বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি অভ্যুদয়ের পরবর্তী সময়ে রচিত বাংলা কথাসাহিত্যের প্রসঙ্গ আসলে সর্বাগ্রে যে নামটি উচ্চারিত হয় তিনি হুমায়ূন আহমেদ । জীবনে যে লোকটির সাহিত্যের কোনোরূপ সংস্পর্শই আসার কথাই ছিল না তাকেও গল্প-উপন্যাস পড়িয়ে ছাড়ছেন হুমায়ূন । পাঠকমহলে এখনো এই সাহিত্যস্রষ্টার যে জনপ্রিয়তা তা লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর প্রতিটা সত্তার কাছে কাছে যেমন বিস্ময়ের একই সঙ্গে ঈর্ষার কারণ ! কলম হাতে হুমায়ূন আহমেদ যেমন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি সাহিত্যের নামে অপসাহিত্য-কুসাহিত্য রচনা, বইয়ের মলাটের সস্তা বিলাসমগ্রী তৈরী, স্রেফ বাজারু- এই অভিযোগগুলিও শুনতে হয়েছে তাকে । হুমায়ূনের জনপ্রিয়তা যেমন সত্যি, তেমনি তাঁর সাহিত্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোও পুরোপুরি মিথ্যে নয় । হুমায়ূনের যে বিপুল সাহিত্য বাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার বেশিরভাগেরই সাহিত্যমূল্য প্রশ্নবিদ্ধ ! তবুও ঢালাওভাবে এই সাহিত্যস্রষ্টাকে বড় লেখকের তালিকা থেকে খারিজ করে দেয়া যে সহজ নয়, তারই উপযুক্ত দৃষ্টান্ত 'নন্দিত নরকে' । হুমায়ূন আহমেদের প্রথম প্রকাশিত এই উপন্যাসটি শুধু পাঠকপ্রিয়তাই পায় নি, সাহিত্যের মান নির্ধারক কোনো যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়ে থাকলে সেখানে মাপামাপি শেষে নির্দ্বিধায় যে কোনো স্তরের পাঠকই এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব অকপটে স্বীকার করার কথা । প্রখ্যাত সমালোচক ও স্কলার ড. আহমেদ শরীফও হুমায়ূনের এই উপন্যাসটির সঠিক মূল্যায়ন করতে ভুল করেন নি । ভূমিকায় শরীফ স্যারের সরল স্বীকারোক্তি-
"পড়ে আমি অভিভূত হলাম । গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সুক্ষ্মদর্শী শিল্পীর, একজন কুশলী স্রষ্টার পাকাহাত ।"
নন্দিত নরকে-- একবাক্যে সহজ সরল ভাষাভঙ্গিমায় রচিত এক সাদামাটা আখ্যান । তবুও যেন জীবনশিল্পীর নির্মাণের কারুকার্যতায় উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে এক অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম ।
হুমায়ূনের অধিকাংশ উপন্যাসের ন্যায় এখানেও দেখানো হয়েছে চলমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় ক্রমেই দুমড়ে মুষড়ে পড়া মধ্যবিত্ত মানুষের ঝুলে থাকা বহির্মুখোশ এবং অন্তর্জগতের নানামাত্রিক সংকট । লেখকের কণ্ঠেই আমরা এখানে শুনছি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের জটিল জীবনপ্রবাহের গল্প । রাবেয়া, রুনু, মাস্টার চাচা, মণ্টু- এরা সবাই-ই এই একবিংশ শতাব্দিতে এসেও আমাদের চারপাশে ঘুরাফেরা করছে । এই প্রাসঙ্গিকতা আছে বলেই পাঠক আজও কোলের উপর নিয়ে কিংবা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বইখানা পড়ছেন , মুগ্ধ হচ্ছেন, নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন ।
সারা উপন্যাসজুড়ে কথকের উপস্থিতি বিরাজ করলেও মূল চরিত্র কিন্তু তার বড় বোন রাবেয়াই । কথক এখানে মূলত একজন পর্যবেক্ষকের ভূমিকাতেই অবতীর্ণ ও বিকশিত হয়েছেন । রাবেয়া চরিত্রটির দিকে মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ করেই পাঠক এই গল্পের রস অনুসন্ধানে সামনে এগিয়ে যান ।
উপন্যাসটি পাঠ করার প্রাথমিক দিক আমরা লক্ষ করি, একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের টানপোড়নের সহজাত চিত্র । যে পরিবারের সমস্ত ভয়, উদ্বিগ্নতার মূলে ঘরের বড় মেয়ে রাবেয়া । রাবেয়া মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ ও হীতাহিত জ্ঞানশূন্য । সোজা অর্থে বললে-- 'পাগলি' । এই পাগলি মেয়েটি সমস্ত পাড়া ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এবং সমস্ত দিন তার মনে যত গল্প জমা হয় সব শেয়ার তার ছোট দুই ভাই-বোনের সঙ্গে । কিন্তু তার দুঃশ্চিন্তাতেই যে পরিবারের সবার জীবনটা একদম নীরস নিরানন্দ হয়ে আছে, সেটা বুঝার সামর্থ্য কি আর আছে রাবেয়ার ! রাবেয়ার বয়স যত বাড়ছে মায়ের চোখের নীচে দিনে দিনে তত কালি জমছে, বাবার মাথার ভিতরের দুঃসহ যন্ত্রণাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ! তাই তো বাবা এইরকম কথা উচ্চারণ করতে পারেন-
"বিষ খাইয়ে মেরে ফেলো মেয়েকে ।"
কিন্তু রাবেয়ার একমাত্র ভাইটির কণ্ঠে আশাবাদী সুর । সদ্য পড়াশোনাটা শেষ করে ভাইটি তার জীবনযুদ্ধের সবচে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি ! তবুও সে স্বপ্ন দেখে-
"রাবেয়া যদি কোনোদিন ভালো হয়ে ওঠে তবে তাকে খুব একজন হৃদয়বান ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিব ।"
ওর স্বপ্নটা মাঝে মাঝেই এসে ধরা দেয় । পাত্র আসে রাবেয়াকে দেখতে । রাবেয়া কনে সেজে করে পাত্রের সামনে আসে । সব ঠিক হয় , এমনকি বিয়ের দিন-তারিখ ঠিকের ব্যাপারেও আলাপ উঠে, কিন্তু পরক্ষণেই সব যেন থমকে, স্বপ্নটাও ধরা দিয়েই হাত ফসকে পড়ে যায়; পাড়ার লোক খোঁচ লাগায়- রাবেয়ার মাথা খারাপ !
মাথা খারাপ তো কী হয়েছে ! আরো আট-দশটা মেয়ের মত রাবেয়ারও যৌবন আছে, সেও স্বপ্নে বিভোর হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে । গায়ে হলুদ, হাতে মেহদি, পায়ে আলতা পরে বউ সেজে বিয়ের সিঁড়িতে বসবে সে ! কিন্তু কোথাও যেন একটা বিষণ্ণ শূন্যতার সুর বেজে উঠে- কে বিয়ে করবে এই পাগলী মেয়েটিকে !
রাবেয়াকে লোকে বিশ্রী বিশ্রী কথা শুনায়, যা জানতে পেরে কিশোরী ছোটবোন রুনুরও হজম করতে কষ্ট হয় ! তবুও ওদের দিন থেমে থাকে না, সময়ের নিয়মে জীবনও একটু একটু করে এগিয়ে চলে; এরই মধ্যে একদিন ওরা সবাই ভয়ে শিউরে উঠে । রাবেয়াকে খুঁজে পাচ্ছে না ! এদিক ওদিক সবাই হন্য হয়ে খোঁজাখুঁজি করে, কিন্তু রাবেয়ার কোনো হদিস নেই ! দিনের আলো নিভে যায় । ঘুটঘুটে অন্ধকার বইয়ে দিয়ে নেমে আসে সন্ধ্যা । হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত রাবেয়া ফিরে আসে, মাস্টার চাচার সঙ্গে ।
মাস্টার চাচা এই উপন্যাসের সবচাইতে রহস্যময় চরিত্র । রাবেয়াদের গৃহশিক্ষক হিসাবেই তিনি পার করে দিচ্ছেন গোটা জীবন । পরিবারটির সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবিড় । বাবার বন্ধু হিসাবেই তিনি এ পরিবারে এসে পা দিয়েছেন সেই কাচা বয়সে । বিয়ে-টিয়ের নাম কখনো মুখে তোলেন নি । পরিবারের সবার প্রিয় এবং বিশ্বস্ত এই মাস্টার চাচা । তিনি অনেক পড়েন, আর রাত হলে আকাশে তাকিয়ে থাকেন । আকাশের সব তারাকেই তার চেনা ।
অবশেষে পরিবারের সবার মুখে একদিন নেমে আসে নির্মমতম আঁধার ! রাবেয়া গর্ভবতী ! লজ্জায় অপমানে পরিবারটি তখনই যেন কবরে ঢুকে গেছে ! তবুও ওরা কাউকে কিছু জানতে দেয় না । রাবেয়াকেও ঘরে আটকে রাখে । তীব্র আর্তনাদে গভীর রাতে রাবেয়া জাগিয়ে তোলে সবাইকে । ওর ঘরে প্রবেশ করতেই সবার গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে যায় ! রক্ত ! রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে, গর্ভপাতের যন্ত্রণায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে রাবেয়া । সেই রাতে রাবেয়াকে বাঁচানোর জন্য সবার আগে যিনি সাইকেলটা নিয়ে ডাক্তার আনতে বেরিয়ে পড়েন, তিনি আর কেউ নন-- মাস্টার চাচা !
কিন্তু না, রাবেয়া বাঁচে না ! ভোরের আলো যখন জানলা দিয়ে ঘরে উঁকি মারে, তখন রাবেয়ার মৃত চোখে কোনো স্পন্দন নেই ! মাস্টার চাচা ডাক্তার নিয়ে আসতেই ঘটে উপন্যাসের সবচাইতে লোমহর্ষক ঘটনা । এক কোপেই মাস্টার চাচাকে খুন করে ফেলে মণ্টু ।
সারা উপন্যাসে মণ্টু নীরব । তবুও শেষ পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদের কলমে সে-ই যেন সবচে উজ্জ্বল ও জীবন্ত । মাস্টার চাচার দ্বারা রাবেয়ার এই সর্বনাশের বিষয়টা শুধু মণ্টুই জানত ! আর তারই শোধ সে কড়ায় গণ্ডায় তুলল !
দুই দুইটি রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে আছে শীতল মাটিতে, একজন খুনিকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে; তবুও যেন পাঠকের চোখ এই নিষ্ঠুর বীভৎসতায় বন্ধ হয়ে আসে না । পড়া শেষেও পাঠক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকেন 'নন্দিত নরকে' শব্দ দুটি খচিত রক্তিম মলাটের দিকে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৩