হ্যারি পটারের নাম শুনেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন।প্রথমেই বলে রাখি,বিশ্ববিখ্যাত এই মুভি সিরিজটির প্রতি দুইধরনের বিশেষ চিত্তাকর্ষক(!) দৃষ্টিভঙ্গী লক্ষ্য করা যায়।
প্রথমত,হ্যারি পটারকে আলতু ফালতু বাচ্চাদের মুভি মনে করে অনেকেই এর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করাকেও অপরাধ মনে করে!কিন্তু বইগুলো পড়ার সৌভাগ্য হলে তাদের প্রায় সকলেরই পটারসম্বন্ধীয় মনোভাব ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যায়!
এবং দ্বিতীয়ত,মানবজাতির মধ্যে খুব বিরল কয়েকজন রয়েছেন যাদের বই না পড়া অবস্থায়ও হ্যারি পটারমুভিগুলো ভালো লেগে যায়।কিন্তু অতি দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে তাদের যদি হ্যারি পটার পড়ার দূর্ভাগ্য(!) হয় তাহলে অধিকাংশেরই মুভিগুলো তেমন ভালো লাগে না!
আপনি কোন দলে সেটা আপনিই ভালো জানেন।এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক...
ব্রিটিশ লেখিকা জে.কে.রাউলিংয়ের বিশ্বকাঁপানো সৃষ্টি হ্যারি পটার।আর বিশ্বকাঁপানো সেই গ্রন্থসিরিজকে অবলম্বন করে নির্মিত হয়েছে আট পর্বের মুভি সিরিজটি,যেটি কিনা এখন সর্বকালের সবচাইতে ব্যবসাসফল সিরিজগুলোর তালিকায় শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে।২০০১ সালে ফিলসফারস স্টোনের মাধ্যমে শুরু হয় সিরিজটির পথচলা আর শেষ হয় গতবছরের ডেথলী হ্যালোস পার্ট টু দিয়ে।এখন প্রশ্ন হল কতটুকু সার্থক ছিল ব্লকবাস্টার এই সিরিজটি?
সাধারনত উপন্যাস থেকে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতে মূলগল্পের স্বাদটি পাওয়া যায় না(লর্ড অব দ্য রিংস অবশ্য ব্যতিক্রম)।আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি রূপালী পর্দার হ্যারি পটারে রাউলিংয়ের হ্যারি পটারের ৫ পারসেন্টও খুজে পাওয়া যাবে না!আবার যাচ্ছেতাই বলে মুভিগুলোকে উড়িয়ে দেওয়াও যাবে না।সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারের বিশাল ব্যবসা করার পাশাপাশি খুঁতখুঁতে সমালোচকদের প্রসংশাও জুটেছে মুভিগুলোর ভাগ্যে।পচাঁ(!) টমেটোতে ফ্রেশ রেট প্রায় সবগুলোরই আশি শতাংশের উপরে।আর hp3 আর hp7.2 এর ফ্রেশ রেট যথাক্রমে ৯১% এবং ৯৬%।imdb তেও মোটামুটি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হ্যারি পটার সিরিজ।
হ্যারি জেমস পটার...বাবা-মা হারানো হতভাগ্য এই অনাথ বালক একদিন জানতে পারে তার রয়েছে বিশেষ জাদুক্ষমতা।হগোয়ার্টস নামক জাদুপ্রশিক্ষন বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে পা রাখে এক নতুন জগতে।আস্তে আস্তে সে পরিচিত হতে থাকে রোমান্ঞ্চকর জগতটির সাথে।কিন্তু নতুন জগতটিও যে ধোঁযা তুলসি পাতা নয় সেটি টের পেতেও বেশিদিন লাগে না হ্যারির।ম্যালফয় নামক এক সহপাঠীর সাথে প্রাথমিক শত্রুতা ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে।আর সেই সাথে বিভীষিকাময় অতীত তো রয়েছেই।যতই দিন যায় ততই হ্যারির জাদুর জগত্ এবং সর্বোপরি নিজের সম্বন্ধে ধারনা বৃদ্ধি পায়।একসময় সে জানতে সক্ষম হয় যে তার সামনে রয়েছে কঠিন চ্যালেন্জ,যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে তার ভাগ্য তো বটেই সেই সাথে গোটা জাদুকর সম্প্রদায়ের ভাগ্য।সিরিজটির প্রতিটি পর্বেই রয়েছে টান টান উত্তেজনা,এডভেন্ঞ্চার আর রহস্য।রয়েছে কল্পনার অসাধারন মায়াজাল আর সেগুলোর অপূর্ব বিন্যাস।কিন্তু হ্যারি পটার কি কেবলই ফ্যান্টাসি?
মুভিগুলো দেখে এমন ধারনা হওয়াই স্বাভাবিক।কেননা ফ্যান্টাসিটিই মার্কিং করে দেখানো হয়েছে ওগুলোতে,তেমনভাবে ফোকাস করা হয়নি রিয়েলিস্টিক ড্রামাগুলোর দিকে।হ্যারি পটার এমন একটি সিরিজ...যেগানে বলা হয়ে একটি অনাথ বালকের স্বপ্নের কথা,মাতৃস্নেহের কথা,বন্ধুত্বের কথা,ভালোবাসার কথা,পারিবারিক বন্ধনের কথা এবং ঘৃনা,মৃত্যুর মত বিষয়ও রয়েছে এখানে।এমনকি টিনেজারদের উড়ন্ত রোমান্স আর দূরন্ত মানসিকতার বাস্তব প্রতিফলনের দিকটিও বাদ যায়নি।ডাম্বলডোরের জ্ঞানী অথচ শান্ত অভিব্যক্তি থেকে শুরু করে ফ্রেড-জর্জের রসিকতা...প্রায় সব ধরনের চারিত্রিক বৈশিস্ট্যসম্পন্ন চরিত্রের দেখা মিলবে হ্যারি পটারে।আর চরিত্রগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল কেউই একদম ভালো বা খারাপ নয়।সর্বোত্তম ব্যক্তিটির মাঝেও আছে কিছু নেতিবাচক দিক আবার জঘন্যতম ব্যক্তিটির মাঝেও আছে কিছু দূর্বলতা।আর স্নেইপের কাহিনী না হয় নাই বললাম..!
কিন্তু দূর্ভাগ্যের সাথে বলতে হয় যে একটি মুভিতেও মূলগল্পের স্বাদটুকু পাওয়া যায় না।আর ঘনঘন পরিচালক বদলের কারনে অসামন্জস্যগুলো তো রয়েছেই।আর দেখা যায় অসংখ্য কাটছাট আর ক্ষমার অযোগ্য কিছু অদল বদল!তিন নাম্বার চলচ্চিত্রে আলফেনসো কাউরনের কাজকেই আমার কাছে সেরা মনে হয়েছে।আর হগোয়ার্টসের নকশাটা আরো ধ্রুপদী হতে পারত এবং বিস্তৃতভাবে দেখালে ভালো হত।মূলগল্পে পার্শ্বচরিত্রগুলোর ব্যক্তিত্ব এবং ভূমিকা ব্যপক থাকলেও মুভিতে এদের অনেককে তেমনভাবে খুজেই পাওয়া যায় না!আরেকটি ব্যাপার হল ২০০১ সালেই সিরিজটি শুরু করা উচিত হয়নি।প্রযোজকের উচিত ছিল শেষ বইটি প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা।তাহলে সিরিজটি সম্পর্কে পূর্নাঙ্গ ধারনা পাওয়া সম্ভব হত এ টু জেড প্ল্যানিং করে কাজ শুরু করা যেত।'৯৯ সালের দিকেই দৃশ্যায়ন শুরু না করে বরং আরো সময় নিয়ে যাবতীয় সকল কাস্টিউমের পৃর্নাঙ্গ ডিজাইন করে ফেললে ভালো হত।তাহলে আর ছয় নাম্বার ছবিতে কুইডিচ জার্সি জাদুবলে(!) চেন্জ হয়ে যেত না!
অনেক অদল-বদল কাট-ছাট থাকলেও মুভিগুলো যে আর দশটা বাজারি পপকর্ন মুভির মত হয়নি তার প্রমান পাওয়া যায় মুভিরিভিউ সাইটগুলোতে।অসাধার গ্রাফিক্স আর ভিজ্যুয়াল এফেক্টের ছোয়া ছিল সবগুলো মুভিতেই।রেডক্লিফ,রূপার্ট গ্রিন্ট আর স্পেশালি এমা ওয়াটসন পিচ্চিকালেও দারুন অভিনয় করেছে।সিনিয়র অভিনেতারা অভিনয়ের খুব সুযোগ না পেলেও যতক্ষন পর্দায় ছিলেন ততক্ষন বেশ প্রানবন্তই ছিলেন বলা যায়।
হ্যারি পটার সিরিজে একদিকে যেমন রয়েছে ফ্যান্টাসির অসাধারন ইন্দ্রজাল অপরদিকে রয়েছে নিষ্ঠুর বাস্তবতার কাহিনী।একদিকে রয়েছে ভালোবাসা,বন্ধুত্বের উপাখ্যান অপরদিকে পাওয়া যায় ঘৃনা,হিংসার প্রতিফলন।বেঁচে থাকার চরম আঁকুতির পাশাপাশি মৃত্যুর ভয়াবহতাকে বেছে নেওয়া..সবই রয়েছে সিরিজটিতে।হ্যারির সাহসিকতা,রনের সরলতা,হার্মায়েনীর বুদ্ধিমত্তা,ডাম্বলডোরের প্রাজ্ঞতা অথবা স্নেইপের রহস্যময়তা..এর সবকিছুই আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে।রহস্য,এডভেঞ্চার,ফ্যান্টাসির পাশাপাশি ভালোবাসা,বন্ধুত্ব,ঘৃনা,মূত্যুর ড্রামাগুরোর বিন্যাস দেখে একটি কথাই বলা যায় যে হ্যারি পটার কোন অবাস্তব ফ্যান্টাসি নয় বরং বাস্তবতাকে পাশে রেখে কল্পনার মায়াজালের মহাকাব্যিক কাহিনী...