারায়ণ জমিদার হন। এবং ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি আনুগত্য পোষণ ও বিরল যোগ্যতার কারণে তিনি সেই সময়ে প্রচুর খ্যাতি লাভ করতে সক্ষম হন।


১৮৭৮ সালে ঢাকার 'নর্থব্রুক' হলে তৎকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিয়োজিত গভর্ণর বড়লাট লর্ড লিটনকে তিনি এক জাঁকজমক পূর্ণ সংবর্ধনা প্রদান করেন। বড়লাট কালি নারায়ণের প্রভু ভক্তিতে গদগদ হয়ে উক্ত অনুষ্টানেই তাকে বংশানুক্রমিক 'রাজা' উপাধিতে ভূষিত করেন। এবং তারপর থেকেই মূলত তিনি মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করেন ভাওয়ালের রাজা কালি নারায়ণ রায় চৌধুরী হিসেবে। কালি নারায়ণ বিখ্যাত ছিলেন বিদ্যা শিক্ষা, সৃজনশীলতা, কর্মঠো এবং বাক্কালাপেও তিনি ছিলেন অ-প্রতিদ্বন্দী। তৎকালিন সময়ে তিনি জয়দেবপুরে একটি বিদ্যালয় এবং একটি দাত্বব্য চিকিৎসালয়ও প্রতিষ্টা করেন।


রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরির পূর্ব পুরুষদের ইতিহাসঃ- রাজা কালি নারায়ণ রায় চৌধুরীর তিন স্ত্রীর মধ্যে ছোট স্ত্রীর নাম ছিল রাণী সত্যভামা দেবী। অপর দুই স্ত্রী ছিলেন রাণী যামিনী দেবী এবং রাণী ব্রক্ষ্মময়ী দেবী। কিন্তু শেষক্ত এই দুই রাণী ছিলেন একদমই নিঃসন্তান। অপরদিকে রাণী সত্যভামা দেবীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন পুত্র রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এবং কন্যা রাণী কৃপাময়ী দেবী। পিতার মৃত্যুর পর রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী বংশানুক্রমে ভাওয়ালের রাজা হন। তিনি বিয়ে করেছিলেন বরিশাল জেলার বানারিপাড়ার অত্যন্ত গুণবতী কন্যা 'রাণী বিলাসমণি দেবী'কে। রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিতার ন্যায় যোগ্য ও কৌশলী ছিলেন। রাজা উপাধিতে ভূষিত রাজেন্দ্র নারায়ণ বিখ্যাত কবি 'কালি প্রসন্ন ঘোষ, বিদ্যাসাগর এবং সি.আই.ই' কে ভাওয়ালের ম্যানেজার পদে নিযুক্ত করেন। এবং এই মেধা এবং যোগ্যতা বলে অতি শীঘ্রোই তিনি তার জমিদারির আরো বিস্তৃতি ঘটান। আর এই সময়েই ভাওয়ালের জমিদারি স্টেটটি ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জ জেলায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে এবং পূর্ব বঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারিতে পরিণত হয়।

উল্লেখ্য যে, যদিও ঢাকার নওয়াব এস্টেটটি পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলাসমূহে জমিদারি বিস্তৃত করেছিল এবং জমিদারির প্রশাসনিক কেন্দ্র ঢাকা শহরেই অবস্থিত ছিল। কিন্তু ঢাকা শহরের অংশবিশেষ ও আশপাশের প্রায় সকল জমির মালিকই ছিলেন ভাওয়াল রাজা কুমার রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি। ১৯১৭ সালে ভূমি জরিপ ও বন্দোবস্ত রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, ভাওয়াল পরিবারটি বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা '২২৭৪টি মৌজায় ৪,৫৯,১৬৩.৩ একর জমির' মালিক ছিলেন। ১৯০৪ সালে জমিদারিটি সরকারকে বাৎসরিক ৮৩,০৫২/- টাকা রাজস্ব হিসেবে প্রদান করে এবং সকল খরচ-খরচা বাদ দিয়ে বছরে প্রায় ৪,৬২,০৯৬/- টাকা নিট আয় করে।


ভাওয়াল রাজ এস্টেটের নামকরণঃ- বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় ভাওয়াল অঞ্চলের নাম নিয়ে রয়েছে নানা মহলের নানা অভিমত। এসব অভিমতের পেছনে কোন দলিল-দস্তাবেজ, শিলালিপি, প্রাচীন স্তম্ভ কিংবা মৃৎলিপি বা গ্রহণযোগ্য তেমন কোন প্রামাণ নেই। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই নামকরণের বিষয়টি মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে প্রায় যুগ হতে যুগান্তর পর্যন্ত। আর মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত সেই সমস্ত অভিমতের কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হলোঃ-

=> রাজা ভবপাল বা ভদ্রপালের নাম হতে ভাওয়ালঃ- অনেক ঐতিহাসিকরা মনে করেন, পাল শাসনামলে এ অঞ্চল পাল বংশের রাজ্যভুক্ত ছিল। পাল রাজাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজা ভবপাল বা ভদ্রপাল। এই ভদ্র পালের এক অধঃস্তন পুরুষ মহারাজা শিশুপাল এক সময়ে এ অঞ্চল শাসন করতেন। অনেকে মনে করেন রাজা ভবপাল বা ভদ্রপালের নামানুসারে এবং তার সময়েই এই এলাকার নামকরণ করা হয়েছে ভাওয়াল নামে।


=> ভগালয় হতে ভাওয়ালঃ- ভগ+আলয় হতে ভগালয় শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। ভগ শব্দটির আবিধানিক অর্থ হলো- ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। এই ছয়টি ভগ বা গুণের যিনি অধিকারী, তিনিই হলেন ভগবান। আলয় শব্দের অর্থ হলো- নীড়, ঘর, বাড়ি, আশ্রয়স্থল, নিকেতন বা ভবন ইত্যাদি। তাহলে ভগালয় শব্দের আবিধানিক অর্থ দাঁড়ায়- খ্যাতিমান, যশ্বসী, বিক্রমশালী বা সম্পদশালীর ভবন বা নিকেতন। আর এই অঞ্চলে সম্পদ বা ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য থাকার কারণে ভগালয় হতে ভাওয়াল শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকে ধারণা করে থাকেন।

=> রাজা ভগদত্তের নাম হতে ভাওয়ালঃ- পৌরাণিক তথা মহা ভারতের যুগে ভগদত্ত নামে এক বিক্রমশালী রাজা ছিলেন। তিনি এ এলাকা শাসন করতেন বিধায় তাঁর নামানুসারে ভাওয়াল শব্দটি এসেছে বলেও অনেকে মনে করে থাকেন।

=> আঁতিভোয়াল থেকে ভাওয়ালঃ- অনেকে মনে করেন, প্রথম দিকে এই এলাকাকে আঁতিভোয়াল বা আঁতিভোল নামে ডাকা হতো। তারা প্রমাণ স্বরূপ উল্লেখ করেন যে, ভাওয়ালের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে আঁতিভোল নামে একটি প্রাচীন নগরী অবস্থিত ছিল। আটিয়া ও ভাওয়াল সন্নিহিত দুটি পরগণার নাম আঁতিভোল হতে এসেছে। আর তাদের ধারণা এই আঁতিভোয়াল শব্দ থেকেই মূলত ভাওয়াল নামের উৎপত্তি হয়েছে।


=> ভাওয়াল গাজীর নাম হতে ভাওয়ালঃ- দিল্লির সম্রাট আকবরের সময়ে যে বারো জন ভূঁইয়া তৎকালীন বাংলায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, তন্মধ্যে অন্যতম ছিলেন পাঠান বংশোদ্ভুত ভাওয়াল গাজী। অনেকে মনে করেন ভাওয়াল গাজী যে এলাকায় স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেছিলেন তার নামানুসারে নাম হয়েছিল ভাওয়াল পরগণা। জন শ্রুতি রয়েছে, ভাওয়াল গাজীর অধঃস্তন এক জমিদার তাঁর পরগণার ৯ আনা হিস্যায় জনৈক ব্রাহ্মণ কর্মচারীকে এবং বাকি ৭ আনা হিস্যায় দুই জন কায়স্ত কর্মচারীকে দান করেন। এবং এরা দিল্লির মুঘল সম্রাট কর্তৃক জমিদার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। ৭ আনা হিস্যার একজন পূবাইলে তাঁর জমিদারি স্থাপন করেন, বিধায় তাকে বলা হতো পূবাইলের জমিদার। অপর জন কাশিমপুরে জমিদারি স্থাপন করায় তাঁকে বলা হতো কাশিমপুরের জমিদার। অপরদিকে ৯ আনা হিস্যার ব্রাহ্মণ কর্মচারী তাঁর জমিদারি ভাওয়ালে স্থাপন করায় তিনি ভাওয়ালের জমিদার নামে খ্যাত হন।

=> উপভাষিক শব্দ হতে ভাওয়ালের উৎপত্তিঃ- তৎকালিন সময়ে ভাওয়াল ও মধুপুর অরণ্যাভ্যন্তরে রাজবংশী ও হাজং নামক এক শ্রেণীর উপজাতির লোকেরা বসবাস করতো। অনেকের মতে, তারা ঘন গজারি জাতীয় গাছে আচ্ছাদিত গহীন লাল মাটির টিলা অঞ্চলকে ভাওয়াল বলে অভিহিত করতো। আবার অনেকের মতে, পাঠান ও মুঘলরা তাদের শাসিত ছোট ছোট অঞ্চলকে ওজিয়াল বলতো। এই ওজিয়াল থেকে ভাজিয়াল বা পরবর্তিতে ভাওয়াল শব্দটি এসেছে।


=> হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে ভাওয়ালঃ- এছাড়াও হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, এক সময় ভাওয়াল পরগনা শাষন করতেন শিশুপাল। তিনি দেবতা লক্ষ্মী নারায়ণের প্রতিমূর্তি ছিলেন। শিশুপাল ছিলেন স্বর্গের দ্বার রক্ষক। কিন্তু তিনি দেবতার প্রহরীদের দেখে বিভিন্ন সময় হাসি ঠাট্টা করতেন। দেবতা প্রচন্ড রেগে গিয়ে তাকে অভিশাপ দেন। এবং স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেন। শিশুপাল তখন দানব কূলে জন্ম নিলেন। তারপর এক সময় দানবদের রাজাও হলেন। রাজা হয়েই তিনি প্রথমে কামরুপ কামাখ্যা এবং ভাওয়াল পরগনা দখল করে নিলেন। তারপর তিনি গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার দিঘি সিটে তার রাজ প্রসাদ নির্মান করেন। আজও দিঘির সিটে তার সেই রাজ প্রসাদের ধ্বংশাবশেষ পাওয়া যায়। শিশু পালের মৃত্যুর পর ঐ এলাকায় চন্ডাল রাজ বংশের প্রদূর্ভাব হয়। চন্ডালদের পর পাঠান শাসক গাজী পরিবাররের আওতাধীন চলে আসে। গাজী পরিবারের হাত থেকে পরবর্তিতে ঐ অঞ্চল চলে আসে রায় পরিবারের হাতে। তারা প্রায় দীর্ঘদিন ভাওয়াল অঞ্চল শাষন করেন। জমিদার প্রথার বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবার দুটিরও অবসান ঘটে বলে অনেক ঐতিহাসিকগন তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন।

ভাওয়াল নামকরণের পিছনে এরূপ আরো বহু মতামত রয়ে গেছে। তবে উল্লেখযোগ্য মতগুলো ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে ভাওয়াল গাজীর নামানুসারে ভাওয়াল পরগণার নামটিই মূলত সার্থক বলে মনে হয়।


ভাওয়াল রাজকুমার এবং রাজকুমারীদের জন্ম ইতিহাসঃ- রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী প্রাপ্ত বয়সে বিয়ে করেছিলেন বরিশাল জেলার বানারিপাড়ার জমিদার কন্যা রাণী বিলাসমণি দেবীকে। বিবাহিত জীবনে স্ত্রী বিলাসমণি দেবীর গর্ভে সর্বমোট তিন পুত্র ও তিন কন্যা জন্ম গ্রহণ করেন। প্রথম সন্তান- কন্যা ইন্দুময়ী দেবীর বিয়ে হয়েছিল গোবিন্দচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (এম. এ, বি. এল) এর সাথে। দ্বিতীয় সন্তান- কন্যা জ্যোতির্ময়ী দেবীর বিয়ে হয়েছিল জগদীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তৃতীয় সন্তান পুত্র বড়কুমার রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী বিয়ে করেছিলেন সরযূবালা দেবীকে। এছাড়াও তিন কুমারের মধ্যে শুধুমা্ত্র এই রণেন্দ্র নারায়ণ রায়ই কিছুটা লেখা পড়া শিখেছিলেন। ফলে ব্রিটিশ রাজ পুরুষদের সাথে তিনি যোগাযোগ রক্ষা ও আলাপচারিতা করতে পারতেন। চতুর্থ সন্তান পুত্র কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী (জন্ম ২৮ জুলাই ১৮৮৪) কোনরূপ নাম সই করতে পারতেন। তিনি ছিলেন অমিতাচারী। খেলাধুলা আর শিকারের প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক ছিল। একবার বৃটিশ সরকার কর্তৃক ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগীতায় তিনি নিজে জকি ছিলেন এবং বলা বাহুল্য তিনিই প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তিনি ১৯০২ সালের মে মাসে হুগলীর বিষ্ণুপদ মুখার্জির মধ্যমা কন্যা অপূর্ব সুন্দরী দেবী বিভাবতীকে বিয়ে করেন। ভাওয়াল রাজ এস্টেটে কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ মূলত মেজোকুমার নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। পঞ্চম সন্তান পুত্র কুমার রবীন্দ্র নারায়ণ রায়ের সাথে বিয়ে হয়েছিল আনন্দ কুমারী দেবীর। এবং সর্বশেষ ষষ্ঠ সন্তান কন্যা তড়িন্ময়ী দেবীর বিয়ে হয়েছিল বাবু ব্রজলাল ব্যানার্জী (এম.এ, বি.এল) এর সাথে।


রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ১৯০১ সালের ২৬ এপ্রিল মৃত্যু বরণ করেন। এই সময় তাঁর তিনপুত্র সন্তানই ছিলেন বেশ নাবালক। সে কারণে জমিদারিটি একবার ১৯০১ সালে এবং আর একবার ১৯০৪ সালে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে চলে যায়। রাজেন্দ্র নারায়ণের তিন পুত্র সন্তানকেই একজন ইউরোপীয় গৃহ-শিক্ষক লেখাপড়া শেখাতেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, তিন পুত্রই ছিলেন অজ্ঞ ও ইন্দ্রিয় পরায়ণ। লেখাপড়া ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি তারা ছিল অত্যন্ত অমনোযোগী। হিন্দু আইনানুসারে তাঁর মৃত্যুর পর ভাওয়াল রাজ্য বা এস্টেটের মালিক হন এই তিন পুত্র। কিন্তু কুমারগণ নাবালক থাকায় তাঁদের মা রাজ মাতা রাণী বিলাসমণি দেবী ট্রাস্টি হিসেবে এস্টেট পরিচালনার ভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন। আর এ কারণে ভাওয়াল রাজ এস্টেট এক সময়ে রাণী বিলাসমণি এস্টেট নামেও পরিচিতি লাভ করেছিল।


রমেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণের মেজো পুত্র। রাজমাতা রানী বিলাসমণি ছিলেন তেজস্বিনী ও দূরদর্শী সম্পন্না একজন মা। রানীমাতা হিসেবে নিজ পরগনার প্রজাদের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ ভোগ-বিলাসে এতটাই মত্ত ছিলেন, যে স্বাভাবিক রাজ্য পরিচালনা তো দূরে থাক; নিজেকেই তিনি ঠিকমত গুছিয়ে রাখতে পারতেন না। তাই রাজমাতা বিলাসমণিই প্রকৃত অর্থে জমিদারির দেখভাল করতেন। এস্টেটের ম্যানেজার বিখ্যাত সাহিত্যিক কালীপ্রসন্ন ঘোষ নিজের বিত্ত-বৈভব বৃদ্ধিতে এতটাই লোভী হয়ে পড়েন যে, রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণকে নিজ স্বার্থে তিনি ভোগবাদের নোংরা নর্তকিদের দিকে ঠেলে দেন এবং এতে করে রাজকোষের অবস্থা দ্রুত আরো খারাপ হতে থাকে। কিন্তু নিজ সন্তানদের এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে রাজমাতা রাণী বিলাসমনি শুধুমাতও একটাই উপায় খুঁজে বের করেন। আর সেটা হলো তাদেরকে শিক্ষিত করা। কারণ ইতিপূর্বে শিক্ষার গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, যার কারণে কুমারদেরকে লেখা পড়া শেখানোর জন্য তিনি মিস্টার হোয়াটন নামক একজন গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত করেন। কিন্তু কুমারদের অবস্থা বিশেষ আশাব্যঞ্জক ছিল না। তারা লেখা পড়ার থেকে আনন্দ ফূর্তি করতেই মূলত বেশি মজা পেতো। মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণও এর কোন ব্যতিক্রম ছিলেন না। হাতে জমিদারির প্রচুর টাকা আসত। সুতরাং রাজা ও রাজমাতার কোনো কথাই তারা কানে তুলত না।


১৯০৭ সালের জানুয়ারি মাসে বার্ধক্যজনিত কারণে রাণী বিলাসমণি মৃত্যু বরণ করেন। অতঃপর তিন কুমার সমান হিস্যায় ভাওয়াল এস্টেটের মালিকানা প্রাপ্ত হন। রাজমাতা রানী বিলাসমণির মৃত্যু হলে ভাওয়াল রাজপরিবারের প্রাসাদ. ষড়যন্ত্রের স্বীকারে পরিণত হয়। মেজো কুমারের উল্লেখযোগ্য কোনো গুণাবলি ছিল না। তিনি শিকারে যেতেন, টমটম হাঁকাতেন। চেহারা রাজাদের মতো হলে কী হবে, চালচলন, পোশাক-আশাকে তাকে রাজপরিবারের সদস্য বলে মনেই হতো না। অন্য দুই কুমারের মতো বেহায়াপনার সঙ্গে বাড়তি যা বলার ছিল তা হলো মেজো কুমার একটা কুৎসিত ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। ধীরে ধীরে মেজো কুমারের দেহে রোগ বাড়তে থাকলে সবাই বুঝতে পারেন ঢাকার চিকিৎসকরা রোগের সঠিক চিকিৎসা দিতে পারছেন না। সুতরাং কলকাতায় যাওয়া চাই।


বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথের হঠাৎ আবির্ভাব এবং মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের মৃত্যু রহস্যঃ- রাজমাতার মৃত্যুর পর পরই ১৯০৮ সালে রানী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাওয়াল রাজবাড়িতে প্রবেশ করেন। সত্যেন্দ্র রাজবাড়িতে এসেছিলেন মূলত শিলং এ ডেপুটির চাকরি নেবেন বলে। কিন্তু জমিদারি পরিচালনায় কুমারদের দুর্বলতা দেখে তিনি রাজবাড়িতে জেঁকে বসেন। এমনকি রাজবাড়িতে রানী বিভাবতীর চেয়েও বেশি প্রতাপে চলতেন তিনি। মেজো কুমারকে কলকাতায় চিকিৎসা করানোর জন্য যারা তার সঙ্গে গিয়েছিলেন. তাদের মাধ্যে বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথও ছিলেন। যদিও তার মা তাকে জয়দেবপুর থেকে উত্তরপাড়ার বাড়িতে যেতেই তাগাদা দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি মায়ের কথা কানেই তোলেননি।


তাছাড়া ছোট কুমার পরে যাবেন বলে রয়ে গেলেন। তবে বড় কুমার ও তার স্ত্রী, মেজো কুমার ও বিভাবতীর সঙ্গে গিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯০৯ সালে মেজোকুমার রামেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর কথিত মৃত্যুর পর এস্টেটের এক তৃতীয়াংশের মালিকানা চলে যায় তাঁর কথিত বিধবা স্ত্রী বিভাবতী দেবীর হাতে। বিভাবতী তাঁর ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ এর হাতে এস্টেটের এক তৃতীয়াংশের ভার ছেড়ে দিয়ে কোলকাতায় গিয়ে বিধবা বেশে জীবন যাপন করতে থাকেন। বড় কুমার রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি ১৯১২ সালে এবং ছোট কুমার রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি ১৯১৩ সালে উভয়ে নিঃসন্তান অবসস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। অবশ্য ছোট কুমারের স্ত্রী আনন্দ কুমারী দেবী পরবর্তীকালে কুমার রাম নারায়ণ রায় চৌধুরি নামক একজনকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

ভাওয়াল রাজ বংশের তিন কুমারের মৃত্যুর পর ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ সরকার ভাওয়াল রাজ এস্টেট পরিচালনার ভার কোর্ট অব ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৭৯ এর ৬ ধারার ক্ষমতা বলে গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন বলে ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটলেও, আইনগত জটিলতার কারণে ভাওয়াল এস্টেটের কিছু কিছু সম্পত্তি এখনও কোর্ট অব ওয়ার্ডস ভাওয়াল রাজ এস্টেট নামে, বাংলাদেশ সরকার ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমি সংস্কার বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনা করছেন।


চুড়ান্ত মৃত্যুর মুখোমুখি মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণঃ- ১৯০৯ সালের ১৮ এপ্রিল, চিকিৎসার প্রয়োজন এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য ২৪ বছরের মেজকুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি পারিবারিক সিদ্ধান্তে ভারতের দার্জিলিং-এ বেড়াতে যান। উক্ত সফরে তার সঙ্গী হন ২০ বছরের স্ত্রী (মেজরাণী) বিভাবতী দেবী, বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ আশুতোষ দাস গুপ্ত এবং ব্যক্তিগত কর্মচারি সহ প্রায় ২৭ জনের একটি দল। এবং দলবল নিয়ে ১৯০৯ সালের ২৫ এপ্রিল মেজকুমার দার্জিলিং গিয়ে পৌঁছান।

দার্জিলিং যাওয়ার মাত্র ১৫ দিন আগে মেজকুমার সালনা কাছারির কাছে জোলারপাড় জঙ্গলে বাঘ (রয়েল বেঙ্গল টাইগার) শিকার করে একটি ছবি তুলেছিলেন। এ ছবিটিই টাইগার ফটো নামে পরিচিত। এবং এই ছবিটাই উনবিংশ শতাব্দীর একটি অন্যতম ছবি হিসেবে বাংলাদেশ আর্কাইভস প্রদর্শণীতে স্থান পায়। কিন্তু দার্জেলিং পৌঁছানোর কিছুদিনের মধ্যেই মে মাসের ৫ তারিখের দিকে মেজো কুমার হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন।


মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ অসুস্থ হয়ে পড়লে আশু ডাক্তার পেট ফাঁপার অজুহাতে তাকে এক পুরিয়া ওষুধ দিয়েছিলেন। কিন্তু ৬ মে ১৯০৯ সালে রাত ৩টার দিকে মেজো কুমার আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবস্থা দেখে আশু ডাক্তার সে রাতে আর ওষুধ দেননি বরং পর দিন সিভিল সার্জনের কাছে আরও ভালো চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করেন। স্ত্রী বিভাবতী যথাসম্ভব স্বামীর কাছে থাকতে চাইলেও তার ভাই সত্যেন্দ্র চিকিৎসকদের পরামর্শ ক্রমে মেজো কুমারকে আলাদা ঘরে রাখেন। সিভিল সার্জন এক ধরনের তরল জাতীয় ওষধ মেজো কুমারকে খেতে দিয়েছিলেন। উক্ত চিকিৎসার পর থেকে মেজো কুমারের অবস্থা কখনো-সখনো ভালোর দিকে গেলেও, আসলে সেটা যে দিনকে দিন খারাপের দিকেই এগোচ্ছিল তা কেউই বুঝতে পারেনি।

৮ মে স্থানীয় ভিক্টোরিয়া হাসপাতালের ডাক্তার ক্যালভার্ট মেজো কুমারের যন্ত্রণা দেখে মরফিয়া ইনজেকশন দিতে চাইলেন, কিন্তু মেজো কুমার ইনজেকশান নিতে রাজি হননি। অবশ্য বিকালের দিকে মেজো কুমার ইনজেকশন নেন এবং এতে করে পেটের ব্যথা কমে যায়। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকবার বমি ও রক্তমিশ্রিত পায়খানা করার কারণে ভয়াবহ রকমের দুর্বল হয়ে পড়েন। মেজো কুমারের শারীরিক অবস্থা নিয়মিত দার্জিলিং থেকে টেলিগ্রাম করে রাজ বাড়িতে জানানো হচ্ছিল। রানী বিভাবতীর মামা, 'বিবি সরকার' নামে একজন ডাক্তার নিয়ে এসে মেজো কুমারের অবস্থা দেখে যান। তখন মেজো কুমারের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়, গা শীতল হয়ে গেছে। ডাক্তার সরকার মেজো কুমারকে মৃত বলে ঘোষণা করে গিয়েছিলেন বলে জানা গেলেও, স্ত্রী বিভাবতী সেটা পরবর্তীতে অস্বীকার করেন।


এদিকে মেজো কুমারের এই অসুস্থতা আরো দিনকে দিন বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রায় প্রতিদিনই দার্জিলিং থেকে জয়দেবপুর রাজ বাড়িতে তার বার্তার মাধ্যমে রাজার (মেজ কুমার) স্বাস্থ্যের খবর পাঠানো হতো। প্রথম টেলিগ্রামে রাজার ৯৯ ডিগ্রি জ্বর, পরের টেলিগ্রামে জ্বর বৃদ্ধি, পেটে যন্ত্রণা, দার্জিলিং সিভিল সার্জন দেখে গেছেন ইত্যাদি খবর আসতে থাকে। ৭ মে সন্ধ্যা থেকে কুমারের অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকে। কারণ ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও বমি, রক্ত মিশ্রিত পায়খানা ইত্যাদী হতে থাকে। এবং ৮ মে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে কোনো এক সময় মোজো কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যু হয়েছে, বলা হয়। কিন্তু রাজ কুমারের মৃত্যুর সাথে সাথে হঠাৎ করে এখানে একটি রহস্যের সৃষ্টি হয় যে, মেজো কুমার ঠিক কখন মারা গিয়েছিলেন? সন্ধ্যায়, নাকি মাঝরাতে? স্টপ অ্যাসাইড বাড়ির দারোয়ানসহ অনেকেই বলেছেন, মেজো কুমার সন্ধ্যায় মারা গিয়েছিলেন। অথচ মেজো রানী ও তার ভাই সত্যেন্দ্র সবসময় বলে এসেছেন মেজো কুমার মাঝরাতে মারা গিয়েছিলেন। তাছাড়া মোজো কুমারের মৃত্যুর সাথে সাথে আর বেশি দেরি না করে দার্জিলিংয়ের কোন এক শ্মশানে তড়িঘড়ি করে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। ১০ মে সকালে মেজো কুমারের মৃত্যুর খবর টেলিগ্রাম করে, সবাই দার্জিলিং ত্যাগ করে জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা করেন। ১১ মে মধ্যরাতে মেজো রানী বিভাবতী সহ অন্যান্যরা জয়দেবপুরে ফিরে আসেন। এবং যথারিতী রাজবাড়িতে তখন শোকের ছায়া নেমে পড়ে।


রাজা রমেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যু রহস্যের গুজব এবং পূনরায় মেজো কুমারের প্রাদূর্ভাবঃ- গতানুগতিকভাবে এ কাহিনী এখানেই শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু ভাওয়ালের এ রাজার জীবন-মৃত্যুর কাহিনীর এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেনি, বরং পরবর্তিতে তা আরো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। কারণ বিধাতা বোধ হয় মেজো কুমারের ভাগ্যলিপিতে এটাই লিখে রেখে ছিলেন। শ্রাদ্ধর দিনই গুঞ্জন ওঠে, যে মেজকুমারের দেহের সৎকার নাকি ঠিক-ঠাক ভাবে হয়নি। তাছাড়া ওই দিন শ্মশান ঘাটে মেজকুমারের লাশ নেওয়ার পর শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। এর মধ্যে লাশ ফেলে লোকজন শ্মশান ঘাট থেকে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু বৃষ্টির পর শ্মশানে গিয়ে তারা আর কোথাও লাশটি দেখতে পাননি। তারপরেও ঘটনার রহস্য বেশ কিছুদিন মাটি চাপা পড়ে ছিল। কেননা লাশ সৎকার করতে যারা এসেছিল, তাদের প্রায় প্রত্যেককেই মোটা অংকের টাকা খাইয়ে সমস্থ ঘটনাকে ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। যার ফলে সেদিন রাতে আসলে ঠিক কি ঘটেছিল তা চাপা পড়ে গেল চির কালের মত। কেউ জানতে পারলো না তা আর!

কিন্তু কোনোমতে গুজব এড়িয়ে শ্রাদ্ধ করা হলেও, আস্তে আস্তে গুজবটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে হিসাবের গোলমালে ভাওয়াল রাজ এস্টেটের ম্যানেজার মিঃ সেনের চাকরি তখন যায় যায়। সত্যেন্দ্র তার বোনকে নিয়ে ম্যানেজার সেনের সঙ্গে পরামর্শ করে, মিস্টার সেনের পরিবর্তে মিস্টার নিডহাম নামক এক নতুন ম্যানেজার নিয়োগ দিলে ষড়যন্ত্র আরও গভীরে গিয়ে ঠেকে। অবশ্য ততদিনে ষড়যন্ত্র ছাড়াই সত্যেন্দ্র রাজবাড়ির কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছিল। কারণ তিন বছরের ব্যবধানে ছোটকুমার ও বড় কুমার মারা গেলে রাজবাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়। রাজবাড়ির তিন রানীই ছিলেন সন্তানহীনা এবং তারা সবাই কলকাতায় পাড়ি জমান। ভাওয়াল রাজ এস্টেটের অবস্থা তখন খুবই করুণ, রাজকোষে যা ছিল ষড়যন্ত্রকারীরা তার সবই ইতোমধ্যে লুটে-পুটে নিয়েছে।


এদিকে ভাওয়াল এস্টেটের অবস্থা যতই দুর্বল হচ্ছিল, মেজো কুমার জীবিত আছেন এবং তিনি একদিন ফিরে আসবেন এ গুজব ততই শক্তিশালী হচ্ছিল। ঠিক তার চারমাস পরে হঠাৎ করে রাজবাড়ির ভেতরে মাধববাড়িতে একজন মৌনসন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। আর তখনই শুরু হয় নতুন উত্তেজনা। চারদিকে খবর রটে যায় ভাওয়াল রাজ মেজো কুমার ফিরে এসেছেন। জনসাধারণ, প্রজা, ভাওয়াল এস্টেটের কর্মচারীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে সন্ন্যাসীকে দেখতে। এছাড়া ১৯২১ সালে ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধের কাছে এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাবের বক্তব্য পাওয়া যায়। জটাচুল, ঘন দাড়ি, সারা গা ভস্মাচ্ছাদিত সন্ন্যাসীর সামনে ধুনি জ্বলছে। রাস্তার লোকেরা তাকে ফিরে ফিরে দেখে যেত। লোকেরা তার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলত। পরিচয় জানতে চাইলে সন্ন্যাসী বলতেন, আত্দ পরিচয় দিতে গুরুর নিষেধ আছে। তবে কেউ কেউ তখনই সন্ন্যাসীকে ভাওয়াল রাজা বলে সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন।


ঢাকার রুপলাল রায়ের বাড়িটা ছিল তৎকালিন সময়ের একটা দ্রষ্টব্য স্থান। সেই রুপ বাবুর বাড়ির সামনেই স্থান নিলেন সন্যাসী। রোদ বৃষ্টির মাঝে তিনি সব সময় সেখানে বসে থাকতেন। তার বেশ ভূষা এবং আচার ব্যবহারের জন্য তিনি খুব দ্রুত অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। অনেকদিন পর আদালতে স্বাক্ষ্য দেওয়ার সময় একজন যেমন বললেন, 'এমন সুন্দর সুশ্রী জটাধারী সন্যাসী ঢাকায় আগে কখনো দেখেছি বলে তো মনে হয় না।' প্রয়শই এই সাধুকে ঘিরে একটা ছোট খাটো ভিড় জমে যেত। ওষধ চাইলে তিনি মাদুলি তাবিজের বদলে তার শরীর থেকে এক চিমটি ছাই তুলে দিতেন। সাধুর ঢাকায় আসার প্রায় চার মাস পরে ভাওয়াল রাজ পরিবার থেকে প্রথম তাকে দেখতে যায় কুমারদের বোন জ্যোতিমর্য়ীর ছেলে বুদ্ধু। জয়দেব পুরের পাশের গ্রাম কাশিমপুরের কয়েকজন ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধু সন্যাসীকে দেখে আসার পরেও কিন্তু নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারলো না। সন্যাসীর সঙ্গে মেজো কুমরের মিল ছিল ঠিকই, কিন্তু এই সাধুই যে তার মেজো মামা মৃত্যুর দ্বার থেকে জীবন্ত ফিরে এসেছে; এমন কথা বুদ্ধু জোর গলায় বলতে পারলো না।


কাশিমপুরের লোকজন তখন স্থির করলেন সন্যাসীকে একদিন স্ব-শরীরের ভাওয়ালে নিয়ে আসতে হবে। ১৯২১ সালের ৫ এপ্রিল কাশিমপুরের অতুল প্রসাদ রায় চৌধুরি সন্ন্যাসীকে রাজবাড়িতে নিয়ে আসেন। মাধববাড়িতে ছাইমাখা সন্ন্যাসীর আগমন সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে প্রজাদের মাঝে নতুন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ঢাকা থেকে বাঁধিয়ে আনা অন্য কুমারদের ছবিগুলো সন্ন্যাসীকে দেখতে দেওয়া হলে, সেটা দেখে সন্ন্যাসী কাঁদতে আরম্ভ করেন। তার কান্না দেখে রাজ কন্যা জ্যোতির্ময়ী দেবীও কেঁদে ফেলেন। পরে অষ্টমী স্নান উপলক্ষে সন্ন্যাসী আবার ঢাকায় ফিরে যান। কিন্তু ৩০ শে এপ্রিল সন্ন্যাসী চন্দ্রনাথ আর সীতাকুণ্ড থেকে আবার জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে ফিরে আসেন। তার দুদিন বাদে চিলাইখালে সন্ন্যাসী স্নান করতে গেলে জ্যোতির্ময়ী দেবী সন্ন্যাসীর গায়ে মেজো কুমারের বিশেষ দাগগুলো দেখতে পান।

মূলত সন্যাসীকে কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ হিসাবে মানুষের কাছে পরিচিত লাভ করানোর ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন তার বোন জ্যোতির্ময়ী দেবী। তাছাড়া ইতোমধ্যে সন্ন্যাসীর আচরণ, কথন, চাহনি, গায়ের প্রকৃত রং, চেহারা ইত্যাদি মেজো কুমারের সঙ্গে বিশেষ মিল থাকায়, সন্ন্যাসীকে কথিত মৃত মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ বলেই বেশি সন্দেহ করা হয়েছিল। তাছাড়া তার গায়ের কাঁটা দাগ ও কয়েকটি জন্মগত দাগ হুবহু মিলে যাওয়ায় জ্যোতির্ময়ী দেবী সরাসরি সন্ন্যাসীর পরিচয় প্রকাশ করতে ব্যাপক চাপ দেন। এবং তিনিই প্রথম মেনে নেনযে এই সন্যাসীই তার হারানো ভাই কথিত মৃত মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ। বোন জ্যোতির্ময়ী দেবীর এই সন্দেহ ক্রমে ক্রমে ভাওয়াল পরগনার হাজারো প্রজার মনের প্রশ্ন হয়ে সন্ন্যাসীর সামনে এসে দাঁড়ায়।


রাজপরিবারের সদস্য এবং প্রজারা সন্ন্যাসীর উত্তরের জন্য রাজবাড়িতে ভিড় করতে থাকে। তাছাড়া সারা জয়দেবপুরে রটে যায় এ খবর। সেদিন সকালেই হাজারো প্রজার সামনে জ্যোতির্ময়ী দেবী সন্ন্যাসীকে বলেন, "তোমার চেহারা আর শরীরের চিহ্নগুলো আমার মেজো ভাইয়ের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। তুমিই আমার নিরুদ্দিষ্ট মেজো কুমার। তোমার পরিচয় প্রকাশ কর।"

এছাড়াও তিনি এমন শর্তও প্রয়োগ করেন যে, উক্ত সন্যাসী যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে মেজো কুমার বলে স্বীকার না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি জল স্পর্শ করবেন না। উপস্থিত জনতাও তখন অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল সন্ন্যাসী কী জবাব দেন সেটা জানার জন্য। কিন্তু সন্ন্যাসী তখনই কোনো জবাব দেননি। তারপর ইচ্ছাতেই হোক অথবা অনিশ্চাতেই হোক, শেষ বিকালের দিকে জনতার কৌতূহলের অবসান ঘটিয়ে সন্ন্যাসী বলতে শুরু করেন, 'আমার নাম রমেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী।'

উৎসুক জনতার মাঝ থেকে প্রশ্ন আসে তোমার মায়ের নাম কী? সন্ন্যাসী জবাব দেন, রানী বিলাসমণি। আবারও প্রশ্ন আসে আপনাকে যে মানুষ করেছিল সেই দাইয়ের নাম কী? মৃদু কম্পমান গলায় সন্ন্যাসী উত্তর করেন, অলকা। তারপর ধাত্রী মায়ের নাম বলেই সন্ন্যাসী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান।


ধাত্রী মায়ের নাম সঠিকভাবে উত্তর করার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত জনতা উলুধ্বনি ও জয়ধ্বনি করে ওঠে। রাজবাড়ি মুহুর্মুহু কেঁপে ওঠে সমবেত জনতার জয়ধ্বনিতে। প্রজারা বলাবলি করতে শুরু করে, তিনিই প্রকৃত মেজো কুমার। এস্টেট যদি তাকে কুমার বলে গ্রহণ না করে তবুও প্রজারা তাকে মেজো কুমার বলেই গ্রহণ করবে। তার সঙ্গে কুমারের মতোই আচরণ করবে। অনেকে তখনই কুমারকে নজরানা দিতে শুরু করে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইংলিসম্যান কাগজে ৭ মে 'ঢাকার সেনসেশন' শিরোনামে সন্ন্যাসী নিজেকে ভাওয়াল রাজা মেজো কুমার বলে দাবি করেছেন বলে একটি খবর প্রচার করে। জ্যোতির্ময়ী দেবীর পাশাপাশি রানী সত্যভামা দেবীও যখন সন্ন্যাসীকে মেজো কুমার বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, স্ত্রী বিভাবতী তখন পর্যন্ত সন্ন্যাসীর কোনো খোঁজ-খবরই নেননি। জ্যোতির্ময়ী দেবী সন্ন্যাসীর কাছ থেকে তার গুরুর নাম জেনেছিলেন, ধরম দাস। পরবর্তিতে ধরম দাসকে খুঁজে সন্ন্যাসীর ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে, তারা সন্ন্যাসীর পক্ষেই কথা বলেছিলেন। কিন্তু পুলিশের ভয়ে ধরম দাস দ্রুতই ঢাকা ত্যাগ করে। তবে পরবর্তীতে ধরম দাস ও তার দলের অন্য সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে সবিস্তারে তাদের সাক্ষ্য পাওয়া গিয়েছিল।


তারপর ১৯২১ সালের ১৫ মে রাজবাড়ির সামনের খোলা ময়দানে এক বিশাল প্রজা সমাবেশের আয়োজন করা হয়। জয়দেবপুর রাজবাড়ির সামনের ময়দানে সেদিন ভোরের দিক থেকে জয়দেবপুর গামী মানুষের ঢল নামতে শুরু করলো। ঢাকা আর ময়মনসিংহ জেলার হাজার হাজার লোক সেই সমাবেশে এসেছিল। সেদিন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক রেল কোম্পানির স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করা হলেও, নানা স্থান থেকে উৎসুক জনতা আরো বিভিন্ন মাধ্যমে করে জয়দেবপুরের দিকে রওয়ানা হতে থাকে। এবং দুপুরের মধ্যে লোক সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১০,০০০ হাজারেরও বেশিতে গিয়ে উপনিত হয়। উক্ত প্রজা সমাবেশে স্থানীয় জমিদার আদিনাথ চক্রবর্তি কুমারের ফিরে আসা এবং সনাক্ত করণের ঘটনা গুলি স্ব-বিস্তার বর্ননা করেন। আদিনাথ চক্রবর্তি সমাবেশে উপস্থিত সবার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দেন- 'কে কে বিশ্বাস করেন, এই সন্যাসিই কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ?'


হাজার হাজার মানুষ হাত উঠিয়ে তাদের সম্মতি জানায়। আর অন্যদিকে বিপক্ষে একটাও হাত ওঠেনি। ওদিকে কুমার রমেন্দ্র নারায়নের নামে খবরের কাগজে বিভিন্ন ভুয়া প্রজ্ঞাপন জারি হতে থাকে। খবর জানা-জানি হলে প্রজারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। গোলমালে ঝুমুরানী নামে এক প্রজাও মারা যায়। ব্যাপারটা তখন শুধু আর সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে রইলো না। গোলমালে প্রজারা ক্ষেপে যায় এবং এক পর্যায়ে ইংরেজ সরকারকে খাজনা দেওয়াও বন্ধ করে দেয়। আর এদিকে সন্যাসী তখন বোন জ্যোতিমর্য়ী দেবির বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। এরই মাঝে রাণী সত্যভামা দেবি কলকাতা থেকে ঢাকায় জ্যোতিমর্য়ীদেবির বাসায় এসে সন্যাসীকে দেখে মতামত দেন যে, সন্যাসীই কথিত মৃত মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়। এমনকি সেই সময় রানী সত্যভামা দেবী মেজো কুমারের স্ত্রী বিভাবতীকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু রানী বিভাবতী সে চিঠি গ্রহণ করেননি এবং নিজে সন্ন্যাসীর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহও দেখাননি।


মেঝো কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণকে ঘিরে সৃষ্ট সেই বিখ্যাত মামলার ইতিহাসঃ- ভাওয়াল রাজ কুমার রমেন্দ্র নারায়ণকে ঘিরে যে ঐতিহাসিক ট্রাজেডি গড়ে উঠেছিল, আসলেই সেটা বেশ ইন্টারেস্টিং। সত্যভামা দেবী মারা গেলে সন্ন্যাসী ১৯২৪ সালে কলকাতায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তার সঙ্গে জ্যোতির্ময়ী দেবীও থাকতেন। এরই মাঝে একবার কলকাতায় এসে বড় রানী সূর্যবালা দেবীর সঙ্গে সন্ন্যাসীর দেখা হয় এবং বড় রানীও তাকে মেজো কুমার বলে গ্রহণ করে নেন। কিন্তু তার পরেও প্রাসাদের মধ্যে কয়েকজন সন্ন্যাসীকে কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ বলে তখনও স্বীকার করে নেননি। তবে নিজ স্ত্রী বিভাবতী, তার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ এবং আশুতোষ ডাক্তার সহ মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারী ছাড়া আর প্রায় সবাই সন্ন্যাসীকে মেজো কুমার বলে গ্রহণ করেছিলেন। ষড়যন্ত্র কারিদের দাবি ছিল, এই সন্যাসী কোন ভাবেই মেজো কুমার হতেই পারেন না।

তবে উক্ত সন্ন্যাসীকে রাজ কুমার হিসাবে তাদের মেনে না নেওয়ার কারণ হিসাবে দেখানো হয়, সত্যেন্দ্র নাথ ইতোমধ্যে মেজকুমারের জীবন বীমার ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে ফেলেছেন। এ ছাড়া মেজকুমারের স্ত্রী হিসাবে বিভাবতী জমিদারির পক্ষ থেকে বাৎসরিক লক্ষাধিক টাকার যে ভাতা পেতেন, তার পুরোটাই গ্রহণ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাই মেজকুমারের ফেরা সত্যেন্দ্র'র জন্য ছিল একটা অশনি সংকেত। তাছাড়া ভাইয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়াটা বিভাবতীর জন্য অসম্ভব ছিল। এর কিছুটা আভাসও পাওয়া যায় বিভাবতীর কথায়। মেজকুমারের কথিত মৃত্যুর তিনদিন পর ১১ মে মেজরাণীকে নিয়ে সত্যবাবু জয়দেবপুর পৌঁছান। এরপর সত্যবাবু একবার বোনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে বিভাবতী মুখ ফিরিয়ে বলে ওঠেন, "দাদা তুমি আমারে রাণী করেছিলে, আবার তুমিই আমাকে ভিখারিণী করলে।"


এর পরপরই গুজব ছড়াতে থাকে রাণী বিভাবতীর সাথে আশু ডাক্তারের পরক্রিয়া সম্পর্কিত। অনেকে ধারনা করেন যে আশুতোষ ডাক্তারই বিষ খাইয়ে মেজো কুমারকে হত্যা করেন এবং রানীর ভাই সত্যেন্দ্র ছিলেন এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা। আশু ডাক্তার এবং রাণী বিভাবতীর গুজব তখন মানুষের মুখে মুখে। সবাই ভাবতে শুরু করে, যে রাণী বিভাবতী আসলেই ভিতরে ভিতরে ডাক্তার আশুতোষ এর সাথে প্রেম করেছিলেন। রাজ প্রাসাদের সামনের যে পুকুরটা এখন নোংরা আর কচুরিপনায় ঢাকা আছে, তারই ধারে ছিল ডাক্তারের বাড়ি। প্রতিদিন সকালে ডাক্তার এসে দাঁড়াতেন সেই বাড়ির ছাদে। আর রাণী এসে দাঁড়াতেন রাজ বিলাসের উপরের বারান্দায়। তারপর দু'জনের মধ্যে তখন চলতো ভালবাসার সংকেত বিনিময়। রাণী বিভাবতী ছিলেন তৎকালিন সময়ের সেরা সুন্দরীদের মধ্যে একজন। ঘাড়ে ছাঁটা চুলে যখন তিনি আলতো পায়ে রাজ উদ্দ্যানের মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন, তখন মনে হতো যেন কোন পরী বুঝি আসমান থেকে নেমে এসে রাজ উদ্দ্যান আলোকিত করে রেখেছে। আর ডাক্তার আশুতোষ যখন এমন একটা পরীকে নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও পাচ্ছিলেন না, তখনতো তার দ্বারা পৃথিবীর সকল অঘটনই ঘটানো সম্ভব! তাছাড়া আরও বলা হয়, সত্যেন্দ্র এবং আশু ডাক্তার সম্পত্তির লোভেই তারা দু'জনে এক সঙ্গে ফন্দি এটে কুমারকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে।

১৯২৬ সালের ৮ ডিসেম্বর সন্ন্যাসী বোর্ড অব রেভিনিউর কাছে দাবি করেন, তার পরিচয় তদন্ত করার জন্য। কিন্তু বোর্ড সে দাবি অগ্রাহ্য করে। ১৯২৯ সালে সন্ন্যাসী ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ১৯৩০ সালের ২৪ এপ্রিল নিজেকে মৃত রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ বলে দাবি করে এবং ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারি চেয়ে বিভাবতী দেবি, তার ভাই সত্যেন্দ্র নাথ এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দ্বায়ের করেন। এবং এই মামলার বিচার কার্য শুরু হয় ১৯৩৩ সালের নভেম্বরের ৩০ তারিখে।


বাদি পক্ষ এবং বিবাদী পক্ষের উকিলরা ছিলেন পুরো পুরি দুই মেরুর। বাদী অর্থাৎ সন্যাসীর পক্ষের উকিল ছিলেন জাতীয়তাবাদি উকিল 'বিজয় চন্দ্র', অন্যদিকে বিবাদী পক্ষের উকিল 'অমিয় নাথ চৌধুরি' ছিলেন ইংরেজদের বিশেষ আস্তা ভাজন। এছাড়াও উক্ত মামলায় প্রধান বিবাদী হিসাবে ছিলেন রাণী বিভাবতী দেবী, তবে মূলত কলকাঠি নেড়েছিলেন তার ভাই সত্যেন্দ্র নাথ এবং আশু ডাক্তার। ফলে এটা অনেকটা যুদ্ধের মত পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ালো। জেলা জর্জ 'অ্যালান হেন্ডারসন' বিচারপতি 'পান্না লাল বসু'কে এই মামলার বিচারক পদে নিয়োগ করেন। পান্না লাল বসুর কোর্টে মেজো কুমার অসুস্থাবস্থায় দার্জেলিং-এ অবস্থান কালে তার চিকিৎসার কাজে যে সিভিল সার্জেন যুক্ত ছিলেন সেই 'জেসি কার্লভাট, ভাওয়ালের বড় রানী সূর্যবালা দেবী' এবং কুমারের তথাকথিত মৃত্যুর সময়ে দার্জেলিংয়ে উপস্থিক কলকাতার ডাক্তার 'প্রণোনাথ কৃষ্ণ আচার্য' এই তিনজনের স্বাক্ষ্য নিয়েই শুরু হয় মামলা।

ডাক্তার আচার্য তার স্বাক্ষ্যে বলেন যে, 'তার দিব্যি মনে আছে দার্জেলিংয়ে ১৯০৯ সালের মে মাসের কোন এক সকালে একজন নার্স এসে তাকে ডেকে তোলেন এবং বলেন যে দ্বিতীয় কুমার মারা গেছেন বলে ভয় হচ্ছে। তিনি গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন যে, ঘটনা আসলে তাই কিনা। সকাল ৬ টার সময় ডাক্তার স্টেপ অ্যাসাইডে গিয়ে পৌঁছান। এবং দেখেন এক ব্যক্তি খাটিয়ায় শুয়ে আছে। যার মাথা থেকে পা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। পরীক্ষার জন্য তিনি চাদরটা সরাতে যাবেন, ঠিক তখনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন বলে উঠেন যে, তিনি ব্রাহ্মন সুতরাং মৃতদেহ ছোঁয়ার অধিকার তার নেই। ডাক্তার আচার্য ভয়ানক ক্ষুদ্ধ হন এই কথায় এবং সেই সাথে সাথে তিনি উক্ত বাড়ি ত্যাগ করে চলে আসেন। অর্থাৎ দেহ তিনি দেখতেই পাননি।'


প্রতিবাদী পক্ষের উকিলের সওয়াল জবাবে ডাক্তার জানান যে, 'তার চল্লিশ বছরের এই ডাক্তারি জীবনে ধর্মের জন্য কোন জীবিত বা মৃতদেহ ছুঁতে কেউ কোন দিনই নিষেধ করেননি বা বাধা দেননি। এমনকি তিনি এও বলেন, যে সেদিন যদি তাকে মৃতদেহ পরীক্ষা করতে দেওয়া হতো, তাহলে তিনি নিশ্চই বলতে পারতেন উক্ত ব্যক্তির সত্যিই মৃত্যু হয়েছিল কি না।'

উক্ত মামলায় বিজয় চন্দ্র চক্রবর্তি সন্ন্যাসীর পক্ষে প্রধান উকিল হিসাবে কাজ করেন। এবং বিভাবতীর পক্ষে অমিয় নাথ চৌধুরি প্রধান উকিল হিসাবে কাজ করেন। বিচার শুরু হয় ১৯৩৩ সালের নভেম্বরের ৩০ তারিখ। বিবাদী পক্ষে আরো ছিল কোর্ট অব ওয়ার্ডস, যা বিভাবতী দেবি ও অন্য দুই কুমারের বিধবা স্ত্রীদের প্রতিনীধি হিসাবে কাজ করছিল। বিবাদী পক্ষের আইনজীবিরা প্রমান করার চেষ্টা করেন যে, এই নিরক্ষর সন্যাসী কোন মতেই ব্রাহ্মন বর্নের হতে পারে না। কিন্তু বাদী পক্ষের আইনজীবিরা প্রমান করে দেখান যে, কুমার রমেন্দ্র নারায়ণও প্রায় নিরক্ষর ছিল। বিবাদী পক্ষ থেকে আরো দাবী করা হয়, কুমারের রক্ষীতা এলোকেশির কাহিনী পুরোপুরি মিথ্যা। কিন্তু বাদী পক্ষ এলোকেশিকেও আদালতে হাজির করে। জেরার জবাবে এলোকেশি জানান, 'পুলিশ তাকে ঘুষ দিয়ে স্বাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছিল।' বিবাদী পক্ষ আরো দাবী করে, কুমারের সিফিলস স্ট্রোক শেষ পর্যায়ে পৌছে যাওয়ায় তার গায়ে দগদগে ঘা ও ক্ষত থাকার কথা। কিন্তু কথিত সন্যাসীর গায়ে তার কোন প্রমান নেই। সন্যাসী মূলত উর্দূ ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু সন্যাসী দাবি করেন যে, ভ্রমন করতে করতে তিনি বাংলা ভুলে গেছেন। কুমারের চোখের রং নিয়েও বিতর্ক ওঠে। এটাও দাবী করা হয় যে, সেদিন শশ্মানে কুমারের চিতায় সম্ভাবত অন্যকারো দেহ দাহো করা হয়েছিল।


প্রায় চার বছর পর এ ঐতিহাসিক মামলাটির শুনানি শুরু হয়। এমনকি দেশের বাইরে বিলেতেও এর কমিশন গঠন করা হয়েছিল। আদালতে মোট ১০৬৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছিল, এর মাঝে ৯৬৭ জন সন্ন্যাসীকে মেজো কুমার বলে সাক্ষী দিয়েছিল। কুমারের নিকটাত্মীয়দের প্রায় সবাই সাক্ষী দেন, যে সন্ন্যাসীই প্রয়াত মেজো কুমার। এমনকি মেজো রানী বিভাবতীর আত্মীয়দের মধ্যেও অনেকেই সন্ন্যাসীর পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিলেন। এমনকি আদালত থেকে জ্যোতিমর্য়ী দেবিকেও স্বাক্ষ্য হিসাবে কাঠ গড়ায় দাঁড় করান। মূলত জ্যোতিমর্য়ীদেবি কুমারের পক্ষে ছিলেন। এবং তিনি দাবি করেন যে, এই সন্ন্যাসীই তার ভাই মেজো কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ। তিনি আরো দাবি করেন যে, সন্ন্যাসীর চেহারায় তাদের বংশের ছাপ রয়েছে এবং সন্ন্যাসী বাংলা বলতে পারেন। বাদি পক্ষ কুমারের স্ত্রী বিভাবতীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বিভাবতী কুমারের চেহারার সাথে সন্ন্যাসীর চেহারার কোন মিল নেই বলে দাবি করেন। কুমারের অন্য ভাইদের বিধবা স্ত্রী অন্যদা দেবি দাবী করেন, কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ ইংরেজি বলতে পারতেন, এবং বাংলা বলতে ও লিখতে পারতেন। যার কোনটাই সন্যাসী পারে না। এবং তার প্রমাণ সরুপ তারা আদালতে কিছু চিঠি বা কাগজ পত্র দাখিল করেন। কিন্তু কুমারের ভাষাজ্ঞানের প্রমান সরুপ পেশ করা সেই চিঠি গুলো অবশ্য পরবর্তিতে ভূয়া বা জাল বলে প্রমানিত হয়।


ভাওয়াল রাজ পরিবারের সদস্য শ্রীমতি রত্না চ্যাটার্জীর স্বাক্ষ্যঃ- উক্ত মামলায় ভাওয়াল রাজ পরিবার এবং আশে পাশের এলাকা থেকে বহু স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। যার মধ্যে অন্যতম স্বাক্ষী হিসাবে পরিগণিত ছিলেন, ভাওয়াল রাজ পরিবারের সদস্য শ্রীমতি রত্না চ্যাটার্জী। শ্রীমতি রত্না চ্যাটার্জীর ভাষ্য মতে জানা যায়, মেজোরানী বিভাবতী ছিলেন স্বৈরীনি। পারিবারিক ডাক্তার আশুতোষ দাশ গুপ্তের সাথে ছিল মেজোরানীর অবৈধ সম্পর্ক। তাছাড়া রাণী বিভাবতী সন্তান লাভের বাসনায় ডাক্তার আশুতোষের সাথে বিবাহ বহির্ভূত অবৈধ মিলনে লিপ্ত হন। যার ফলে আশু ডাক্তারের অবৈধ সন্তান বিভাবতীর গর্ভে চলে আসে। কেননা মেজোকুমার ছিলেন শারিরীকভাবে সন্তান দানে সম্পূর্ণ অক্ষম। কারন অ-সংযম যৌনাচারে কিছু দিন আগেই তিনি সিফিলিসে আক্রান্ত ছিলেন। পরে ব্যাপারটা রাজ বাড়িতে জানা-জানি হয়ে গেলে মেজোকুমার যখন বড় রানী সরযুবালা ও ছোট রানী আনন্দকুমারীর প্ররোচনায় বিভাবতী কে শাস্তি দিতে উদ্যত হলেন, ঠিক তখনই তিনি মেজোরানী ও আশু ডাক্তারের ফাঁদে পড়ে দার্জিলিং যান চিকিৎসার জন্য। উল্লেখ্য যে দার্জিলিং চিকিৎসা চলাকালিন সময়ে বিভাবতী তার স্বামী মেজোকুমারকে আরো বেশি করে দূর্বল এভং অসুস্থ্য করার জন্য তকে স্বল্পমাত্রায় বিষ প্রয়োগ করতো।


এর পর ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সন্ন্যাসী নিজেই স্বাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হন। সন্ন্যাসী তার নিজের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের যে সাফাই পেশ করেন, সেটা ছিল অনেকটা এই রকমঃ-

- সেই রাতে আমি আশু ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি। পরের দিন এক ডাক্তার সাহেব আসেন। আমার পেট ফাঁপত। আশু ডাক্তার সেদিন ওষধু দেওয়ার পর আমি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু পর দিন আবারও যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছিলাম। আশু ডাক্তার কাচের গ্লাসে আমাকে কী একটা ওষুধ খেতে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ওষধে কোনই কাজ হচ্ছিল না। পর দিন শরীর আরও খারাপের দিকে গেল। এবং আমি যে ক্রমশ্য দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম, সেটা খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছিলাম। তিনদিনের দিন আমি আরো বেশি দূর্বল হয়ে পড়ি। এবং আশু ডাক্তার আমাকে আবারও সেই একই ওষধ খেতে দেন। কিন্তু তাতে কোনই লাভ হয়নি। সেই রাতে আনুমানিক আটটা থেকে নয়টার মধ্যে আশু ডাক্তার আমাকে গ্লাসে করে কি একটা ওষধ দিলেন। তাতেও কিছু হয় না। কিন্তু সেটা খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমার বুকের মধ্যে জ্বালা করতে লাগল, বমি হলো, এবং সারা শরীর ছটফট করতে লাগল। ওষধ খাওয়ার প্রায় তিন চার ঘন্টা পর থেকে এসবই আরম্ভ হয়েছিল। যন্ত্রনায় আমি তখন চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু সেই রাতে কোন ডাক্তার এলো না। এভাবে কিছুক্ষন চলার পরে এবার শুরু হলো রক্ত পায়খানা। খুব দূর্বল হয়ে পড়ছিলাম আমি। তারপর একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ি। যখন চোখ মেলি, দেখি পাশে চারজন সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানতে চেয়েছিলাম, আমি কোথায়? তারা ইশারায় ও মৃদু স্বরে আমাকে হিন্দিতে জবাব দিয়েছিলেন, কথা না বলতে। সুস্থ হয়ে উঠলে আমি সন্ন্যাসীদের সঙ্গে হেঁটে ও ট্রেনে চেপে বহু দেশ-বিদেশ ঘুরতে থাকি। তখন আমার স্মৃতি শক্তি একদমই হারিয়ে যায়। আমি আমার অতীতকে ভুলে যাই। তবে আমি মাঝেমধ্যেই আমার গুরুকে জিজ্ঞেস করতাম, বাড়ি ফেরার কথা বলতাম। গুরু জবাব দিতেন, সময় হলেই যাবি। আমি এভাবে বহু বছর এদেশ-ওদেশ বেড়িয়ে নেপালে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখান থেকে তিব্বত। কিন্তু তিব্বত থেকে আবার নেপালে ফিরে আসার পথে গুরু বললেন, তোর বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। আমি গৌহাটি থেকে ট্রেনে চেপে ফুলছড়ি হয়ে ঢাকা আসি। বাকল্যান্ড বাঁধের কাছে আমি বসে থাকতাম। অনেকেই আমাকে ভাওয়াল রাজা বলে ভিড় জমাত। আমি জয়দেবপুরে হাতির পিঠে চেপে ফিরে আসি।


সেই শুরু। এরপরে প্রায় ১৬ বছর ধরে চলল এই মামলা। বিভিন্ন ধরনের জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে রায় গেল সন্ন্যাসীর পক্ষে। এমনকি আরো অনেক আদালত থেকেও এই মামলার রায় সন্ন্যাসীর পক্ষেই আসলো। কিন্তু বিবাদী পক্ষ না দমে মামলা চালাতেই লাগলো। বিভাবতীকে জেরা করার ক্ষেত্রে তিনি সব সময় প্রায় একই কথা বলেছিলেন। বাদি পক্ষের ব্যারিষ্টার কোন জেরাতেই তাকে টলাতে পারছিলেন না। বাদি পক্ষের ব্যারিষ্টার কর্তৃক জেরা গুলো ছিল অনেকটা এই রকমঃ-

বাদি পক্ষের ব্যারিষ্টারঃ- এটা আপনি নিশ্চই জানেন যে, বাদী পক্ষের দাবি তাকে দার্জেলিং-এ খাবারের সাথে আর্সেনিক খাওয়ানো হয়েছিল?
বিভাবতীর নরম কণ্ঠের উত্তরঃ- হ্যাঁ!
- আর আপনি বললেন যে মেজো কুমারের পিত্তশূল বেদনা খুব বেড়েছিল, এবং ইনজেকশনে তার বেদনা কমেছিল। কিন্তু কুমার যে মারা যাবে, সেটা আপনি বা ডাক্তাররা বুঝতে পেরেছিলেন কি?
- আমার কাছে মৃত্যু অপ্রত্যাসিত ছিল।
- আমি কিন্তু একথা বলছি না যে, আপনি নিজ হাতে কুমারকে বিষ দিয়েছিলেন বা বিষ খাওয়ানোর কথা জানতেন? সুতরাং আমার প্রশ্নের উত্তর গুলো খুব ধীর স্থির ভাবে ভেবে চিন্তে উত্তর দেবেন! আচ্ছা আপনি কি জানেন যে, পিত্তশূলের ব্যাথাতে মৃত্যু খুবই বিরল?
- হ্যাঁ জানি।
- আচ্ছা আপনি নিশ্চই জানেন যে, পিত্তশূলে রক্ত পায়খানা হয় না। কিন্তু অপরদিকে আর্সেনিক খাওয়ালে রক্ত পায়খানা হয়। এখন আপনি বুঝতে পারছেন কি, যে আপনার স্বামীকে আর্সেনিক খাওয়ানো হয়েছিল?
- কি করে বুঝবো? আমি কি ডাক্তার?
- আপনি নিজে কখনো গভীর ভাবে ভেবে দেখেছেন, সত্যিই আপনার স্বামীকে আর্সেনিক খাওয়ানো হয়েছিল কিনা?
- আমি জানি ওটা মিথ্যে কথা।
- আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো না কিন্তু?
- আমার অত ভাববার দরকার নেই। কারণ ঐ কথা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। আর্সেনিকে কি হয় না হয় তা আমি আগেও জানতাম না। আর এখনও জানি না।
- আপনি বোধ হয় আজও পর্যন্ত এটা জানেন না যে আশু ডাক্তারের সই করা একটি প্রেসক্রিপশন পাওয়া যাচ্ছে। তাতে কিন্তু আর্সেনিক ছিল?
- না। আমি ঐ সম্পর্কিত বিষয়ে কিছুই জানি না।
- আচ্ছা আপনার স্বামীর মৃত্যুর পর আপনার লাভ হয়েছে না ক্ষতি হয়েছে একটু বলবেন কি?
- কোন স্ত্রীই তার স্বামীর মৃত্যু কামনা করতে পারে না। সুতরাং আমিও পারি না!
- কিন্তু গুজব আছে, আপনার আর আশু ডাক্তারের মধ্যে নাকি একটা পরক্রিয়া সম্পর্ক চলছিল? উক্ত গুজব সম্পর্কে আপনি কি বলবেন? কিংবা গুজবটা যদি সত্যিই হয়, তাহলে তো দেখা যায় কুমারের মৃত্যুতে আপনার লাভই ছিল?
- আমি গুজবে বিশ্বাস করি না। তাছাড়া ডাক্তার বাবুর সাথে আমার কোন ধরনের সম্পর্ক নেই।


বাদি পক্ষের ব্যারিষ্টার কর্তৃক এমন হাজারও প্রশ্ন বিভাবতীকে করা হলেও, শেষ পর্যন্ত তাকে একচুলও টলানো সম্ভব হয়নি। পরবর্তিতে সন্ন্যাসীর গুরুকেও এই মামলায় খবর দিয়ে নিয়ে আসা হয়। তিনি কিভাবে সন্ন্যাসীকে কুড়িয়ে পেলেন এবং কিভাবে তাকে শিষ্য করে গড়ে তুললেন। এবং কিভাবে তাকে আবার তার দেশে ফেরত পাঠালেন তার সবিস্তার বিবরন দিলেন। এভাবে উভয় পক্ষের সমাপনী যুক্তি চলে প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে। এবং সঙ্গত কারণে মামলার রায় দেওয়ার পূর্বে শুনানী মুলতবি করা হয় ১৯৩৬ সালের ২০ এপ্রিলে। বিচারক পান্নালাল বসু তিনমাস ধরে এই বিচারের রায় নিয়ে চুড়ান্ত কাজ করেন। তারপর ১৯৩৬ সালের আগষ্টে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ রায় প্রদান করেন এবং সন্যাসীর পক্ষেই রায় দেন। কারণ সন্যাসীযে মেজো কুমার সেটাই আদালতের কাছে মনে হয়।


তবে রাণী বিভাবতী এবং আশু ডাক্তারের সম্পর্ক নিয়ে যে গুজব ওঠে তা অবশ্য প্রমানিত হয়নি। তা হলেও আশু ডাক্তার এবং সত্যেন্দ্রনাথের উপরে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ কিন্তু মিথ্যা বলে প্রমানিত হলো না। তবে আসল সত্যযে কি ছিল সেটা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ কখনোই কাটেনি। এখনও অনেকের মত অনুযায়ী, সন্যাসী ছিল আসলে একজন বড় মাপের প্রতারক। আবার অনেকের মতে রাণী আর তার ভাই দু'জনে মিলে আসলেই মেজো কুমারকে খুন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা তা পারেন নি। মামলার রায় জানতে বিশাল জন সমাগম হয়। এছাড়াও মামলার রায় দেওয়ার পরপরই পান্না লাল বসু বিচারকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ভাওয়াল স্টেটের কুমার রমেন্দ্র নারায়ণের ভাগ থেকে সন্যাসীকে টাকা নিতে অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু অন্যান্য বিষয় নিঃস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত যাবতিয় সম্পত্তি স্থগিত রাখা হয়। এবং এই সম্পত্তি কোর্ট অব ওয়ার্ডস এর হাতে রাখেন। এবং একই সময় তিনি বিয়ে করেন। যার ফলে রাজস্ব বোর্ড মামলা নিয়ে কার্যক্রম তখনকার মত বন্ধ রাখে।

তাছাড়া উক্ত রায়ের পর মিঃ এ. এন. চৌধুরি মামলা ছেড়ে দেন, কিন্তু বিভাবতী হাল ছাড়তে নারাজ ছিলেন। এর পর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের কারণে মামলার আপিল ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে। ঐ সালেই রাণী বিভাবতীর আইনজীবিরা হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে লন্ডনের প্রাইম কাউন্সিলে আপিল করে। জার্মান বিমান হামলায় কাউন্সিলের ভবন ক্ষতি গ্রস্ত হওয়ায় প্রিভিউয়ের অধিবেশন ঘটে তখন হাউস অব লর্ডসে। ১৯৪৫ সালে সেখানে শুনানী শুরু হয় । ডি. এন. প্রিট দাবিদারের পক্ষে এবং ডব্লিউ ডব্লিউ কে পেইজ, কোর্ট অব ওয়ার্ডসের পক্ষে মামলা পরিচালনা করে। প্রিভি কাউন্সিলর মামলার রায় শুনতে রাজি হন এবং 'লর্ড থাঙ্কের্টন, লর্ড হার্বার্ট ডু পার্স্ক, এবং স্যার চেতুর মাধবন' আপিলের বিচার করেন। আটাশ দিন ধরে চলে শুনানী। তারপর ১৯৪৬ সালের ৩০ জুলাই তারিখে বিচারকেরা দাবিদারের পক্ষে রায় দেন। এবং যাবতীয় আপলি নাকচ করে দেন। পরের দিন কলকাতার টেলিগ্রাফ মারফত মামলার রায় জানানো হয়।


ফরেন্সিক বিজ্ঞানের জন্য এই মামলা ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। এই মামলাতে একজন অপরিচিত মানুষের পরিচয় বের করবার নানা ধরনের কলা কৌশলের যথেষ্ট প্রয়োগ ঘটেছে। কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ এবং সন্যাসীর শারীরিক মিল ছিল অনেক বেশি। মেজো কুমার রমেন্দ্রনারায়ণের উচ্চতা, জামার মাপ, জুতার মাপ, চুলের রং, শরীরের বিশেষ চিহ্নগুলোর সবই সন্ন্যাসী মেজো কুমার বলে প্রতীয়মান হন। বিশেষ করে ডাক্তাররা মেজো কুমারের শরীরে যে কয়েকটা বিশেষ জন্মগত দাগ, তিল, ফোঁড়ার দাগ ও দুর্ঘটনার ফলে আঘাতের চিহ্ন রয়েছিল, তার সবগুলোই হুবহু খুঁজে পান। এছাড়াও দুই ব্যক্তির আলোকচিত্রিতেও যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকি তাদের দু'জনের কথা বলার ধরন, গলার স্বর, হাঁটার গতি, সব কিছুরই যথেষ্ট মিল রয়েছে। যদিও আঙ্গুলের ছাপ নেওয়ার পদ্ধতীটি এই মামলার সময় চালু ছিল, কিন্তু কোন একটা অজ্ঞাত কারণে সেটা আর পরীক্ষা করা হয়নি। ধারনা করা হয়, কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ বার বছর আগে নিখোঁজ হওয়াতে, তার আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। প্রিভি কাউন্সিলের রায় বের হওয়ার পরদিনই খবর বের হলো কলকাতায়। সে দিন টা ছিল ১৯৪৬ সালের ৩০ শে জুলাই। কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ শেষ পর্যন্ত তিনটা কোর্টেই নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে সক্ষম হলেন। পরদিন যখন খবরটা শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লো, তার ধর্মতলার স্ট্রিটের বাড়িতে তখন হাজার হাজার লোকের সমাগম। সবাই তাকে অভিনন্দন জানাতে চায়!


এবার চিরদিনের মত চলে গেলেন কুমার রমেন্দ্র নারায়ণঃ- মামলার জয়লাভের পর কুমার রমেন্দ্র নারায়ণের ধর্মতলা স্ট্রিটের বাড়িতে তখন লোকে লোকারণ্য। আর সেই দিন সন্ধ্যাতে ঘটলো আরো এক এমন ঘটনা, যা ছিল অনেকের পক্ষেই এক অপ্রত্যাসিত বিশাল ধাক্কা। কুমার যচ্ছিলেন কর্নওয়াল স্ট্রিটের উপর ঠনঠনিয়া কলি বাড়িতে পূজো দিতে। ঠিক এমনই মূহুর্ত্বে রাস্তায় বের হওয়ার সময় হঠাৎ তার হৃদ যন্ত্র গেল বন্ধ হয়ে। কুমার অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। সেই সাথে সাথে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো। তখন তার বয়স ছিল তেষট্টি বছর। পরদিন হিন্দুস্থান র্স্টান্ডার্ডে ছোট করে খবর বের হলো-

"বহুল আলোচিত ভাওয়াল রাজ স্ট্রেটের মেজো কুমার সেই সন্ন্যাসী রমেন্দ্র নারায়ণ, হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। তার শরীর কিছুদিন থেকেই ভাল যাচ্ছিল না। হেমো থিসিস এ আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৬ সালের পহেলা আগষ্ট তিনি শেষ নিঃস্বাশ ত্যাগ করেন।"

প্রিভি কাউন্সিলের রায় জেনে বহু লোক তার বাড়িতে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে তার মৃত্যু সংবাদ শুনে সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়। তারা কি আসলেই জানতো, যে মানুষটাকে তারা এত সমাদর করে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিল, ঠিক সেই একই সময়ে তার মৃত্যুর শেষকৃত্যে তাদেরকে অংশ গ্রহণ করতে হবে? জানা গিয়েছে যে, বন্ধু বান্ধব এবং প্রজাদের সাথে দেখা করতে এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে জয়দেব পুরে যাওয়ার তার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সন্ন্যাসীর সে আশা আর পূরণ হলো না। কুমারের শ্রাদ্ধ হলো কলকাতায়, ১৯৪৬ সালের ১৩ই আগষ্ট। মাত্র ৩৭ বছরের মধ্যে এটা তার দ্বিতীয় নম্বর শ্রাদ্ধ। আর এভাবেই শেষ হলো মেজো কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণের জীবনের অদ্ভুদ ট্রাজেডি ময় কাহিনী।


সেই সন্ন্যাসী কি সত্যিই মেজো কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় ছিলঃ- যদিও ভাওয়াল এবং তার আশে পাশের মানুষেরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে, ঐ সন্ন্যাসীই ছিলেন কথিত তাদের মৃত কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ। কিন্তু তার পরেও যারা ঐ জিনিসটাকে আজীবনের জন্য মিথ্যা বলে মনে করে আসছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাণী বিভাবতী, বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্র এবং ডাক্তার আশুতোষ রায়। তারা তাদের মৃত্যুর আগ মূহুর্ত্ব পর্যন্ত কখনোই স্বীকার করে নেননি যে, ঐ সন্ন্যাসীই তাদের মৃত কুমার হবেন। এমনকি বংশ পরম্পরায়ও তারা এই রিতীটা চালু করে রেখেছিলেন নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মত। তারা মনে করতো এটা তাদের উত্তরাধীকার সূত্রে পাওয়া একটা সত্য ঘটনা, যা প্রত্যেকটা ভুল ইতিহাস জানা মানুষকে জানানো তাদের নৈতিক দ্বায়িত্ব। কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে, ঐ সন্ন্যাসীই যদি মৃত কুমার না হয়ে থাকবেন, তাহলে আসলে তিনি কে ছিলেন? তার পরিচয়ই বা কি? আর কেনই বা তার সাথে মৃত কুমারের চেহারার এত মিল ছিল? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজতে হলে জানতে হবে ঐ সন্ন্যাসী সম্পর্কে রাণী বিভাবতী দেবীর পরিবার আসলে কি বলে! তাদের দাবি, সেই সন্ন্যাসী ছিলেন মূলত রাজবাড়ির আস্তাবলের সহিসের ছেলে। আর তাই গোটা রাজ বাড়ির ইতিহাস ছিল তার নখদর্পণে। এছাড়া আসল রহস্য ছিল তার পিতৃ পরিচয়ের মধ্যে। আগেকার দিনে সব জমিদার বাড়িতে যেমন ঘটতো, এখানেও ঠিক তাই ঘটেছিল। অর্থাৎ এই ব্যক্তির বাবা ছিলেন স্বয়ং রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। তিনি তার এক সুন্দরী দাসীর সাথে পরক্রিয়া করার ফলেই জন্ম হয় এই সন্ন্যাসীর। আর সে জন্যই রাজ কুমারের সাথে তার চেহারার এত মিল ছিল। কোন একটা অপরাধের কারণে সে রাজ বাড়ি থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, এবং পরবর্তিতে মৃত কুমার সেঁজে রাজবাড়িতে ঢুকে রাজকীয় সম্পত্তি হাতাতে চেয়েছিল। কিন্তু এটাও যে সত্য কাহিনী, তারও কোন ভিত্তি ছিল না!


পরিশিষ্টঃ- রানী বিভাবতী পরে যে ২০ বছর বেঁচে ছিলেন, পুরো সময়টা জুড়েই তিনি অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলতেন- 'যদিও পৃথিবীর সব আদালতের রায়ে তিনি পরাজিত। তবে সবার উপরে যে বিচারক আছেন, তার বিচারে কিন্তু তার হার হয়নি। বহু বছর আগেই যার মৃত্যু হয়েছে, তার পরিচয় হারিয়ে যে ব্যক্তি চলেছিল দেবির পূজো দিতে। দেবী তাকে ঠিকই সমূচিত শাস্তি দিয়েছেন।'

জানা যায়, বিভাবতী প্রিভি কাউন্সিলের রায়েও একদমই আশ্চার্য হননি। কারণ কাশীর জ্যোতিষীরা তাকে নাকি বলে ছিলেন যে, তিনি অবশ্যই এই মামলায় হারবেন। কিন্তু তার সঙ্গে তারা এও বলেছিলেন যে, ঐ ব্যক্তি কোন দিনই তার সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে না। পরবর্তিতে অবশ্য জ্যোতিষীদের গননাই ঠিক বলে প্রমাণিত হলো।


১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইস্ট বেঙ্গল স্টেট একোইজেশন এন্ড এক্ট পাশ করলো পূর্ব পাকিস্থান সরকার। আর এই আইনে জমিদারী প্রথা চিরদিনের মত বিলুপ্ত হয়ে গেল। জমিদারদের বদলে এখন থেকে কৃষক প্রজার সঙ্গে রাজ্য সরকারের সরাসরি সম্পর্ক। জমিদারি বিলোপের ফলে স্থির হলো যে এখন থেকে জমিদাররা তাদের নিজের জমির মাত্র তেত্রিশ একর জমি নিজেদের অধিকারে রাখতে পারবেন। অবশিষ্ট জমির উপর তার আর কোন অধিকার থাকবে না। অবশ্য সে জন্য ক্ষতিপূরণ মিলবে সরকারের কাছে থেকে। বহু জমিদারই এই আইনের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করলেও সেটা নাখচ হয়ে যায়। তাছাড়া জমিদারদের কাছে লর্ড কর্নওয়ালিস যে প্রতিজ্ঞা করেন, এ আইন তারও বিরুদ্ধে। আগেই বলা হয়েছে যে, ভাওয়াল কুমারের হয়ে মামলা লড়েছিল যে ডি. এন. প্রিট, তিনিই এই সময় ঢাকায় আসেন পূর্ব পকিস্থান সরকারের পক্ষ হয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়তে। প্রিভি কাউন্সিলের রায় বের হওয়ার পর কিছুদিন তৃতীয় রানী আনন্দ কুমারীর দত্তক পুত্র রাম নারায়ণ রায় তার বংশের জমিদারের মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৫০ সালে যখন জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়, তখন একেবারে সরাসরি নিজস্ব অংশ টুকু বাদ নিয়ে জমিদারের বাকি অধিকার তাকেও ছেড়ে দিতে হলো।


সেই বছরেরই মাঝা মাঝি মাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে এলেন কলকাতায়। জমিদারিতে রমেন্দ্র নারায়ণের যে অংশ ছিল, সেটেলমেন্টের সময় কোর্ট অব ওয়ার্ডস মৃত কুমারের অন্যতমা রাণী হিসাবে বিভাবতি দেবীর প্রাপ্য ধার্য করলো আট লক্ষেরও কিছু বেশি টাকা। উকিলরা রাণীকে বোঝালেন, এ তারই টাকা। আপিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেবল এই টাকা কোর্ট অব ওয়ার্ডস তাদের নিজেদের কাছে রেখে দেবে। কিন্তু বিভাবতী তা নেননি। তার যুক্তি, 'ওরা তো মৃত সেই ব্যক্তির বিধবা স্ত্রী ভেবেই আমাকে এই টাকা দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে ও টাকা নিলে তো এতদিন পর্যন্ত যে ব্যক্তিকে আমি মিথ্যা বলে জেনেছি, সেটাকে এখন আবার সত্য বলে স্বীকার করে নিতে হবে। সুতরাং তিনি টাকা প্রত্যাখ্যান করলেন।'


বিচারক পান্না লাল বসুর পরিচয়ঃ- ভাওয়াল সন্ন্যাসীর এই আশ্চার্য কাহিনীর মধ্য থেকে যদিকোন একজন মূল নায়ককে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তিনি হবেন বিচারক পান্না লাল বসু। ঢাকা আদালতের সাব অর্ডিনেড জর্জ। তার রায়ের উপরেই ভিত্তি করে উচ্চতর আদালতের বিচারকরা এই মামলার পূণ বিচার করেন। একটা আশ্চর্য রহস্য সমাধানের প্রবল ইচ্ছা তো বটেই। এছাড়াও পান্না লাল বসুর এই বিচারের মধ্যে ছিল, অনেক অতিরিক্ত অনুপ্রেরণা। তিনি সেই জাতীয়তাবাদি প্রজন্মের বিচারক। বিদেশি শাসকদের দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে যারা তাদের দৃষ্টিকে সচেতন ভাবে আলোকিত হতে চেয়েছিলেন, বিদেশি সরকারের নথি পত্র গুলোকেউ যারা প্রবল সন্দেহের চোখে দেখতেন। তিনি সেই জাতীয়বাদি প্রজন্মের বিচারক, যিনি তার আদর্শের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। পূর্ব জীবনে তিনি দর্শন শাস্ত্রের শিক্ষক ছিলেন। তার চাকরি জীবনের এই শেষ মামলাটিতে তার সেই দর্শণ বোধ্যতা দারুন ভাবে কাজে লেগে যায়। ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা প্রমাণ করে, যে মানুষের আত্ম পরিচয়ই আসল নয়, এটা অর্থহিন, আকস্মিক। মানুষ যা বিশ্বাস করে, যা করতে চায়, তাকেই বলে তার পরিচয়।


পুনশ্চঃ- জয়দেব পুরের রাজ বাড়িতে এখন বাংলাদেশ সরকারের সরকারি অফিস। যে বড় দালানে জমিদার এবং সাহেবরা এসে বসতো, সেখানে এখন বসে গাজীপুরের ডেপুটি কমিশনারের অফিস। উপরের রাণীদের ঘর গুলিতে বসে গাজি পুরের যত হাকিম'রা। সেই মেঝের মার্বেল আর নেই। এখন সেখানে সাধারণ সিমেন্টের আস্তরন। তবে বড়বড় কাঠের পুরোনা দরজা গুলো শুধু এখনো রাজকীয় মহীমা নিয়ে স্ব-শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। আর দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়ির গেটের বিশাল সেই সিংহ দরজা। দরজার সামনে আগে যে খেলার মাঠ ছিল, যেখানে একদিন হাজার হাজার মানুষের সামনে হাতির পিঠে জয়দেব পুরে সেই সন্ন্যাসীর ঐতিহাসিক আবির্ভাব ঘটে; সেই মাঠ এখন ফুটবল স্টেডিয়াম। তবে আজও দলে দলে কৌতুহলি মানুষ এসে দর্শন করে যায় আলোচিত সেই ভাওয়ালের রাজ বাড়ি। দর্শন করে রাজবাড়ির রাজকীয় সব কার্যকলাপ। তাছাড়া সরকারি অফিসের কর্মচারিরা খুবই যত্ন এবং ধৈর্য্য সহকারে সেই সমস্ত দর্শনার্থীদেরকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাজবাড়ির খুঁটিনাটি দেখায়। তাদেরকে সেই বিখ্যাত মামলার ঐতিহাসিক কাহিনী শোনায়। আর শোনায় অনিন্দ্য সুন্দরী রাণী বিভাবতীর কথা! যিনি তার মৃত্যুর আগ মূহুর্ত্ব পর্যন্তও বিশ্বাস করেননি বা স্বীকার করে নেননি, যে ঐ সন্ন্যাসীই ছিল তার স্বামী কথিত ভাওয়াল জমিদার বাড়ির মেজো কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী।

তথ্যসূত্রঃ- ভাওয়ালের এই রাজ কুমারকে নিয়ে এর আগেও বহু ব্লগার সামহোয়্যার ইন ব্লগে অনেক পোস্ট প্রকাশ করেছে। যারা পুরানো ব্লগার তারা অনেকেই হয়তো এ সম্পর্কিত বিষয়ে ভাল বলতে পারবে। তাছাড়া জনপ্রিয় এই কাহিনীটা হয়তো অধিকাংশ মানুষেরই খুব ভাল ভাবেই জানা। তবে আমার আজকের পোস্টটা জানা এবং অজানা, উভয় পাঠকের জন্যই না হয় পূনরায় প্রকাশ করা হলো। যদিও আমার আজকের পোস্টের যাবতিয় তথ্য সবই অন্য মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা। তথাপিও সামুর একজন ব্লগারের এ সম্পর্কিত একটা পোস্টকে আমি তথ্যসূত্র হিসাবে প্রকাশ করলাম। এছাড়া আমার আজকের পোস্টের যাবতিয় তথ্যই অনলাইন ভিত্তিক বিভিন্ন বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা। যার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি লিংক নিচে প্রকাশ করা হলোঃ-

০১। ভাওয়াল কেস-উইকিপিডিয়া & এনসাইক্লোপিডিয়া।
০২। ভাওয়ালের রাজবাড়ী-উইকিপিডিয়া & এনসাইক্লোপিডিয়া।
০৩। কিংবদন্তির ভাওয়াল রাজা: রূপ কথাও হার মানায় যে কাহিনি।
০৪। ভাওয়ালের সন্ন্যাসী রাজা।
০৫। একদিন ভাওয়াল রাজ প্রাসাদে (ছবি সহ)।
০৬। ভাওয়াল রাজ পরিবারের রহস্য।
০৭। ছবি সূত্র-পোস্টে উল্লেখিত সবগুলো ছবিই এখান থেকে সংগ্রহ করা।

অডিও ক্লিপঃ- ভাওয়াল পরগনার এই রাজ কুমারকে নিয়ে বহু গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা এমনকি বিভিন্ন রেডিও প্রোগ্রামে গল্প বলার ছলে সুন্দরভাবে তার মৃত্যু ইতিহাস এবং রহস্যময় পূনরুত্থানের সেই কাহিনী উপস্থাপন করা হয়েছে। ঠিক তেমনই একটা রেডিও প্রোগ্রামের অডিও লিংক আপনাদের সংগ্রহে রাখার সুবিধার্থে আমি নিচে শেয়ার করলাম। এবিসি রেডিওর অনেক গুলো জনপ্রিয় প্রোগ্রামের একটি হলো 'কুয়াশা' পর্ব। আর সেই কুয়াশা পর্বেরই ৫২ নং ই-পিসডে "ভাওয়াল রাজার মামলা" নামে প্রচার করা হয় তুমুল জনপ্রিয় এই কাহিনীটি। রেডিও উপস্থাপক শারমিনের উপস্থাপনায় এটি ABC Radio 89.2 FM থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। ইচ্ছা করলে আপনারা নিন্মোক্ত লিংকটা থেকে উক্ত ঘটনাটি ডাউনলোড করে শুনে নিতে পারেন। (ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন)

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ- টাইপিংয়ের ভুলের কারনে হয়তো অনেক জায়গায় বানানে ভুল থাকতে পারে। সেটাকে বিবেচ্য বিষয় হিসাবে না ধরে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে কৃতার্থ হবো! তাছাড়া এতক্ষণ যাবত সাথে থেকে এবং কষ্ট করে এতবড় একটা পোস্ট পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন! হ্যাপি ব্লগিং....!! !:#P
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ১১:১৮
২৯টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×