সালাউদ্দিন শাহরিয়া
টেফাই এই নামটা মানুষ শুনলে ভয় পেতো। শুধু আমিরপুর এলাকা জুড়ে টেফাই এর অবস্থান ছিলো। শিশুরা যখন রাতে ঘুমাতো না এবং বিভিন্ন দুষ্টুমি করতো তখন টেফাই আসছে বললে একদম চুপ হয়ে ভদ্রভাবে থাকতো। বাজার হাটে মানুষ সন্ধ্যার আগে সময় সব কেনাকাটা করে নিতো। সবাই অসহায় অবস্থায় আছে। টেফাই কখন কোথায় আক্রমন করবে এই ভয়ে। অন্য অঞ্চলের মানুষ আমিরপুর অঞ্চলে আসতো না । তাদের ভিতর ভয় আরো বেশি। যদি আমিরপুর অঞ্চলের টেফাই আমাদের সাথে চলে আসে তাহলে তো আমাদের অঞ্চলেও এর যন্ত্রনা ভোগতে হবে। এই বিষয় নিয়ে একটা পরগনা চিন্তিত।
একজন লোক আরেক জনকে জিজ্ঞাসা করতো টেফাই কি? উত্তর ছিলো টেফাই হলো একটা ভূতের নাম। আমিরপুর এলাকায় এর ভর করেছে। শুধু মানুষের বাড়িতে আক্রমন করে। মানুষের টিনের ছাদে, মাটির দেয়ালে মাটির টুকরো দিয়ে ঢিল মারে।
আমিরপুর গ্রামের মানুষ রাতে ভয়ে ভয়ে কাটাতো। দিনে কোন খুঁজ বা আক্রমন কিছুই পাওয়া যেতো না। শুধু টিনের ছাদে, আর মাটির দেওয়ালে মাটির টুকরো দিয়ে ঢিল মারার ফলে মানুষ একেকটা রাত কাটাতো একেকটা বছরের মতো। তাছাড়া ঘুম আসতো না টিনের ছাদের টিল মারার ঢাকে। টাস টাস করে ঢাকতে থাকতো নিজ বাড়ি ও আশপাশের বাড়ির টিনে। বড়রা যদিও ভয় পেতো না তবুও যন্ত্রনা ভোগতো। বাড়ির মহিলা ও শিশুরা রাতে বাহিরে পশ্রাব করতে বের হতো না টেফাইয়ের ভয়ে। এর অভিজান প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে।
জুম্মার দিন নামায পড়ালেন মসজিদের নতুন ইমাম মাও. গাজী উদ্দিন। দোয়া করে শেষ হলো। তারপর গ্রামের মুরব্বিরা বললেন ছোট বড় গ্রামের সবাই থাকতে টেফাইয়ের বিষয়ে। তারপর জমা হলো। মুরব্বিরা বললো আমাদের এলাকায় টেফাই ভর করেছে গত জুম্মাবার থেকে। আজ প্রায় এক সপ্তাহ। প্রথম দিন আক্রমন করে আমাদের প্রাক্তন ইমাম মাও. আজির আহমদের সাহেবেরে বাড়ি থেকে। তারপর থেকে শুরু হয় আমাদের এলাকার প্রতিটি বাড়িতে। ঠিক এই সময় বললেন মাও. আজির উদ্দিন আমাদের গ্রামে মনে হয় বড় করে শিরানী করা হয়নি। যার ফলে আজ আমাদের ভুগতে হচ্ছে। মুরব্বিরা বললো হতে পারে। সামনের শুক্রবার শিরানীর করার উদ্যোগ নিলো সবাই মিলে।
একে একে এভাবে ছয়দিন কাটলো যন্ত্রনায় এলাকাবাসীর। পরের দিন বড় করে শিরানী করা হলো। জুম্মার নামায পড়ে লম্বা দোয়া করা হলো। তারপর শিরানী দেওয়া হলো । সবাই মনে মনে ভাবতে থাকলো আজ থেকে হয়তো আর টেফাই এর যন্ত্রনা ভোগতে হবে না। কিন্তু রাতে দেখা যায় আরো বেশি ঢিল শুরু হলো গ্রামে। আগে থেকে দ্বিগুন টাস টাস করে ঢিল মারছে টেফাই। তারা চিন্তিত। তারপর দোষারুপ করলো গ্রামের এক দিনমজুর হানিফ মিয়া মাও. আজির আহমদ সাহেবের বিরুদ্ধে। যে উনি শিরানীর কথা বলে আমাদের গ্রামে আরো দ্বিগুন জ্বালা বাড়িয়েছেন। তখন মাও. আজির আহমদ বললেন কেনো ? আজ যদি টেফাই চলে যেতো তাহলে কেউ কি বলতো আমার পরামর্শে কাজে লেগেছে। তখন তো বলতে গ্রামবাসীর সিদ্ধান্তের ফলে। তারপর মুরব্বি সাহেব বললেন চুপ থাকো হানিফ মিয়া। সব বিষয়ে নাক গলানো তোমার অভ্যাস গেলোনা। তারপর গ্রামের প্রধান মুরব্বি হুছন আলী বললেন, টেফাই কিন্তু দিনে গায়েব হয়ে যায়। রাতে ঢিল মারে অথচ কোন জায়গা থেকে ঢিল মারা হচ্ছে তা আমরা জানিনা বা দেখিনা। কোন মানুষ যদি ঢিল মারতো তাহলে সম্ভব হতো কিভাবে সারা এলাকায় একসাথে ঢিল মারা। তাও আবার যুবক কয়েক জন রাতে পাহারা দিয়েও কাজ হয়নি। শুধু ঢিল আর ঢিল। এর জন্য আমাদের একটা পথ আছে। সেটা হলো মোল্লারে কাছে যাওয়া। সবাই বলতে থাকলো হে হে মোল্লার প্রয়োজন। তারপর পাশের এলাকার একজন মোল্লা আনা হলো। তিনি বললেন তাদের গ্রামে মসজিদের গাছ একটা কাটা হয়েছে। ওখানে থেকে জ্বীনের আসর ছিলো। গাছ কাটার ফলে তাদের বাসস্থান শূন্য হওয়াতে তারা তার প্রতিশোধ নিচ্ছে গ্রামে। সবাই বলতে লাগলো এখন কি করা যায়। তখন পাশের এলাকার মোল্লা বলল আজিরত লাগবে ৫৯৯৯ টাকা। সবাই দিতে রাজি হলো। তারপর আমিরপুর গ্রামে তার এক মুরিদ আজিরতে বসায়। বসিয়ে বিভিন্ন কলাকৌশল করে। তারপর বিভিন্ন শর্ত দিতে থাকে। একের পর এক টাকার প্রসঙ্গ উঠে। আর টেফাইয়ের বিষয়টা বুঝে সে টাকা লওয়ার সুযোগ পেতে থাকে। এক এক মিথ্যা বলে আমিরপুর গ্রাম থেকে লক্ষ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়। কিন্তু টেফাইয়ের অত্যাচার আর সহ্য করতে হয়। তারা পাশের এলাকায় অনেক বড় বড় হুজুরদেরকে চিঠি দিতে থাকে। আমিরপুর এলাকাকে সাহায্য করা জন্য। কিন্তু কোন উত্তর আসতোনা।
পাশের এলাকার মানুষ জন এ বিষয়ে নিয়ে কোন কথা বলে না। ভয়ে তাদের একটাই যদিও এ বিষয়ে কথা বার্তা বলি তাহলে আবার যদি আমাদের ওপর ভর করে।
একদিন গ্রামের দশজন সাহসী যুবক বললো বাঁচলে বাঁচবো আর মরলে মরবো তবে ঐ টেফায়ের খুজ বের করে ছাড়বোই। জীবনে মরতে হবে তো একবারই। তারপর তারা দশজন বাঁশের ঝাড়ের ঝুপে ঝুপে দা, সেল ও লাটি নিয়ে এক একটা ঝুপে সন্ধ্যার সময় থেকে লুকিয়ে থাকলো। তারা চুপ করে সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলো টেফাইয়ের আক্রমন নিয়ে। হঠাৎ দেখা যায় মাও. আজির আহমেদ লুঙ্গি পেচ মেরে কালো গেঞ্জি গায়ে মাটির টকুরা রাখা একটি ব্যাগ তার বাড়ির বাহিরের বাথরুমে গেলেন। যুবকরা যার যার জায়গায় অপেক্ষায়। একটু পরে দেখা যায় পাশের অঞ্চলের মোল্লাও মাও. আজির আহমেদের ঘর থেকে বাহিরের বাথরুমে আসলেন আর সেখান থেকে আরেকটা ব্যাগ নিলেন। সাথে দেখা যায় বাটুল আছে। আর বাটুল নিয়ে অন্য কোথাও যাচ্ছেন। আরো একটু সময় পরে দেখা যায় মাটির টকুরো দিয়ে ঢিল মারা শুরু। তবে কোথায় কিভাবে হচ্ছে তা দেখা যাচ্ছে না। একজন আস্তে আস্তে এসে দেখে যে বাথরুমের ব্যান্ডেলের ফাক দিয়ে শুধু ঢিল যাচ্ছে। এখন খেলো ধরা আর দশজনের ধোলাই শুরু। চারিদিকে হৈ চৈ শুরু টেফাই ভূত না মানুষ আর ধরা পড়েছে। ধোলাই দেওয়ার পর তাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হয়।
তারপর বিচার শুরু। তখন মুরব্বিরা বললেন তুমি একজন হুজুর হয়ে এমন কাজ করবে আমরা কখনো আশা করিনি। তাছাড়া তুমি আমাদের গ্রামের মসজিদের ইমামও ছিলে। আচ্ছা এগুলো করার কারণ কি। তখন মাও. আজির আহমদ বললো আমাকে যখন ইমামতি থেকে বেরকরা হয়। তখন আমি বেকার ছিলাম। কোন কাজ করার মতো কিছুই ছিলো না। ঠিক এই সময় পাশের এলাকার মোল্লা আমাকে পরামর্শ দেয় টেফাই সাজার। তারপর আমি বললাম টেফাই সেজে লাভ কি হবে। তখন সে বললো লাভ অনেক আছে। তখন সে আমাকে পরিকল্পনার কথা বলে। তারপর আক্রমন শুরু করি আমার বাড়ি। সেখানে আমি নাম উড়াই টেফাই এসেছে টেফাই এসেছে। আর সেখান থেকে টেফাই নাম এর উৎপত্তি। এখন লাভ হলো আমি প্রসঙ্গ তুলবো কোন মোল্লা ধরার কথা আর এখান থেকে শুরু হবে ইনকাম। তবে আমি শিরানীর কথা বলে আমাকে সন্দেহ না করার জন্য। কিন্তু পরে মোল্লার কথা বলার আগে মুরব্বিরা বলে ফেললেন। তাই সুযোগ আমাদের সুযোগ আরো বড় হয়েগেল। তারপর আমাদের আরো বড় স্বপ্ন ছিলো গ্রামে কোন বড় পীর এর খবরস্থান আছে। আমরা সেই খবরস্থানটির সেবা যত্ন না করি এজন্য টেফাই আক্রমন করতেছে বলে একটা মাজার তৈরী। সেখান থেকে টাকা ইনকাম শুরু আর টেফাইয়ের গল্প শেষ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:২১