somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রত্যয়ী আমার ঘরে এসেছিল

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ২:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রত্যয়ী আমাকে প্রায় বলতো - আমাদের একটা ঘর হবে কবে?
আমি মজা করে বলতাম - চলে আসো আমার রুমে। রুম্মেটদের তাড়িয়ে দিবোনে!

প্রত্যয়ী হাসতো। হো হো করে হাসতো। হেসে হেসে বলতো-
'কি করবা রুমে আসলে?'
বলতাম - 'পুরুষ হবো, এক্কেবারে পুরুষ!'
'থাক! পুরুষ হওয়া লাগবে না তোমার আর। তুমি আমার অর্ঘ্য সোনা আছো, অর্ঘ্যসোনাই থাকো'

টিউশনির এ মাসের বেতনটা পেয়েই নতুন একটা মোবাইল কিনেছি। নকিয়া 2100 মডেলের। প্রত্যু বলেছে এইটাই আমার জীবনে নেয়া সেরা সিদ্ধান্তের একটা। সেটটা নাকি তার অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি অবশ্য বরাবরের মত ভাব নিয়ে বলেছি-
'দেখতে হবেনা, পছন্দটা কার!'

এই কথাটা প্রত্যয়ীর বহুবার শোনা। গত ফাল্গুনে হালকা নীলচে একটা শাড়ি পড়ে জীবনের সেরা সাঁজটা সেজেছিলো প্রত্যয়ী। এমনটাই তার দাবী। আমি বরাবরই বলে এসেছি-
'তুমি না সাজলেও আমার চোখে তুমি রাণীই থাকবা'। এই কথাতেও তার মন ভরেনি।
সারাদিন শাহবাগ-দোয়েল চত্ত্বর- টিএসসি- শহীদ মিনার-কলা ভবন ঘুরে ফিরে আড্ডা দিয়েও ফেরার সময় দেখি তার মুখে হাসি নেই! জিজ্ঞেস করলাম - কি হয়েছে?
'আমি আমার জীবনের সেরা সাঁজটা সেজে আসলাম, আর তুমি কোন কিছুই বললা না?'
'ওহ সরি! কি বলতে হবে বলো?'
'থাক! লাগবে না বলা!'
'আরে না না। বলো কি বলতে হবে?'
'গাধা একটা! বুঝোনা? আমাকে কেমন লাগছে দেখতে বলো?'
'সত্য করে বলবো?'
' না মিথ্যা মিথ্যা বলো' :/
'আমি ক্লিওপেট্রাকে দেখিনি। প্রত্যুসোনাকে দেখেছি! দেখতে হবেনা, পছন্দটা কার!'
'থাক হইসে। তোমার আর ঢং করা লাগবে না'

এভাবেই চলতো আমাদের খুনসুটি। অনার্স শেষে মাস্টার্সে যখন ভর্তি হই তখন আমার সামনে ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তাটা বাসা বাঁধে। প্রত্যয়ীর ইচ্ছানুযায়ী বিসিএস এর প্রিপারেশন নেয়া শুরু করি। কিন্তু হলে থেকে বিসিএস এর প্রিপারেশন নেয়াটা সমস্যা হচ্ছিলো ভেবে একটা বাসার খোঁজ করতে থাকি। আপাতত ইনকাম বলতে মাসে চারটা টিউশনি থেকে পাওয়া ১১ হাজার ৫০০ টাকা। তাই মনে মনে প্রিয় শহীদুল্লাহ হল ছেড়ে একটা বাসার খোঁজ করতে থাকি। শান্তিনগরে চামেলিবাগে একটা একরুমের বাসা পেয়ে যাই। মাসিক ভাড়া ৫ হাজার। এক মাসের এডভান্স দিলেই হবে। বাসাটা নেওয়ার রিস্কটা নিয়ে নিলাম কারণ বাসাটা একটা চিলেকোঠার মধ্যে। আমার অনেক অনেক পছন্দ হয়েছে। বাসাটা কনফার্ম করেও প্রত্যয়ীকে কিছুই জানাইনি এই সংক্রান্ত।

হল ছাড়ার আগের দিন প্রত্যয়ীকে আমি জানাই- আমি আর হলে থাকছি না। প্রত্যয়ী আমার কথায় রাগ করে। আমি ওর রাগ ভাঙ্গাতে বলি-
'তুমি না আমাদের একটা ঘর চেয়েছিলে? এই তোমার ঘর। সারপ্রাইজ দিবো বলে কিছু জানাইনি তোমাকে'
প্রত্যয়ী অবাক হয়। আমার কথা শুনে মুগ্ধ হয়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি-
'কবে আসবে আমাদের সংসারে'?
প্রত্যয়ী লাজুক হাসি হাসে। মেডিকেল এপ্রনটা আরো ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নেয়। লজ্জা লজ্জা চোখে বলে উঠে- 'না আমি আসবো না, আসলেই তুমি পুরুষ হইতে চাইবে!'
'তোমার ছোঁয়া পেলে যে আমি সর্বদায় পুরুষ ,হে নারী'!

প্রত্যয়ী সেদিনের মত বিদায় নিয়ে বাসায় চলে যায়। তিনদিন হলো আমি নতুন বাসায় উঠেছি। ঘরের নাম দিয়েছি- 'ইহা অর্ঘ্যের রাজ্য, প্রত্যয়ীর সাম্রাজ্য' । প্রত্যয়ীর সাম্রাজ্যে এই তিনদিনে একবারের জন্যেও আগুন জ্বলেনি। প্রত্যয়ীর এলেই রান্না হবে এইখানে।

এক সকালে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনি। ঘুম-ঘুমু চোখে দরজা খুলে দেখি আমার ক্লিওপেট্রা নীল শাড়ি পড়ে সামনে দাঁড়িয়ে।
'কি ব্যাপার! ফোন না দিয়ে এক্কেবারে সরাসরি অর্ঘ্যের রাজ্য দখলে চলে এলেন যে'? মৃদ্যু হেসে আমি বলি!
'ইহা প্রত্যয়ীর সাম্রাজ্য হে বৎস! আমার আনুগত্য গ্রহন করো'

আমি সুবোধ বালকের মতো তার আনুগত্য গ্রহন করি। প্রত্যয়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আজ ক্লাসে যাবেনা, এমনকি আমাকেও ক্লাস টিউশনি কোত্থাও যেতে দেবেনা। আমি তাহার স্বৈরাচারী আচরণে নীরবে মেনে নিই। তার জারি করা ১৪৪ ধারা ভাঙাবার সাহস আমি দেখাইনি।

প্রত্যয়ী পুরোটা রুম এক এক করে গোছাতে থাকে। আমি চৌকিটার উপর শুয়ে দেখতে থাকি -কতোটা পরম মমতায় সে গুছাচ্ছে ঘর।
স্বৈরাশাসকের মত সে অর্ডার করে- তাকিয়ে থাকলে হবে? যাও বাইরে যেয়ে নাস্তা নিয়ে আসো। আর বাজার করে নিয়ে আসো। আজ আমি তোমাকে রেঁধে খাওয়াবো।
'একেলা পাইয়াছি হেতা পলাইয়া যাবে কোথা'- সামরে রেখে কি আর বাজারে যেতে ইচ্ছে করে?
তবুও গেলাম! রানীর আদেশ! মানতে তাই বাধ্য!

বাজার সেড়ে ঘরে ফিরে দেখি চমৎকার একটা গুছানো ঘর। এই আমার ঘর- এই আমার বেহেশত। প্রত্যয়ীর চশমাটা খুলে আমার ঘরের ছোট্ট হাত আয়নাতে নিজের কপালের টিপটা ঠিক করছে। অদ্ভূত রকমের সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। যেন এরচে সুন্দরী আর কাউকে কখনো দেখিনি আমি!

ক্ষণিক তাকিয়ে থাকার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। আয়নাটা ফেলে তার ওষ্ঠে চুমু খেতে থাকি। একের পর এক, অনেকগুলো। একবার-দুইবার-তিনবার- বহুবার।
তারপর...
তারপর আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই, হারিয়ে যাই।

সন্ধ্যা হলে প্রত্যয়ী বাসায় ফেরার তাগাদা অনুভব করে। ওকে ছাড়া আমার আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমি ওকে জোর করে বলতে থাকি- থেকে যাওনা আজ! তোমাকে ছাড়া এই ঘর আমার শুন্য লাগবে!
প্রত্যয়ী কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বলে- আবার আসবো! আমাকে এখন যেতে দাও।
আমি শান্তিনগর মোড়ে গিয়ে ওকে রিক্সায় তুলে দিয়ে আসি। ফেরার পথে চামেলিবাগ হয়ে শহীদবাগে যাই। শহীদভাগ থেকে ফেরার পথে রাস্তায় তিনজন পথ অবরোধ করে। কিছু বুঝে উঠার আগেই মোবাইল, মানিব্যাগ নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। আমি বেবোধের মত তাকিয়ে দেখতে থাকি আমার মোবাইল ছিনতাই হওয়ার দৃশ্য।

মোবাইল হারানোর বেদনা আমার কাছে তীব্রতর হতে থাকে। কিন্তু সারাদিনের কথা মনে করতেই কেমন ভুলে যাচ্ছি বারবার মোবাইল হারানোর কথাটা। প্রত্যয়ী বাসায় পৌছালো কিনা তাও জানা হলোনা। রাতটা আমার আনন্দ-বেদনায় একাকার হয়ে ছটফট করে কাটে।

পরের দিনের ভোর। আমি মোবাইলের দোকানে যাই প্রত্যয়ীকে ফোন দিয়ে খবরটা জানানোর জন্যে। প্রত্যয়ীর মোবাইল বন্ধ। ভাবলাম- রাগ করেছে বোধহয়!
যাইহোক ওর কলেজে যাবো নে এখন- সিদ্ধান্ত নিই।
৮ টাকা দিয়ে প্রথম আলো পত্রিকা কিনে রুমে ফিরে। শেষ পৃষ্টার ইনসেটে অল্প করে লেখা 'রাজধানীতে বাসের ধাক্কায় রিক্সারোহী পিষ্ট' -ছবিটা প্রত্যয়ীর!

মুহূর্তে আমার মনে হলো সারা পৃথিবী ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দুলছে। আমি চিৎকার করে পত্রিকাটি ছিঁড়তে থাকি, চোখের সামনে যা পাই তাই ভাঙতে থাকি। তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই...কিচ্ছু না।

এখন অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। বদলে গেছে আমার পৃথিবী। আমার কাছে আমার সাম্রাজ্যটা নেই তবুও কেমন যেন আছি। ভালো আছি না খারাপ আছি এই বোধটুকু আমার মধ্যে কাজ করেনা।

শুধু এইটুকু জানি আমি ঢাকা শহরে আর এখন বাসে চড়িনা, গাড়িতে চড়িনা। রিক্সাতে করে পুরো শহর ঘুরি। রিক্সাতে বসেই প্রত্যয়ীকে খুঁজে পেতে চাই। আমার খুব বিশ্বাস একদিন একটা বাস এসে আমার রিক্সাটাকে পিষ্ট করবে আর আমি প্রত্যয়ীর কাছে চলে যাবো। আমার প্রত্যয়ীর সাথে আবার মিলিত হবো। প্রত্যয়ী আমাকে দেখে খুশি হবে। সেই খুশিতে ম্লান হবে পৃথিবীর বাকি সকল আনন্দযজ্ঞ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:৪৪
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×