somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেড়-ঘণ্টার রোমাঞ্চকর বাঁক......!! (নো ম্যান্স ল্যান্ড-৭)

২১ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মিরিক লেকের পাহাড়ি ঢালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে থাকা জীপের ছাদে উঠে পড়লো মাধবী আর অরণ্য। ড্রাইভারের ঠিক মাথার উপরে দুটো টায়ারের মাঝের ফাঁকা জায়গায় বসে পড়লো ওরা দুজন। শেষ বিকেলের রঙিন আলোয় জীপ চলতে লাগলো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা আর উঁচুনিচু, ঘন অরণ্যে ছেয়ে থাকা রাস্তা, ক্ষণে-ক্ষণে ঘিরে ধরা অন্ধকারের ভয়ানক বাঁকে-বাঁকে। এই ডানে উঁচু পাহাড় তো বামে গভীর গিরিখাত! আবার বামে উঁচু-উঁচু পাহাড় তো ডানে গভীর গিরিখাত!

জীপে যখন বাঁক নিচ্ছিল ওদের অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে পড়ছিল যে শুধু টায়ার ধরে থেকে সামলানো মুশকিল! টায়ার সহই উড়ে যেতে পারে যে কোন এক পাহাড়ের গভীর খাঁদে!আর সেই জীপ ফাঁকা রাস্তায় এতোই দ্রুতবাঁক নিচ্ছিল যে, একবার পড়ে গেলে কেউ জানতেই পারবেনা যে কে, কোথায়, কখন আর কিভাবে পড়ে গেল!

একবার কোন এক বাঁক নিতে গিয়ে সামান্ন ঝাঁকুনি লেগেছিল আচমকা জীপের ব্রেক কষাতে! আর তাতেই ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়! কোন মতে আঁকড়ে ধরলো একে অন্যকে, মাধবী আর অরণ্য! একটি টায়ার প্রায় গাড়ির কাঁচের কাছে এসে পড়েছিলো! সে যাত্রায় একে অন্যকে আঁকড়ে বেঁচে গিয়েছিল ওরা! তবে ভয়ের চেয়েও বেশী ভালো লেগেছিল এক অনন্য রোমাঞ্চ! অরণ্যকে উচ্ছ্বসিত করেছিলো মরণ নেশা ছুঁয়ে যাওয়ার উম্মত্ত আনন্দ! আর মাধবীকে,অরণ্য...! মাধবীকে স্পর্শ করছিল অরণ্যর সেই আঁকড়ে ধরা। ছুঁয়ে দিয়েছিল মাধবীর মন-প্রাণ! আকস্মিক আর অজান্তেই...!!

এরপর ওরা দুটো টায়ার এক জায়গায় করে নিল এতটুকু ফাঁকা না রেখে! পিছনের রেলিং এর সাথে ওদের ব্যাগ, সেই ব্যাগে হেলান দিয়ে ওরা দুজন। দুই জনের দুই হাত দুজনের টায়ার ধরেছে শক্ত করে, আর অন্য দুই হাত দুইজনের হাতের বন্ধনে হয়েছে আবদ্ধ! হ্যাঁ নিরাপত্তার খাতিরে, আতঙ্ক দূরে রাখতে, একে অন্যকে সাহস যোগাতে, বাকি পথটুকু হাসি-আনন্দে, আতঙ্ক-উচ্ছ্বাসে আর একে অন্যের সাথি হতে...!

প্রায় ৩০ মিনিট চলার পরে চা বাগানের সবুজ আলোতে পড়া সোনালি সূর্যের রঙে ভেসে গেল চারদিকের সাদা মেঘ, সবুজ পাহাড়, দূরের ধুসর মেঘ আর পাহাড়ি বর্ণিল গ্রাম। যেদিকে আর যতদূর চোখ যায় বর্ণিল আকাশ, রঙিন মেঘ আর নীল পাহাড়ের সিঁড়ি যেন থরে থরে বসে আছে কারো পথ চেয়ে, অনন্ত অপেক্ষায়! যে অপেক্ষার শেষ নেই, হবেনা কোনদিন! প্রকৃতির এই মাধুর্যতায় খুব বেশীক্ষণ হারিয়ে যেতে পারেনি ওরা, ঘিরে ঘরেছিল উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারিতে দাড়িয়ে থাকা গহীন অরণ্য!

কখনো ঘিরে ঘরছে কালো পাহাড়ি অন্ধকার, কখনো ক্ষীণ আলোর রেখা, কখনো মাথার উপর থেকে ঝরে পড়ছিল পাহাড়ি ঝর্ণার নিস্পাপ অশ্রু! কখনো গাছের ডালের হাত থেকে চোখ-মুখ বাঁচাতে নুয়ে পড়া একে অন্যের উপর! কখনো ছোবল মারছিলো বাসের কচি পাতার ধারালো ফলা! কখনো ওদেরকে ঘিরে ধরছিলো ধূসর মেঘ, আর রাস্তার ভয়াবহ বাঁক থেকে বাঁচতে অরণ্য আর মাধবী নির্ভরতার আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছিল একে অন্যের বন্ধনে, আবদ্ধ হয়ে!!

এরপর অরণ্য আরো গভীর আর অন্ধকার হল! গাছের ডাল গুলো আরও নিচে নেমে এলো! আগের চিকন ডালের জায়গা নিল মোটা শুকনো আর সূচালো এক একটা ভয়াবহ ডাল! যে ডালের থাবা ও ছোবল থেকে শুধু হাত আর বাঁচা সম্ভবনা! হাতে বেশ বেশ লাগছে, এমনকি কেটেও গেল দুই এক জায়গায়! তাই এবার খুব দ্রুত অরণ্য ওর ব্যাগ থেকে গেঞ্জি বের করে প্যাঁচালো দুই হাতে, আর মাধবী ওর ওড়না প্যাঁচালো ওর দুই হাতে! এরপর থেকে গাছের ডাল এলেই ওরা ওদের দুই জনের দুই হাতে দুজনকে বেঁধে ফেলে, বাকি দুই হাত উঠিয়ে দেয় কপালের উপরে! যেন গাছের ডাল হাতে লেগে, মাথার উপর দিয়ে চলে যায়!

বিকেল প্রায় শেষ, সন্ধা নামবে এমন সময় ওরা পাহাড়ি পথ প্রায় শেষ করে ফেলেছে। বেশ অনেক্ষন পরে ওদের জীপ আবারো চলে এলো চা বাগানের ভিতরে। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে, ঝর্ণার ধারা হয়ে ছুটে চলা পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর কান্না বা অভিমানি গান! লোহার ব্রিজের ঝংকার তোলা কান ফাটানো শব্দ, ভিজিয়ে দেয়া মেঘেদের দল, ছেকে ধরা বানরের কলরব, গাড়িতে লাফিয়ে ভয় ধরিয়ে যাওয়া বানরের বেয়াদবি আর ভঁয়ে আতঙ্কে আঁতকে ওঠা মাধবীর আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলে আশ্রয় খুঁজে নেয়া অরণ্যর বুকে...!!

যা মাধবীর আনন্দ আর অরণ্যর অসস্থি এখন......!

এভাবে আরও প্রায় ২০ মিনিট চলার পরে ওরা চলে এলো সমতলের রাস্তায়। এবার জীপ যেন চলছেনা, রীতিমত উড়ছে যেন...!! চারিদিকের গাছপালা, চা বাগান, বন-জঙ্গল, পাহাড়ি জলাশয়, বাড়ি-ঘর যেন শা-শা করে পাশ কাটিয়ে উড়ে চলেছে ওদের জীপ! যেটা এতক্ষণ ধরে চলে আসা পাহাড়ি রাস্তার চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল! যেকারণে এবার নিজেকে বাঁচাতে আর ভারসম্য বজায় রাখতে অরণ্যকেও ধরে থাকতে হল মাধবীকে...!! ওদের জীপ না এসে পৌছা পর্যন্ত শিলিগুড়ি জংশনে...!!

নেমে এলো ওরা, জীপের ছাঁদ থেকে, একে অন্যের হাত ধরে বা হাতের মাধবী আর অরণ্যর হাতের সাহায্যে......

খুব ক্লান্ত ওরা খুব ক্লান্ত... সারা রাস্তার পাহাড়ি পথের ঝাঁকুনি, ভয় আতংক ওদের আরও ক্লান্ত করে তুলেছিল মানসিকভাবে। এবার একটু চা বা কফি না পেলেই নয়। হাটতে হাটতে ওরা গিয়ে বসলো পাশের শিলিগুড়ি রেল ষ্টেশনের এক ফাঁকা রেল লাইনের উপরে গিয়ে। রেল লাইনে যাবার আগে প্ল্যাটফর্ম থেকে নিয়ে নিল দুই মগ ভর্তি কফি।

কফিতে চুমুক দিচ্ছিল আর কথা বলছিল ওদের আগামী দিন সকালে দেখা হওয়া, মাধবী সাথে করে নিয়ে আসবে অধরাকে বিধান মার্কেটের এক কফি সপে...

ওরা এখন উঠবে, মাধবী ফিরে যাবে ওর হোস্টেলে আর অরণ্যকে খুঁজে নিতে হবে একটি ঠিকানা, এক রাতের আবাস। একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নেবে, সেই প্রত্যাশা জানিয়ে ধরবে দুজন দুজনের পথ......

কিন্তু কিভাবে আর কি কারণে যেনপিছনের শিলিগুড়ি ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে ভেসে এলো এই গান......

“আজ ফিরে না গেলেই কি নয়...”
“সন্ধা নামুক না, জোনাকি জ্বলুক না...”
“নির্জনে বসি আরো, কিছুটা সময়”
“কিছুটা সময়......”

হেসে ফেলল মাধবী আর অরণ্য দুজন-ই, লাজুক চোখে তাকিয়ে, দুজনের দিকে.........!!

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ১১:৫৯
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×