'একুশ' বাঙ্গালী জাতীয় জীবনে শুধু একটি গাণিতিক সংখ্যা কিংবা কেবল ইতিহাসের বর্ধিত কলেবর নয়। নয় কেবল প্রভাতফেরি অথবা আবেগঘন কন্ঠে উচ্চারিত গান- 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী/আমি কি ভুলিতে পারি'। একুশ বরং একটি স্বতন্ত্র ইতিহাস; একটি ভাষার পূনর্জন্ম, পৃথিবীর সকল মাতৃভাষার সার্বভৌমত্ব অধিকারের সংবিধান; সভ্যতার জলজ্যান্ত সাক্ষী, কালের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর!
সময়ের যুগোপযোগীতায় এ দিনটি আমাদের মাঝে তার উপস্থিতি জানান দেয় একান্ত স্বকীয়তা নিয়ে। কখনো ধর্মীয় অনুশাসনের মাঝে বন্দি হয়ে, কখনো রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে অগ্নিঝরা দিন হয়ে। দেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে যদিও একুশ এনেছে স্বতন্ত্রতা তবুও আমরা সর্বদাই একে পেয়েছি এক জায়গায়- স্বমহিমায়। আর তা হলো এই একুশের ক্ষণেই রচিত হয়েছিল বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠা মর্যাদার গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। যারা আমাদের বাক স্বাধীনতার টুটি চেপে হত্যা করতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে বায়ান্ন'র এই দিনে গর্জে উঠেছিল প্রতিবাদী স্বরগুলো। যার নাম ভাষা আন্দোলন এবং এরই স্বার্থক বাস্তবায়ন- একুশে ফেব্রুয়ারী। সেই থেকেই একুশ আমাদের জাতীয় চেতনা।
আজ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মাতৃভাষার জন্য পূর্ব বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) শিক্ষিত সমাজ যা করেছিল তা বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মাতৃভাষার জন্য উৎসর্গকৃত প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত ভাষাকে সম্মান জানিয়েই ১৯৯৯ সালে Unicef এর অঙ্গ সংগঠন Unesco ঘোষণা করেছে "International Mother Language Day"। তবে একটি বিষয় এখানে স্পষ্ট করা দরকার তা হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাংলাভাষাকে সম্মান দেখিয়ে ঘোষণা করা হলেও মূলতঃ এর মাধ্যমে পৃথিবীর সকল মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অথচ ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পরও আক্ষেপের সাথে বলতে হচ্ছে, এই সহজ সত্যটি আমরা কেউ উচ্চারণ করিনি, করতে চাইনি। রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, শফিউলদের রক্তস্নাত ফ্রেব্রুয়ারীর চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমাদের বলা উচিত ছিল- 'আমাদের মাতৃভাষার মতো অন্য কোন ভাষা যেন পুঁজিবাদী শোষক শ্রেণির রক্তচক্ষুর কবলে না পড়ে। পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্র মাতৃভাষাও যেন হারিয়ে না যায় কালের পরিক্রমায় ইতিহাসের গর্ভে।' কিন্তু সেটা তো করছিই না, এমনকি নিজের মাতৃভাষার প্রতিও আমরা চুড়ান্ত উদাসীনতা দেখাচ্ছি। যে বাংলা ভাষার জন্য এত রক্তক্ষয় সেই ভাষার রক্ষা, চর্চা ও এর প্রয়োগে আমরা কতোটা সচেতনতার পরিচয় বহন করি তা আমাদের আশেপাশে দৃষ্টি দিলেই দেখতে পারি! বাংলাদেশের শহর তো বটেই উপজেলা, ইউনিয়ন লেভেলে পর্যন্ত মার্কেট, ভবন ও প্রতিষ্টানগুলোর সাইনবোর্ড লেখা হয় ইংরেজীতে। আশ্চর্যের বিষয় ইদানিংকালে হিন্দিও পরিলক্ষিত হয়! শুধু তাই নয় বাংলাদেশের শিক্ষিত মিডলক্লাস তাদের সন্তানদের বাংলা মাধ্যম বাদ দিয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে আগ্রহী দেখা যায়। বাংলা মাধ্যমে পড়ানো যেন সেকেলে ব্যাপার! এই হলো আমাদের বাংলা ভাষার প্রতি দৈন্যতার উদাহরণ। এই অবস্থায় আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম কি করে বাংলা ভাষার প্রতি অনুরক্ত হবে এবং বাংলা ভাষার যথাযথ প্রয়োগ হবে সেটি এই সময়ের সর্বাপেক্ষা বড় প্রশ্ন। উপরোক্ত কথাগুলোর মানে এই নয় যে, আমরা অন্যান্য ভাষার বিরোধীতা করছি। আন্তর্জাতিক ভাষা হিশেবে ইংরেজি ভাষার প্রয়োজন রয়েছে। তবে 'আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি তারপরে ইংরেজি শেখার পত্তন'। কবিগুরুর উদ্ধৃতিটি ভুলে গেলে চলবে না। কেবল পড়াশোনার ক্ষেত্রেই নয় আমরা আমাদের আচার-অনুষ্টানে, টিভি, বেতার প্রোগ্রামে এমনকি সরকারী দপ্তরে পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে একপেশে করে রেখেছি। অথচ এই কাজ যে কতটা গর্হিত কাজ তা অনুমেয়।
বাংলা ভাষার চর্চায় এরুপ অবহেলা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।একসময় বলা হতো বৃটিশদের সুর্য অস্ত যায়না। তারা সারাবিশ্ব শাসন করেছে এবং সেই সুযোগে তাদের ভাষার প্রভাব ছড়িয়ে দিয়েছে সর্বত্র। আজ তাদের সম্রাজ্য, উপনিবেশ কোনটিই নেই। কিন্তু ভাষার কর্তৃত্ব অবিচল আছে। জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে হলে আজ ইংরেজি ভাষাজ্ঞান অপরিহার্য। এর কারন ইংরেজির চর্চা ও প্রচার। বর্তমানে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা যে অবস্থানে আছে তা কিন্তু একদিনে সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ বন্দুর পথ অতিক্রম করে তবেই আমরা বাংলা ভাষা পেয়েছি। হাজার বছরে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ভাষা। সমৃদ্ধ হয়েছে সাহিত্য অঙ্গন। বেড়েছে সাহিত্যকর্মি, লেখক, প্রকাশক। ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্টা; ১৯৬৮ সালে মুনীর অপটীম বাংলা টাইপরাইটার; ১৯৭০-এ বাংলা সাটলিপি; ১৯৭২ এ বাংলা বিশ্বকোষ ও বাংলা উন্নয়ন বোর্ড; ১৯৮৬ তে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু; ১৯৯২ এ প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম; ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসপ্রাপ্তি; ২০০১ এ মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা; ২০০২ এ সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষা; ২০০৩ বাংলাপিডিয়া ইত্যাদি দীর্ঘ এই সময়ে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল। তবে এসব উন্নতি দএখে মনে হয়েছিল, একদিকে জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার, অন্যদিকে ব্যপক অনুবাদ-পরিভাষা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা ভাষা স্বদেশ তো বটেই বিদেশেও অন্যান্য ভাষার মধ্যে নিজের অবস্থান করে নিবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। অথচ মাতৃভাষা হিশেবে বাংলার দৃষ্টান্তকে সম্মান ও স্মরণ করে ইউনেস্কো 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' ঘোষণা করেছে।
আজকের পৃথিবীতে বিশ্বায়নের চাপে নির্দিষ্ট একটি ভাষার ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে গেছে। এর ফলে ছোট ছোট ভাষাগুলোই কেবল নয় অনেক প্রধান ভাষারও অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। খুব কম ব্যবহৃত হয় পৃথিবীতে এমন অনেক স্থানীয় বা আঞ্চলিক ভাষা ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিশ্বায়নের প্রবল চাপই যে তার একমাত্র কারন তা কিন্তু নয়। এসব ভাষার এই দূরাবস্থার মূলে ছিল চর্চা, পঠন ও পাঠনের অযত্ন-অবহেলা এবং উদ্যোগহীনতা। এ সমস্ত ক্ষেত্রে ভাষাগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন হয় সর্বাগ্রে। কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা বরাবরই এসব ব্যাপারে উদাসীন। যদিও প্রতিটি দেশের সরকারের উচিত আঞ্চলিক, সংখালঘু বা বিচ্চিন্ন জনগোষ্ঠির ভাষাকে অবহেলা না করে সেসব ভাষায় ঐ জনগোষ্ঠির লোকেদের অধ্যয়ন ও ব্যবহারের অধিকার সংকুচিত না করে তার ব্যবস্থা করা।
মাতৃভাষার উপর প্রকাশিত- 'এ্যটলাস অব দ্য ওয়ার্ল্ড ল্যাংগুয়্যাজ ইন ডেঞ্জার অব ডিস এ্যপিয়ারী'তে উল্লেখিত এক পরিসংখহানে দেখা যায়, পৃথিবীতে ৬২ হাজার ৮০৯টি ভাষা আছে এবং সেগুলো 'জীবন্ত ভাষা' নামে পরিচিত। এতে উদ্বেগের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে এগুলোর অর্ধেকের মতো হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে! আশ্চর্যের বিষয় হলো- বর্তমান বিশ্বের ৮৬টিরও বেশি ভাষায় কথা বলে গড়ে ১ জন লোকে। এখন যদি ঐ ব্যক্তির মৃত্যু হয় তবে স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবী থেকে একটি ভাষার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আমাদের দেশেও বাংলা ছাড়া আরো ৩৬ রকম মাতৃভাষার প্রচলন আছে। সগুলোর ধারক ও বাহক আধিবাসী সম্প্রদায়। এদের মধ্যে চাকমা ভাষাভাষীদের সংখ্যা ৩ লাখের মতো, ডারলঙ ৯ হাজার। এছাড়াও কোক, লুসাই, ম্র, রিয়াং, খিয়াং প্রভৃতির মতো অসংখ্য ভাষা সম্পর্কে আমরা অজ্ঞাত। অথচ এসব ভাষার অভ্যন্তরে লুকিয়ে আছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মত গৌরবময় ইতিহাস ও বর্ণময় ঐতিহ্য। সুতরাং এসব ভাষাও আমাদের সম্পদ। বাংলা ভাষার মতো সবধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এই ভাষাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
মাতৃভাষার জন্য আমরা প্রান দিয়েছি। কিন্তু আমাদের অবজ্ঞার শিকার হয়ে যদি চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অন্য একটি মাতৃভাষা বিলুপ্তির পথে হাটে তবে এটা মহান একুশের শিক্ষা হতে পারেনা। শুধু ফেব্রুয়ারী এলেই যে আবেগাপ্লুত হয়ে নির্দিষ্ট একটি দিনকে উদযাপনকরা হবে এটা যথেষ্ট নয়। বরং সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে ভাষাকে সুদৃঢ় ও সমৃদ্ধ করতে। একুশে ফেব্রুয়ারী কেবল বাংলাদেশির নয়, সারা বিশ্বের। এ দূর্লভ অর্জন যেমন আনন্দের তেমনই এর মর্মবাণী উপলব্ধি করতে না পারাটা বেদনারও। সাহিত্য, শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষার শুদ্ধ প্রচলন বাড়াতে হবে। তবেই যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে সেইসব ভাষা শহীদদের প্রতি, যাঁদের জন্য আমরা বাংলাকে পে্যেছি মাতৃভাষারুপে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৪৬