somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পালানো শৈশব

২০ শে জুন, ২০১৮ রাত ৯:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ছোট সময় মনে হতো প্রতিটা ঘটনার পেছনে যেন লুকিয়ে আছে কোন না কোন রহস্য। প্রতি মুহূর্তে সেইসব রহস্যের অর্থ উন্মোচিত হতো আমার চোখে। সেই অতিশৈশবে একজন লোক আসতো আমাদের বাড়িতে ঘোড়ায় চড়ে। আমরা তাকে ডাকতাম নানা বলে। দূর সম্পর্কের নানা। লাল রঙের ঘোড়ায় চেপে তিনি আসতেন সবাই তাকিয়ে থাকতো তার দিকে। আর কাউকে আমি ঘোড়ায় চড়তে দেখিনি এলাকায়। যখনই আসতেন দেখতাম লাল রঙের একটা ঘোড়া ধূলার মেঘ উড়িয়ে যাচ্ছে, তখনকার সেই দৃশ্য আমার জন্য ছিল পরম বিস্ময়ের...

প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত, প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে সবসময় পরিষ্কারভাষায় জাগতো। প্রতিটি অভিজ্ঞতার অর্থ আমার কাছে খুব চোখা ও স্বতন্ত্র হয়ে দেখা দিত...
গ্রামের ক্ষেতে ক্ষেতে নানা রঙের শাক সবজির দীর্ঘ, ঋজু সারি ঝকঝকে সূর্যালোকে যখন খলখল করে হেসে উঠতো আমার মনের মধ্যেও কেমন একটা খুশির ফোয়ারা ছুটতো...
ভোরবেলা সবুজ, ভেজা ধান ক্ষেতের আইল ধরে যখন ছুটতাম আর শিশিরের স্পর্শ লাগতো আমার গালে, পায়ে। সেই স্পর্শে অনুভব করতাম স্নিগ্ধ, মৃদু চুম্বন....

সিংধা বাঁকের সবুজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম কংশ নদের তন্দ্রালু হলুদ স্রোত বয়ে যাচ্ছে ক্লান্তিকর এক গতিতে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার ভেতর এক ধরণের অসীমের অনুভূতি জেগে উঠতো...
শরতের মেঘ ভাসা আকাশে যখন একঝাঁক বুনো হাঁস পাখা চালিয়ে উড়ে চলে যেত হাওরের দিকে। তাদের দীর্ঘ কাকলিতে আমার মনও উঠতো নেচে।
চুলার জলন্ত কাঠের সুরুসুরি দেওয়া গন্ধে আমার মনে আনতো একধরণের মিশ্র বিষণ্ণতা...

গ্রামের ভাঙা পথের ধূসর ধূলোয় খুব দেমাকের সঙ্গে দু'টো চড়ুই যখন হুটোপুটি করছিল একদিন, তাদের সেই ক্ষুদে দেমাক অনুসরণ করার অসম্ভব বাসনা জেগেছিল আমার মনেও। যখন দেখতাম একা একা পিঁপড়ে মুখে করে বোঝা টেনে চলেছে কোন অজ্ঞাত যাত্রায়, তখন ইচ্ছে হতো আমিও ওর সঙ্গী হই...
একবার চুপচাপ পানির কিনারে বসে থাকা এক চিংড়িকে খুঁচিয়েছিলাম। মাছটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে জং ধরা একটা ছোট্ট বাক্সের একেবারে ভেতরের দিকে জড়োসড়ো হয়ে লুকিয়ে ছিল। দেখে আমার অন্তর ভরে গিয়েছিল অনুশোচনায়...

তারপর কবে দেখেছিলাম অদৃশ্য সূর্যের আলোয় মেঘের দলে কেমন জ্বলন্ত সোনালী আর বেগুনি রঙ ধরে। সেই রঙের ভেতর থাকা কেমন বেদনার্ত মহিমা আমায় বিষণ্ণ করে তুলেছিল...
গাছের পাতায় পাতায় একটানা বৃষ্টির শব্দে অনুভব করেছিলাম এক ধরণের উদাসীনতা..
পঁচা কাঠের অন্ধকার ফোকরে লুকানো ফ্যাকাসে সাদা ব্যাঙের ছাতা কেমন যেন দুর্বোধ্য গোপনীয়তা ধারণ করতো...

আব্বার কব্জির তড়িৎ মোচড়ে যখন জবাই করা মুরগির গলাটা যেত ভেঙে। এবং সেটা উঠোনময় অন্ধভাবে দাপাদাপি করে মরতো সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে নিজে না মরেও আমি যেন অনুভব করতাম মৃত্যুকে...
কুকুর বিড়ালের জিভ দিয়ে দুধ-পানি চেটে চেটে খাওয়া দেখে নিজের খেতে ইচ্ছে হতো একই কায়দায়। তারপর একদিন মনে হলো ওরা এভাবে খেতে শিখে নিজেদের কষ্টই বাড়িয়েছে শুধু...
শীতে যখন দেখতাম সদ্য কাটা খেজুর গাছ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে মিষ্টি রস। তখন তৃষ্ণায় আমার গলাটাও যেত শুকিয়ে...

এক বিকেলে বিলের ধারে শুকনো কচুরিপানার নিচে একটা কুণ্ডলী পাকানো সাপের অবসর যাপন দেখে আমার কণ্ঠ অবধি জমে ছিল কেমন একটা বিচিত্র ভয়। এবং মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়েছিল আমার রক্ত প্রবাহে...
শ্যাওলা ঢাকা বিশাল 'কালাওঝা' গাছের মৌন সৌম্যতা দেখতে কী যে ভাললাগতো আমার। উঠোন জুড়ে তোষকের মতন উঁচু হয়ে বিছিয়ে থাকা ফুল আর ফুলের গন্ধে নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম ক্রমশ...
চৈত্রের দাবদাহে ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া ক্ষেত - মাঠ দেখে আমার ভেতর জন্ম নিত এক মহাজাগতিক ক্রুরতা...

বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ আমার ভেতরকার ঘরবাড়িও ভিজিয়ে দিত। নতুন কাটা রসালো ঘাসের গন্ধে আমার মধ্যে কেমন একটা খিদে জেগে উঠতো। কেমন একটা ঘোর কাজ করতো..
এরপর যখন তারাভরা স্থির, নিস্তব্ধ রাতের আকাশ থেকে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সোনালী কুঞ্ঝটিকা চুঁইয়ে পড়তো মাটির দিকে তখন আমার অনুভবে মিশে যেত এক ধরণের শান্ত ভয়। আজ এতদিন পরেও যা আমাকে তাড়া করে ফিরে। রাতের পর রাত বাইনোকুলার জানালায় তাক করে দেখতাম অদৃশ্য সব তারাদের হঠাৎ ভেসে ওঠা...

তন্দ্রালু গ্রীষ্মরাতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া। রাত ভর ঘুরে বেড়ানো, জোনাক পোকা তাড়া করে ফেরা এবং দু'হাতের মুঠোয় তাদের বন্দী করা ছিলো রুদ্ধশ্বাস, উদবেগাকুল আনন্দ...
মিষ্টি হাস্নুহেনার পাগলকরা সৌরভে থাকতো উজাড় করা বদান্যতা...
বাতাস আর রোদের খেলায় আন্দোলিত দীর্ঘ চকচকে সবুজ ধানের ঢেউ খেলানো প্রান্তর থেকে চুঁইয়ে পড়তো বাঁধনহারা মুক্তির স্বাদ...
একদিন দেখি শিমুল গাছের শিমুল কলা ফেটে আছে। ছোট ছোট শিমুলবিচি তুলার পাখা লাগিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তখন কেমন একটা নৈর্ব্যক্তিক প্রাচুর্য অনুভব করেছিলাম...

একবার বাড়ির পেছনে একা একা হৃষ্টপুষ্ট এক পাতিহাঁস হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছিল। তা দেখে আমার গলায় বল্কে উঠেছিল করুণ প্যাকপ্যাক ধ্বণির বুদবুদ...
একদিন দেখি এক সাদা গোলাপের ওপর এক হলুদ -কালো বোলতা আনাড়ির মতো কিন্তু অসীম ধৈর্যে অনেকক্ষণ ধরে উড়ছেতো উড়ছেই। তার একটানা গুঞ্জরনে আমার মনেও রোমাঞ্চ জেগে উঠেছিল...

ক'দিন ধরে বাড়িতে আছি। শৈশবের চিরচেনা পথঘাট আর স্মৃতিভূমির দারুণ বদলে যাওয়া দেখে নিজেকে কেমন নিঃস্ব লাগছে। কেমন যেন অসহায় আর একলা লাগে। সেই পুকুর, নদী, বিল আর বৈকালিক খেলার মাঠ আজ আর নেই। নেই সেইসব অনুভূতির ফিরে আসার নাম। এখানে সময় কেবলই যায় ফিরে আসেনা কখনো, কোনদিন...
এখানে শৈশবের সাথে চোখাচোখি হয় রোজ, দেখা হয়না কখনো....
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৮ রাত ৯:৫৫
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×