somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবির “দায়বদ্ধতা”, ব্লগার স্বদেশ হাসনাইনের একটি কবিতা ও তৎসংশ্লিষ্ট আমার কিছু ভাবনা

৩০ শে এপ্রিল, ২০১১ ভোর ৬:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সামুতে অনেক লেখিয়ে কবিতা লেখেন। সময়াভাব ও আলসেমীর কা্রণে সবার কবিতা পড়া হয় না বা বেশীর ভাগ কবিতাই চোখ এড়িয়ে যায়। তারপরও বিশেষ যে কয়েকজনের কবিতা আমাকে টানে, ভালো লাগে এবং অনুসরন করার চেষ্টা করি, তাঁদের মধ্যে আনন্দ লীলা মজুমদার , শিরীষ , শেখ জলিলস্বদেশ হাসনাইন আছেন।

সেদিন স্বদেশ হাসনাইনের পুরোন লেখা ঘাটতে ঘাটতে কবিতা: কবি ও কবির দায়বদ্ধতা কবিতাটি আমার দৃষ্টি আকর্ষন করলো। কবিতাটিতে হাসনাইন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এনেছেন, আর তা হলো কবির “দায়বদ্ধতা বা commitment”। ব্যাপকার্থে একে আমরা কলাকৈবল্যে ব্যাপৃত শিল্পের যে কোন শাখার শিল্পীর দায়বদ্ধতার প্রশ্ন আকারেও হাজির করতে পারি। হাসনাইনের সেই কবিতা পড়তে যেয়ে আমাকে নতুন করে এই ধুন্ধুমার প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেঃ সমাজে একজন শিল্পীর (এখানে ‘কবি’ পড়ুন) দায়বদ্ধতা বলতে আমরা কি বুঝি, দায়বদ্ধ থাকাটা জরুরী কি না, বা কতটুকু জরুরী, ইত্যাদি। সেই সূত্র ধরেই হাসনাইনের ওই পোস্টে একটি দীর্ঘ মন্তব্য করেছিলাম, যা পরবর্তীতে মনে হলো মন্তব্যটি একটি আলাদা পোস্ট আকারে দিলে মন্দ হয় না, কেননা তাহলে আরো দশজনের অংশগ্রহনে এটি একটি আলোচনার প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। কবিতায় যাঁরা কবির “দায়বদ্ধতা” নিয়ে ভাবতে চান, তাঁদের প্রাণবন্ত মতামত কামনা করছি। নীচে হাসনাইনের সেই কবিতার প্রেক্ষিতে আমার মন্তব্যটি এখানে তুলে দিলামঃ

"আমরা যে কবি চাই তাকে চিনিয়ে দিতে হবে পথ,
আশার কপাট খুলে পবিত্র ইচ্ছেগুলোর কথা বলতে হবে
বিচ্ছেদের উল্টো পিঠে মানুষের ফিরে আসা বলে দিতে হবে,
ইস্পাতের শব্দ যদি সে জানে, শিকারের বল্লম করে তুলে দিতে হবে পাঠকের হাতে"


উপরের চারটি লাইন (নাকি স্তবক?) পড়ে আমার কিছু ভাবনার কথা বলি। লাইন চারটিতে সরাসরি ভাবেই একজন কবির দায়বদ্ধতা বা commitment-এর কথা বলা হয়েছে। শিল্প, বিশেষ করে কবিতা চর্চায় কমিটমেন্ট নিয়ে আমার বুদ্ধিবৃত্তি বলে যে, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নন্দনতত্ত্ব রূপকের চাতুর্য্যে, উৎপ্রেক্ষার উদ্ভাবনী ও ছান্দসিকতার মূর্ছনায় অতি সুন্দর ও অতি উৎকৃষ্ট হতেই পারে কিন্তু বৃক্ষ যদি কবির কবিতার শ্রোতা না হয়, কৃষকের পিঠে খরতাপে যখন লবণ উৎপাদিত হয়, তখন কবিতা যদি প্রেরণা না হয়, তাঁতি যদি টানা-দোটানায় কবিতার ভেতর নিজেকে খুঁজে না পায় তা’হলে কবিতা লিখার দরকার নাই। নজরুল-রবীন্দ্রনাথের যুগের পরে বাংলা কবিতা কবিরা লিখছেন নিজেদের জন্য। এই নিজ মানে তাঁর তৈরি অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন জনগোষ্ঠির এক ক্ষুদ্রাংশ। বাংলা কবিতায় অসংখ্য রূপক ক্লিশে হয়ে গেছে। রূপকের বাহাদুরি কবিতার প্রাণ নয়। এতে শব্দের,ভাষার ক্ষমতা খর্ব হয়। জোর করে ভাব তৈরি হয় না। চিন্তার চর্চা করতে হয়। চিন্তা কোনো গায়েবী ব্যাপার না। নিজেকে- নিজের স্ব ও অপর- অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে চিন্তা চর্চার প্রাথমিক পাঠ নেয়া যায়। শুধু ভাবালুতা দিয়ে কবিতা হয় না। মধ্যবিত্তের ভাবালুতা কবিতাকে বিনষ্ট করেছে(দ্রষ্টব্যঃ মহাদেব সাহা টাইপ কবিতা)। বাংলা কবিতার সঙ্গে বাংলা কবিতা প্রধান ধারার সাথে কোন সম্পর্ক নাই। কারণ প্রধান ধারা গ্রামে- কুষ্টিয়ায়, মৈমনসিংহে কিংবা অন্য কোন অঞ্চলে। শহরে খুব কম বাংলা কবির জন্ম হয়েছে। আসল পদ্য ভাষার শব্দরত্নরাজি জালালুদ্দিন পড়লে বুঝবেন। রবীন্দ্রনাথ এই ভাষার সবচেয়ে বিকশিত রূপ বলে এক অর্থে গণ্য হতে পারেন। অন্য অর্থে নয়। তিনি ভাব ও ভাষা অকাতরে নিয়েছেন বটে কিন্তু আবার পয়দা করেছেন যে ভাব তার প্রতি অনেক সমালোচনা থাকতেই পারে। তিনি ভাষার ক্ষেত্রে প্রথম বিপ্লবী। আমরা এখনও তার কবি হয়ে উঠার সাথে বাংলার জনজীবনের ভাব ও ভাষার দিক তলিয়ে দেখি নাই।

এর বিপরীত ভাবনাও আমাকে তাড়িত করে। যেমন, “কবিতা” মনে হয় প্রজ্ঞা, মনন, অনুভূতি, দার্শনিক আকুতির শব্দনির্ভর এক সংবেদনশীল নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ। এই “দার্শনিকতায়” উৎপাদনশীলতা আর ভাবুকতা থাকবে, থাকতে পারে, না-ও পারে। তাই বলে কি মানুষের সংবেদনশীলতাকে কমিটমেন্টের বেড়াজালে আটকে রেখে মাথার দিব্যি দিয়ে কবিতা লিখতে হবে?

একজন শব্দনির্মাতা তথা কবির কাজ নয় নির্দিষ্ট কোন কমিটমেন্টে দস্তখত করে নিজের প্রজ্ঞা, মনন ও আবেগানুভূতিকে খাঁচাবন্দী করা। কবি তাঁর নিজের আনন্দের জন্য লিখবেন, তাতে বর্তমান, নিকট বা দূর ভবিষ্যতে প্রাণ ও প্রকৃতিকে কতটুকু “সাহায্য” করলো- সেটা কাল বা সময়ের আবর্তে ঐতিহাসিকভাবেই নির্ধারিত হয়, হয়ে যাবে, হয়ে যেতে বাধ্য। একজন লেখিয়েকে যে কোন ধরনের কমিটমেন্টের বেড়াজালে আবদ্ধ হবার তকমা এঁটে দেয়ার ঘোর বিরোধী আমি।

কোনো কবির গায়ে রাজনৈতিক বা দার্শনিক তকমা বা ব্র্যান্ডিং করার কারণেই বহু কবিকে আমরা হারিয়েছি। আর এটা কবিতার জন্য খুবই ভয়ংকর। বাংলা কবিতার ইতিহাসে এটা বহুবার ঘটেছে। একসময় বামপন্থিরা কবিদেরকে “প্রগতিশীলতার” সনদপত্র বিতরণ করতেন। তার ফল বাংলা কবিতাকে ভোগ করতে হয়েছে। প্রজ্ঞার সাথে কাব্যের সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে। সে-কারণে কাউকে মাঠে নেমে হাল বাইতে হবে, শ্রমনির্ভর উৎপাদনশীলতার মধ্যে থাকতে হবে এটি নিশ্চিতভাবে একটি পেটি-বুর্জোয়া ধারণা। ঘাম ঝরলেই শ্রম হয় না, খুন করলেই বিপ্লব হয় না। চিন্তা স্বয়ং একটি কাজ। চিন্তা ও কাজকে আলাদা করার অর্থ হলো, বস্তু ও ভাব আলাদা করা। বিশ্লেষণের দরকার, প্রাণ ও তার রসায়নের, বস্তু ও তার বিকাশের জন্য সব কিছুকেই ভাগে-ভগ্নাংশে, বিক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া-মিথষ্ক্রিয়ার মধ দিয়ে ভেঙে-চুরে দেখা দরকার। সেই দিক থেকে বলছি, জনজীবন ও প্রকৃতির সবচেয়ে খারাপ সময়ে- যখন প্রাণ আর প্রকৃতির প্রতিকৃতি নয়- এটা আমি মানি যে নন্দনতত্ত্ব মানুষ বা প্রকৃতির ন্যারেশন নয়, মনন ও অনুভূতির মধ্য দিয়ে মেটাফোরিক ও সিম্বলিক করে তোলা। বিশ্লেষণ বা বর্ণনা নয়, মেটাফোরই ট্রান্সিড্যান্টাল সারমর্ম ধারণ করে। বিপ্লবের বীজ মেটাফোরিক। অবশ্যই “কবিতা” মনে হয় প্রজ্ঞা, মনন, অনুভূতি, দার্শনিক আকুতির শব্দনির্ভর এক সংবেদনশীল নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ।

এখন আমি কি করি বলেন তো? কোন রাহ্‌-এ যাই খোদা কি করি গো সাঁই?

** ভাষা ও তার বহিঃপ্রকাশকে কবিতার নন্দনতাত্বিক বাক্যবন্ধে আবদ্ধ করায় যে আপনি ভীষণ শক্তিশালী, উপরের কবিতাটাই তার প্রমাণ। তাই আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন রইলো আপনার প্রতি।
----------------------------------------------------------------------------------

কবিতা ও কবির দায়বদ্ধতা প্রশ্নে কারও কোন ভাবনা থাকলে শেয়ার করবেন আশা রাখি।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১১ সকাল ৮:৩৭
১২টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×