somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাহিত্যপাঠ : আলবেয়ার কাম্যুর 'দি আউটসাইডার' (প্রথম পর্ব )

২৩ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



‘দি আউটসাইডার’— যার পরতে পরতে রয়েছে বুর্জোয়া ক্যাপিটালিস্ট সমাজব্যবস্থার মূলনীতির শেকলে আটকে থাকা ব্যাক্তিজীবনের চূড়ান্ত পতনের বিধ্বংসী বীভৎস রূপ ! অনর্থক জীবনের অর্থ উদঘাটনের প্রয়াস ! এবং নিরুত্তর দুনিয়ার কাছে উদ্ভট সব জিজ্ঞাসা !
জার্মানি-ফ্রান্স যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে দাঁড়িয়ে এই বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাসটি নির্মাণ করেন ফরাসি দার্শনিক লেখক অ্যালবেয়ার কাম্যু । মূল উপন্যাসটি লেখা ফরাসিতে— ‘ল্য এত্রনজার’ । ১৯৪৬ সনে স্টুয়ার্ট গিলবার্ট যা ‘দি আউটসাইডার’ নামে অনুবাদ করেন ।
সাহিত্যের মাধ্যমে অস্তিত্ববাদী দর্শনকে জনপ্রিয় তোলার যে উদ্যোগ সার্ত্রে-বুভ্যুয়ার-কাম্যুরা গ্রহণ করেছিলেন; ‘দি আউটসাইডার’ তারই এক সার্থক বাস্তবায়িত রূপ ।
যাইহোক । তথ্য কিংবা তত্ত্বের খই ফুটিয়ে দর্শন কপচানো নয়— একজন পাঠক হিসাবে উপন্যাসটি পাঠের মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে একটা সংক্ষেপ-সার আপনাদের সামনে তুলে ধরাই এ লেখার মূল উদ্দেশ্য ।

“মা মারা গেলেন আজ । হয়তো বা গতকাল; আমি ঠিক জানি না...”
এই রকম অদ্ভুত বাক্য দিয়েই আখ্যানের সূচনা ! তারপর ক্রমাগত বিস্তার ।
উপন্যাসে নির্মিত আখ্যানের আগাগোড়ায় প্রতিফলিত হয়েছে ‘মারসো’ নামক এক ব্যক্তিক সত্তার অযৌক্তিক প্রলাপ । আশ্চর্যময় দৃষ্টি দিয়ে জগতকে অবলোকন । এবং জীবনের প্রতি বরাবরই নিরাসক্ত মনোভঙ্গি ।
বৃদ্ধাশ্রমে মায়ের মৃত্যু-সংবাদ যখন ছেলে মারসোর কাছে এসে পৌছায়— তখন আমরা দেখি মারসো মোটেই শোকাহত হচ্ছে না । তার অনুভূতির রঙও পাল্টাচ্ছে না । কিংবা মায়ের সঙ্গে অতীতের কোনো স্মৃতি রোমন্থন করার কোনো প্রচেষ্টাও নেই । বরং মায়ের লাশের পাশে বসে মারসো সিগারেট টানছে । আর অদ্ভুত হাস্যকর ভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণ করছে, শোকাহাত কান্নারত মানুষগুলোকে ।
বৃদ্ধাশ্রমের রেজিস্টার মারসোকে ডেকে এনে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করে । জানতে চাওয়া হয়— বৃদ্ধ মায়ের প্রতি তার মত অবিবাহিত টগবগে তরুণ দায়িত্বহীনতার কারণ কি ? কোনো কাঁচুমাচু নয়, মারসোর পরিষ্কার জবাব— সামান্য চাকুরী তার । যা দিয়ে তার মাকে সাহায্য করা কখনোই সম্ভব ছিল না ।
সামান্য হলেও উপার্জনের একমাত্র আশ্রয়স্থলের প্রতি মারসো কিছুটা হলেও অনুগত । ভোরে ঘুম থেকে উঠেই অফিসে দৌঁড় ! কিন্তু অফিসের বড়কর্তা যখন মারসোর অভ্যস্ত জীবনটাকে বদলে ফেলার কথা বলেন কিংবা পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের অর্থনৈতিক চাকাকে আরো গতিশীল করে জীবনটাকে অর্থময় করে তোলার জন্য তাগিদ দেন; তখনো মারসো জীবনের অভ্যস্ততায় ও অনর্থকতায় অনড়—
“কেউ কারো সত্যিকার জীবন বদলাতে পারে না; যাইহোক এক জীবন আরেক জীবনের মতই ভালো । এবং আমার বর্তমান চমৎকারভাবে খাপ খাচ্ছে আমার সঙ্গে...”
“...তিনি যে ধরণের উচ্চাশার বললেন, ছাত্র থাকাকালীন সে ধরণের প্রচুর উচ্চাশা আমার ছিল । কিন্তু পড়াশোনায় যখন ইস্তেফা দিতে হল তখন শীঘ্রই বুঝলাম এ সবকিছুই নিরর্থক...”
মারসো চরিত্রের এই ধরণের অ্যাবসার্ডিটি (absurdity) আমাদেরকে এমন এক বিদ্যমান বাস্তবতার দিকে ইশারা করে, যার মূলে রেয়েছে জগদ্দল পাথরের মত গেড়ে বসা সেই অর্থনৈতিক সিস্টেম— যার কাছে মারসোর জীবন উচ্ছিষ্টের মতই মূল্যহীন !
শুধু মা কিংবা অফিসের বড়কর্তা নয় । মারসোর এমন হৃদয়হীন কাণ্ডজ্ঞানহীন অ্যাবসার্ডিটি জীবনের সবাখানে সবার প্রতি ।
এমনকি মারসোর বান্ধবী মারি— যে মারসোর সঙ্গে একই অফিসে টাইপিস্টের কাজ করে । নিজের শরীর বিলিয়ে দিয়ে যে মারসোর নিস্তরঙ্গ জীবনকে যে একটু হলেও তরঙ্গায়িত করতে চায় । যার হাসি দেখে মারসোর অনুভূতিহীন চিত্ত একটু হলেও দুলে ওঠে— সেই মারির প্রতিও মারসোর আচরণ একই । কিঞ্চিত হলেও হৃদয়বান হয়ে উঠতে পারে না মারসো । বারবার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাইতে গিয়ে মারিকে আমরা কেবল প্রত্যাখ্যাতই হতে দেখি ।

মায়ের অন্ত্যাষ্টিক্রিয়া শেষ করে মারসো যখন চাকুরীর তাগিদে যান্ত্রিক শহরের নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটে ফিরে আসছিল; তখন আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে এক অদ্ভুত চরিত্রের সঙ্গে । বুড়ো সালমানো । একটা কুৎসিত চর্মরোগে আক্রান্ত কুকুরকে সঙ্গী করে সালমানোর বেঁচে থাকা । নিজের পোষা কুৎসিত কুকুরটির প্রতি তার রাজ্যের ঘৃণা । অথচ কুৎসিত ঘৃণিত কুকুরটি যখন হারিয়ে গেল , তখন দিশেহারা সালমানোর হাহাকারের দৃশ্য দেখে মারসোর মত আমরাও শুনতে পাই, জীবনের গভীর তলদেশে আচড়ে পড়া শূনত্যার প্রতিধ্বনি ।
কিন্তু সেই প্রতিধ্বনি মারসোর বন্ধু রেমন্ডের কানে পৌঁছায় না । রেমন্ড— সারা উপন্যাসের সবচেয়ে ইন্টারিস্টিং চরিত্র । লোকে যাকে ‘বেশ্যার দালাল’ বলে ডাকে । কিন্তু সে নিজেকে পরিচয় দেয় গুদামঘরের একজন দারোয়ান হিসাবে । এই ধরণের ভাঁড়ামি মারসোর কাছে হাস্যকর হলেও রেমন্ডের প্রতি মারসোর মোটেই বীতশ্রদ্ধ কিংবা বিতৃষ্ণ নয় । বরং আসক্ত । কেননা ঘুরেফিরে সেই এক নির্মম বাস্তবতাই ওদের দু’জনকে পিষে মারছে । দু’জনেই প্রচলিত সামাজিক নৈতিকতার মানদণ্ডে অপরাধী ।
একটি মেয়েলী কেসে ফেঁসে গিয়ে যখন রেমন্ড মারসোর কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বলে— “ তুমি তো সংসারের কিছু জানো, সুতরাং তুমিই পারো আমাকে সাহায্য করতে। তা হলে সারা জীবন আমি তোমার বন্ধু হয়ে থাকব...”— তখন নৈরাশ্য আর নিরর্থকতার শেকলে আটকা জীবনটা যেন কিছু সময়ের জন্য হলেও আশাবাদী ও অর্থময় হয়ে উঠে ।

অনুবাদক : মুনতাসীর মামুন
প্রকাশক : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র





সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:৩১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×