somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিচারঃ- "অপূর্ব সুন্দরের কুৎসিত অবয়ব! ভয়ংকর মাদক তৈরির অন্যতম প্রাকৃতিক উপাদান; 'পপি ফুল'- এর সাতকাহন!"

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পপি ফুল! যার অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে হয়তো আমাদের মধ্যে কোন ধরনের বিতর্ক নেই। পারস্য রাজ্যে যাকে আদর করে ডাকা হয় ভালোবাসার ফুল। উর্দুতে যার নাম 'গুল-ই-লালাহ' বা শহীদের প্রতীক। পপি গাছ এর আদি নিবাস ইউরোপে হলেও বর্তমানে এটি পৃথিবীর সর্বত্র পরিচিত তার ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য। যদিও মাদক দ্রব্য উৎপাদনের জন্য পপির লাল এবং গোলাপী রঙের ফুলটাকেই সর্বাধিক প্রধান্য দেওয়া হয়। তবে লাল এবং গোলাপী ছাড়াও সাদা, হলুদ এবং নীল রংয়ের পপি ফুলকেও বিভিন্ন দেশে দেখতে পাওয়া যায়। এই ফুলের পাপড়িগুলো হয় রেশমের মতো নরম এবং ততধিক কোমল প্রকৃতির।


☆☆ পপি ফুলের পরিচয়ঃ- পপি, Plantae জগতের মধ্যে Papaver Somniferum প্রজাতির Ranunculales বর্গের Papaveraceae পরিবার ভুক্ত একটি ভয়ংকর সুন্দর ফুল। যার বৈজ্ঞানিক নাম- 'Papaver Somniferum'. ফুল বিশেষজ্ঞদের ধারনা, পপি ফুলের এই নামকরণ করা হয় প্রাচীন গ্রীক পুরাণের ঘুমের দেবতা 'সোমনাস'-এর নামানুসারে। কারণ পপির ক্ষেতে বয়ে যাওয়া মৃদু শীতল বাতাস এতটাই স্পর্শকাতর আর আরামদ্বায়ক যে, তা যে কোন প্রাণীদেরকেই ঘুম পাড়িয়ে দিতে সক্ষম!


প্রকৃতির বুকে পাওয়া বিভিন্ন রং-এর পপি ফুল আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রূপকার্থে বিশেষ ভাবে সমাদৃত। এবং এর রং-কেও আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ জিনিসের প্রতীক হিসাবেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন বিশ্বে লাল রং-এর পপি ফুলকে মূলত মৃত্যু, স্মরণসভা, সাফল্য এবং ভালবাসার প্রতীক হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। সাদা রং-এর পপি ফুল শেষকৃত্যানুষ্টান, স্মৃতিচারণ মূলক সভা-সেমিনার এবং শান্তি পূর্ণ ঘুমের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। এবং নীল, গোলাপী এবং বেগুনি রং-এর পপি ফুলকে কল্পনা, বিলাসিতা এবং সাফল্যের অন্যতম বাঁধার প্রতীক হিসাবে দেখা হয়ে থাকে।


তাছাড়া প্রাচীন গ্রীক এবং রোমানদের কাছে এটি প্রশান্তিদ্বায়ক, ঘুমবর্ধক এবং আনন্দদ্বায়ক হিসাবেও বেশি পরিচিত। তবে চীন এবং জাপানের কাছে লাল রং-এর পপি মূলত গভীর-প্রগাঢ় প্রেম এবং বন্ধুত্বের প্রতীক হিসাবেই বেশি সমাদৃত। আর সাদাকে তারা দেখে তাদের সংস্কৃতির প্রতীক হিসাবে।


ঐতিহাসিক তথ্য মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে এই ফুলটি লাগানো হয়েছিল ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদের পাশের বাগান। তাছাড়া প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যে গভীর সম্পর্কের অন্যতম প্রতীক হিসাবেও লাল পপি বিশেষ ভাবে জনপ্রিয়। এমন কি বিশ্বের কিছু কিছু দেশে সেই দেশের অন্যতম শহীদ বীরদের প্রতি সম্মান জানাতে তাদের শ্মষান-সমাধিতে পপি ফুলের পুষ্পস্তবকও অর্পণ করা হয়। নিচে তেমনই কিছু বিখ্যাত কাজে পপি ফুলের ব্যবহার উল্লেখ করা হলঃ-


প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন প্রায় ৮ লাখ ৮৮,২৪৬ জন ব্রিটিশ ও কমনওয়েলথ সেনা। তাঁদের স্মরণে ঠিক ততগুলো হাতে তৈরি কৃত্রিম পপি লাগানো হয়েছিল ঐতিহাসিক লন্ডন টাওয়ারের পাশের বিশাল উদ্যানে। ১১ নভেম্বর শেষ হয় এই প্রদর্শনী।


একই স্থানে প্রায় ১৬ একর জমির উপরে পপি লাগানোর ফলে দূর থেকে দেখলে মনে হতো, লন্ডন টাওয়ারের আশ-পাশটা যেন রক্তের সমুদ্রে পরিণত হয়ে গিয়েছে। প্রায় ১৬টি ফুটবল মাঠ বা ২৫০টি টেনিস কোর্টের সমান জায়গায় লাগানো হয়েছিল এই ফুলগুলো।


তৎকালিন সময়ে লন্ডন টাওয়ারের পাশের সেই পপির বাগান পরিদর্শন করেছিলেন ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সাথে ছিলেন প্রিন্স উইলিয়ামস এবং হ্যারিসহ পুরো রাজ পরিবার।


ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও এই পুষ্প সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলেন। এসময় নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে তারা একটি করে ফুল লাগান।


ধারনা করা হয়, পুরোনো পদ্ধতিতে প্রতিটি গাছ লাগাতে স্বেচ্ছাসেবীদের দিনে তিন শিফটে প্রায় ২৩ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়েছিল। মূলত মাটির তৈরি ফুল, ইস্পাতের ডাল আর কাঠামো তৈরি করতেই এই বিপুল সময় ব্যয় হয় তাদের।


তৎকালিন সময়ে প্রায় ৪০ লাক্ষ পর্যটক এই প্রদর্শনী পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। আর তাদের বেশিরভাগই সেই প্রদর্শনী থেকে ফুল কিনেছিলেন, পরবর্তিতে যে ক্রয়কৃত টাকার সবটাই যুদ্ধে আহত সৈনিকদের ত্রাণ তহবিলেই জমা দেয়া হয়।


ব্রিটেন সহ গোটা বিশ্বে পপিকে কেন স্মারক হিসাবে দেখা হয় (?) এই প্রশ্নের উত্তরটা অবশ্য অনেক পুরোনো। ১৮০৩ থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যে 'নেপোলিয়নিক যুদ্ধে' নিহত সৈন্যদের কবরের (বর্তমানে বেলজিয়ামের অংশ 'ফ্ল্যান্ডার্স' এলাকায় অবস্থিত) চারপাশে হঠাৎই অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে লাল পপি জন্মেছিল। অনূর্বর হলেও যুদ্ধের কারণে সেখানকার মাটিতে লাইম এর পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলেই মূলত পপি'র জন্মের মূল কারণ বলে অনেকে মনে করেন। তাছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লিখিত একটি বিখ্যাত কবিতার মধ্যেও এই লাল পপি স্থান পায়। আর সেই থেকেই ব্রিটেনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের স্মরণের প্রতীক হিসেবে পপি'র ব্যবহার হয়ে আসছে।


প্রদর্শনী শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু যারা এই রক্তাক্ত সমুদ্র দেখেছেন তাদের স্মৃতিতে এটি আজীবন ধরে অমলিন হয়ে থাকবে।


☆☆ পপি ফুলের ইতিহাসঃ- পপিকে আমাদের মধ্যে অনেকের কাছে একটি নতুন প্রজাতির ফুল বলে মনে হলেও, এটি আসলে কোন মতেই নতুন প্রজাতির কোন ফুল নয়। বরং আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বেই এর গোড়াপত্তন হয়ে গেছে। পপি ফুল সম্পর্কিত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০০ সালের দিকেও মাদক হিসাবে পপি চাষের প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেক ইতিহাস বিদরা মনে করেন, তৎকালিন মেসোপটমিয়া অর্থাৎ ইরাকের নিম্নাংশে সব থেকে বেশি এই পপি চাষ হতো। তৎকালিন সময়ে যার নাম ছিল 'গুলগিল বা আনন্দের গাছ।'


তারপর সেই আনন্দের গাছ তার আনন্দ ছড়াতে ছড়াতে ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এমন কি ভূ-মধ্যসাগর থেকে শুরু করে সদূর চীন পর্যন্ত সিল্ক রোডের অন্যতম বানিজ্য পন্য হয়ে ওঠে পপি থেকে উৎপাদিত সব থেকে মারাত্মক ড্রাগস্ আফিম। যার কারণে চিকিৎসাশাস্ত্র তথা বর্তমান বিজ্ঞানীদের কাছে পপি 'মাদার অব ড্রাগস্ বা মাদকদ্রব্যের আম্মা' হিসাবেই বেশি পরিচিত।


তাছাড়া ১৮৩৯ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে দুই দফায় বৃটেন এবং চীনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মূল কারণও ছিল এই পপি। কিন্তু তারপরেও পপির যুগ যুগান্তরের এই ধ্বংসাত্মক ভ্রমণ থেমে থাকেনি। বরং কিছু কূচক্রি মহলের লালসার কারণে তা আরো বেশি বিস্তৃতি লাভ করেছে বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। বর্তমানে মধ্য এশিয়ার তুর্কিস্থান থেকে শুরু করে পাকিস্থান, আফগানিস্থান এবং মায়ানমারের প্রায় ৪৫০০ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে এই ধ্বংসাত্মক পপি চাষের অভায়রণ্য গড়ে উঠেছে।


পৃথিবীর সর্বপেক্ষা মারাত্মক ফুল এই পপি চাষে আমাদের বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকটি জেলার চাষীরাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। অনেকে জেনে, অনেকে না জেনে আবার অনেকে বিভিন্ন কূচক্রি মহলের দ্বারা লালসার শিকার হয়ে দিনের পর দিন চাষ করে চলেছে পপি নামক এই মাদকদ্রব্যের আম্মাকে। দেশের অনেক বিশিষ্টজনরা মনে করেন, গত নব্বইয়ের দশকে অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে মায়ানমার থেকে দূর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে এই সর্বনাশা পপি।


বর্তমানে বান্দরবন জেলার থানচি উপজেলার সর্বত্রই এখন পপি চাষ আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। থানচি সীমান্তে সার্বক্ষনিক পাহারায় নিয়োজিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের দাবি, চাষীরা এগুলো লাগায় মূলত সরিষা, সয়াবিন তামাক বা ঐজাতীয় গাছের সাথে। যার কারণে গাছ ছোট থাকতে যা একদমই ধরার উপায় নেই যে, কোনটা সরিষার চারা আর কোনটা পপি গাছের চারা। তারা এই পপি চাষের জন্য মূলত সাঙ্গু নদীকেই বেশিরভাগ সময় ব্যবহার করে। তাছাড়া এই পপি চাষের জন্য থানচি উপজেলার গভীর অভায়রণ্যের মাঝে এমন কিছু দূর্গম পাহাড়ী এলাকা গুলোকে বেছে নেওয়া হয়, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বহিনীর দ্বারা সার্বক্ষণিক পাহারা দেওয়াটা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।


পপি মূলত ফুল হিসাবে যতটা না বিখ্যাত, তার থেকে বেশি বিখ্যাত (নাকি কূখ্যাত?) এটা থেকে উৎপাদিত মরণঘাতি মাদকদ্রব্য 'আফিম, ফরফিন, হিরোইন এবং প্যাথেড্রিন'-এর জন্য। কারণ এই পপি ফুলই হল মাদকদ্রব্যের অন্যতম প্রাকৃতিক কাঁচামাল। যদিও পূর্বেই বলা হয়েছে লাল এবং গোলাপী রং-এর ফুল থেকেই মূলত ঐধরনের ধ্বংসাত্মক মাদকদ্রব্য তৈরি হয়ে থাকে। তবে পপির এমন কিছু নিরীহ প্রজাতি আছে যেগুলোকে কেবলই বাগানের শোভা বর্ধনের জন্যই ব্যবহার করা হয়।


তাছাড়া ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের পাশাপশি পপি ফুলের কিছু ঔষধি গুণও রয়েছে। তবে সে যাই থাকুক না কেন, সব কিছু ছাপিয়ে যখন একটা সুন্দর জিনিসকে কুৎসিত কাজে ব্যবহার করা হয়; তখন তার যতই ভাল গুণাগুণ প্রচার করা হোক না কেন সেটা বোধহয় চাপা পড়ে যায় ঐ খারাপের মধ্যেই।


☆☆ পপি ফুল থেকে চাষীরা কিভাবে আফিমের কাঁচামাল সংগ্রহ করে থাকেঃ- মূলত ডিসেম্বরের শেষ ভাগ থেকে নিয়ে জানুয়ারি মাসের পুরোটাই হল পপি চাষের জন্য একটি উপযুক্ত মৌসুম। ডিসেম্বরের শেষ দিকে পপির বীজ বপন করার পরে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে বীজ থেকে চারা অঙ্কুরিদগম হয়ে সেটা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফুল ধরার জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। তারপর আরো দু'একদিনের মধ্যেই সেই ফুলের পাপড়ি ঝরে গিয়ে সেখানে থেকে যায় গুঁটি গুঁটি দেখতে পপি ফল।


আর ফল যখন পরিপক্ব হয়ে ওঠে, তখন ব্লেড দিয়ে তার গায়ে গভীর আঁচড় কেঁটে দেওয়া হয়।


ফলে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা পরপর ফলের গা থেকে যে কষ বের হয় সেটাকেই চাষীরা সংগ্রহ করে, এবং এটাকেই বলা হয় প্রাকৃতিক ভাবে পাওয়া আফিমের অন্যতম কাঁচামাল। এরপর অবশ্য বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এটাকে অন্যান্য উপজাত জৈব রাসায়নিক দ্রব্যে পরিণত করা হয়।


☆☆ পপি ফল থেকে উৎপাদিত মাদকদ্রব্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ- দ্যা মাদার অব ড্রাগস্ খ্যাত পপি হল মরণঘাতি মাদকদ্রব্যের অন্যতম প্রাকৃতিক কাঁচামাল। এটা থেকে প্রাপ্ত ফলের কষ দিয়েই প্রথমতো আফিম নামক নেশা জাতীয় দ্রব্যাদী তৈরি হলেও পরবর্তিতে বিভিন্ন প্রকৃয়ায় এই ফলের কষ থেকেই উৎপাদিত হয় নেশার রাজা হিরোইনও। এছাড়া পপি ফল থেকে সর্বনাশা মাদক মরফিন এবং প্যাথড্রিন নামক আরো দুইটি নেশা জাতীয় দ্রব্যাদীও উৎপাদন করা সম্ভব। এক কথায় বলতে গেলে বিশ্বের যাবতিয় ধ্বংসাত্মক মাদকদ্রব্যের অন্যতম উপদানই হল এই পপি! তো আসুন এবারে জেনে নিই কিভাবে পপি ফল থেকে আফিম, মরফিন এবং হিরোইন নামক মাদকদ্রব্য গুলো প্রস্তুত করা হয় সেটাঃ-


☆☆ পপি ফল থেকে আফিম উৎপাদনের প্রকৃয়াঃ- পপি গাছে উৎপাদিত কাঁচা ফলের খোসার উপরে ব্লেড বা ছুরি জাতীয় জিনিস দিয়ে গভীর আঁচড় কাটলে যে সাদা সাদা কষ বের হয়, তা ২৪ ঘণ্টা রোদে শুকালেই পাওয়া যায় আফিম। তখন এর রং সাদা থেকে হয়ে যায় কালো বা কালচে বেগুনী। যদিও চিকিৎসাগত দিক থেকে বেদনা-নাশক হিসেবে মানুষ আফিমকে ব্যবহার করে আসছে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই, তবে বর্তমান সময়ে সেটা আর চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত না হয়ে বরং ব্যবহৃত হচ্ছে যুবসমাজকে ধ্বংস করার কাজে।


তাছাড়া তৎকালিন সময়ে মানুষ আফিমকে ব্যবহার করতো ব্যথা কমানো, অনিদ্রা দূর করা এবং কাশি ও ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ করার মত ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা ক্ষেত্রে। তবে ধীরে ধীরে যখন মানুষের কাছে এর নেশা সৃষ্টির সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, ঠিক তখনই শুরু হয়ে যায় এর অপপ্রয়োগ। প্রথমে রোমান, সেখান থেকে আরবীয়রা। তারপর তাদের থেকে চীন, ভারত, মায়ানমার থেকে শুরু করে পাকিস্থান, আফগানিস্থান এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশেও ছড়িয়ে পড়ে এর ব্যাপক প্রচলন। আর এভাবেই ক্রমশ্য এটি তার প্রভাব বিস্তার করতে করতে এখন বিশ্বের কাছে "আফিম" হিসাবে এক নামে পরিচিত!


☆☆ পপি ফল থেকে মরফিন উৎপাদনের প্রকৃয়াঃ- সাধারণত নেশা সৃষ্টির প্রকৃত মূল উপাদান থাকে আসলে পপি ফলের রসে। আর এই রসকে বিভিন্ন উপায়ে প্রকৃয়া জাতের মাধ্যমেই তৈরি হয় মরফিন। পপি ফলে এটার পরিমাণ থাকে শতকরা প্রায় ১০ ভাগের মত। এছাড়াও এই রসের মধ্যে 'নোসকাপিন, প্যাপাভেরিন, কোডিন, থিবেইনের' মত নেশা জাতীয় দ্রব্যাদিরও সংমিশ্রণ থাকে বেশ অল্প পরিমাণে।


তবে সব থেকে বেশি থাকে মরফিন এবং অনেক চিকিৎসকদের ধারণা তীব্র কাঁশির আশ্চার্যজনক প্রতিসেধক হিসাবে মরফিন খুবই কার্যকরি। তাছাড়া ব্যথা কমাতে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা হার্টফেল করার মতো অবস্থায় উদ্বেগ দূর করতে, ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে, অস্ত্রোপচারের আগে, অসুস্থ ব্যক্তির অতিরিক্ত শারীরিক চাঞ্চল্য দূর করতে; এমনকি কখনো কখনো মুমূর্ষু ব্যক্তির মনে সাময়িক আনন্দের ভাব জাগাতেও মরফিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে। চিকিৎসা শাস্ত্রানুসারে অনেকেই মনে করেন, মরফিন সরাসরি আমাদের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে (CNS) কাজ করে বলেই ব্যাথা কমাতে এর জুড়ি মেলা ভার।


ঐতিহাসিক তথ্য মতে, ১৮০৪ সালে জার্মান রসায়নবিদ 'ফ্রেডরিক এডাম' জার্মানির পিডারবর্নে সর্ব প্রথম মরফিনকে আলাদা করতে সক্ষম হন। এবং আলাদা করার পরে তিনি এর নাম দেন 'Morpheus', যেটাকে তখন একটু ভিন্নভাবে 'The Greek God of Dreams'-ও বলা হতো। তারপরে অবশ্য ধীরে ধীরে এটাকে 'Morphium' নামকরণে অভিসিক্ত করা হয়। তবে এই আবিষ্কারের দীর্ঘ সময় পরে অবশেষে 'ইউনিভার্সিটি অব-রচষ্টারের প্রফেসর ড. মার্শাল ১৯৫২' সালে এসে সর্ব প্রথম তার ল্যাবরেটরীতে বসে মরফিন তৈরি করতে সক্ষম হন। এবং সেখান থেকে নিয়ে এখনো পর্যন্ত মরফিন, চেতনানাশক হিসাবে হসপিটালে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সমান ভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।


তাছাড়া শারীরিক ভাবে কোনো অসুস্থ রুগীকে যদি ৪ ঘণ্টা পর পর মরফিন দেওয়া হয়, তাহলে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সে তার ওপর শারীরিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তবে এর ব্যাপক ব্যবহারের ফলে অনেক সময় ধীরে ধীরে ব্যবহৃত ব্যক্তি মারাত্মকভাবে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তার জীবন, চিন্তা-চেতন এমনকি তার ব্যক্তি-মানসিকতা সবকিছুই তখন মরফিন নির্ভর হয়ে পড়ে।


☆☆ পপি ফল থেকে হিরোইন উৎপাদনের প্রকৃয়াঃ- নেশার রাজা হিসাবে হিরোইনের নাম আমাদের কাছে সর্বাধিক পরিচিত। জার্মান শব্দ 'heroisch (heroic)' থেকেই মূলত হিরোইন নামের উৎপত্তি। ১৮৭৪ সালে বৃটিশ ডাক্তার 'এলডার রাইট' সেন্ট ম্যারি হাসপাতালে মরফিনের সাথে 'এ্যাসিটিক এনহাইড্রাইড' গরম করতে গিয়ে সর্ব প্রথম হিরোইন আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। সাথে সাথে তিনি এটাও বুঝতে পারেন যে, মরফিনের থেকে হিরোইনের কার্যক্ষমতা আরো অনেক গুণ বেশী। রাইটের আবিষ্কার এরপরে অবশ্য প্রায় ২৩ বছর যাবত ঐ আবিষ্কারের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর '১৮৯৭ সালে এসে জার্মান রসায়নবিদ হফম্যান' তার ল্যাবরেটরীতে বসে সর্ব প্রথম স্বতন্ত্রভাবে হিরোইন প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। মূলত জার্মান রসায়নবিদের আবিষ্কারের পর থেকেই হিরোইন নামটি জন-সাধারণের কাছে সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। তাছাড়া হফম্যান তার সেই গবেষনায় আরও দেখান যে. হিরোইন মরফিনের থেকে প্রায় ২-২.৫ গুন বেশি শক্তিশালী।


মূলত মরফিন আসক্তদের আসক্তি কমানোর জন্যই হিরোইনের আবিষ্কার। অর্থাৎ তৎকলিন সময়ে হিরোইন ছিল মরফিন আসক্তদের ঔষুধ সরুপ। তবে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে নেশা বাড়ানোর উপকরণ হিসাবে এর কার্যক্ষমতা লক্ষ করে ধীরে ধীরে এটাকে এখন কেবল মাত্র একটি নেশাজাতীয় দ্রব্যাদী হিসাবেই দেখা হয়ে থাকে। তাছাড়া নেশা সৃষ্টির সক্ষামতা হিসাবে হিরোইনের শক্তি এতটাই বেশি যে, কেউ যদি কোন রকম ভাবে একবার এটাতে আসক্ত হয়ে পড়ে; তাহলে এর থেকে বেরিয়ে আসাটা তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। এমনকি হিরোইনের আসক্তি ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইন্ডিয়ার বিখ্যাত মনোচিকিৎসক ডাঃ শত্রুজিৎ দাশগুপ্ত বলেন যে, "একাধিকবার যৌন মিলনে একজন মানুষের কাছে যে ধরনের সুখকর অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তার চেয়ে অন্তত দশগুন বেশি আনন্দ আসে একবার হিরোইন চেজ করলে.....!!"


☆☆ আফিম থেকে হিরোইন তৈরির কয়েকটি ধাপঃ- প্রথমত আফিম থেকে হিরোইন প্রস্তত করার জন্য সর্ব প্রথম কাঁচা আফিমকে ভিজিয়ে পরিশুদ্ধ হয়। তারপর সেই পরিশুদ্ধ ভেজা আফিম থেকেই বেরিয়ে আসে মরফিনের উপাদান। এরপর দ্বিতীয় ধাপে সেই মরফিনকে অ্যাসিটাইলেশন করে সেটাকে আবারও পরিশুদ্ধ করা হয়। এবং তৃতীয় ধাপে এসে সেই পরিশুদ্ধকৃত উপাদানের সাথে আরো বিভিন্ন কিছু রাসায়নিক পদার্থ (যেমনঃ সুরাসার ,কাঠকয়লা, এসিটোন ইত্যাদি) মিশিয়ে সেটাকে তাপ দিয়ে তৈরি করা হয় ডায়াএসিটিল মরফিন। আর এই ডায়াএসিটিল মরফিনকেই আমরা সহজভাবে হিরোইন নামে সব থেকে বেশি চিনি। যার রাসায়নিক নাম হল- 'ডায়ামরফিন হাইড্রোক্লোরাইড।' আর শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটাই সত্য যে, মরণঘাতি এই সব নেশা জাতীয় দ্রব্যাদি তৈরির অন্যতম প্রাকৃতিক কাঁচামালই হল পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর ফুল পপি।


❏ ❏ সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ- যে কোন নেশাজাতীয় দ্রব্যাদিই মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটা ব্যক্তি, গোষ্টি তথা গোটা জাতির জন্য এতটাই মারাত্মক যে, এর প্রভাবে পড়ে একটা জাতিও ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। তাছাড়া এই নেশা একজন নেশাখোরের উপরে এতটাই প্রভাব বিস্তার করতে পারে যে, সেটা থেকে তার জীবন-যৌবন, পরিবার-পরিজন এমনকি সমাজ; এই তিনটিকেই একদম সমূলে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। তাই আসুন, আমরা নেশা জাতীয় দ্রব্যাদি বর্জন করি। নিজে বাঁচি অপরকেউ বাঁচতে সহযোগিতা করি!!


পরিশেষে, এইটা ফ্রিইইইই হিসাবে দিয়া দিলাম! পোস্ট পড়তে পড়তে যারা অতিশয় ক্লান্ত হইয়া গেছেন, শুধুমাত্র তাদের জন্য..... ;)

❏ ❏ তথ্যসূত্রঃ- প্রত্যেকটা ছবিসহ পোস্টে উল্লেখিত যাবতিয় তথ্য ইন্টারনেটের বাংলা এবং ইংরেজি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা। সেগুলোরই উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লিংক নিচে উঠিয়ে দেওয়া হলঃ-

উইকিপিডিয়া & এনসাইক্লোপিডিয়া- পপি ফুল।
পপি ফুল; এর অর্থ এবং প্রতীক সমূহ।
শহীদদের স্মরণে পপি ফুল- ডয়েচেভেল।
ভালোবাসার ফুল ‘পপি’; সর্বনাশের আঁতুড়ঘর- বিডিটাইম।
ছবি সূত্র-পোস্টে উল্লেখিত সবগুলো ছবিই এখান থেকে সংগ্রহ করা।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ- টাইপিংয়ের ভুলের কারনে হয়তো অনেক জায়গায় বানানে ভুল থাকতে পারে। সেটাকে বিবেচ্য বিষয় হিসাবে না ধরে বরং ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে কৃতার্থ হবো! তাছাড়া এতক্ষণ যাবত সাথে থেকে এবং কষ্ট করে এতবড় একটা পোস্ট পড়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন! সবাইকে বিলম্বিত নতুন বছরের শুভেচ্ছা! হ্যাপি ব্লগিং..... !:#P
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:৫৮
৫৫টি মন্তব্য ৫৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

×